বালকবেলার পুজোর তিন কাহন

লেখক : রতন চক্রবর্তী

এক

ঠাকুর দেবতারা যেখানে থাকার থাকেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে তাদের থাকার মত বিশেষ কোন বন্দোবস্ত দেখিনি। দাদু-ঠাকুমার ভরা সংসার। দু’টো মাঝারি মাপের ঘর আর দু’টো ঘরের মাঝে বিভাজন সরিয়ে নিয়ে টানা একটা হলঘর। জনা ষোল বয়স্ক তরুণ বালক-বালিকার মাঝখানে ঠাকুর দেবতারা থাকবেনই বা কোথায়! ঘরের এককোণে একটা জলচৌকির উপর, বোধহয় ক্যালেণ্ডারের ছবিতে থাকতেন দশভূজা। ওই একটা বাঁধানো ছবিতেই অনেক দেবদেবীর বাস। তার উপর চালচিত্রে রয়েছেন আরও অনেকে। সবমিলিয়ে ভারী সুন্দর। একান্নবর্তী একটা পরিবারের প্রতিভাস, আমাদের সংসারের মতই। মনুষ্যেতর প্রাণীরাও সেখানে ফেলনা নয়। উদ্বাস্তু জীবনে তখন অন্নের ঘোর অনটন। কাজেই দশভূজার একান্নবর্তী পরিবার তার পোষ্যাদিসহ কয়েকটা নকুলদানা খেয়েই, ঠাকুমার পাতা আসনে দিন গুজরান করতেন! সংসার ও মন্দির (আসনের) কোথাও কোন বাহুল্যের বালাই নেই। পুজো বলতে সন্ধ্যায় বাড়ির জ্যেষ্ঠ থেকে কনিষ্ঠ সকলকে হাজির থাকতে হত ওই পাতা আসনের সামনে। ছাড় পেতেন কেবল তারা, যারা অন্যত্র অন্নসংস্থানের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। প্রথম প্রার্থনা গানে ‘লিড’ দিতেন “মাগো”, মানে আমাদের নাতি-নাতনিদের ঠাকুমা। এই দলে আমাদের রাঙা পিসির ছেলে এবং তিন বালিকাও ছিল। সে প্রায় সত্তর-বাহাত্তর বছর আগের কথা। আমি তো এখন আশি পেরিয়ে আরও দু’বছর এগিয়ে, তৃতীয় বছরে ঢোকার মাস চারেক আগে আছি। প্রার্থনার আজ মাত্র একটি ছাত্র মনে আছে সেটা হল “… জনার্দনো মধুসূদনো জয় হে।” ওইটুকু মনে থাকার কারণ সম্ভবত আমার ঊর্ধ্বতন সাত পুরুষের মধ্যে ওই দু’টি নাম আছে। এটা অবশ্য ওই বালকবেলায় মনে হয়নি। আমার ছেলেকে আমি তার ঊর্ধ্বতন আট পুরুষের নাম লিখে দিতে গিয়ে, হঠাৎ এটা মনে হয়! তবে কি আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন পুরুষদের নামে কোন বন্দনাগীতিতে কন্ঠ মেলাতাম? আবছা আবছা মনে পড়ে, মাগো তারপর আমার বাবার নাম ধরে বলতেন “শান্তি, এবার তুই তোর ঠাকুরের নাম গান ধর।” বাবা গাইতেন, “তোমারও অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি যাই …”।

যে বয়সে দশভূজার ছবির সামনে কোরাসে গলা মেলাতে হত সন্ধ্যায় যে দুটি গানে, তারা দু’জনেই ঠাকুর। মাগো একবার দুর্গাপুজোর গল্প বলেছিলেন, দুগ্গা ঠাকুর থাকেন তার বর শিবঠাকুরের আপন দেশ কৈলাসে। প্রতি বছর মহালয়ার আগের দিন তিনি আমাদের কাছে আসার জন্য রওনা দেন। অনেক দূরের পথ। ঘোড়া, গজ, নৌকো, দোলা – এক এক বছর এক একটায় চড়ে আসেন। আসেন দুই ছেলে গণেশ-কার্তিক আর দুই মেয়ে লক্ষ্মী-সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়ে। আমি ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, “শিব ঠাকুরও আসেন। ঐ তো চালচিত্রের ঠিক উপরে শিব ঠাকুরের কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া ছবি দেখছি।” মাগো বলেছিল, “উনি আসেন দুর্গাকে আড়াল করে আকাশপথে পুজোর ঘটা দেখতে।” আমরা ভাইবোনেরা বায়না ধরে ছিলাম আমরাও পুজোর ঘটা দেখব। ঠাকুরমা বলেছিলেন, “সে তো প্রতি পুজোয় তোর পিসিরা বাড়ি এলে, আমাদের বাড়িতে যেমনটা হয় তেমনি ব্যাপার। দুগ্গাও তো বাপের বাড়িতেই আসে। সবাই মিলে একত্রে ঘটা করলে সেটা বেশ বড় রকমের আনন্দ হয়। দুগ্গা পৌঁছে যান ষষ্ঠীতে। আর তারপরের তিন দিন ঢাকের বাদ্য, পুজোপাঠ, ভোগের প্রসাদ, যাত্রা, মেলা আরও কত কি! সেটা হত আমাদের দেশে। এখানে আমরা এই কলোনিতে নতুন এসেছি। এখানেও হবে নিশ্চয়ই।”

দাদু (ঠাকুরদা) একবার মোক্ষম খবর দিলেন। এবার আমাদের কলোনিতে দুর্গোৎসব হবে। ১০৫ ঘর মিলে এক টাকা করে চাঁদায় যতটুকু উৎসব করা যায়, তাই হবে। শুনতে পাচ্ছি, আমাদের এই বাঁশদ্রোণী গভর্নমেন্ট কলোনির পাশেই নিউ গভর্নমেন্ট কলোনি বসবে। বালিগঞ্জ ময়দান ক্যাম্প, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার সেনা ছাউনি থেকে উঠে আসবে প্রায় দু’শো পরিবার। ওরা আসার পর আরও বেশি ঘটা হবে দুই কলোনি মিলিয়ে। এরপর থেকে দাদুর সঙ্গে আমার খাতির বেড়ে গেল চতুর্গুণ। মাগোকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “বাবা যে ঠাকুরের গান করেন, তিনি কোন ঠাকুর? ছবিতে তিনি কি আছেন?” মাগো বলেছিলেন, “তিনি রবি ঠাকুর। যারা কিছু লেখাপড়া শেখে, তাদের মনে থাকেন তিনি। তুই একটু বড় হলে, তোর কমিউনিস্ট ডাক্তার বাবার কাছ থেকে, তার ঠাকুরের কথা শুনে নিস।” আমি যখন ক্লাস সিক্সে উঠলাম, বাবা সে’বছর চিরবিদায় নিলেন। অবশ্য ‘বীরপুরুষ’ নিয়ে রবি ঠাকুরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটিয়েছিল আমার বাবাই। সন্ধ্যার আসরের মাগো চলে গিয়েছিলেন তার বছর তিনেক আগে। মনে পড়ে, মণিকুন্তলা সেন (প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেত্রী) তাঁর জয়ন্তিদিকে (আমার মাগো) সভানেত্রী করে কয়েকবার বক্তৃতা দিয়েছিলেন পাড়ার কালীবাড়ি চত্বরে। কে যে কোথায় কখন যায়, সেটা খুঁজে দেখার বাসনা আমার মনে জাগিয়ে দিয়েছিলেন, খুব সহজভাবে আমার দাদু। রবি ঠাকুরের কথা বলতে বলতে, একটা লাইন তখনই আমার দুঃখী মনে দাদু গেঁথে দিয়েছিলেন, “…ফুরায় যাহা ফুরায় শুধু চক্ষে।” সবাই থকে, নানাভাবে বদলে বদলে, মনে হবে অচেনা। বলেছিলেন, “অচেনাকে চিনে চিনে জীবন যাবে ভরে।”

দাদু চলে যাবার বছর আমি এইটে পড়ি। সেই বছরেই তিনি আমাকে বলেন, “তোমার বাবা অচেনা মানুষদের চিনতে চিনতে কমিউনিস্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি গান্ধীবাদী। তুমি বড় হয়ে বুঝবে মানুষ চেনার কাজে এই দুই মতবাদের মধ্যে মিলটাই বেশি।” কথাগুলিতে উদ্ধৃতি চিহ্ন দিলাম এই কারণে, দাদু সম্ভবত এটাই আমাকে বলতে চেয়েছিলেন তাঁর জীবনের অংশ, জ্যেষ্ঠ সন্তানের প্রতি তাঁর আস্থা ও বিশ্বাস ব্যক্ত করতে গিয়ে। তিনি বোধহয় বাবাকে জানার অন্বেষণে আমাকে ব্রতী হতে বলেছিলেন। আমি বোধহয় বাবার একটি মনোভাবকে আমার জীবনে প্রতিফলিত করতে পেরেছি। বাবার মতাদর্শের পথে চলতে চলতে, আমি বাবার খ্যাতি-প্রতিপত্তি-পরিচিতির কিছুই ব্যবহার না করে, চলার পথে দৃঢ় থেকেছি। বাবাও তাঁর হেডমাস্টার বাবা উমেশচন্দ্র চক্রবর্তীর অতুল বিদ্যার খ্যাতি, কলকাতার সুখ্যাত কলেজে চাকরি ছেড়ে, মহামতি অশ্বিনীকুমার দত্তের আহ্বানে, বরিশালের রহমতপুর গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার হয়েছিলেন। কোনও ভূ-সম্পত্তি গ্রহণ না করে, স্কুলের তৈরি করা হেডমাস্টারের বসতির অ-মালিক থেকে। সপরিবারে সেখানেই ছিল তাঁর বসবাস। দেশবিভাগ পর্যন্ত সেখানেই সংসার করা এবং ছাত্রাবাসসহ স্কুলের সমস্ত দায়িত্ব সামলে অবশেষে কলকাতার এই ক্যাম্প, সেই ক্যাম্প হয়ে, বাঁশদ্রোণীতে আসা। তখনকার শাসকদলে ঠাকুরদার খ্যাতি কম ছিল না। তাঁর ছাত্ররা অনেকেই খ্যাতিমান ও সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু বাবা তা নিজের কাজে লাগাননি। এই শোণিতধারা প্রবাহিত রাখার জন্যই কি দশভূজার ছবির সামনে, সম্ভবত পূর্বজদের স্মরণ করে, মাগোর প্রার্থনা সংগীত? আমার কেন জানি মনে হয়, ওই গান ঠাকুরদার রচনা! নাও হতে পারে। কেউ তো কিছু লিখে রেখে যাননি! মাগো মারা যাবার পর এই আসরে প্রার্থনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অশৌচকালের পর আর কোরাস হয়েছে বলে মনে করতে পারি না। শুধু মনে পড়ে, প্রথম দুর্গাপুজো দেখার হালকা স্মৃতি। তাতে মন মাতেনি। নমো নমো করে পুজো হয়েছিল প্রথমবার গভর্নমেন্ট কলোনির। চারিদিকে তুমুল বৃষ্টি। নতুন প্যাণ্ট-জামার প্রশ্নই ছিল না তখন। প্রথম পুজোর কেবল সোঁদা জলকাদার গন্ধ মনে পড়ে সবচেয়ে বেশি। তারপর থেকে দুই কলোনির মিলিত পুজোর খবর পেয়ে ঠাকুরদার কাছে আমার বিচিত্র সব ‘বায়না’র কথা। ইনিয়ে বিনিয়ে, কায়দা করে সেসব মনে পড়ে গেলে, এখনও ভিজে চোখে, মুখে হাসি এসে যায়… বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া- প্রার্থনার স্বর শুনলেই। সেই গল্প একটু শোনাব।

দুই

আমার শৈশব তথা বালক বেলায় আদি গঙ্গার পাড়ে, বিধানচন্দ্র রায়ের জাপান সফরের অভিজ্ঞতার নিরিখে নাকি তৈরি হয়েছিল অ্যালুমিনিয়ামের দু’টি ঢেউ খেলানো ‘ওভাল’ আকৃতির ছাউনির নিচে চারটি ঘরের ১০৫ টি বাড়ি! প্রতি পূর্ণিমা রাতের জোছনায় সমুদ্রের ঢেউ দেখতাম তখন। শিয়াল ছিল প্রচুর, সাপও। রাতে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত উঠোনের দূরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পাশাপাশি অনেকগুলো বাড়ির চালে সমুদ্রের ঢেউ দেখতাম। মজা লাগত শরতে হালকা কুয়াশায় সেই মোহময় দৃশ্যে। নীল আকাশ আগমনী গাইত যেন পিসিদের দলের মতই। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে অনেকটা করে লম্বা পাশাপাশি জমিতে কাশফুলে দোলা লাগত। দাদু মাঝে মাঝে শোনাতেন বাবার ঠাকুর, রবি ঠাকুরের কবিতা –

“এসেছে শরৎ, হিমের পরশ
লেগেছে হওয়ার পরে …”

‘সহজপাঠ’ পড়া শেষ করে তখন ‘ইংরেজি পাঠ’-এর চারটি লেসনের বেশি দাদু পড়িয়ে দিয়েছেন। এবং দেখতে দেখতে ক্লাস এইট, ধরে ফেলতে চলেছি পুজোর পরের পরীক্ষায়। দাদু তখনও তারা হয়ে যাননি। মনে পড়ে, অ্যালুমিনিয়ামের শেডের, অ্যালুমিনিয়ামের পার্টিশন দেওয়া চার রুমের বাসিন্দা আমরা তখন, বাঁশদ্রোণীর গঙ্গার ওপাড়ের নেতাজি নগরের উদ্বাস্তুদের তৈরি স্কুলে পড়তে শুরু করেছি। তার আগের বছরই, শীত যায়-যায় সময়ে, ওদের, মানে বালিগঞ্জ ময়দান ক্যাম্পের তাঁবুর ছাউনিগুলো পড়তে শুরু করেছিল। লোকজনের ভিড়ে জমজমাট কালীবাড়ি। বাঁশবন থেকে শিয়ালের হাঁক কিন্তু চলছিলই। জোনাকির ঝাঁকের আলো আঁধারি দেখলে বুক ছমছম তখনও করত। ভালোও লাগত। সে বছরই, ময়দান ক্যাম্প থেকে আস্ত একটা ক্লাব সংঘশ্রী, লাইব্রেরী সমেত বসে পড়েছিল— সামনেই বন্ধ হয়ে যাওয়া ডেয়ারি ফার্মের গরুর সাবেক আস্তানার হল ঘরে। আমার বাবার মামাতো ভাই শঙ্কু আমার কাকা হলেও, সমবয়স্ক। ওরাও এসেছে। কাজেই সেই সূত্রে ক্লাবের একদল বালকের মধ্যে আমিও ঠাঁই করে নিয়েছি।

এই সবের আগে থেকেই দাদুর সঙ্গে পুজোর ব্যাপারটার ‘ঘটা’ ইত্যাদি বুঝেছি। আমি মনের গোপন ইচ্ছে দাদুর কাছে ফাঁস করে, তার সাহায্য চেয়েছিলাম। দাদুও গোপনে আমাকে জানিয়েছিল, তার অপূর্ণ ইচ্ছের কথা! আমি প্রথমে দাদুকে বলেছিলাম, “তুমি এখন ছেলেমানুষ হয়ে গেলে পুজোয় কি করতে!” এখন বুঝতে পারি, দাদু বিদ্বান এবং অসাধারণ বুদ্ধিমান মানুষ। আমার মতলবখানা ধরে ফেলেছিলেন। বেশ উৎসাহ দেখিয়ে বললেন, “তোমার মত বেলুন আর লজেন্স কিনতাম পুজোর ক’দিন।” তার আগে পিসি, কাকু, আমার ঠাকুরদা, আর সব বড়দের ফুটফর্মাস খেটে একটা করে পয়সা আদায় করে পুজোর জন্য জমাতাম। পুজোয় কি ছেলেমানুষদেরও কম খরচ! তার উপর এখনকার মতো ফুচকার তো স্পেশাল খরচ। দাদু-ঠাকুমাদের পাকা চুল বেছে দেওয়ার জন্য চুক্তি করে এক কুড়িতে এক পয়সা ‘টিপস’ও আদায় করে নিতাম। ‘টিপস’ শব্দটা রবি ঠাকুরের লেশনে পাইনি। বুঝে নিলাম ওটাই বুঝি মজুরি। আমি ফস করে দাদুকে বলেছিলাম, “তুমি আমার মত তামাক সেজে ধরিয়ে দিলেও পয়সা কিছু পাবে, ছেলেমানুষ হলে।” দাদু বুঝলেন, তার ট্যাঁকের দিকে আমার নজর। কিন্তু আমি কি এতই কচি খোকা! তখনও তো দুর্যোধন হয়ে উঠিনি। তাই ও ব্যাটার মত ‘নাল্পে সুখম অস্তি’ না জানলেও, আসল চাহিদা পেশ করলাম এর পরেই দাদুর কাছে। দাদু কি করে জানি, অনেক খবর পায়, টান টান হয়ে বসে বসে কয়েকজন মানী মানুষ-বুড়োর সঙ্গে ওজনদার কী সব আলোচনা করতে করতে। দাদু বলল, “আমি ছেলেমানুষ হলে, আমার দু’চারজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে, মণ্ডপে ঠাকুরের পিছনে রেখে দেওয়া ফলটল হাতাবার চেষ্টা করতাম। আর মধুর শিশি থেকে খানিকটা মধু হাতে ঢেলে চেটে খেয়ে নিতাম।” বুঝলাম গতবারে আমাদের এই কাণ্ড দাদুর কানে গিয়েছে। বললেন, “জিভে পিঁপড়ার কামড় খেয়ে অবশ্য শিখে নিতাম চুরি করা মহাপাপ। কী জানি ফের ছোট হলে কথাটা মনে থাকবে কিনা! এখন তো ভাবছি থাকবে।”

আমিও সেদিন মোক্ষম চাল দেব বলে ঠিক করেই পড়া মুখস্ত করে দাদুর কাছে পড়া দিয়ে তবে সঙ্গে আসর পাতিয়েছি। সঙ্গে ছিল শঙ্কু। সে তখন আমাদের বাড়িতেই বালক দলের সঙ্গে থাকত।ঘুমোত আমাদের বাড়িতে। তাবুতে খুব শীত! যুক্তি ফেঁদেছিলাম দুজনে মিলে। সেও আমার দেখাদেখি দাদুকে ‘দাদু’ বলত। তাই বলে হিংসে করতুম না। ওর বাবাকে মানে, আমার বাবার মামাকে, আমিও দাদু বলতাম। ব্যাস। শোধবোধ!
আমি দাদুকে বললাম, “তুমি দুগ্গা ঠাকুরকে বলেকয়ে আমারও জনা সাতেক বন্ধুকে পুজোর ক’দিন বড় করে দাও, বর চেয়ে।”
দাদু বলল, “গত বছর রেডিও শুনতে কোন এক বাড়িতে মহালয়ার দিন ভোর রাতে গিয়েছিলে তো! শোননি, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মশাই কেমন বর প্রার্থনা করেন, যশং দেহি, ধনং দেহি মন্ত্র বলে? তুমিও রোজ সকালে উঠেই ঠাকুরের কাছে তোমার বন্ধুদের জন্য মহালয়ার আগে থেকেই চার দিনের জন্য বড় হওয়ার বর প্রার্থনা করো। এর জন্য আমাকে দরকার কী?”
আমি দেখলাম, দাদু আমাদের কাঁধে বর প্রার্থনার দায়িত্ব চাপিয়ে নিজে আলগা হতে চাইছে। আরে দাদু! আমিও তোমার আশীর্বাদে কম চালাক নই!! আমি বললাম, “আরে ঠাকুররা তো শুধু সংস্কৃত বোঝে। আমরা তো সবে ‘নর’ আর ‘নদী’ শব্দরূপ মুখস্ত করছি। তুমি সংস্কৃতে বর চেয়ে নিজের যখন ইচ্ছে হচ্ছে, তো ছোট হয়ে যাও চারদিনের জন্য। আর আমাদের জন্য বর চেয়ে আমাদের চার দিনের জন্য বড় করে দাও। ব্যস, আমাদেরও ইচ্ছে পূরণ হবে। তোমারও।”
দাদু বলল, “ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে ওই একটাই মুশকিল। তারা কেবল সংস্কৃত শিখেছে। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি বোঝেনা। কাজেই তোমরা বড় হতে হতে সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি, ল্যাটিন সব ভাষা শিখতে থাকো। দেখবে কোনও ধর্মের কোনও ঠাকুর দেবতার কাছে বর চাইতে হবে না। শুধু “অক্ষর” সাধনা করো। অক্ষরগুলো ঠিকঠাক সাজিয়ে শব্দ বানাতে শেখো। আর শব্দগুলো দিয়ে সুন্দর সুন্দর প্রার্থনা বানাও। আমি তোমাদের একটা মন্ত্র শিখিয়ে দেব আজ। তার আগে একবার আমার চার দিনের জন্য ছোট হওয়া আর তোমাদের চার দিনের জন্য বড় হবার বিপদ বোঝো! চার দিন পর ছোট থেকে বড় হবার মন্ত্র তুমি যদি ভুলে যাও আর জ্যাঠা ছেলে হয়ে থাক, তবে তো তোমাদের সঙ্গে আর মজার কথার প্যাঁচ, কাটাকুটি খেলতে পারব না। তার চেয়ে …”
শঙ্কু শুধু চুপচাপ কথা শুনে যাচ্ছিল। এবার ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি এখনই বড় হতে চাই না’। দাদা ব্লেড দিয়ে দাড়ি কাটা শিখতে গিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটিয়েছিল। আমিও বিপদ টের পেয়ে, বদলাবদলিতে এই ছেলে মানুষ থাকার সুযোগটা হঠাৎ হাতছাড়া করার সাহস পেলাম না। কান্না পেয়ে যাচ্ছিল ভয়ে। দাদুকে দু’জনেই বললাম, “আমরা এখনই বড় হতে চাই না। তুমি আমাদের জন্য বর ভিক্ষা করো না দুগ্গার কাছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ‘চাই চাই’ মন্ত্র বলুক গে। আমাদের দরকার নেই।” দাদু বললেন, “শোননি তোমার সুন্দর কাকু নাটক লিখেছে? সৌমেন ঠাকুর নাটক করা শেখাবেন। শঙ্কুদের ক্যাম্পের বড়রাও নাটক করবে। সব হবে কালীবাড়িতে। তার আগে মহালয়ার ভোরে দুই কলোনির লোকজন চেনাশোনা করতে গান করবে, কেরিকেচার করবে। তারপর মাইকের সামনে রেডিও রেখে, সবাই মিলে একত্রে মহালয়া শুনবে। হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে ভোররাত থাকতেই নানা কিছু ঘটা হবে।”

তিন

বছর বারো-তেরো বয়সের দেখা মহালয়ার আগে বিচিত্রানুষ্ঠানের কথা শোনাতে বসেছি এখন। আদি গঙ্গার পাড়ে আমাদের বাঁশদ্রোণী গ্রামে আমাদের ১০৫ ঘর মিলিয়ে যে পুজো দেখেছিলাম জীবনে প্রথমবার, সেবার ঝড়জলের সাথে আমাদের চোখের জলও অনেকটাই মিশেছিল। পুজো হয়েছিল, আমরা শিশু বয়সে এসে যেখানে গঙ্গার পাড়ে একটা মোটা তাল গাছের পাশেই শ্মশানটা দেখেছিলাম, তার সামনে বেশ বড় একটা জায়গায়। শ্মশানে মড়া পোড়াতে দেখিনি। আমাদের বাবা কাকারা মড়া পোড়াতে আসা কয়েকজনকে বাধ্য করেছিল “লাশ ঘুইর‍্যা যাও” শুনতে। এই কথাটা ‘চলো সাগরে’ নাটকের বইতে বিজন ভট্টাচার্যের তিনটি নাটকের একটির নাম। তখনও তা লেখাই হয়নি। এটা আমার এখনকার ধার নেওয়া। পরে বিজনদাও একবার আমাদের সংঘশ্রীর একাঙ্ক নাটকের প্রতিযোগিতায় সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন, কুমার রায়ের সঙ্গে। আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল নিবিড়। শম্ভু মিত্র নেহাত দিল্লিতে ছিলেন, না হলে তিনিও স্বাক্ষর দিতেন মনে হয়। সংঘশ্রীর ছিল বিরাট প্রভাব। আর আমি তো এদের প্রায় নেওটা ছিলাম! যাক, সেসব ভিন্ন প্রসঙ্গের কথা।

বন্ধ হয়ে যাওয়া পুবের শ্মশানের পশ্চিমপ্রান্তে ছিল বট-অশ্বত্থ জড়াজড়ি করে ওঠা এক বিশাল পঞ্চবটি (জন-কথা) বৃক্ষ। গোল করে বাঁধানো প্রশস্ত মূল। সেখানে বসত মাতব্বরদের শলাপরামর্শের আসর। দাদু সভাপতি। আর ছিল, বটগাছের বিচিত্র ঝুড়িতে আপনাআপনি তৈরি, একটা দোলনার মতই নিরাপদ, বালকবেলার প্রধানতম আকর্ষণ। আমরা এক এক সপ্তাহ, এক একজন ক্যাপ্টেন হয়ে, দোল খাবার বিলিব্যবস্থা করতাম। নিউ গভর্নমেন্ট কলোনির ওরা প্রথমে গায়ের জোরে দখল নিতে চেয়েছিল, পুরোটা এঁটে উঠতে পারেনি। আমি শঙ্কুর কল্যাণে সংঘশ্রী হয়ে যাওয়ায় মিটমাট হয়েছিল গভর্নমেন্ট এবং নিউ গভর্নমেন্ট সংঘাতের।

আমরা সাত-আটজন মিলে ঠিক করেছিলাম, মহালয়ার দিন সুযোগ বুঝে মিস্ত্রীপাড়ার রফিককাকুদের (তারাই আদি বাসীন্দাদের একটা বড় অংশ ছিল) তিনটে বাতাবি লেবু গাছ থেকে কম করে গোটা পনের জাম্বুরা (বাতাবি) ছিঁড়ে নিয়ে লুকিয়ে রাখব, আমাদের ডিচের পুকুরপাড়ের একটা ঝোপে। তারপর বিকেলে খাব। আমাদের চোখে তখন সব জাম্বুরাই মধু।

রাত তিনটে নাগাদ সাবেক শ্মশানের মাঠের পাশের রাস্তায় বসবে জলসার আসর। বড়রা বসবে গোল বাঁধানো চত্বরে। কারও বাড়ি থেকে একটা পেল্লায় রেডিও এনে তার সামনে মাইক (এটা যে শব্দ জোরে করার যন্ত্র জানতাম না) ফিট করতে ব্যস্ত থাকবে রফিককাকুরা। ওদের পাড়ার সবাই আসবে বটতলার চত্বরে মহালয়া ‘জলসায়’(শব্দটা বোধহয় সেই প্রথম শুনেছিলাম)। রফিককাকুর ছোট ভাই আলাউদ্দিন আমাদের দলে ভিড়ে সংঘশ্রী হয়েছিল। আমরা তো পুরনো বন্ধুই। সে আমাদের অভিযানের নেতা। তাদের গাছের জাম্বুরা হাতাব আমরা! ও পাকাগুলো চিনে গোপনে দাগিয়ে রাখবে। পুজোর প্রথম ‘পাকা প্ল্যান’। এবং সবাইকে এড়িয়ে ‘সাকসেস’। আলাউদ্দিনের বড়দি আয়েশাপিসি সেদিন আমার সোনাপিসির সঙ্গে রাতে আমাদের বাড়িতে থেকেও কিছু টের পায়নি। আলাউদ্দিন মাঠের কাজ সেরে সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়ির লপসি খিচুরি, বেগুন ভাজা-পোড়া খেয়ে আমরা শঙ্কুর সঙ্গেই দাদুর চৌকির পাশে ঠাঁই করে ঘুমের ভান করেছিলাম, হলঘরে যাইনি। পাছে দাদা, পরিতোষদারা আমাদের মতলব টের পেয়ে যায়, আমাদের তিনমূর্তির ফিসফাস কথা ধরে! তবেই তো ভাগ বসাবে, বলে দেবার ভয় দেখিয়ে! ছোট হলেও আমরা কি কম ‘ব্ল্যাকমেইল’ জানি নাকি! কিন্তু সেটা হব কেন? তাই দাদুই নিরাপদ আশ্রয়। রাত আড়াইটায় ‘মাইক টেস্টিং’ (শব্দটা আলাউদ্দিন শিখিয়েছিল) শুনলেই উঠে পড়তে হবে। পরে জেনেছিলাম দাদাদের দল হাঁস চুরির প্ল্যান করে মাত্র একটা পেয়েছিল! হাঃ হাঃ হাঃ! মাঝরাত পার হ’লে যাওয়ার ঢালাও পারমিশন তো ছিলই। অতএব কোন বিপত্তি হয়নি ‘অপারেশন জাম্বুরা’-র। খুব মজাও পেয়েছিলাম, প্রথম চুরিবিদ্যার এই সাফল্যে। পরে চুপচাপ ফের বটগাছ তলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঢুকে পড়ে অনুষ্ঠান শুনে তো হাঁ। কী মজা! কী মজা!

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শুরু হবে ভোর চারটায়। তার আগে দু’চারটে গান কবিতা হয়ে গিয়েছে বোধহয়। আমরা যখন ঢুকলাম, তখন মীরাদি (যদিও আমরা প্রাইমারিতে এক ক্লাসে ছিলাম) দারুণ গাইছে। ঘোষণা হল, “গভর্নমেন্ট কলোনির আগমনী গান শ্যাষ হইল। এবার নিউ গভর্নমেন্ট কলোনির অধীর ইন্দু মজার গপ্পো কইয়া ক্যারিকেচার করবে”।

সংঘশ্রীর অধীরদা শুরু করলেন, “বইহালের(বরিশালের) এক গণ্ড গেরামের এক মিঞাভাই খুব ভাল পীরের গান গাইতো। হ্যারে হায়ার কইর‍্যা আনা হইছিল মোগো গেরামে। পীরবাবার অনেক গান হুনানের (শোনানোর) পর ব্যাবাকে (সবাই) তারে চাইপ্যা ধরল, “তুমি বইহাল শহরে গিয়া কেমন দুগ্‌গা পূজা দেইখ্যা আইছো হেইডা শোনাও। মোরা যাইতে পারি নাই গেরামের জমিদারের পূজা ফ্যালাইয়া। কও দেহি (দেখি) কেমন ঘডা (ঘটা) হইছে হেয়ানে (সেখানে)। হেইয়া শোনার লেইগ্গা (জন্য অর্থে) তোমের হায়ার দিছি মোরা। চারাইজ্জা জমিদার পুরসকার দেবে নে তোমাগো। লও লও! আরম্ভ করো। সহরে হুনছি বারোয়ারি পূজা করে বেবাকে মিল্লা (মিলে)”।
গায়ক মিঞাভাই কইল, “হেইহানে তিনখান বারোয়ারিতে হায়ার ছিল মোর তিনদিন। গান হইছে মেলা (অনেক)। বড় বড় মেলা বইছিল। কত জিনিসপত্তর, অত নাম কইতে পারমু না। ডাইল বাডা (বাটা) দিয়া কত কি ভাজা বেচতে আইছে মাইসে (মানুষে), আমি বরং তোমাগো দুগ্গা ঠাউর (ঠাকুর) দেহার (দেখার) গান শুনাই।”
টানা সুরে অধীরদা নানা ভঙ্গি করে, একটু নাচ মিশিয়ে সেই গান যা শুনিয়েছিলেন, তার অল্প কিছু মনে আছে। যা ভুলেছি, তার সঙ্গে দু’চারটি মিলের শব্দ জুড়ে লিখছি…

আহা কী দুগ্গি দ্যাখলাম চাচা
আহা কী দুগ্গি দ্যাখলাম চাচা
বাগ মাইসের যুধধ মোগো
দশহাত লইয়া খারাইয়্যা কী কর-ও-ও
বাগে মাইষেরে ফ্যালায় খাইয়্যা
ছারাইয়্যা তো দিলে পার-ও-ও
আহা কী দুগ্গি দ্যাখলাম চাচা –
আহা কী দুগ্গি –
সোন্দর পানা হইলদা মাইয়্যা
প্যচা লইয়া হাস্ছে চাইয়্যা
আর এক মাইয়্যা স্বেতি ধলা

হাসের উপার রইছে বইয়্যা
দশ হাত লইয়্যা তুমি মাগো
খারাইয়্যা কী করওও
অখন-ই তো ঘরে যাইয়্যা ওষুধ কর-ও-ও
আহা কী দুগ্গি দ্যাখলাম চাচা –
আহা কী দুগ্গি –
দুইডা পাশে দুইডা পোলা
হাতির মুণ্ডু ইন্দুর পাশে একটা পোলা
সোন্দর পোলাডা ধনুক লইয়্য
মুইউর পাছাইয়্যা রইছে বইয়্যা
আহা কী দুগ্গি দ্যাখলাম চাচা
আহা কী দুগ্গি –
দশ হাত লইয়া তুমি মাগো খারাইয়্যা কি করো-ও-ও
রাগ পায়ে ঘরে যাইয়া
শ্বেতি মাইয়্যার ওষুধ করো ও-ও
যাওয়ার আগে ভোগের শ্যাষে
তুমি মোগো কাডাম শুদ্দা
সবাই মিইল্লা ব্যাবাকেরে
দয়া করো-ও-ও-ও
আহা কী দুগ্গি দ্যাখলাম –
পোন্নাম বাবু মশাইরা
বাদ – দশরার পেন্নাম।


লেখক পরিচিতি : রতন চক্রবর্তী
অর্ধশতক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। দৈনিক, সাপ্তাহিক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চাকরির পাশাপাশি কাজ করেছেন বিদেশি দূতাবাসের কলকাতা তথ্য দপ্তরে। তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন। লিখেছেন ছোট গল্প, নাটক চিত্রনাট্যও। মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী। জন রিডের টেন ডেজ দ্যাট স্যুক দ্য ওয়ার্ল্ড নামে রুশবিপ্লবের দশ দিনের কাহিনি নিয়ে বিশ্বখ্যাত রিপোর্টাজ গ্রন্থ অবলম্বন করে লিখেছেন নাটক অভ্যুত্থান যা ৭৪ জন কুশীলব নিয়ে অভিনীত হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।