বেগুনি রঙের নেশা

লেখক : অনিকেত পাহাড়ি

‘খেলব হোলি রং দেব না….’
দাঁড়ান দাঁড়ান মশাই। রং তো দেবেন বুঝলাম, তা কী রং দেবেন? কী বললেন? লাল-হলুদ-সবুজ-গেরুয়া…যা খুশি? উঁহু, তা বললে তো চলবে না। শুধু বেগুনি রং অ্যালাউড! না মশাই, মোটেই মশকরা করছি না! এরকমও হয়! আচ্ছা, ওই যে ফিল্ম ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’-তে যখন টম্যাটো ছোঁড়াছুড়ি করছিল, তখন তো এমন বলেননি! হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই দেশের কথাই বলছি। কী বললেন? বেগুনি টম্যাটো? ধুর মশাই। এ হল গিয়ে ওয়াইন – বিশুদ্ধ মদ! খাওয়া নয় মশাই, গায়ে ঢালা! ঠিক ধরেছেন, খেলা হবে! কেমন সে খেলা? শুনুন তবে –

স্পেনের উত্তরে আরো (Haro) বলে একটা জায়গা আছে, বুঝলেন, সেখানে এক বিচিত্র উৎসব হয় – লা বাতাইয়া দেল ভিনো (La Batalla del Vino)। ব্যাটল অফ ওয়াইন! ভাবুন একবার। গ্যালন গ্যালন মদ দিয়ে হোলি খেলা আর কী! এই আরো (Haro) জায়গাটা কিন্তু লা রিওহা (La Rioja) প্রভিন্সের মধ্যে পড়ে, যেখানকার ওয়াইন পৃথিবী বিখ্যাত। বুঝতেই পারছেন এক্কেবারে জম্পেশ ব্যাপার। প্রতি বছর জুনের ২৯ তারিখ হাজার হাজার মানুষ হাজির হয় লাল ওয়াইনে শরীর ভেজাতে। আমাদেরই মত জলবন্দুক, বালতি, বোতল নিয়ে। শুধু রঙের বদলে থাকে ওয়াইন। ভাবছেন এত মদ পায় কী করে? না না, সুইগি করে আনায় না মোটেই! 

সক্কাল সক্কাল আরো (Haro)-র মেয়র আসে ফিতে কাটতে। আহ, লিটারেলি নেবেন না সব কথা। ধম্মকম্মের ব্যাপার, মশাই! ধম্ম না থাকলে কি কম্ম, থুড়ি উৎসব হয়! সবেরই শুরুর কথা থাকে। এই উৎসবের শুরু নাকি ষষ্ঠ শতকে, বুঝলেন। স্যান ফেলিস (San Felice) ছিলেন আরো (Haro)-র প্যাট্রন সেইন্ট, অর্থাৎ কিনা হর্তা-কর্তা-বিধাতা। তাঁর আশ্রম (Hermitage) ছিল কাছেই এক পাহাড়চূড়ায় বিবিলিও ক্লিফস (Bilibio Cliffs)-এ। মেয়র সকাল সাড়ে সাতটায় স্যান ফেলিস ভ্রাতৃসংঘের সব জনগণ নিয়ে বিবিলিও ক্লিফসের চ্যাপেলে আসেন প্রার্থনা করতে। আরে এ চ্যাপেল সৌরভের চ্যাপেল না মশাই! খ্রিষ্টানদের প্রার্থনাঘর। এসব মিটে গেলে মেয়র সাঁ করে এক রকেট ছোঁড়েন, আর ব্যাস! শুরু হয়ে যায় খেলা ভাঙার খেলা! সাদা পোশাক আর লাল রুমাল নিয়ে আসে সব গাঢ় বেগুনি হতে। এর একখানা গালভরা নাম আছে – ওয়াইন ব্যাপ্টিজম! ওয়াইন যে খ্রিষ্টের দৈবী ক্ষমতার প্রতীক, সে তো জানেনই।

এতক্ষণ উসখুস করছেন যার জন্য, সেটা বলি। এত ওয়াইন আসে কোত্থেকে? বিশাল বিশাল ট্যাঙ্কার পাঠানো হয় টাউন হল থেকে। একেকটা ট্যাঙ্কারে থাকে প্রায় পনের হাজার লিটার ওয়াইন! এখনই চোখ কপালে তুললে হবে! এখানেই শেষ নয় মশাই। ট্যাঙ্কার একটা নয়, একাধিক। এর ওর গায়ে ঢালা হয় প্রায় পঞ্চাশ হাজার লিটার ওয়াইন! বুঝুন কাণ্ড! জলবন্দুক, বালতি আর বোতল বোতল ওয়াইনের বন্যায় ভাসতে থাকে আপাত শান্ত শহর আরো (Haro)। আর এখন শুধু দেশি নয়, বিদেশিদেরও আনাগোনা বেড়েছে বিস্তর। ফেসবুক আর রিলসের দুনিয়ায় লোকাল বলে কি আর কিছু আছে! ওয়াইন নষ্টের কথা ভাবছেন নিশ্চয়ই? গায়ে না ঢেলে পেটে গেলে কী জবরদস্ত ব্যাপার হত ভেবে গা রিরি করা স্বাভাবিক। এত ঢালাঢালির মধ্যে পেটে কি আর যায় না কিছু? আলবাত যায়। তবে কি জানেন, এগুলো নাকি সবই ছাঁট মাল, বোতলবন্দি হবার যোগ্য নয়! 

ও হ্যাঁ, একে যুদ্ধ বলে কেন, সেটাই বলিনি। এর একটা গল্প আছে, জানেন? শোনা যায়, দ্বাদশ শতকের কোন এক সময়ে আরো (Haro) আর তার প্রতিবেশী গ্রাম মিরান্দা দে এবরো (Miranda De Ebro)-র মধ্যে সীমানা নিয়ে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়। ফলে, দু’জায়গার লোকেরাই সীমানা পাহারা দিত, যাতে নিজেদের এলাকা বেদখল না হয়ে যায়। এই প্রথা নাকি চারশো বছর চলে। শেষে কী হয় জানেন? দু’পক্ষই একে অন্যের দিকে ওয়াইনের বোতল ছুঁড়তে থাকে। এই হল ব্যাটল অফ ওয়াইন! হাউ সুইট!

না না, এরা মোটেই সারাদিন দোল খেলে না আমাদের মত। ওয়াইন শেষ, খেলা শেষ। তারপর খানাপিনা, হুল্লোড়। বেগুনিরঙা তরুণ-তরুণী চলল তখন প্লাসা দে লা পাস (Plaza de la Paz), আরো (Haro)-র প্রাণকেন্দ্র। আর তারপর তো তাদের হুজুগে বুলফাইটিং আছেই! ভেজা মাটিতে মদের গন্ধ…নেশা লাগিল রে’… বেগুনি রঙের নেশা!


লেখক পরিচিতি : অনিকেত পাহাড়ি
রসিক বাউন্ডুলে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।