লেখক : মধুমিতা ঘোষ
গাড়িতে হর্ণ দেওয়া মাত্র মুন্যা নিচে নেমে এল। দেখলাম হ্যাণ্ডব্যাগ ছাড়াও আর একটা ছোট ব্যাগ নিয়েছে। সেটা আমিও নিয়েছি। বলা তো যায় না, আজ যদি ফিরতে না পারি! মুন্যা আমার বড়মামার মেয়ে। লেকটাউনে থাকে। আমি থাকি নাগেরবাজার ।
“বুকাই, রুবির সামনে শম্পু রেডি হয়ে ওয়েট করবে। ওকে তুলে নেব।”
আমি ঘাড় নাড়লাম। শম্পু আমার ছোটমামার মেয়ে।
রবিবারের সকাল। রাস্তা বেশ ফাঁকা।
শম্পুকে তুলে নিয়ে গাড়ি আবার গতি নিল। শম্পু ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “দেখো না, কাল রাতে সন্দীপের এক বন্ধুর ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি ছিল। লেট নাইটে ফিরেছি। ভেবেছিলাম বেলা করে উঠব। তা সক্কালবেলাতেই বড়দাভাইয়ের ফোন। বলল, শোন, আম্মাকে যদি শেষ সময়ে দেখতে চাস তো এখনই চলে আয়।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমাকেও বড়দাভাই খবরটা দিয়েছে। তারপর এক এক করে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।”
শম্পু ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “আম্মার এক্স্যাক্ট বয়স কত হবে গো?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “দিদার মনে হয় আটানব্বই হবে। কারণ গতবছর বিজয়ার দিনে আমি গিয়েছিলাম, তখন ছোটমামা বলল, আর আড়াইটা বছর কাটিয়ে দিলেই মায়ের শততম জন্মদিনটা বেশ ধূমধাম করে পালন করব। মেজমাসি তখন মজা করে বলল, দাঁড়া ছোটদা, ততদিন আমরা বেঁচে থাকি। তবে তো! ছোটমামা বলল, তাতে কী হয়েছে? নাতি-পুতিরা তো আছে, ওরা সেলিব্রেট করবে।”
মুন্যা বলল, “সত্যি ,ভাবা যায়! এখনও এই বয়সেও আম্মা কিন্তু হেঁটে বাথরুমে যায়।”
শম্পু হেসে বলল, “সন্দীপ তো বলে, তোমার আম্মা যেভাবে ব্যাটিং করে যাচ্ছে, হাণ্ড্রেড ইয়ার পার করেই ছাড়বে।”
শম্পু বলল, “আশ্চর্য কী জান, আমি তো লাস্ট দোল পূর্ণিমার দিনে গেছিলাম। বেশ অনেকদিন পর গেলাম। কিন্তু গলার আওয়াজেই কেমন চিনে গেল।”
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “সত্যি দিদার স্মৃতি এতটুকুও লোপ পায়নি। আমার বাসরঘরে নাতজামাইকে কী কবিতা শুনিয়েছিল, সেটা অবধি মনে আছে।”
সোনারপুর মোড়ের মাথায় এসে ড্রাইভারকে মামারবাড়ির রাস্তাটা দেখিয়ে দিলাম। বাড়ির সামনে গাড়ি আর বাইকের ভিড় দেখে বুঝলাম আত্মীয়-স্বজন সব আসতে শুরু করেছে।
আমরা প্রথমে দিদার ঘরে ঢুকলাম। ঘরের মধ্যে বেশিরভাগই চেনা মুখ। দিদাকে এভাবে কখনও শুয়ে থাকতে দেখিনি। আপনাআপনিই চোখে জল চলে এল।ছোটমামার সঙ্গে দেখা করার জন্য বাইরে এলাম। মেজমাসি বসেছিল। আমাদের দেখে ছলছল চোখে বলল, “মাকে দেখলি? কাল বলতে গেলে সবাই সারারাত জেগে। ছোটদারও তো বয়স কম হল না। তার ওপর প্রেসার আর সুগারের রোগী। ওই খোকন আর বাসুই যা করার করছে।”
খোকন আর বাসুকে আমরা সবাই বড়দাভাই আর ছোটদাভাই বলি। বড়মামার দুই ছেলে। এই বাড়িরই দোতলায় থাকে।
আমাদের দেখে ছোটমামা চাপা শ্বাস ফেলে বলল, “ভেবেছিলাম সোনারপুরে এখনও পর্যন্ত কেউ একশ পেরোয়নি। মা-ই হবে ফার্স্ট। কিন্তু সেটা আর বোধহয় হ’ল না। রাত থেকে কোন নড়াচড়া নেই। ডাক্তার তো বলেই গেলেন, পাল্স খুব ক্ষীণ। এখন শুধু অপেক্ষা।”
বড়দাভাই আমাদের দেখে ঘরে ঢুকে বলল, “শোন তোরা এসে গিয়েছিস যখন, তখন টিফিন আর রান্নার ব্যাপারটা দেখ। মাসি একা হাতে পারবে না। বাসু বাজার থেকে এই এল বলে।”
আমি বললাম, “এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? সবাই তো আমরা ঘরের লোক।”
ছোটমামা বলল, “আরে ঘরের লোক বলে ক্ষিদে পাবে না? সবাই কত দূর দূর থেকে এসেছে।”
অনেকদিন পর সবার সঙ্গে দেখা হ’লে যেটা স্বাভাবিক, সেটাই হচ্ছে। রোগীর ঘরে ভিড় কম। ছোটমামার ঘরে কেউ একজন পুরীতে বেড়াতে গিয়ে কত বাজে পাণ্ডার খপ্পরে পড়েছিল তার গল্প শোনাচ্ছে। আমার বৌদি আর পাশের বাড়ির মণিদি কোথায় ভাল ম্যাথসের টিউশন পাওয়া যাবে, সেই নিয়ে আলোচনা করছে।
বারান্দায় কেউ একজন কাজের লোকের কামাই নিয়ে কথা বলছে। দেখলাম দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে বসেই কয়েকজন রাজনীতি নিয়ে জোর তর্ক করছে। বসার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম, ছোটমেসো গম্ভীর মুখে আজকের খবরের কাগজটা পড়ছে। রান্নাঘরে যাবার সময় গেটের মুখে ফুল কেনার জন্য লেকমার্কেট যাওয়া হবে না রাজপুর বাজার থেকেই কেনা হবে, এ বিষয়ে মৃদু আলোচনা কানে এল।
শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এখনো তো মানুষটা বেঁচে আছে। এখনই এই আলোচনাটা না করলেই নয়!
ওদিকে ডাল সম্বরার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
দেখতে দেখতে বেলা দেড়টা বেজে গেল। ভাত খাওয়ানোর জন্য মাটিতে আসন করা হয়েছে, আর টেবিলে বয়স্ক কয়েকজনের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি, মুন্যা আর বাসু পরিবেশন করছি। নেহাত হলঘর বড় বলে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। সবে ভাতের মধ্যে ডাল দিয়েছি, হঠাৎ আয়ামাসির চিৎকার কানে এল। সব্বাই হুড়মুড়িয়ে দিদার ঘরে ছুটলাম। পায়ের ধাক্কায় কারও জলের গ্লাসের জল পড়ে গেল, কারও শালপাতা ভর্তি ভাত চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। বোধহয় ডালের গামলাটাও উল্টে গেল। ছোটমামা আর মেজমাসি টেবিলে বসেই ডুকরে উঠল। বড়দাভাই কাকে যেন চেঁচিয়ে বলল, “ডাক্তারকে ফোন কর এখনই।”
ঘরে পৌঁছে দেখলাম, দিদা চোখ খুলে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের সবাইকে দেখে ক্ষীণস্বরে আয়ামাসিকে বলছে, “এত লোকজনের গলা শুনছি, আর আমাকে ঘুম থেকে ডাকিস নি? টেবিল থেকে আমার চশমাটা দে। দেখি, কে কে এসেছে?”
লেখক পরিচিতি : মধুমিতা ঘোষ
পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। বই পড়তে,বাগান করতে, গান শুনতে খুব ভালবাসি। বেড়াতেও খুব ভালবাসি। জঙ্গল আমার প্রিয়।গল্প লিখি। অনেক গল্প বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।