লেখক : গৌতম দত্ত
পলাশ বনে দোলা দিয়ে যায় ফাগুনের হাওয়া, মেলে দেয় ডানা দূর থেকে দিগন্তরে – গাছে গাছে নতুন পাতার আগমনে দীপ্ত হয় নতুনত্বের আহ্বান। ফাগুনের হাওয়া দোলা দেয় সোনালী ধানের ক্ষেতে, মনটাও মেলে দিতে চায় ডানা – জমে থাকা সুপ্ত স্বপ্নগুলি একে একে রঙিন হয়ে ধরা দেয় মনের কোণে। কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় সব। ফেলে আসা অতীত ভেসে বেড়ায় মনের প্রতিটি আনাচে কানাচে। বিকেলের আধো অন্ধকারে খুঁজে বেড়াই তাকে। দোলনার মৃদু দোলায় কেবলই তার কথা। ফাগুনের হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলে হাত বুলিয়ে, মুদিত নয়নে, পাঁচ-পাঁচটা বছর আগে তাকে ফেলে আসার কথা। সে কি আজও আছে আমার অপেক্ষায়, নাকি সময়ের হাওয়ায় হারিয়ে গিয়েছে কোথাও? বা কারও ঘরণী হয়ে? পৃথিবী বড় বেইমান – সময়কে বন্দি করে নিয়ে যায় সাথে, ফিরিয়ে দেয় না আর। কষ্টকে রেখে যায় পিছনে।
জানালা দিয়ে প্রথম দেখেছিলাম তাকে। এক মায়াবী রূপে ধরা দিয়েছিল আমার অন্তরে। তার ছন্দময় হেঁটে যাওয়া, কপালের মাঝে ছোট্ট একটি টিপ, রঙিন ওষ্ঠে মৃদু হাঁসির ছোয়া, মেঘ ঘনচুল ঝরণার স্রোতের মত পিঠ বেয়ে নিচে নেমে আসা। সেই প্রথম দেখা। অন্তরের কোঠায় আলোড়ন তুলে তার চলে যাওয়া। সেই দিনের পর থেকে দোলনার পরিবর্তে স্থান হ’ল বাড়ির সামনের রকে। সকাল দশটা বাজলেই অন্তরের অস্থিরতা আমাকে মনে করিয়ে দিত তাকে, এসে বসতাম ঐ রকে – হাতে মোবাইল। চোখ দুটো মোবাইলের মধ্যে বন্দী থাকলেও মন থাকত তার পথের দিকে। তার আসার সাথে সাথে বুকে বেজে উঠত মেঘের গর্জন, রোমে রোমে ভিসুভিয়াসের অগ্নিপাত, এলোমেলো হাওয়া, গা বেয়ে নেমে আসা ঘাম, বুকের ঘড়ির কাঁটা যেন স্তব্ধ, মোবাইলটা হাতে ধরা, গুটি গুটি পায়ে তার আসা, একরাশ সুগন্ধি ছড়িয়ে আমার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া… অতীত যেন আজ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই পিঙ্ক শাড়িতে তার হেঁটে আসা, কপালে সেই টিপ, কাজল চোখের গভীরতা, মুখে ভাসানো সেই মৃদু হাসি। আমি কেবল মুগ্ধভাবে তাকিয়ে। তার ধীর পায়ে চলে যাওয়া, হঠাৎ যেন ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। আমি শান্ত, নীরব, বাকরুদ্ধ। শরীরটা যেন জড়সড়, কথা বলার সেই দুর্জয় সাহস আমাকে সাহস জোগাচ্ছে না।
প্রতিদিনের নিয়মে গেঁথে থাকা নিয়মাবলী বেশি দিন স্থায়ী হ’ল না। আমাকে যেতে হ’ল আমেরিকায় পিএইচডি করতে। কলেজ শেষের সেই কয়েকটা দিনের মুহূর্তকে পথের সাথী করে নিয়ে গেলাম সঙ্গে। অন্তরে চিন্তার মেঘের আনাগোনা। কখনও-সখনও ডানা মেলে হারিয়ে যেতাম মনের গহ্বরে। পাঁচ-পাঁচটা বছর। সে কি থাকবে আমার অপেক্ষায়?
কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না। এক এক করে কেটে গেল পাঁচটা বছর। সম্বিতের মনে আজও সে বারে বারে ফিরে আসে, দোলা দিয়ে যায় বসন্তের হাওয়া, মেলে ধরে স্মৃতির কোণায় জমে থাকা তার কথা, আসা যাওয়ার মাঝে হারিয়ে যাওয়া কিছু মুহূর্ত। সে কি আজও আসে পায়ে নূপুরের শব্দ তুলে? নাকি হারিয়ে গিয়েছে সব, মুছে গিয়েছে সবকিছু?
আজও আছে সেই দোলনা, অতীত স্মৃতিকে বহন করে। সম্বিত পায়ে পায়ে বসল গিয়ে তার এক কোণে। একরাশ প্রশ্ন যেন বুক ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।অন্ধকার ঘিরে আছে মনের চতুর্দিকে। আজ বাতাসেও যেন এক বিষণ্ণতার ছাপ, নেই পাখির কলতান। সম্বিতের মনে অস্থিরতা। দোলনার থেকে উঠে গিয়ে বাড়ির রকে গিয়ে বসল। হাতে সেই মোবাইল। কই, আগের মত মেঘের গর্জন তো শোনা যাচ্ছে না আর, ঝেঁপে বৃষ্টিও আসছে না আগের মতো। কত মানুষ চলে গেল পাশ দিয়ে – আছে কেবল শূন্যতা। উঠে দাঁড়াল সম্বিত। বিদেশ থেকে আসার পর সাত-সাতটা দিন কেটে গিয়েছে। তবু তার…
সম্বিত রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল। কত মানুষের সাক্ষাৎ, কত মানুষের ব্যস্ততা। সময়ের কাঁটা চলে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। ভাবতে ভাবতে সামনের বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় কখন যে এতদূর এসে পড়েছে বুঝতে পারে নি, সম্বিৎ ফিরল পিছনে এক নারীকন্ঠের ডাক শুনে। একটু হকচকিয়ে পিছন ফিরে তাকাল। পিছনেই একজন মহিলা দাঁড়িয়ে।
“কি? চিনতে পারছেন?” গলাটা বড্ড চেনা।
শরীরের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল, একটা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেল শরীরের মধ্যে দিয়ে। এই তো সে, যাকে হারিয়েছিলাম সেই সুদূর গহন বনে, যার অন্ধকারে হারিয়ে যায় পথ, বাঁশবাগানের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় চাঁদের উঁকিঝুকি, গাছের ডালে ডালে স্তব্ধ পাখিদের কলতান – আজও তো আসেনি বাউল তার গানের ডালি নিয়ে – শনশন করে বয়ে যায় বাতাস, বয়ে যায় সময়, আমি আছি নীরবে তোমার পথ চেয়ে, ডেকে ডেকে ক্লান্ত সারমেয়র দল রাস্তায় ঘুমিয়ে, তোমার শূন্যতায় প্রতিটি জনপদ যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। এই সেই তুমি।
“কী ভাবছেন? চিনতে পেরেছেন?”
সম্বিত একটু অপ্রস্তুত ভাবেই জবাব দিল, “হ্যাঁ, চিনব না কেন?” চোখ মেলে তাকাল তার দিকে। এক মনমোহনী দৃষ্টি – চোখের তারায় বিদ্যুতের ঝলক, মুখে স্মিত হাসি। আমি ভাবিনি, সে কখনও আমার সামনে এভাবে এসে দাঁড়াবে। কাল যেটা ছিল অতীত, আজ তা বাস্তব। বলল, “আপনাকে ভুলব কী করে?”
“যাক্, তবে চিনতে পেরেছেন। আপনার স্মৃতিশক্তি দেখছি ঠিকই আছে। পাঁচ-পাঁচটা বছর কেটে গেল, আজও আমি আপনার মন থেকে মুছে যাই নি!” ঠোঁট চেপে হাসলেন ভদ্রমহিলা। কী বলব তাকে? সেই প্রথম দেখা, আর আজ সে আমার পাশে। সম্বিতের সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। যাকে পাঁচ বছর আগে দেখেছিল এক নিস্তব্ধ নিঝুম রাত, আজ জৈষ্ঠের তপ্ত দহন। সত্যিই সে তো?
“কি ভাবছেন?” একটু থেমে বললেন, “আরে বাবা, আমিই সেই মেয়ে, যাকে দেখার জন্য একবার হলেও রকে এসে বসতেন – সেটাই ভাবছেন তো?”
সম্বিত আরও অবাক-অস্থির -চঞ্চল। মাথাটা যেন কয়েক মণের বোঝা। মনের ইতস্ততা কটিয়ে বলল, “আসলে হঠাৎ করে এ ভাবে পরিচয়, তাও আপনার সাথে। তাছাড়া আপনি যে ভাবে শুরু করলেন, সবটা হজম করতে একটু সময় লাগছে।”
“কেন? আমি সহজভাবেই তো কথা বলছি। আপনি যদি সবসময় মৌন থাকেন, তবে তো আমাকেই কথা বলতে হবে। আপনি হয়ত ভেবে থাকতে পারেন, পাঁচ বছর আগে যে রকম দেখে গিয়েছিলেন, তেমনই এসে দেখবেন।” বলেই আবার ঠোঁট চেপে হাসলেন। সম্বিৎ একটু জড়সড়। কথা যেন সব জড়িয়ে যাচ্ছে। কয়েকবার তাকাল তার দিকে।
“তা কোথায় যাচ্ছেন? হাতে তো বাজারের ব্যাগ দেখছি না, কাঁধেও ঝোলানো ব্যাগ নেই। তবে কি আমাকেই খুঁজতে বেড়িয়েছেন?” এবার হেসে ফেললেন ভদ্রমহিলা। সম্বিত তখনও তাকিয়ে। সেই মুক্তোঝরানো হাসি, চোখেও যেন এক দুষ্টুমির চাহনি। তার হাসিতে কিঞ্চিৎ অস্বস্তিবোধ করল সম্বিত, পরক্ষণেই নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, “বলতে পারেন, অনেকটা তাই।”
“তা হলে চলুন,” বলেই আঙুল দিয়ে সামনের দিকটা দেখাল।
“কোথায় যাবেন?”
“আরে বাবা, আপনাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছি না। সামনে একটা কফিশপ আছে, চলুন ওখানে গিয়ে বসি। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়েই কি কথা বলবেন?”
সম্বিত মাথাটা নাড়িয়ে সায় দিল।
যেতে যেতে সম্বিত একবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে প্রখর রোদ, বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই। শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘামের পরশ, মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছে, গলাটাও শুকিয়ে কাঠ। প্রথম দেখায় একটা ভাল লাগা ছিল, মনে একটা আবেগ ছিল, অন্তরের টান তাড়িয়ে নিয়ে যেত, বসে থাকতাম রকে। আর এখন? তবে এটাই কি ভালবাসা? কথায় আছে, প্রেম আসে নীরবে নিভৃতে, আপন আলো মেলে। এটাও কি তাই? চুপচাপ সম্বিৎ ভদ্রমহিলার সাথে কফিশপে এসে বসল। বসার সাথে সাথেই ভদ্রমহিলা বললেন, “দুটো কফির অর্ডার দিন।”
“আমকে বলছেন?”
“আশেপাশে তো তেমন কাউকে দেখছি না আপনি ছাড়া।” একটু তির্যক সুরেই কথাটা বললেন। তারপর একটু থেমে বললেন, “একজন মহিলাকে নিয়ে কফিশপে এসেছেন, তাকে কফি খাওয়াবেন না?” চোখে তার দুষ্টুমির হাসি।
“ও হ্যাঁ, নিশ্চয়ই,” বলে সঙ্গে সঙ্গে সম্বিত দু’টো কফির অর্ডার দিল। ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “সাথে আর কিছু নেবেন না?”
“সেটাও বলতে হবে? দুটো স্যান্ডউইচ বলুন।” সম্বিতের নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হ’ল। পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে দু’টো স্যান্ডউইচের অর্ডার দিল।
“এবার বলুন তো আপনার নামটা। অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছি, ওটাই জানা হয় নি।”
“আমি সম্বিত সেনগুপ্ত।”
“আমি শ্রাবনী মজুমদার।” এবার শ্রাবনীকে একটু শান্ত মনে হ’ল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটু সিরিয়াসভাবে বলল, “তা পাঁচটা বছর কিসের জন্য ইউএসএ-তে গিয়েছিলেন?”
“পিএইচডি করতে।”
“কী নিয়ে?”
“স্ট্যাটিস্টিক্স।”
“ওরে বাবা, আপনি তো মশাই ডেনঞ্জারাস! যে বিষয়ে কেউ সচরাচর যায় না, আপনি তাই নিয়ে পিএইচডি করলেন। আপনাকে তো মার্ক করে রাখতে হয়।”
“কেন এই কথা বলছেন? এই বিষয় নিয়ে বহু ছেলেমেয়েই তো পড়াশুনা করছে। যাক, এবার আপনারটা বলুন।”
“কেমিষ্ট্রি নিয়ে মাস্টার ডিগ্ৰি করেছি, তারপর চুপচাপ বসে আছি।”
“চাকরির চেষ্টা করেন নি?”
“চাকরি? আপনারা, পুরুষরা যেভাবে হাত-পা ছড়িয়ে পৃথিবীটাকে জড়িয়ে আছেন, আমাদের স্থান কোথায়?”
“আপনি বলতে চাইছেন মেয়েরা চাকরি করছে না?”
“করছে, তবে পুরুষের অনুপাতে কম।”
“আপনার যা পড়াশুনা, তাতে চেষ্টা করলে আপনিও চাকরি পেতে পারতেন।”
“আপনি কি চাকরিওয়ালা মেয়েদের বেশি পছন্দ করেন?”
“কেন এই কথা বলছেন? তা ছাড়া আমার চাওয়ায় আপনার কী যায় আসে?”
“আসে যায় মশাই, আসে যায়…”
“কেমন করে?”
“ও আপনি বুঝবেন না। সত্যি কথা কী জানেন, আজ না হোক কাল যার সাথে আমার বিয়ে হবে, সে যদি চাকরিটা পছন্দ না করে, তখন? ছেড়েই তো দিতে হবে। শুধু শুধু কষ্ট পাওয়া। তার থেকে বরং যার সাথে জীবন কাটাতে হবে, তার সাথে আলোচনা করেই না হয় ঠিক করা যাবে।” কথাগুলো কানে গেল না সম্বিতের, এক দৃষ্টিতে শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে। তুঁতে রঙের সালোয়ার কামিজে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। পিঠের উপর হাল্কা করে বেনুনি বাঁধা, কপালে কালো রঙের টিপ, সাদা মুক্তোঝরা হাসি। এ সেই, যাকে দেখার জন্য এক সময় বুকে বাজত হাজারো ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, থেমে যেত বুকের স্পন্দন, পারফিউমের গন্ধে ছেয়ে যেত মন, এক আচ্ছন্নতায় মুখ যেত ঢেকে। আজ সে কফিশপে তার সামনের টেবিলে।
“তখন থেকে কী ভাবছেন বলুন তো?”
শ্রাবনীর কথায় একটু হকচকিয়ে উঠল সম্বিত। “না, সে রকম কিছু না।”
“একটা কথা সত্যি করে বলুন তো। আপনি কি কখনও ভেবেছেন এভাবে আমাদের দেখা হবে?”
“একটু আশা তো ছিলই। হয় আপনার আগের রূপে, অথবা সিঁদুরপরিহিত এক বধূরূপে।”
“কোনটাতে দেখলে খুশি হতেন?”
“এখন যেমনটা দেখছি।”
“বুঝলাম! আপনি এখনও সেই আগের মতই আছেন, পাচঁ বছর বাদেও সব মুছে যায়নি।”
“আমি তো কিছুই মুছতে চাই না।”
“কেন? আমাকে ভালবাসেন?”
“অতটা ভেবে দেখিনি। যখন আপনাকে প্রথম দেখি, একটা আকাশী শাড়িতে, বাতাসে পারফিউমের গন্ধ, আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। কেন জানি না, আপনাকে বড্ড কাছের মানুষ মনে হয়েছিল। ঐ পারফিউমের গন্ধটা আজও আমার চেনা। ওটা নাকে এলে কেমন যেন আনমনা হয়ে যাই।”
“আর আজ?” নিষ্পলক দৃষ্টিতে সম্বিতের দিকে তাকিয়ে রইল শ্রাবনী।
“আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর। এই ড্রেসে আপনাকে কিন্তু আরও ভাল লাগছে। আমার চলে যাওয়ার আগের দিন আপনি একটা গোলাপী শাড়ি পরেছিলেন। সেই দিনই আমি বাইরে যাবার অফারটা পাই।”
“আমি তাহলে আপনার কাছে লাকি বলুন?”
“সেটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে।”
শ্রাবনী কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, “পাঁচটা বছর তো ওখানে কাটালেন। পেলেন তেমন কাউকে?”
“সেই মন নিয়ে তো সেখানে যাই নি, গিয়েছিলাম পড়তে। চোখ তুলে দেখার সময় কোথায়? তবে অবসর সময়ে কেবল ফেলে আসা স্মৃতি নিয়েই নাড়াচাড়া করে বেড়িয়েছি। আর আপনি যে এত প্রশ্ন করছেন, আপনি কি পেলেন তেমন কারও দেখা?”
“পেয়েছি তো। না হ’লে সময়ই বা কাটবে কী করে?” চাপা হাসিতে মুখ ঢাকল।
“তবে কি আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে?” হঠাৎ আকাশে যেন বাজ পড়ল। সম্বিতের শরীর জুড়ে গরম হাওয়া, কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম।
“কেন থাকবে না? না থাকাটাই তো অস্বাভাবিক।”
“না না, তা ঠিক,” বিষণ্ণতায় ঢেকে গেল সম্বিতের মন। ঝোড়ো হাওয়ায় সব যেন উড়িয়ে নিয়ে গেল। সম্বিত চুপ করে রইল।
“আপনিও তাহলে স্বীকার করছেন?” শ্রাবনী কথা বলতে বলতে সম্বিতের দিকে তাকাল। কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ, বৃষ্টি আসতে পারে, বাতাস থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ। বিষণ্ণ চাহনিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে সম্বিত। “কী ব্যাপার? বয়ফ্রেন্ডের কথা শুনে আপনার মুখটা কেমন পাংশুটে হয়ে গেল।”
সম্বিত স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। “কই? না তো। আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে, সে তো ভাল কথা। এবার বিয়েটা সেরে ফেলুন।”
“ধীরে মশাই, ধীরে। বললেই হুট করে হয়ে যাবে না। ওকে এখানে আসতে দিন, তারপর না হয়…”
“ও বলতে কার কথা বলছেন?”
“কেন? আমার বয়ফ্রেন্ড।”
“দেখুন শ্রাবনী দেবী, আমার মনে হয় আমার এখানে থাকাটা উচিৎ হবে না। আমি বরং উঠি।”
এবার শ্রাবনী একটু ঝাঁঝিয়ে উঠল, “বসুন তো মশাই। এখনও তো সে আসে নি। আসুক, তবে যাবেন।”
সম্বিত বসল বটে। ভাবল, এই সেই মেয়ে, যাকে নিয়ে এতক্ষন ধরে স্বপ্নের জাল বুনে চলছিল?
“কী হ’ল, চুপ করে গেলেন যে? বুঝেছি। আমার উপর অভিমান হয়েছে। ভাল, ভাল, একটু আধটু অভিমান থাকা ভাল। ভাবছেন, কে এক মহিলা আমার সাথে এতক্ষণ ধরে মশকরা করে যাচ্ছে, তাই তো?” মুখে হাসির রেশ। একটু থেমে সম্বিতের দিকে তাকাল, “আরে মশাই, যা ভাবছেন তা নয়। যদি দেখি তার থেকে আপনি বেটার, তখন নয় তাকে বাদ দিয়ে দেওয়া যাবে। দেখুন, সেও আমাকে ভালবাসে, আপনিও ভালবাসেন। দেখতে হবে না কে বেটার?”
সম্বিতের স্বর এবার কঠোর। “ক্ষমা করবেন। বুঝতে পারছি ছেলেদের ভালবাসার কোন মূল্যই আপনার কাছে নেই। এটা কি সবজির বাজার, যে দরদাম করে দেখছেন, ভালমন্দ খুঁজছেন?”
শ্রাবনীর স্বর এবার শান্ত। চোখে চোখ রেখে বলল, “আপনি বাজারে গেলে চোখের সামনে যা দেখেন, তা তুলে নেন? নেন না তো? আমি করলে দোষটা কোথায়?”
“বুঝেছি। আপনার সাথে এতক্ষণ সময় কাটানোটাই আমার ভুল হয়েছে। এবার আমাকে যেতে দিন।”
“বাব্বাঃ, কী রাগ!”
“রাগের মত কথা বললে রাগ তো হবেই।”
“বসুন, বসুন। এতদিন বাদে দেখা, রাগ করে চলে যাবেন? আমার মনের কথা তো আপনার জানাই হ’ল না। যা জানলাম সবটাই তো আপনার। আমার কথা শুনবেন না?”
“কী শুনব বলুন? যা বলার তা তো বলেই দিলেন। নতুন কি আর শোনাবেন?”
“তাই? এত তাড়াতাড়ি আমাকে চিনে ফেললেন? এই কয়েক মুহূর্তেই? এত ঠুনকো আপনার চিন্তাধারা? এই তো বললেন, আমার স্মৃতি আজও আপনার মনকে নাড়া দেয়। সে সব কি মিথ্যে?”
সম্বিত একটু ধাতস্থ হ’ল। “সরি, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। এক্সট্রিমলি সরি।”
“ঠিক আছে। আর সরি বলতে হবে না।”
“তা আপনার বন্ধু তো এখনও এল না…”
“সময় এলেই আসবে। যতক্ষণ না আসছে, ততক্ষণ কি আপনার কথা বলতে আপত্তি আছে?” কথাগুলো একভাবে বলে চুপ করল, একবার চেয়ে দেখল সম্বিতের দিকে। “মশাই, একটু পজেসিভ হোন। বয়ফ্রেন্ড মানে বয়ফ্রেন্ড – প্রেমিক নয়, বুঝলেন? এইটুকু বোঝার মত মানসিকতা নিশ্চয়ই আপনার আছে।” সম্বিত একেবারে চুপ। “আমরা বয়ফ্রেন্ড বলতে সবসময় ব্যাপারটাকে অন্যভাবে দেখি। সব দেখাই যে সত্য হবে, এটার কোন কারণ আছে কি? শুধু শুধু আপনি আমার উপর রাগ করলেন। যেভাবে চোখ পাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, এই বুঝি দু’ ঘা বসিয়ে দিলেন আমার গালে।”
“ছি ছি, কী সব কথা বলছেন! আমাকে দেখে বুঝি তাই মনে হয়?”
“ও মুহূর্তে কিন্তু মনে হয়েছিল।”
“এতক্ষণ বাদে আমাকে দেখে আপনার এই মনে হল?” সম্বিত হাতের ঘড়িটা একবার দেখল, হঠাৎ মন চঞ্চল হয়ে উঠল। “কই, আপনার বন্ধু তো এল না?”
“এলে খুশি হবেন?”
“তা জেনে আপনার কী লাভ?”
“লাভ না থাকলে বলি, এতদিন বাদে দেখা, সাক্ষাৎটা মধুময় হোক আপনি চান না? তাই সময়টা নষ্ট করে কী লাভ? এটাই তো ভাল সময় পরস্পরকে চিনে নেবার ক্ষেত্রে।”
সম্বিত একটু বিরক্ত ভাবে বলল, “আপনার মাথাটা কি ঠিক আছে? আপনি কখন কী যে বলেন, বুঝি না। এখন তো মনে হচ্ছে আপনি নিজেই এক প্রশ্নচিহ্ন। একটু সহজ করে বললে ভাল হতো না?”
“কেন? আমি তো সহজ সরল ভাষায় কথা বলছি। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, সেটা তো আপনার ব্যাপার। শুনুন, আপনাকে একটা পরামর্শ দিচ্ছি, শীঘ্রই একটা প্রেম করুন। দেখবেন, সব কথা সহজভাবে বুঝতে পারবেন।” হাত দিয়ে হাসিটা চাপল।
“সেটা আর হ’ল কোথায়, শুরুর আগেই তো হারিয়ে গেল।”
“মানে? আপনি কি আমার কথা বলছেন? তাহলে সোজাভাবে বলুন না আপনি আমাকে ভালবাসেন।”
“ধরুন তাই। তাতে কি সব পরিবর্তন হয়ে যাবে?”
“যেতেও তো পারে।”
“মানে?”
“মানে কিছু নেই, এইটুকুই বুঝতে পারছি আপনি আমার বয়ফ্রেন্ডকে মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। তাই তো?”
“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?” চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগল সম্বিত। একটু থেমে বলল, “আচ্ছা, তার নামটা জানতে পারি?”
“তম্বিস।”
“এ আবার কেমন নাম!”
“কেন? নামের মধ্যে বেশ নতুনত্ব আছে।”
“বেশ। আসতে বলুন তাকে।”
“এলে তো তার সাথে ঝগড়া করবেন।”
“না, করব না, কথা দিলাম।” সম্বিত মাথা নিচু করে বসে।
শ্রাবনী একটা কিছু ভাবতে ভাবতে বলল, “আজ আর হবে না।”
“কেন?”
“হাতের ঘড়িটা দেখেছেন? আপনি যখন বলছেন, তখন কালকেই আসতে বলেছি। আজ ওঠা যাক।”
“আর একটু বসলে হয় না?”
“এই তো যাব যাব করছিলেন, এখন আবার কী হ’ল?”
“পাঁচটা বছর শরীর দিয়ে যে স্রোত বয়ে গেছে, যাকে শয়নে-স্বপনে দেখেছি, তাকে এই সামান্য সময়ের জন্য পেয়ে কি ছাড়া যায়?”
“দাঁড়ান দাঁড়ান। কাল তম্বিসকে আসতে দিন, তখন দেখব আপনি ওর সামনে কিভাবে প্রেমনিবেদন করেন।”
সম্বিত থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। “আপনি কখন যে কী বলেন, বুঝি না। বড্ড গোলমেলে আপনি।”
কফিশপ থেকে বেরিয়ে এল। যেতে যেতে শ্রাবনী বলল, “এভাবে আমাকে ফাঁকি দিয়ে আর কোথাও যাবার পরিকল্পনা নেই তো? বড্ড খুঁজেছি আপনাকে, জানেন? কতবার আপনার বাড়ির সামনে দিয়ে গিয়েছি, দেখতে পাই নি। কী যে খারাপ লাগত। ভেবেছিলাম, আর হয়ত দেখা হবে না, বড্ড কষ্ট পেয়েছিলাম। একবার তো বলে যেতে পারতেন। মনের কোণে যখন জায়গা দিয়েই ছিলেন, তখন সাহস করে একটু এগিয়ে এসে বলে যেতে পারতেন না?”
“এই তো এত কথা বললেন, বয়ফ্রেন্ডকে ডাকবেন বলছেন – আপনি কী চান বলুন তো?”
“যেটা চাই, সেটাই তো এখন বলছি।”
“তবে কফিশপের কথাগুলো…”
“ও সব বাদ দিন। যাবেন না তো আমাকে ফেলে?”
“এই যদি আপনার মনের কথা ছিল, এত ভনিতা করার কি দরকার ছিল?”
“আপনি কিন্তু আমার কথার জবাব দেন নি।”
“এটা ভাবলেন কী করে? আমার অন্তরের দ্বার প্রথমদিন থেকেই খোলা আপনার প্রতীক্ষায়।” শ্রাবনী এবার সাবলীল, শান্ত। সম্বিত বলল, “আমাদের কি আবার দেখা হবে?”
“বললাম তো, কালই আবার দেখা হবে।”
“এই কফিশপে?”
“দেখি চিন্তা করে…”
“আবার হেঁয়ালি শুরু করলেন?” সম্বিতের কথায় শ্রাবনী হেসে উঠল।
পরের দিন সকাল প্রায় এগারটা। শ্রাবনী সম্বিতের বাড়িতে এসে হাজির। ঢুকতেই সম্বিতের মায়ের সাথে দেখা। শ্রাবনী প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করল, “সম্বিত কোথায় মাসিমা?”
সম্বিতের মা ইতস্তত ভাবে জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে তো চিনলাম না মা। কী নাম তোমার?”
“আমি শ্রাবনী। সম্বিতের বন্ধু।”
“দেখো না, বাজারের জামা পরেই শুয়ে আছে, অসময়ে ঘুম। দেখো ওর ঘরে গিয়ে,” বলে ঘরটা দেখিয়ে দিল। শ্রাবনী সন্তর্পণে সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এল। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল, সম্বিৎ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। শ্রাবন্তী অতি সন্তর্পণে তার মাথার কাছে বসল। ডান হাতটা সম্বিতের চুলে বিলি কাটতে লাগল। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “তম্বিস এসেছে দেখা করতে, দেখা করবে না?”
শ্রাবনীর কণ্ঠস্বরে সম্বিতের ঘুমটা ভেঙে গেল। মুখ ঘুরিয়ে দেখল, শ্রাবনী মাথার কাছে বসে। চমকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল, “আপনি এখানে? এই ভাবে? মা দেখতে পায় নি?”
“তাঁর সাথে কথা বলেই তো ঢুকলাম।”
“আর তম্বিস? সে কোথায়?”
“তুমি না ভীষণ বোকা। তম্বিসটা কে, এখনও চিনতে পার নি?”
“কে বলো তো?”
শ্রাবনী চুলটা ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “তম্বিস মানে হল সম্বিত। ইস, এই সহজ কথাটা সেদিন বুঝতে পারলে না, উল্টে রাগ দেখালে।”
সম্বিৎ হো-হো করে হেসে উঠল। শ্রাবনীর কোলে মাথা রেখে দু’হাত দিয়ে কোমরটা জড়িয়ে ধরল। “তাহলে এত নাটকের কি দরকার ছিল?”
“যাকে এত ভালবাসি, তাকে একবার যাচাই করে দেখব না?”
লেখক পরিচিতি : গৌতম দত্ত
গৌতম দত্ত - ৫৬/৬,বীরেন রায় রোড প্যারিস পাড়া কলকাতা ৭০০০০৮