পুনর্জন্ম

লেখক : স্বাতী রায় চৌধুরী

আজ মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার দিন ছিল। মেয়ের বাড়ি মানে ভাড়া বাড়ি, যেটা মেয়ের বর্তমান ঠিকানা, সল্টলেক সেক্টর টু। কর্মসূত্রে মেয়ে কলকাতায় আর আমি দুর্গাপুরে। মাঝে মাঝে মনটা যখন বড্ড উচাটন হয়ে ওঠে, তখন লোটাকম্বল নিয়ে ছুটি মেয়ের কাছে। কর্পোরেট অফিসে নতুন চাকরি ওর, হুট্ বলতেই আমার কাছে এসে উঠতে পারে না। অগত্যা আমাকেই ছুটতে হয়, নাড়ির টান যে বড় টান! যাই হোক, যা বলছিলাম, সপ্তাহখানেক মেয়ের বাড়ি কাটিয়ে আজ বাড়ি ফেরার জন্য করুণাময়ী থেকে দক্ষিণবঙ্গ রাজ্য পরিবহনের বাসের টিকিট কেটে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বাস এলে উঠে জানলার ধারে সিটটা খুঁজে নিয়ে বসে পড়লাম। বাস ঠিক সময়ই ছাড়ল। আমার পাশে আমারই মেয়ের বয়সী একটি মেয়ে, দেখলাম কানে হেডফোন গুঁজে নিবিষ্টমনে মোবাইল দেখে চলেছে। আমি আবার চলন্ত গাড়িতে মোবাইল দেখা বা বই পড়া – কোনটাই ঠিকমত করতে পারি না, বড্ড মাথা ঘোরে, বমি বমি পায়। তার চাইতে অনেক ভাল লাগে জানলা দিয়ে বাইরের অপসৃয়মান পৃথিবীটাকে দেখা, মনে হয় এই দুনিয়ার সাথে রেস লাগিয়েছি আমি, আর সবাইকে পিছনে ফেলে আমি এগিয়ে যাচ্ছি।

বাস ছুটে যাচ্ছে হাইওয়ে ধরে হু-হু করে। এখন কলকাতা থেকে দুর্গাপুর যাওয়ার এই হাইওয়ে আগের থেকে অনেক চওড়া হয়েছে। ফলে জ্যামজটও তুলনামূলকভাবে কম। তার উপর আজ আবার রবিবার। তাই বেশ ভালই যাচ্ছে বাসটা। জানালার ধারে বসে পিছনে ছুটে চলা গ্রাম, শহর, দোকান, বাজার, মাঠ, ঘাট, রাস্তা, মাইলফলক – এই সব কিছু বিভূতিভূষণের ছোট্ট অপুর মত দু’চোখ দিয়ে গিলতে গিলতে কখন একটু ঝিমুনি মতন এসে গিয়েছিল জানি না। হঠাৎ তীব্র ঝনঝন আওয়াজ ও তার সাথে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি, ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখলাম বাসের যাত্রী, ড্রাইভার, কণ্ডাক্টর সকলের মুখে উত্তেজনার ছাপ, খানিকটা আতঙ্কেরও। ড্রাইভারকে সবাই নির্দেশ দিচ্ছে, “আরে ধরুন, ধরুন, ট্যাঙ্কারটাকে ধরুন…।” ড্রাইভারও একটু এগিয়ে বাসটিকে রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে কণ্ডাক্টরকে নিয়ে পিছন দিকে ছুটে গেল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে এইসব কাণ্ড দেখে তো আমি একেবারে হতবাক। দেখলাম, পাশের মেয়েটিও বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছে, আর ওর পায়ের কাছে কাচের আয়না সমেত একটা প্লাস্টিক হোল্ডারের ভাঙা অংশ পড়ে আছে। সম্ভবত বাসের কোন মিরর ভেঙে পড়েছে। কি হয়েছে কিছু বুঝে ওঠবার আগেই দেখলাম বাস থেকে পুরুষযাত্রীরা সব হৈ-হৈ করে নিচে নেমে গেল। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে পাশের মেয়েটি বলল, উল্টো দিক থেকে আসা একটি তেলের ট্যাঙ্কার নাকি বাসটিকে সাইড থেকে ধাক্কা মেরে বাসের গা ঘষে দিয়ে পিছন দিকে চলে যায়। এই ধাক্কার ফলে বাসের সাইড মিরর ভেঙে গিয়ে তার একটা টুকরো মেয়েটির পায়ের কাছে এসে পড়ে। আমি তো শুনেই আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম ওর লেগেছে কিনা। ও জানাল পায়ের কাছে পড়েছে, তাই ও আঘাত পাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম।

ইতিমধ্যে যেসব পুরুষ যাত্রীরা বাস থেকে নেমে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে এসে জানাল যে ট্যাঙ্কারটি ধাক্কা মেরেছিল, তার ড্রাইভার পালিয়ে গিয়েছে। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, পুলিশ আসবে। যা কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে এবং আতঙ্কের পর আতঙ্ক – বাস কখন ছাড়বে কিছু বলা যাচ্ছে না।

সেই সকালবেলা মেয়ের বাড়ি থেকে হালকা ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। খিদেতে পেট চুঁই-চুঁই করছে। আমি বুঝতে পারলাম এই অবস্থা শুধু আমার একার নয়, বাসযাত্রীদের অনেকেরই একই অবস্থা। ভেবেছিলাম শক্তিগড়ে নেমে ভাল করে টিফিন করবো। তা “দিল্লি এখন বহুদূর”! কি আর করা? হাতব্যাগে একটা গামছা-টামছা থাকলেও কাজে দিত, পেটে বাঁধা যেত। অগত্যা শুধু জলই ভরসা। প্রায় ঘণ্টাখানেক ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থায় থাকার পর খবর পেলাম পুলিশের গাড়ি এসেছিল এবং তারা আবিষ্কার করেছে যে দুর্ঘটনার জায়গাটি তাদের থানার অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং, আমাদের আরও কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে যেতে হবে সুনির্দিষ্ট থানায় অভিযোগ জানানোর জন্য। যাইহোক, বাস তো আবার চলতে শুরু করল। কণ্ডাক্টর যখন তার মোবাইলের জিপিএস খুলে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিচ্ছে কোন পথে উক্ত থানায় যাওয়া যাবে, সেই সময় এক বাসযাত্রী থানায় যাবার ব্যাপারে তাঁর তীব্র আপত্তি জাহির করলেন, “ও কণ্ডাক্টর ভাই, আমাদের কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। এর আগে ঘণ্টাখানেক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেন, এখন বলছেন থানায় যাবেন। সেখানে আবার কতক্ষণ লাগবে কে জানে? আমাদের তো সময়ের দাম আছে মশাই।”
ভদ্রলোকের কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য বাসের মধ্যে একটা থমথমে পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। আরও কেউ কেউ হয়ত ওই ভদ্রলোকের সাথে একমত। আমিও যে একেবারে এ’রকম ভাবছিলাম না, তা নয়। কিন্তু অন্য কেউ কিছু বলার আগেই আমার সিটের ঠিক পিছনের সিটটিতে বসা এক যুবক, শুনলাম সে নাকি ইউটিউবার, জোর গলায় বলে উঠল, “আপনি কি মশাই সময়ের কথা বলছেন? ওই তেলের ট্যাঙ্কারটা আরেকটু জোরে ধাক্কা মারলে তো গোটা বাসটাই জ্বলে যেত, আমরা কেউই প্রাণে বাঁচতাম না, আর আপনি সময়ের কথা বলছেন?”
বাসের মধ্যে একটা হালকা বচসা শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ ভদ্রলোককে সাপোর্ট করার জন্য বলল, “আমরা সেই সকালে বাসে উঠেছি, এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল, কারও খাওয়া দাওয়া হয়নি। আমাদের তো খিদেও পেয়েছে।” সত্যি বলতে কি খিদেতে আমারও পেট চু্ঁই-চুঁই করছিল। মনে মনে একটুও বিরক্ত যে হইনি, তা নয়। ভদ্রলোকের কথায় সমর্থন জানাতে উঠে দাঁড়াব কি দাঁড়াব না ভাবছি, এমন সময় বাসের দরজার ঠিক পাশের সিটে বসে থাকা এক দিদিমণি, যিনি এতক্ষণ চুপটি করে সবার কথা শুনছিলেন, এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “দেখুন, খিদে আমাদের সবার পেয়েছে, কষ্ট আমাদের সবার হচ্ছে। তবু এত বড় ঘটনাটা পুলিশকে ইনফর্ম না করাটা খুব ভুল কাজ হবে। ভবিষ্যতে এ’রকম ঘটনা আমাদের কারও না কারও সাথে আবারও ঘটতে পারে। আজ ভাগ্য আমাদের সাথ দিয়েছে, সেদিন নাও দিতে পারে। তাই এই ঘটনা যাতে আর কোনদিন কারও সাথে না হয়, তার জন্য আজকে আমাদের এই কষ্টটুকু স্বীকার করতেই হবে। আমি কি কিছু ভুল বললাম?”
বাসের সহযাত্রীরা প্রায় সবাই একযোগে তাঁকে সমর্থন জানাল। উপায়ান্তর না দেখে আমিও জানালাম। অতঃপর আমরা থানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। থানাটি চুঁচুড়া ও ব্যান্ডেলের মাঝামাঝি একটি মফস্বল এলাকায়। হাইওয়ে থেকে ডান দিকে বাঁক নিয়ে বাসটি নেমে একটি গলি রাস্তা ধরল। রাস্তাটা এত সরু যে, ড্রাইভার দাদাকে খুব সাবধানে বাস চালাতে হচ্ছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট থানার খোঁজ পাওয়া গেল। গাড়িটি একটু এগিয়ে ঘুরিয়ে এনে থানার সামনে দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার, কণ্ডাক্টর আর সেই ইউটিউবার ভাই তার ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে নেমে গেল। বেশ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, যে ভদ্রলোক থানায় যাবার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন, তিনিও ওদের সাথে গেলেন।

আমি জানলার গায়ে হেলান দিয়ে শরীরটাকে প্রায় ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলাম। পাশের মেয়েটি দেখলাম ব্যাগ থেকে একটি বিস্কিটের প্যাকেট বের করেছে। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে হিন্দিতে বলল, “আণ্টি, লিজিয়ে না।”
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, “নেহি নেহি, তুম খা লো, ম্যায় তো হেভি ব্রেকফাস্ট খাকেই বাস মে উঠা থা।”
মেয়েটি আমার হিন্দি কি বুঝল কে জানে, বিস্কিট খেতে শুরু করল। আমি বোতলের বাকি জলটুকুও নিঃশেষ করে গলায় ঢেলে নিলাম।

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ধরে চলল অভিযোগ নিবন্ধীকরণ প্রক্রিয়া। পুলিশের ক্যামেরাম্যান বাসটির বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে কত যে ছবি তুলল, ভিডিও করল, তার ঠিক নেই। সব প্রক্রিয়া শেষে বাস যখন আবার ঘড়ঘড় করে চলতে শুরু করল, তখন পেটের ভিতরে খিদের দাপাদাপিটাও বন্ধ হয়ে গেছে। পেটের ভিতরের ছুঁচোটা একশোটার বদলে দু’শোটা ডন-বৈঠক মেরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছুঁচোর দাপাদাপিটা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে একটা অদ্ভুত উদাসীনতা আর দার্শনিকভাব আমার চিন্তার জগতকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলল। মন প্রশ্ন করল, “কে আমি? কী উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে এসেছি? যে উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে এসেছি, সেই সব কাজ কি আমার সম্পূর্ণ হয়েছে?” উত্তর পেলাম হয়নি, “হয়নি।” পরম করুণাময় ঈশ্বর হয়ত আমার জন্য আরও বড় কোন অ্যাসাইনমেণ্ট রেডি করেছেন। আর তাই এখন আমার এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া চলবে না। নয়ত আজ অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত, কিন্তু ঘটল না। কেন? আমার কি তবে আজ পুনর্জন্ম হল? এত দিনের হতাশা, ব্যর্থতা, অভাব, অভিযোগ নিয়ে ল্যাজেগোবরে হয়ে থাকা একটা তুচ্ছ জীবন থেকে নতুন কোন উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য মনে মনে নতুন করে জন্ম নেওয়া? জানি না, কিন্তু মন বলছে পিছনে তাকিয়ে হাহাকার, বিলাপ করে কাটিয়ে দেবার জন্য এই বাড়তি সময়টুকু আমাকে দেওয়া হয়নি। আমাকে সামনে তাকিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। চরৈবেতি! চরৈবেতি! লক্ষ্য ঠিক সামনে চলে আসবে। আর তা পূরণ আমাকেই করতে হবে, তাই এই পুনর্জন্ম।

ভাবনার দোলায় দুলতে দুলতে যখন শক্তিগড় এসে পৌছালাম, তখন ঘড়িতে সন্ধে ছ’টা। আশ্চর্য, সেই খিদের দাপদাপানি আর নেই, ক্লান্তিবোধ নেই, বিরক্তি নেই, নেই হতাশাও। বদলে অদ্ভুত এক উত্তেজনায় আমি যেন টগবগ করে ফুটছি। আমি বুঝতে পারলাম আজকের এক ভয়ংকর দুর্ঘটনার হাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া আমার আমিটাকে একেবারেই বদলে দিয়েছে। সত্যি সত্যিই আমার পুনর্জন্ম হয়েছে।


লেখক পরিচিতি : স্বাতী রায় চৌধুরী
স্বর্গীয় কাজল রায় চৌধুরী ও কুমকুম রায় চৌধুরীর সন্তান অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর স্বাতী রায় চৌধুরীর সাহিত্যের প্রতি টান ছোটবেলা থেকেই। বাবা ও মায়ের অনুপ্রেরণায় লেখালেখির সূত্রপাত হলেও কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা একমাত্র মেয়ে সৃজিতা।‘আলোর ফুলকি' এবং আরো অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনে ওনার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।‘ফিরে দেখা' , ‘উল্কা' এবং 'উত্তরের জানালা' এবং 'অণুুু-চ্চারিত' তার প্রকাশিত চারটি কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া হিন্দীতেও একটি কাব্যগ্রন্থ তার প্রকাশিত হয়েছে 'কশমাকশ' নামে যেটি পিডিএফ আকারে প্রকাশিত হয়েছে। গৃহশিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্যের আরাধনা এটাই তার দৈনন্দিন জীবন সূচী।সাহিত্যের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসাই তাকে জীবনযুদ্ধে লড়ার প্রেরণা দেয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।