লেখক : মানব মন্ডল
আমার আর নীলাঞ্জনার শেষ দেখাটা এতটাই অপ্রত্যাশিত হয় যে, শেষবারের মত ‘বিদায়’ বলারও সুযোগ পাওয়া যায় নি। নারী ততক্ষণই আপনার, যতক্ষণ সে রাগ করে, অভিমান করে, অধিকার খাটায়, বিরক্ত করে, ভালবাসে, খেয়াল রাখে। কিন্তু যখনই আপনি একবার তার আত্মসম্মানে আঘাত করবেন, অবহেলা করবেন, ব্যস্ততা দেখাবেন দিনের পর দিন, তখন যদি একবার সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, আপনার সবকিছুই থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, বিশ্বাস করুন, তখন হাজারবার চাইলেও আগের সেই মানুষটাকে আর ফিরে পাবেন না।
ওকে কেউ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, আমার বাইরে কারও সাথে সম্পর্ক আছে। নারী যেমন ভালবাসতে পারে, তেমন ঘেন্নাও করতেও পারে। যদিও সে তার শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যায় ভালবাসার সম্পর্কটা আগলে রাখার, কিন্তু আমি শত অপমান সহ্য করেও চেষ্টা করেছিলাম বাঁচিয়ে রাখতে সম্পর্কটা। কিন্তু পারিনি। শেষ দেখাটা শুধু একটি শারীরিক দূরত্ব তৈরি করে না, এটি দু’টি আত্মার মধ্যে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে। সেইদিন রাতে শেষবার ও আমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিল। তাই হয়ত ওকে ছাড়া আমার ঘরের শূন্যতাটা বড় বেশি কাঁদায় আমাকে।
আসলে সম্পর্কটা আমি শেষ করতে চাই নি। কারণ আমি আশা করেছিলাম, ও একদিন না একদিন জানতে পারবে আমি ওকে ছাড়া কাউকে ভালবাসিনি। ডিভোর্স পেপারে আমি সাইন করলাম না, কিন্তু ওর নতুন বয়ফ্রেণ্ড কী কারসাজি করে ঠিক ডিভোর্সটা নিয়ে নিল। আমি আমার দুঃখ-কথা স্মৃতিগুলো সোশাল মিডিয়ায় ভাগ করে নিতাম। সেখানে ওর বন্ধুরা নানা কটুক্তি করতে থাকল। বিভিন্ন চরিত্রগুলো আমাদের সম্পর্কটা আরও বিষাক্ত করে দিতে চাইল। ওরা আমার সম্পর্ক ভাঙার নতুন কারণ আবিষ্কার করল। আমাকে পুরুষত্বহীন বলেই প্রমাণ করতে চাইছিল নীলাঞ্জনার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। দাম্পত্যসুখ দিতে পারিনি বলে চলে গেছে – এমন দাবি করছিল। একটা সম্পর্ক ভাঙলে অনেক মানুষের সাথে সম্পর্ক ভেঙে যায়। আত্মীয়তা শত্রুতায় পরিণত হয়।
আমি বাড়ি ছেড়ে বিদেশে পাললাম, কারণ আমাকে তখন বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করল বাড়ি থেকে। ওরা চাইছিল, কোন একটা মেয়েকে বিয়ে করে একটা সন্তানের জন্ম দিয়ে আমি যেন প্রমাণ করি আমি একটা পুরুষ। তাই আমি শীঘ্রই বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পুরুষত্বের প্রমাণ দিতে আমি একটি মেয়েকে ভালবাসাহীন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করতে চাইছিলাম না।
পুরুষত্ব কি? এ যুগের পুরুষ জানে কি? একজন সুযোগ্য নেতা এবং স্বৈরাচারীর মাঝে পার্থক্যটা ঠিক কোথায়? নিয়ন্ত্রণ করবার চাহিদা কোন মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, অথবা সহানুভূতিশীল হতে গিয়ে কখনও নিজের আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দেওয়া হয়ে যায়। নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষোভ আর সময়ের প্রয়োজনে দুঃসাহস আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিয়ে নেয়। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কী করা উচিত, তা নিয়ে বিভ্রান্তির শেষ নেই আমাদের। পুরুষ শব্দটি সংস্কৃত ‘পুরুষ’ থেকে এসেছে। ব্যাকরণে এটি ক্রিয়ার কর্তা ও কর্মের বিশেষ রূপকে বোঝায়। বাস্তবে পুরুষ কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করা একটি নাম মাত্র।
জীবনের প্রতিটি সম্পর্কের একদিন হয়ত শেষ দেখা হয়ে যায়। কেউ চলে যায় দূরে, কেউ হারিয়ে যায় সময়ের স্রোতে। কিন্তু সেই শেষ দেখার মুহূর্তটা, যেখানে চোখে জল, মনে অস্থিরতা আর ঠোঁটে জমে থাকা হাজারটা কথা, সবচেয়ে গভীর ও স্মরণীয় হয়ে থাকে। শেষ দেখা মানেই হয়ত তাই শেষ না, কিন্তু সেই সময়টা হয়ে ওঠে এক চিরন্তন অনুভূতির প্রতীক। স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে বারবার।
যাই হোক, ডাইরি লেখা শেষ হতে না হতে একটা পোড়া গন্ধ নাকে এল। উঠোনে উনুনের কাছে ছুটে গিয়ে দেখি বেগুনের তরকারি পুড়ে কয়লা। ভাত পুড়ে গিয়েছে। একসাথে রান্না বসানোটা উচিত হয়নি আমার। তাড়াতাড়ি হাঁড়ি নামাতে গিয়ে হাতে ছেঁকা খেলাম। পিছন থেকে হঠাৎ শিউলি এসে ওগুলো নামিয়ে দিল। তারপর পুরনো স্বভাবমত মুখে শোনাল, যার সারাংশ হ’ল আমার আবার বিয়ে করে নেওয়া উচিৎ। আমার মত ক্যাবলাকান্তর দ্বারা একা একা ঘরকন্নার কাজ করা সম্ভব নয়।
আমি ওর খোঁজ নিলাম। আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল বছর দশকে আগে বোধহয়, পিসতুতো ভাই সোমনাথের বিয়েতে। তখন ওর সবে বিয়ে হয়ছে। ওকে বরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ওর মুখের রঙটা বদলে গেল। ও কথা ঘুরিয়ে বলল, “বুবাইদা, সোমনাথের বৌ বলল তুই নাকি বৌ-দুঃখে দেবদাস হয়েছিস। নীলাঞ্জনা দিদি সত্যিই কি অনেক সুন্দর দেখতে ছিল?”
আমি বললাম, “তুই ওর থেকে অনেক সুন্দর দেখতে। কিন্তু ভালবাসা তো শুধু সৌন্দর্য দেখে হয় না।”
ও কেমন একটা উদাসভাবে বলল, “তা কি করলে পুরুষের মন পাওয়া যায়? তুই আমাকে বিয়ে করলি না কেন জানি না। দেখ আমার পেটটা – এক বাচ্চার মা কেউ বলবে? দক্ষিণের নায়িকাদের মত ফিগার মেনটেন করি। তবুও বরের মন পাই না।”
ওর নাভির পাতাল গভীরতা, ফরসা পেট যে আমার পুরনো দুর্বলতা, ও সেটা ভাল করেই জানত। কিন্তু ওদিকে আমার নজর গেল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “তোকে কষ্ট দিয়েছি বলেই তোর অভিশাপে হয়ত আজ এত কষ্ট পাচ্ছি।”
ও ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। “তুই এমনভাবে বলিস না। আমি তোকে ভালবাসতাম, আমি কোনদিন তোকে অভিশাপ দিই নি। তোকে আজও আমি ভালবাসি।”
আমি ওকে ছাড়াতে চাইলাম না, বরং আমার হাত দু’টো আমার অজান্তেই ওকে জড়িয়ে ধরল।
ও বলল, “আজও আমি ওই রাতের কথা ভুলি নি। তুই রাতে যাত্রা দেখতে যাওয়ার নাম করে যখন আমাদের বাড়ি এসেছিলি, তখন বুঝতে পেরেছিলাম তুই কতটা শয়তান। আমার মন ছটফট করছিল। আমি জানতাম, আমার মরণ হবে তোরই হাতে। রাতে তুই যাত্রা দেখতে গেলি না। আমি সবকিছু দিলাম তোকে। তুই তারপর থেকে নিয়মিত আসতিস আমাকে পড়ানোর নাম করে, প্রেম করতিস আমার সাথে। আমি স্বপ্ন দেখতাম, তুই আমাকে তোর মত করে তৈরি করছিস ভেবে। কিন্তু আমাদের গল্পটা জানাজানি হতেই তুই আসা বন্ধ করে দিলি। আমার বিয়েটাও হুট করে দিয়ে দিল। সেনাবাহিনীতে কাজ করা বাবা, ওনার কাছে আত্মসম্মানটাই বেশি ছিল তো, তাই। নয়ত আমি তোর জন্য অপেক্ষা করতাম। কারণ তুই তো শেষবার যখন দেখা হয়ছিল, বলিসনি এটাই আমাদের শেষ দেখা। তাই আমি সত্যিই তোকে কোনদিন অভিশাপ দিইনি।”
আমার বুক ওর চোখের জলে ভিজে গেল। আমি বললাম, “আমিও তো তোর ভালবাসাটা বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম, তোর শারীরিক চাহিদা পূরণ করছিস শুধু, তোর আত্মসমর্পণের মূল্য দিই নি। সবার কথা শুনে ভুল ভেবেছিলাম। আসলে মদন বলেছিল, তোর সাথে ওর সম্পর্কে হয়েছে কয়েকবার, হালকা পাতলা। তাই তোর মনটা আমি বুঝতে পারিনি কোনদিন। তোর বয়ঃসন্ধিক্ষণের মেয়ে হয়ে ওঠার সময়টুকু সুযোগ হিসাবে কাছে লাগিয়ে শরীরের চাহিদা মিটিয়েছি, তোর মনের খবর নেবার সুযোগ হয়নি।”
ও বলল, “সেটাই। মদন, শ্যামল, ঘেঁটু – সবাই বলছে ওরা আমার নাগর, তুই মেনেও নিয়েছিস। সত্যিই তো, সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মাল কি বিয়ে করা যায়? থাক সে পুরনো কথা। ছোটবেলায় খেলনাবাটি খেলার সময় কতবার তো আমার বর হয়েছিস তুই। আজ একটা দিনের জন্য আমাকে তোর বৌ হতে দিবি? তোর এদিকে তো কেউ আসে না। বদনাম হবার ভয় নেই। বাপের বাড়ির লোকজন জানে, আমি শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছি। আসলে যাওয়ার পথে তো তোর সাথে শেষবারের মত দেখা করে যেতে চাইলাম। আজ তোকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াব, তোর এঁটো বাসন মেজে দেব, তোর বিছানা করে দেব, তোর কাপড় ধুয়ে দেব, রাতে সোহাগ করব। একদিনের বৌ হতে দিবি তোর? এটাই তো হয়ত আমাদের শেষ দেখা।”
আমার বাড়িটা একটা পুরনো নীলকুঠি। অনেক জমি, একটা পুকুর, চারিদিক নানা ফলগাছে ঘেরা একটা খামার, কাছারি, আর একটি সুন্দর প্রাসাদের মত বাড়ি। জীবনের সব সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কিনেছি, যদিও জলের দর পেয়েছি। ভূতুড়ে জায়গা বলে কেউ বিশেষ আসে না এদিকে। যদিও সবাই কাছারি বাড়িতে আর মূল বাড়িতে ভূত দেখেছে। তাই আমি আলাদা করে দু’টো ঘর বানিয়ে আমার রাধামাধবকে নিয়ে থাকি পুকুরে পাড়ে।মাঝে মাঝে শুটিং পার্টি, পিকনিক পার্টিকে ভাড়া দিই। তবে সবাইকে বলা থাকে, বিকালের মধ্যে জায়গা খালি করে দিতে। তেনাদের কোনদিন আমি বিরক্ত করিনি। তেনারাও আমাকে করেনি। পাঁচ-ছয়মাস ভালই কাটিয়ে দিলাম আমার এই নতুন ঠিকানায়।
আদরমাখা ভোরে ওকে বললাম, “যখন তোর বর অন্য মেয়ের সাথে দিন কাটাচ্ছে, তখন তুই তোর বরকে ডিভোর্স দিয়ে ছেড়ে চলে আয় আমার কাছে।”
ও বলল, “আমার একটা মেয়ে আছে, ভুলে যেও না।”
আমি ওকে আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরে বললাম, “ভাল তো, আর বাচ্চাকাচ্চা লাগবে না আমার। বাচ্চা হতে গেলে তোর কত কষ্ট, তোর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবারও ভয় আছে। তোর মেয়েকে আমার নিজের মেয়ে ভাবতে আপত্তি কোথায় আমার?”
ও বুকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার বর একটা দশ লাখ টাকার চেক, একটা ফ্লাটের দলিল, আর ডিভোর্স পেপার আমার শোবার ঘরে রেখে গিয়েছে গত ছয়মাস আগে। তাই সাতদিন সময় দাও, আমি ফিরে আসব।”
ওটা আমার শেষ দেখা নয় ভেবে মন খুশি হয়ে গেল। দিন কাটছিল না, সাতদিন যেন সাত বছরের মত। সাতদিনের মাথায় আমি ছুটে গেলাম ওদের বাড়িতে। দরাজাতেই আমাকে ঢুকতে বাধা দিল একটা পুঁচকি মেয়ে । পাক্কা বুড়ি সে, অচেনা মানুষকে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। শিউলির মা আমাকে চিনতে পারল না। ওর বাবা মারা যাবার পর বোধহয় শরীরটা ভেঙে পড়েছে। ওনাকে দেখে মন খারাপ হ’ল। কিন্তু মন ভেঙে গেল, যখন শুনলাম শিউলি ছয়মাস আগে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ওর যে রূপের জন্য এ গ্রাম পাগল ছিল, আগুনে পুড়ে নাকি বীভৎস হয়ে গিয়েছিল।
বাড়ি ফিরে এসে দেখি ও উঠানে বসে। ও বলল, “আমার মেয়েকে দেখলি? মায়ের দিন ফুরিয়ে এসেছে, আর এক মাসের মধ্যেই মারা যাবে। তুই আমার মেয়েটাকে দেখবি রে?”
আমি ওকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম, “হ্যাঁ, দেখব। কিন্তু আমরা দেখব। কথা দে, আমাদের জীবনে শেষ দেখা বলে কোন শব্দ থাকবে না…”
লেখক পরিচিতি : মানব মন্ডল
উল্লেখ যোগ্য বই "পুতুল তৈরির গল্প কথা"

