লেখক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী
রঞ্জন সান্যাল আজ ভোরে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিনের প্রথম ওঠা রবি কিরণ গায়ে মাখতে মাখতে বারান্দার গায়েই নিমগাছের পাতায় হাত ছোঁয়ালেন। বহু পুরনো নিমগাছে ক’দিন ধরে একটা বুলবুল বাসা বানাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে যত রাজ্যের কাঠকুটো নিয়ে এসে জড়ো করছে। তিনদিনের চেষ্টায় মোটামুটি একটা বাটির রূপ ধরা দিচ্ছে রঞ্জনের চোখে। এবার বোধহয় বুলবুলিটি ডিম পাড়বে। তারপর দুজন মিলে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে তাদের বড় করে তুলবে।
“আপনার চা।” বুলার ডাকে সম্বিৎ ফেরে রঞ্জনের।
“তোমার ম্যাডামকে দিয়েছ?”
বুলা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে চলে যেতে যেতেও ফিরে আসে।
“কিছু বলবে? চা-টা ভাল হয়েছে।”
“না, চায়ের কথা জিজ্ঞেস করি নি। বলছি, সত্যিই আর আপনারা একসঙ্গে থাকবেন না দাদা?”
বুলার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হয় রঞ্জনের। অনেকদিন ধরে বুলা তাঁদের বাড়ির সবকিছু দেখভালের দায়িত্বে আছে। হয়ত তাদের ভালবাসে। রঞ্জন বা দূর্বার বুলার প্রতি আলাদা করে কোনও অনুভূতি তৈরি হয়েছে কিনা, তাঁরা সেটা ভেবে দেখেন নি। তবে বুলার ওপর নির্ভরতা নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছে। সে বাড়ি গেলে একদিনে পৃথিবীটা ওলটপালট হয়ে যায় সান্যাল বাড়ির। বুলা সর্বক্ষণ থাকে বলে সবই জানে। রঞ্জন আর দূর্বা দীর্ঘ সাতাশ বছর একসঙ্গে থাকার পর তাদের মনে হয়েছে আর একসাথে কাটানো যাচ্ছে না। তাই আজ নিয়ে দ্বিতীয়দিন তারা উকিলের কাছে যাবে।
রঞ্জনের সেই ক্লাস ইলেভেন থেকে দূর্বার সঙ্গে বন্ধুত্ব। পরাগবাবুর কোচিং ক্লাসে দু’জন দু’জনের পাশাপাশি বসে অঙ্ক কষা। রঞ্জন চিরকাল অঙ্কে কাঁচা। আর দূর্বা অঙ্ক-ফিজিক্সে তুখোড়। ফলে দুর্বল রঞ্জনকে অঙ্ক দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতে দিতে দূর্বা কখন যেন রঞ্জনের প্রেমে পড়ে গেল। সায়েন্সে একেবারে খারাপ রেজাল্ট করে রঞ্জন আর বাড়ি থেকে বের হত না যখন, তখন দূর্বা এসে ওকে টেনে বাইরে বের করত। রঞ্জনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আর্টস নিয়ে কলেজে ভর্তি হবার জন্য সমানে লেগে থাকত। তারপর রঞ্জন প্রথাগত সায়েন্সের রাস্তা ছেড়ে বাংলা নিয়ে পড়বে ঠিক করল। কিন্তু এই ভাবনাটা ভেবে ওঠা খুব স্বাভাবিক ছিল না। বাংলার কোন ভবিষ্যৎ নেই, এটা যেন সকলের মনে বদ্ধমূল ধারণা একটা। কিন্তু রঞ্জনকে সেই পথ বেছে নিতে দূর্বা তখন যদি সাহস না যোগাত, তাহলে আজকের বাংলার তুখোড় অধ্যাপক রঞ্জন সান্যালের জন্ম হত না। দূর্বা শুধু রঞ্জনকে নয়, রঞ্জনের বাবা মাকেও কনভিন্স করেছিল এক জাদুকরীর মত।
তারপর একটার পর একটা হার্ডল টপকে রঞ্জন যখন পিএইচডি-তে ঢুকল, তার কিছু আগে থেকেই ছোট ছোট গল্প লেখা শুরু করেছে সে। মাঝেমাঝে কবিতা। লেখে, কিন্তু কোথাও পাঠায় না। হঠাৎই একদিন একটি বিখ্যাত পাক্ষিক পত্রিকা বাড়িতে ডাকযোগে হাজির, তার সঙ্গে একটি চেক ও চিঠি। রঞ্জন কিছুই বুঝতে না পেরে বই খুলে নিজের একটি কবিতা ওই বইয়ের পাতায় ছাপার অক্ষরে দেখে হতবাক হয়ে গেল। এটা কি করে সম্ভব! সে তো কোথাও কোনও লেখা পাঠায়নি। তবে কি দূর্বা?
কিছুক্ষণের মধ্যেই দূর্বা এক হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে হাজির।
“কাকিমা, কাকু, শিগ্গির এস। তোমাদের ছেলে এখন বিখ্যাত হয়েছে। তারই খাওয়ানো উচিত। কিন্তু সে তো ভীষণই কৃপণ। তাই আমিই খাওয়াচ্ছি তোমাদের।” রঞ্জনের বাবা-মা তখনও ব্যাপারটা কিছুই জানেন না। ধীরে ধীরে সব শুনে সকলেই আনন্দে আত্মহারা। প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে যাবার পর রঞ্জন দূর্বার হাত ধরে ঘরে টেনে এনে জিজ্ঞেস করতে চাইল যে, দূর্বা কবে এটা পাঠিয়েছে। উত্তরে দূর্বা ওর চুলের মুঠি ধরে নিজের দিকে টেনে এনে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে সমস্ত প্রশ্ন শুষে নিয়েছিল। তারপর থেকে নিয়মিত গল্প-কবিতা বের হতে হতে একজন খ্যাতনামা লেখক হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি।
এর বছর দু’য়েক পরে চারহাত এক করে দিতে সময় নেননি দু’পক্ষের পিতা মাতা। কিন্তু রঞ্জন তখন থেকেই একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছিল। একেই কমবয়সী সুপুরুষ প্রফেসর দেখলেই ছাত্রীরা কেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার উপর আবার খ্যাতনামা সাহিত্যিক। রঞ্জনের চারপাশে এখন সুন্দর মুখের ভিড়। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, যে রঞ্জন একেবারেই মিশতে পারত না লোকসমাজে, সে এখন অতি সহজে সকলের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। আগে যে ভিড় দেখলে সে পালিয়ে কোণ খুঁজত, সে এখন চারপাশে ভিড় না থাকলে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। সত্যি বলতে কি, রঞ্জন এখনই বিয়ে করতে খুব একটা ইচ্ছুক ছিল না। কিন্তু দুই পরিবারের চাপে আর কিছু বলার সুযোগ পেল না সে। দূর্বাকে সেই ছোট থেকে দেখতে দেখতে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর নতুন কিছু না পেলে রঞ্জনের আজকাল একঘেয়ে লাগে। যদিও দূর্বা এই পরিবর্তন বোঝেনি সে সময়।
বিয়ের দেড় বছরের মাথায় রিকু এল ওদের জীবনে। দূর্বা ভেবেছিল কানায় কানায় ভরে উঠল তাদের সংসার। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই কানে আসতে লাগল টুকরো টুকরো গসিপ। রঞ্জন নাকি এক ছাত্রীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে প্রায় একবছর ধরে। প্রথম দিকে দূর্বা উড়িয়ে দিয়ে মন দিয়ে সংসার আঁকড়ে ধরেছে। রঞ্জন বাড়ি ফিরলে তাকে দেখেও দূর্বা কিছু আলাদা বোঝে নি। রঞ্জন সমস্ত ব্যাপারটা সুন্দরভাবে একটা মিথ্যের চাদরে আড়াল করে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু বেশিদিন আড়াল থাকল না। আড়াল ছিঁড়েখুঁড়ে সম্পর্কের দৈন্যতা ধরা পড়ল একদিন। রঞ্জন আগের ছাত্রীকে ছেড়ে যখন আর একটি নতুন বান্ধবীতে মগ্ন, তখন সেই পুরনো ছাত্রী এসে দূর্বাকে সব বলে যায়। এর আগেও যে রঞ্জন আরও সম্পর্কে জড়িয়েছে, সে কথাও জানতে পারে দূর্বা।
দূর্বা সেদিন যখন ছেলেকে নিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল, তখন রঞ্জন আটকানোর চেষ্টা করেনি। কিন্তু রঞ্জনের বৃদ্ধ বাবা-মা এসে হাত ধরে কেঁদে বলেছিলেন যাতে সংসারটা থাকে। একটি মাত্র নাতিকে তাঁরা ছাড়তে চাননি। রঞ্জনও প্রমিস করেছিল, আর এ’রকম সম্পর্কে জড়াবে না। বলেছিল, মেয়েগুলো অসম্ভব গায়ে পড়ে, তারও ভুল হয়ে যায়। দূর্বা রিকুর মুখ চেয়ে আবার বিশ্বাস করেছিল, বা হয়ত বিশ্বাস করেনি। কিন্তু সংসারটা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল, যেটা বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ছোট থেকে শিখে বড় হয়ে ওঠে। সব বুঝেও না বুঝতে চাওয়া এরকম অনেক সংসারই তো টিকে থাকে। শুধু দু’জনের মধ্যে কোন ভালবাসার সেতু থাকে না। সেটা আধভাঙা হয়ে অন্ধকারে পড়ে থাকে, রেলিং ভেঙে ঝোলে। অজস্র অন্ধকার জগতের প্রাণী বাসা বাঁধে ভাঙা সেতুর তলায়।
ক’দিন আগে রিকু চলে গেছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। বলেছে দু’বছর পর ফিরবে। কিন্তু রঞ্জন বা দূর্বা দু’জনেই জানে, কেরিয়ার সচেতন রিকু আর হয়ত ফিরবে না। একে একে দূর্বার বাবা, রঞ্জনের বাবা চলে গেছেন। রঞ্জনের মা আঁকড়ে রেখেছিলেন দূর্বাকে এতদিন, বা বলা যেতে পারে ওদের দাম্পত্যকে। তিনিও চলে গেলেন এক বছর। দূর্বা এতদিনে সাজানো খেলাঘর থেকে নিজের ঘরে ফিরতে চাইছে। সংসার টিকিয়ে রাখার দায় থেকে মুক্তি চাইছে সে। রঞ্জনের আটকানোর কোনও রাস্তা জানা নেই আজ। তবু সে চাইছে দূর্বা থাকুক। সম্পর্কটা একটা অভ্যাস, সেটা চট করে ছিঁড়ে ফেলা যায় না বোধহয়। নাহলে ওই বুলবুলির বাসাটা দেখে রঞ্জনের এত কষ্ট হচ্ছে কেন?
লেখক পরিচিতি : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী
লেখিকা মৈত্রেয়ী ব্যানার্জীর জন্ম পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনার নিকটবর্তী বানীনাথপুর গ্রামে। শৈশবেই হাওড়া জেলার বালীতে চলে আসেন। কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। লেখিকা একজন বাচিক শিল্পী। দুটি একক গল্প সংকলন ও বহু পত্র পত্রিকায় গল্প প্রকাশিত হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক গল্প সংকলনেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে।