লেখক : অভীক সিংহ
ছোট থেকেই শুনে আসছি, পাপ বস্তুটা খুবই গুরুতর। যদিও জন্ম-ধম্ম-কম্ম-স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে এই পাপেরও আবার বিভিন্ন তারতম্য আছে, আমি বাপু সক্কাল সক্কাল মাথাটাথা চুলকে নিজের খেরোর খাতার পিছনের পাতায় বিস্তর জটিল অঙ্ক কষে এই পাপের কয়েকটা সুবিধামত ভাগ বের করে নিয়েছি। এই যেমন, খুচরো পাপ, “ওতে কিছু হবে না” গোছের মৃদুবর্গীয় পাপ, “এটা না করলেও পারতিস” গোছের মধ্যমবর্গীয় পাপ, “সব্বোনাশ করেছে রে” গোছের কেলোর কীর্তন বর্গীয় পাপ, এবং সবার উপরে মহাপাপ। এই যেমন ধরুন, আপনার বাচ্চার সামনে রাখা চকলেটটা তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে টপাক করে নিজের মুখে পুরে দেওয়া, বন্ধুকে রসগোল্লা খাওয়ানোর নাম করে তার হাঁ মুখে একফোঁটা রস ফেলে বাকিটা নিজের পেটে চালান করে দেওয়া, বা পাবলিকের স্নান করার সময় তার গামছা নিয়ে কেটে পড়া – এইগুলো প্রায় সবই পড়ে খুচরো পাপের আওতায়। তারপরে ধরুন, পাবলিকের বিরিয়ানির প্লেট থেকে খপাৎ করে আলুটা তুলে নিয়ে সাবড়ে দেওয়া, নুডলসে কুমড়োর সসের বদলে লঙ্কাগুঁড়ো মেশানো জল মিশিয়ে দেওয়া, অথবা প্রাতঃকৃত্যের পরে হাত ধোওয়ার সাবান আর স্নান করার সাবান বদলে দেওয়া – এইগুলো পড়ে মৃদুবর্গীয় পাপের আওতায়। এবারে, পরীক্ষার আগে কারও ক্লাসনোট নিয়ে কেটে পড়া, বন্ধুর প্রেমিকাকে তার চিঠি পৌঁছে দিতে গিয়ে নিজেই প্রেমনিবেদন করে বসা, অফিসে বসের কাছে কারও নামে কাঠি করে আসা – মধ্যমবর্গীয় পাপের ঘরাণায় এদের ফেলা যায়। এরপরেই আসে কেলোর কীর্তন বর্গীয় পাপ। বসের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার ভুল করে রেখে যাওয়া মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে সেক্রেটারিকে রোম্যাণ্টিক মেসেজ পাঠিয়ে সেটার স্ক্রীণশট নিয়ে বসের বৌকে পাঠিয়ে দেওয়া, হেডস্যারের সই নকল করে স্কুলের নোটিশবোর্ডে ছুটির ঘোষণা করে দেওয়া, অথবা পরীক্ষার দিন সকালে “স্যার মারা গিয়েছেন” বলে হস্টেলের ছেলেপুলে জুটিয়ে সান্ত্বনা মিছিল বের করে পরীক্ষা ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা, ইত্যাদি হ’ল এই ধরণের পাপের নমুনা। এছাড়াও পরীক্ষার হলে পকেট থেকে চোথা বের করা পাপ, কিন্তু চোথা পাশের জনকে সাপ্লাই না করাটা আরও বড় পাপ। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে হিসি করা পাপ, কিন্তু দেওয়ালে হিসি করতে করতে নিজের নাম লেখার চেষ্টা না করাটা আরও বড় পাপ। আমার জীবনে কমবেশি এই সবধরণের পাপেরই অভিজ্ঞতা আছে, অর্থাৎ হয় পাপকম্মটি করার নয়ত প্রত্যক্ষ করার। তাই দেওয়ালে ফটোফ্রেমে গলায় শুকনো বেলফুলের মালা নিয়ে ঝুলে পড়ার পরে আমি যে সাক্ষাৎ যমরাজের সাথে বসে পাবজি খেলব, সেই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু এই কয়েকদিন আগে পর্যন্তও আমার মনে একটা বিষয় নিয়ে একটু হ’লেও আক্ষেপ ছিল। সেটা হ’ল, আমার মহাপাপের কুমারীত্ব দশা তখনও পর্যন্ত কাটেনি। কিন্তু কয়েকদিন আগেই এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল, যেটার পরে আমার সেই আক্ষেপ চিরতরে মুছে গেল। সেই কথা ভাবতে ভাবতেই এসে বসেছি লাউঞ্জের বাইরে। ইতিমধ্যে একটি অপকম্ম করতে গিয়ে আড়চোখে দেখে নিয়েছি কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে কি না। চুপিচুপি কাজটি সেরে বেয়ারার হাত থেকে চায়ের কাপটি নিয়ে লাউঞ্জের বাইরে সোফায় এসে বসেছি, এমন সময় পিছন থেকে আওয়াজ আসল, “আমি কিন্তু দেখে নিয়েছি।”
আমি মুখ ঘুরিয়েই দেখি সান্যালদা দাঁড়িয়ে, হাতে চায়ের কাপ, মুখে মুচকি হাসি। বুঝলাম ধরা পড়ে গিয়েছি। আমি নার্ভাস হাসি হেসে বললাম, “এই, দেখে ফেলেছ নাকি?”
“তা নয়ত কি,” বলে সান্যালদা আমার সামনের সোফাটায় বসতে বসতে বলল, “কোন শালা গ্রীন টি-তে তিন চামচ চিনি মেশায় বলো তো?”
আমি হে-হে করে হাসতে হাসতে বললাম, “আরে, ওটা…এই একটু আর কী…”
“দিব্বি গেলে বলছি, তোমার মত জ্ঞানপাপী আর দু’টো দেখিনি। এই কালই আমার সাথে ডাক্তারের কাছে গেলে। ডাক্তার বলল সুগার বাড়ছে, চিনি খাওয়া কমাতে, আর রোজ সকালে গ্রীন-টি খেতে। আর তুমি গ্রীন টি-তে তেড়ে চিনি মেশাচ্ছ? মাইরি, কোন লজ্জাশরম নেই?”
“হেঁ হেঁ, আসলে ডাক্তার তো বলেছিল গ্রীন টি খেতে আর চিনি কম খেতে। গ্রীন টি-তে চিনি দিয়ে খেতে তো বারণ করেনি।”
“সত্যি মাইরি, তুমি আর তোমার লজিক জিন্দাবাদ।” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সান্যালদা সামনে টেবিলের উপর রাখা খবরের কাগজটা তুলে নিল। “কী সব যে চলছে চারিদিকে! এ ওকে বোমা মারছে, ও একে মিসাইল ছুঁড়ছে। জগৎটা উচ্ছন্নে গেল মাইরি, ছ্যা ছ্যা ছ্যা।”
“আরে সব জিওপলিটিক্যাল ঝোল গুরু। এমন ভাবে সবকিছু ঘেঁটে ঘ হয়ে আছে, এর উৎস খুঁজতে যাওয়ার চেয়ে পাঁজি ঘেঁটে সলমন খানের বিয়ের তারিখ খুঁজে পাওয়া সহজ।”
“আর জিওপলিটিক্স! সব শালা গলা পর্যন্ত পাপে ডুবে আছে।”
“তা ঠিক বলেছ গুরু। চারিদিকে যা চলছে, নরক মাইরি ব্যাঙ্গালোরের ট্র্যাফিক হয়ে যাবে।”
“কি মনে হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে নাকি?”
“এদিকে গৃহযুদ্ধ সামলাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি, আর তুমি বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে পড়েছ।”
“তাও ঠিক। সকলই কর্মফল, বুঝলে কি না অভীক?”
“গীতায় বলা আছে, কর্ম করে যাও, ফলের আশা করো না। সেটা তো অপকর্ম আর কর্মফলের ক্ষেত্রেও একইভাবে খাটে।”
“হক কথা।”
“এই যে পাপ-পুণ্য নিয়ে বলছ, আমিও সম্প্রতি একটা মহাপাপ করে এসেছি।”
“বলো কী। কবে? কোথায়?”
“এই রাশিয়া গিয়ে…”
সান্যালদা আমার দিকে একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি রাশিয়ায় গিয়ে মহাপাপ করে এসেছ? ব্যাপারটা তো খুব একটা ভাল ঠেকছে না অভীক। বাড়িতে বৌ-বাচ্চা আছে, আর তুমি…”
“আরে না না গুরু, কী যে বলো। তুমি যা ভাবছ, তা একেবারেই নয়। এটা তার থেকেও অনেক বড় লেভেলের মহাপাপ। এই জন্মে মুক্তি পাব বলে মনে হয় না।”
“কী ব্যাপার বলো তো? কি কাণ্ড করে এসেছ এবারে?”
“আরে সে একেবারেই বলার মত নয় গুরু। ভাবলেই কেমন যেন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।”
“এই, অনেক ভাট বকেছ। একটু ঝেড়ে কাশো তো শুনি।”
“আমাকে দিয়ে বলিয়েই ছাড়বে? লোকসমাজে মুখ দেখাতে পারব না গুরু।”
“তা নয়ত কি? শুনেই দেখি, তুমি কী এমন পাপ করে এসেছ, যাতে লোকসমাজে মুখ দেখাতে পারবে না।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি যখন এত জোর করছ, তখন তো আর কোন উপায় নেই। কিন্তু তার আগে আরেকটা করে চা বলে দিই?”
“হ্যাঁ, বলে দাও। কিন্তু তোমার গ্রীন টি-তে আর একদম চিনি মেশাবে না। ওটা সকালের পাপের প্রায়শ্চিত্ত।”
আমি মুখটা তেতো করে বেয়ারাকে ডেকে একটা গ্রীন টি আর একটা দুধ-চিনি দিয়ে চা দিতে বললাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেয়ারা এসে টেবিলে চা দিয়ে গেল। আমি বিস্বাদ মুখে চিনিছাড়া গ্রীন টি-র কাপটা তুলে একটা চুমুক দিয়ে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে গল্পটা শুরু করলাম।
তুমি তো জানোই যে আমি বেশ কয়েক বছর ধরেই রাশিয়ার কিছু অর্থনীতির অধ্যাপকদের সাথে গবেষণার কাজ করি। তো মাস দেড়েক আগে সেই কাজের সূত্রেই ওনারা আমাকে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকলেন একটা লেকচার দেওয়ার জন্য। আমন্ত্রণটা পেতেই মনটা যেন একেবারে খুশিতে পাগলু ড্যান্স করে উঠল। আমার ঘুরতে মানে তো হয় গোয়ার সমুদ্রতট, নয়ত বাড়ির ছাদ – আমার দৌড় তো সেই পর্যন্তই। সেখানে সোজা রাশিয়া যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে চারিদিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে খুশিতে দু’পাক নেচে নিলাম। রাশিয়া! চারিদিকে ধূ-ধূ করছে বরফ, কুলকুল করে বইছে ভদকা, আর কিলবিল করছে কমিউনিস্ট। একটা ভেতো বাঙালির জীবনে এর থেকে বেশি আর কীই বা চাওয়ার থাকতে পারে। তাই আমন্ত্রণটা আসতেই সটান রাজি হয়ে গেলাম। দেখতে দেখতে গত মাসে ওরাই আমার আসা-যাওয়ার টিকিট, বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে থাকা-খাওয়া, আর আনুষঙ্গিক সবকিছুরই ব্যবস্থা করে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দিল, আর আমিও পত্রপাঠ ভিসা অফিসে কথাবার্তা বলে সবকিছু ঠিকঠাক করে নিলাম। প্রথমবার পাসপোর্টে কোন দেশের ভিসার ছাপ পড়ল। পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে আনন্দে, আবেগে, উত্তেজনায় সে এক জগাখিচুড়ি অনুভূতি গুরু। সে জিনিস বলে বোঝানো সম্ভব নয়। দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন এগিয়ে আসল। প্রথমে গোয়া থেকে মুম্বাই, তারপরে মুম্বাই থেকে দুবাই, এবং শেষে দুবাই থেকে রাশিয়ার একাতেরিনবার্গ। তো সময়মত লোটাকম্বল-বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে “দুগ্গা-দুগ্গা” করে বেরিয়ে পড়লাম।
গোয়া থেকে মুম্বাইয়ের ফ্লাইটটা ছিল রাতে। মুম্বাই গিয়ে যখন পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে প্রায় রাত বারোটা। দুবাই যাওয়ার ফ্লাইট রাত আড়াইটে। দুবাই পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল সাড়ে পাঁচটা। সেখান থেকে রাশিয়ার ফ্লাইট আড়াই ঘণ্টা পরে, সকাল আটটায়। হাতে অঢেল, অফুরন্ত সময়। অতএব ধীরেসুস্থে চেক-ইন, ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি চেক সেরে নির্ধারিত গেটের সামনে গিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হাতে এখনও সময় আছে প্রায় দেড়ঘণ্টা মত। নিশ্চিন্তচিত্তে ব্যাগ থেকে একটা গল্পের বই বের করে পড়তে লাগলাম। একটু পরেই কেমন যেন একটু সন্দেহ হ’ল। সবকিছু এত সুন্দরভাবে হয়ে গেল, কোন ঝুটঝামেলা নেই। নিজের কপালের উপর তো আমার অগাধ আস্থা, তাই সন্দেহটা আরেকটু বাড়ল। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখলাম। নাহ্, সন্দেহজনক তো কিছু মনে হচ্ছে না। মনে মনে ভেবে দেখলাম, হয়ত একটু বেশিই ভেবে ফেলেছি। বিড়ালের ভাগ্যেও তো মাঝেমধ্যে শিকে ছেঁড়ে বলে শুনেছি। কিন্তু সেই কল্পনার পুসির উপর যে ভাগ্যদেবতা এইভাবে হিসু করে দিয়ে চলে যাবেন, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। বইটা নিয়ে আবার বসতে যাব, এমন সময় এয়ারপোর্টের মাইকে একটা ঘোষণা হল, “মুম্বাই থেকে দুবাই যাওয়ার ফ্লাইট এক ঘণ্টা দেরিতে ছাড়বে।” মনে মনে কিঞ্চিৎ প্রমাদ গণলাম। যদিও দুবাই পৌঁছে রাশিয়া যাওয়ার ফ্লাইট ধরার জন্য হাতে সময়টা আড়াই ঘণ্টা থেকে কমে দেড় ঘণ্টা হ’ল, তবুও ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে। কিন্তু একটু তৎপরতার সাথে কাজ করতে হবে, নইলে সমূহ বিপদ। চিন্তাটা কাটানোর জন্য বইটা সবে খুলে বসেছি, একমন সময় চোখ গেল বাইরের দিকে। এক্কেবারে সব্বোনেশের ক্যাঁথায় আগুন দশা! বাইরে শুরু হয়েছে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি, এবং সেই কারণেই মুম্বাই থেকে সমস্ত ফ্লাইট দেরি করে ছাড়বে। আকাশে বিদ্যুৎচমকের বহর দেখে পেটটা গুড়গুড় করতে শুরু করল। ফ্লাইট আরও দেরি করবে না তো? চিন্তার গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের চোটে আমার কল্পনা থেকে ধীরে ধীরে বরফ গলতে আর ভদকা উবে যেতে শুরু করেছে। গেটের পাশে কাচের দেওয়ালটার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের হাল হকিকত জরিপ করছি, এমন সময় আমার লেজে বাঁধা আশঙ্কার কালিপটকাটি ফাটল সশব্দে। মাইকে ভেসে আসল এক ঘোষণা, “প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে মুম্বাই থেকে দুবাই যাওয়ার ফ্লাইট আরও দুই ঘণ্টা দেরিতে ছাড়বে।” আমি অমায়িক আলুর দমের মত হাঁ করে মাইকটার দিকে চেয়ে রইলাম ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করবার জন্য। যেটুকু বুঝলাম, বৃষ্টি আমার সতীন হয়ে পুতিনের সাথে সাক্ষাতের স্বপ্নের গোড়ায় পেস্টিসাইড ঢেলে দিয়েছে। দুবাই থেকে রাশিয়ার ফ্লাইট ধরা অসম্ভব। এবারে উপায় কী? চোখের সামনে অচিরেই অন্ধকার ভেসে উঠল। এইভাবে বৃষ্টি আমায় ভদকার গন্ধ শুঁকিয়ে বোকা বানিয়ে বোতল নিয়ে কেটে পড়বে? কভি নেহি। কালবিলম্ব না করে ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে ছুটলাম এয়ারলাইন্সের অফিসের দিকে, আর মাথার মধ্যে অনর্গল চলছে “জবাব চাই, জবাব দাও।” একটু দূরেই অন্য একটি গেটের কাছে আমার এয়ারলাইন্সটির সবেধন একটি অফিসারকে দেখতে পেলাম। ছুটতে ছুটতে তাঁর সামনে গিয়ে ব্যাগটি মাটিতে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে পুরো ব্যাপারটা বললাম। সবকিছু শুনে তিনি বললেন, “হমম, এ তো মহা সমস্যা। দুবাই থেকে রাশিয়ার জন্য অন্য কোন ফ্লাইট আছে কি না, সেটা তো আমার জানা নেই।”
“প্লিজ একটু চেষ্টা করে দেখুন না। পরশু সকালে রাশিয়াতে আমার লেকচার আছে, যে কোন ভাবে কালকের মধ্যে আমায় পৌঁছতেই হবে।” আমি প্রায় আর্তির স্বরে বলে উঠলাম।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবলেন। তারপরে বললেন, “আমাকে দু’মিনিট সময় দিন। আমি দেখছি।” বলেই নিজের পকেট থেকে একটা ওয়াকিটকি বের করে কারও সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। আমি চাতক পাখির মত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কথা বলতে বলতে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কাল দুপুর একটায় একটা ফ্লাইট আছে দুবাই থেকে রাশিয়া পর্যন্ত। সেটা রাশিয়া গিয়ে পৌঁছবে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। আপনার কোন অসুবিধে নেই তো?”
অসুবিধে? বলে কী? ক্ষুধার্তের কাছে মাটন বিরিয়ানি আর ফুলকপি বিরিয়ানি, পরীক্ষার হলে চল্লিশ নম্বরের চোথা আর কুড়ি নম্বরের চোথা, আর সিঙ্গেল ছেলেদের লাক্স আর লাইফবয়ের মধ্যে বিভেদ করা মহাপাপ। আমি বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে বলে ফেললাম, “কোন অসুবিধে নেই। ওখানে সিট পাওয়া যাবে?”
“হ্যাঁ, কয়েকটা সিট খালি আছে।”
“তাহলে আপনি প্লিজ আমার জন্য একটা সিটের ব্যবস্থা করে দিন।”
“দাঁড়ান, দেখছি,” বলে ভদ্রলোক আবার ওয়াকিটকিতে কথা বলতে লাগলেন। আমার মনের মধ্যে বরফ আবার একটু একটু করে জমতে শুরু করল, ভদকার কুলকুল শব্দটা আবার কানের মধ্যে ভেসে উঠতে লাগল। কয়েক মিনিট পরেই ভদ্রলোক কথা শেষ করে ওয়াকিটকিটা পকেটে রেখে বললেন, “ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। ওখানে এয়ারপোর্টে এয়ারলাইন্সের লোক থাকবে। আপনি ফ্লাইট থেকে নেমেই ওদের সাথে যোগাযোগ করবেন, ওরাই আপনার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে।”
সত্যি কথা বলতে কী, আমার তখন ইচ্ছে করছিল লাফিয়ে উঠে ভদ্রলোকের গালে একটা চুমু খেয়ে নিতে। কিন্তু চুমুর পরবর্তী অবশ্যম্ভাবী ঠ্যাংবিদারক ঘটনাপ্রবাহের কথা কল্পনা করে নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখে ওনাকে “অশেষ ধন্যবাদ” বলে ফিরে আসলাম নিজের গেটের সামনে। এবারে অপেক্ষা দুবাই পৌঁছনোর ফ্লাইটের।
ফ্লাইটটিকে অত্যন্ত সময়নিষ্ঠ বলতে হবে। ঘোষিত প্রতিশ্রুতিমত এক্কেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক তিনঘণ্টা দেরিতেই দুবাই পৌঁছল, এক মিনিটও কম সময় নেয় নি। দুবাইতে ফ্লাইট থামার পরে বাইরে বেরিয়েই দেখি এয়ারলাইন্সের লোক অপেক্ষা করছে। তাদের কাছে যেতেই তারা আমার রাশিয়া যাওয়ার পুরনো বোর্ডিং পাসটা নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিল আমার নতুন ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস। নতুন বোর্ডিং পাসটা হাতে নিয়ে একবার ভাল করে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম। হ্যাঁ, সব ঠিকই আছে। ফ্লাইট দুপুর একটায়। এবারে আমার মরা গাঙে যেন একটু বানের সঞ্চার দেখা দিল। হাতে সময় আছে দু’ঘণ্টার মত। চটজলদি ছুটলাম ইমিগ্রেশন ডেস্কের দিকে। দুবাইতে ভারতীয়দের আনাগোণাটা বেশি হওয়ার কারণে বিশেষ বেগ পেতে হ’ল না। চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই ইমিগ্রেশন এবং সিকিউরিটি চেক সামলে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হলাম আমার নির্ধারিত গেটের সামনে। গেটের উপরে আমার ফ্লাইটের নম্বরটি জ্বলজ্বল করছে। নিজের ভাগ্যের উপরে অশেষ আস্থা থাকার কারণে পকেট থেকে বোর্ডিং পাসটি বের করে একবার ফ্লাইটের নম্বরটা মিলিয়ে নিলাম। হ্যাঁ, এটাই। আর কোনও চিন্তা নেই। এবারে দেরি করে হলেও পৌঁছে যাবই। গেটের সামনে কাঁধ থেকে ব্যাগটি রেখে নিশ্চিন্তে একটা সিট বাগিয়ে আরাম করে বসলাম।
এবারের ফ্লাইটটিও যারপরনাই সময়নিষ্ঠ। একেবারে পাঁজি-নক্ষত্র মেনে, ঘড়ি ধরে, ঠিক দেড়ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে তারপরে বাবাজির শুভাগমন ঘটল। গেটের পাশে কাচের জানালা দিয়ে ফ্লাইটের দিকে তাকিয়ে আছি, আর ব্যাকগ্রাউণ্ডে হেমন্ত গাইছেন, “আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি…”। আস্তে আস্তে গেট খুলল। সমস্ত যাত্রীরা এক এক করে এগোতে শুরু করল ফ্লাইটের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে ফ্লাইটের দিকে যেতে যেতে মনের মধ্যে সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি – “যেন হিয়া ডাকে পিয়া তুমি রাশিয়া, রাশিয়া।” ফ্লাইটে উঠে নিজের সিটে গিয়ে বসামাত্র সারাদিনের ধকলটা যেন ছেয়ে আসল সারা শরীরে। শিষ্ট কমিউনিস্টের মতই নাসাগর্জন করে স্বপ্নাবিষ্ট হলাম।
দিব্যি ঘুমোচ্ছিলাম, হঠাৎ ঘুম ভাঙল কাঁধে একটা আলতো টোকায়। কষ্টেসৃষ্টে চোখ মেলে চেয়ে দেখি, আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক সুদর্শনা এয়ার হোস্টেস। ঘুম ভেঙে চোখের সামনে ওই রকম এক সুন্দরীকে দেখেই “রাশিয়া এসে গেছে?” কথাটা বেফাঁস মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি আমার প্রগলভতাকে কভার ড্রাইভ করে বাউণ্ডারি লাইনের বাইরে পাঠিয়ে মৃদু হেসে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “ডিনার করবেন তো?”
আহা! এই রকম সাদর অভিবাদন তো আমাদের মত পেটরোগা আমাশাক্লিষ্ট পাবলিকের কাছে রবীন্দ্রনাথের হারানো নোবেল খুঁজে পাওয়ারই সামিল। সেই স্বর্ণকেশী শ্বেতশুভ্রার অমোঘ আহ্বান লঙ্ঘন করবার দুঃসাহসকে ড্রিবল করে আমিও বত্রিশ পাটি দন্তবিকাশ করে বলেই ফেললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, দিয়ে দিন।” বলার পরেই খেয়াল পড়ল, গতকাল রাত থেকে পেটে কিছুই পড়েনি। ক্ষিদেয় পেটে সুমোর দল ডন-বৈঠক দিচ্ছে। নাকে মুখে কিছু গুঁজতে পারলে মন্দ হত না। আমার উত্তর শুনে তিনি সেই মৃদু হেসেই জিজ্ঞাসা করলেন, “ভেজ না ননভেজ?”
যে পরিমাণ ছাগল এবং মুরগি আমার দয়ায় ইহজগতের মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে মোক্ষলাভ করেছে, তারপরে “ভেজ” বললে নরকের ল্যাট্রিনেও স্থান পাব না। তাই গর্বের সাথে উত্তর দিলাম, “ননভেজ।”
“চিকেন রাইস, ফিশ কারি, আর চিকেন বিরিয়ানি – আপনি কোনটা নেবেন?”
এ যেন দাদাকে অফসাইডে ফুলটস ডেলিভারি, তাও ইডেনের মাঠে। প্রিন্স অফ ক্যালকুটা গোস ডাউন দ্য উইকেট, ওপেনস দ্য ফেস অফ দ্য ব্যাট, অ্যাণ্ড আ ম্যাগনিফিশিয়েণ্ট শট স্ট্রেট ইন দ্য গ্যালারি! “চিকেন বিরিয়ানি।” সুন্দরী একটা ঊজ্জ্বল হাসি দিয়ে বিদায় নিলেন। ফিরে এলেন মিনিট কয়েক পরেই, হাতে একটি বেশ বড় প্যাকেট। আমার কাছে এসে আমার সামনের ডিনার ট্রে-টি নামিয়ে তার উপরে প্যাকেটটি রেখে বললেন, “আপনার ডিনার, খেয়ে নেবেন।”
আমি “হ্যাঁ” বা “না” কিছুই বলতে না পেরে কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে চোখ ফেরালাম আমার সামনে রাখা প্যাকেটটির দিকে। মাঝারি সাইজের প্যাকেট, কাছে নাকটা নিয়ে গিয়ে একটু শুঁকে দেখলাম। গন্ধটা বেশ অদ্ভুত, ঠিক বিরিয়ানিসুলভ মনে হ’ল না। কিন্তু ক্ষিদেও পেয়েছে। প্যাকেটের উপর থেকে ঢাকনাটা আস্তে আস্তে খুলে পাশে রাখলাম। এবারে প্যাকেটের ভিতরের বস্তুটিকে একটু কৌতূহলের সাথে পর্যবেক্ষণ করলাম। সাদা ভাতের উপর চার-পাঁচটা ন্যাতানো ভাজা পেঁয়াজ, আর সেই ভাতের একদিকে আলুপোস্তর আলুর আটভাগের একভাগ সাইজের কাটা একমুঠো আলু সেদ্ধ করে গোলমরিচ ছেটানো, আর অন্যদিকে দু’টুকরো চিকেন। আমি কিছুক্ষণ বস্তুটির দিকে হাবা গঙ্গারামের মত চেয়ে রইলাম। হাজার হোক, সুন্দরী নিজের হাতে বিরিয়ানি বলে এই বস্তুটি ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, তাই আমি সর্বকল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে আমার চেনা জানা বিরিয়ানিগুলোর সাথে এটাকে তুলনা করার চেষ্টা করে চলেছি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রণে ভঙ্গ দিয়ে ভাবলাম উপায় যখন নেই, তখন একটু খেয়েই দেখা যাক। এই ভেবে হাতের চামচ দিয়ে চিকেনের টুকরোগুলো একটু নাড়াচাড়া করতে শুরু করলাম। চিকেনগুলোকে সেদ্ধ করে কোন এক অনির্বচনীয় অর্বাচীনমার্কা চীনে সস মাখিয়ে পরিবেশন করেছে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, চিকেনগুলো আমার দিকে চেয়ে আর্তচিৎকার করছে, “ওরে আমায় খা, আর কমোডে গিয়ে মুক্তি দে। এই সস মাখার আফসোস আর বরদাস্ত করতে পারছি না।” এক চামচ তুলে মুখে দিলাম। একধাক্কায় সুকুমার রায়ের কবিতাটা মনে পড়ে গেল, “খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না।” লাক্সারির এই নমুনা হলে সিজিদ্দার ডালভাত জিন্দাবাদ। এ জিনিস গলা দিয়ে গলাধাক্কা মেরে নামানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। হঠাৎ প্যাকেটের কোণের দিকে একটা প্লাস্টিকের পুঁটুলির দিকে নজর পড়ল। প্রায় কাঁদোকাঁদো অবস্থায় পুঁটুলিটিকে তুলে এনে খুলে প্রায় ককিয়ে উঠলাম।
“অ্যাঁহ! আচার!”
বিরিয়ানির সাথে আচার – এ তো সাক্ষাৎ উত্তম কুমারের মুখে হিমেশ রেশমিয়ার গান। যদিও আমার সামনে রাখা বস্তুটি বিরিয়ানি হ’লে দেবও মহানায়ক, কিন্তু সুন্দরী নিজের হাতে এই জগাখিচুড়ির ঘ্যাঁটকে বিরিয়ানি বলে পরিবেশন করে গিয়েছেন, মানা করি কোন দুঃসাহসে? শেষে অনেক ভেবে, দাঁতে দাঁত চেপে, চোখের জল মুছে, চরম সিদ্ধান্ত নিলাম – আজ আমার মহাপাপের অ্যাকাউণ্টটা খুলেই ফেলব। চামচে করে একটু আচার তুলে নিয়ে ফেললাম সাদা ভাতটার উপরে। সেদ্ধ চিকেন, সেদ্ধ আলু, আর সেদ্ধ চালের সাথে সেই আচার মিশিয়ে “জয় চাচা আর্সালান” বলে দিলাম মুখে পুরে। ব্যাকগ্রাউণ্ডে বেজে চলেছে, “পাপা ক্যাহতে হ্যায় মহাপাপ করেগা”। ক্ষিদের চোটে ভর সন্ধ্যেবেলায় মধ্যগগনে ঝুলতে ঝুলতে “নেসেসিটি” যে “মাদার অফ মহাপাপ” হয়ে যাবে, কল্পনাও করিনি। বিরিয়ানির সাথে আচার গলাধাক্কা খেয়ে পেটে সেঁধিয়ে গেল।
সিগেরেটটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফিল্টারটা অ্যাশট্রেতে রাখছি, এমনসময় সান্যালদা বলে উঠল, “শেষে বিরিয়ানির সাথে আচার – তোমার এই দুর্দিন দেখতে হবে ভাবিনি।”
আমি সোফায় হেলান দিয়ে উদাসমুখে বললাম, “কপাল গুরু, কপাল। তাই তো সেই ফিরে আসার পর থেকেই প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছি।”
“প্রায়শ্চিত্ত? কী রকম?”
“ফিরে আসার পর থেকে প্রায় আট-দশদিন ধরে টানা দু’বেলা বিরিয়ানি খেয়ে চলেছিলাম। আর সেজন্যই…” বলে উদাসমুখে আকাশের দিকে তাকালাম।
“সেজন্যেই কী? বলবে তো।” সান্যালদা অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
আমি গ্রীন টি-র কাপটা হাতে তুলে সান্যালদার দিকে তাকিয়ে বললাম, “এই সবুজ সেঁকোবিষ কেন খাচ্ছি, এবারে বুঝলে?”
“তাহলে মহাপাপ, সেখান থেকে প্রায়শ্চিত্ত, সেই কারণে সুগার, আর সেখান থেকেই গ্রীন টি।” বলে সান্যালদা হো-হো করে হাসতে হাসতে বলল,”আমার দুধ চা-টা কিন্তু বেড়ে বানিয়েছে।”
“ধুৎ, আমি চললাম।” বলে আমি কেটে পড়লাম। পিছন থেকে এখনও সান্যালদার গলার আওয়াজ আসছে, “কী হে পাপী, বিরিয়ানি খাবে নাকি…”
লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ডঃ অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।
বেশ লেখা৷
অনেক ধন্যবাদ অর্পিতা 😊😊😊