শূন্য: কিছু নেই, অথচ সবকিছু

লেখক : তাহসিনুর রাইয়ান

ভাবুন তো, যদি আমাদের সংখ্যা-পদ্ধতিতে শূন্য না থাকত, তাহলে কেমন হত পৃথিবী? আজকের কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, এমনকি আধুনিক ব্যাঙ্কিংয়ের হিসাব-নিকাশও হয়ত দাঁড়িয়ে যেত অচলাবস্থায়। আমরা শূন্যকে এত স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করি, যে এর অনুপস্থিতি কল্পনাই করা যায় না। অথচ ইতিহাসের এক দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের কাছে শূন্য ছিল একেবারেই অচেনা, এমনকি সন্দেহজনক।

প্রাচীন সংখ্যার জগৎ

প্রাচীন মিশরীয়, ব্যাবিলনীয় কিংবা গ্রীকদের সংখ্যা-পদ্ধতিতে শূন্যের জায়গা ছিল না। তারা সংখ্যা বানাত কেবল গোনার জন্য—পশু, শস্য, সৈন্য। যখন গোনার মত কিছুই নেই, তখন “কিছু নেই” আলাদা করে বোঝানোর দরকার কী—এমনটাই ছিল তাদের যুক্তি। রোমান সংখ্যায় আজও শূন্য নেই। সেখানে I, V, X, L, C, D, M—সব আছে, কিন্তু 0 নেই। ভাবুন তো, রোমানরা কখনও 2025 লিখতে চাইলেও তাদের সংখ্যায় শূন্যের ব্যবহার করার সুযোগ নেই।

ভারতের আবিষ্কার

শূন্যকে সত্যিকার অর্থে সংখ্যা হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ভারতীয় গণিতবিদেরা। পঞ্চম শতকে আর্যভট্ট স্থান-মূল্য পদ্ধতিতে (place value system) শূন্যের ধারণা দেন। এর ফলে 10 আর 100-এর মধ্যে পার্থক্য বোঝানো সম্ভব হয়। আর সপ্তম শতকে ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর ব্রাহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত গ্রন্থে শূন্য নিয়ে নিয়ম লিখলেন—

“কোন সংখ্যার সঙ্গে শূন্য যোগ করলে সেই সংখ্যাই থাকবে।”
“কোন সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে ফল হবে শূন্য।”
“কিন্তু কোন সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করা যাবে না—কারণ ফলাফল তখন অসংজ্ঞায়িত হয়ে যায়।”

এই নিয়মগুলো এতটাই বিপ্লবী ছিল যে, আজকের আধুনিক গণিত ও কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভিত এদের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে।

আরবের হাত ধরে ইউরোপে

ভারতের শূন্য অঙ্কটি আরব গণিতবিদদের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। নবম শতকে আল-খোয়ারিজমি (যাঁর নাম থেকেই “algorithm” শব্দটি এসেছে) শূন্যকে ব্যবহার করে পাটিগণিতের নতুন নিয়ম তৈরি করেন। লাতিন ভাষায় “শূন্য” শব্দটির অনুবাদ হ’ল zephirum, সেখান থেকে ইংরেজি zero শব্দের জন্ম। কিন্তু ইউরোপে শুরুতে শূন্যকে সহজভাবে গ্রহণ করা হয়নি। মধ্যযুগে চার্চ মনে করত, শূন্য মানে শূন্যতা, যা ঈশ্বরের সৃষ্টির বিরোধী। এমনকি কিছু দেশে শূন্য ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞাও ছিল। তবু সময়ের সঙ্গে প্রমাণিত হ’ল, শূন্য ছাড়া উন্নত গাণিতিক হিসাব-নিকাশ সম্ভব নয়।

শূন্য ছাড়া প্রযুক্তি অচল

আমাদের আধুনিক কম্পিউটার দাঁড়িয়ে আছে দ্বিমিক সংখ্যা পদ্ধতি (binary system)-র ওপর। এখানে কেবল দুটি সংখ্যা: 0 এবং ১। বিদ্যুৎ থাকলে “১”, বিদ্যুৎ না থাকলে “0”—এই সহজ দুই অঙ্ক দিয়েই গড়ে উঠছে সফটওয়্যার, ইণ্টারনেট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। অতএব, শূন্য ছাড়া আজকের ডিজিটাল সভ্যতা কল্পনাই করা যায় না।

শূন্যের দার্শনিক দিক

শূন্য শুধু সংখ্যায় নয়, মানুষের চিন্তাধারায়ও বিপ্লব এনেছে। ভারতীয় দর্শনে “শূন্যতা” মানে এক গভীর সম্ভাবনা, এক শূন্য গর্ভ থেকে সবকিছুর জন্ম। গণিতেও শূন্য অসীমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। যেমন, ভগ্নাংশে কোন সংখ্যাকে যত ছোট সংখ্যায় ভাগ করি, ফলাফল তত বড় হয়। আর যখন ভাগফল শূন্যের দিকে যায়, তখন ফলাফল অসীমের দিকে ছুটে যায়।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে শূন্য

আজকের পদার্থবিজ্ঞানেও শূন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। কোয়াণ্টাম মেকানিক্সে “শূন্য অবস্থা” বা vacuum আসলে একেবারেই ফাঁকা নয়—বরং সেখানে অদৃশ্য কণা জন্ম নেয় আর মিলিয়ে যায়। মহাকাশের ফাঁকা শূন্যতায়ও শক্তি লুকিয়ে আছে, যাকে বলে vacuum energy। অর্থাৎ, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে “শূন্য” কখনই পুরোপুরি ফাঁকা নয়।

মজার ধাঁধা

একটা প্রশ্ন ভাবুন—যদি আপনার কাছে একটি কেক থাকে এবং সেটিকে ৪ ভাগ করেন, প্রতিটি ভাগ হয় ১/৪। যদি ৮ ভাগ করেন, প্রতিটি ভাগ হয় ১/৮। কিন্তু যদি কেকটিকে 0 ভাগ করেন, তখন কী হবে? উত্তর নেই। শূন্য ভাগে কোন কিছু ভাগ করা যায় না। এখানেই লুকিয়ে আছে শূন্যের রহস্য।

শূন্য কেবল একটি অঙ্ক নয়, এটি এক মানসিক বিপ্লব। এটি আমাদের শিখিয়েছে—“কিছু নেই” থেকেও “সবকিছু” সৃষ্টি করা যায়। শূন্যের আবিষ্কার ছাড়া আধুনিক গণিত, বিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তি – কোনটাই দাঁড়াত না আজকের অবস্থানে। মানুষের কল্পনার এই বিস্ময়কর ফসলই হয়তো আমাদের সভ্যতার সবচেয়ে নীরব অথচ শক্তিশালী আবিষ্কার।


লেখক পরিচিতি : তাহসিনুর রাইয়ান
সংক্ষিপ্ত পরিচয়: অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী, প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইয়ান'স রিডারস কর্নার।

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।