নরাসুরমর্দিনী

লেখক : বিপ্লব নসিপুরী

সামনে সোজা রাস্তা পেয়ে জোর গতিতে চার বক্রাকার পায়ে এগিয়ে চলেছে এসইউভি। পুজোর আগে সব মিটমাট। আর হবে নাই বা কেন, যার হাতে কড়ি তাকে কে পরাবে দড়ি? সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পর আজ বেরিয়েছিল ওরা। ওরা বলতে মোহিত আর দীপু। চেনা গণ্ডি ছেড়ে দূরের পাবে আনন্দের মাত্রাটাকে আরও একটু চড়িয়েছিল লাল তরলে। লোহিত তরল পাকস্থলীর গরাদ ভেঙে নালিপথে নেমে আরও সূক্ষ্ম চোরাপথ ধরে মিশছিল এক লাল নদীধারার সাথে। গাড়ির তীক্ষ্ণ আলোয় কুয়াশা ছিন্ন পথে তাকিয়ে নেশা জড়ানো চোখ। সহসা আটকে গেল চাকা। একটা কালোরেখাপাত তৈরি করলে চাকার বক্ররেখা। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী আকাশ। কালো কালির বুক জুড়ে ফুটে রয়েছে ঊজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক – যেন পত্রহীন গোলাপপুষ্প। আর পথের পরে যেন পূর্ণশশীর আবির্ভাব।
এক ঝলক আপাদমস্তক দেখে মোহিত হয়ে মোহিত বললে, “কে তুমি সুন্দরী?”
উদীয়মান সূর্যরাঙা গাত্রবর্ণ, পরনে হালকা রঙের শাড়ি, রাঙা সিঁথি – যেন স্বর্গের অপ্সরার আগমন ঘটেছে ধরাধামে। যে সৌন্দর্য্য সাধুদেরও তপোভঙ্গ করে, আর এরা তো নিতান্তই দুই রক্তমাংসের যুবক। মাথা ঘুরে গেল ওদের। শুধুই মাথা, সর্বাঙ্গে যেন একটা শিহরণ খেলে গেল।
গাড়ি থেকে নেমে এল মোহিত। এই লাবণ্যময়ী রাত্রির অন্ধকারকে যেন আরও মায়াবী করে তুলছে। এই পথটা বড় নির্জন। একাকী একজন অপরূপা, তবুও তাদের দেখে ভয় পাচ্ছে না, এটা ভেবেই খানিক আশ্চর্য হ’ল সে। তবে কি…
মনের ঘরে ফুটে উঠল বিশেষ গলিরাস্তার দু’ধারে কড়া মেকআপ, আকর্ষণীয় পোশাকের আড়ালে উঁকি মারা যৌবনা মহিলাদের ছবি। না, এতখানি ঘরোয়া সাজে সজ্জিতা কোন বারাঙ্গনাকে দেখেনি মোহিত।
অপরূপা আড়ষ্টকণ্ঠে বললে, “আমি ষোড়শী। সামনেই আমার বাড়ি। একটু যদি লিফট দেন, তো খুব উপকার হয়? ট্রেনটা লেট করল। হাতে টাকা নেই যে গাড়ি করব।”
দীপু ভাবে, “হ্যাঁ ষোড়শীই বটে। কী অপরূপ শোভা। যেন ষোলবর্ষীয়া স্নিগ্ধ দেবীমূর্তি।”
মোহিত গদগদ কণ্ঠে বলে, “এ তো আমাদের পরম সৌভাগ্য। উঠে আসুন।”
স্টিয়ারিং হাতে দীপু। খানিকটা চোখের খেলায় মোহিতের সাথে বোঝাপড়া হয়ে গেল আগামীর পরিকল্পনা।

কালো রাস্তায় মায়াবী আলো পথে এগিয়ে চলেছে ওরা। মোহিত মনে মনে ভাবে, “আকাশের চাঁদ আর সূর্য একসঙ্গে ধরা দিয়েছে তার কাছে।”
ঊষা নাকি জোছনা, কোনটা নাম দেবে, তাতে সংশয়ী মন। তবে চাঁদ হোক বা সূর্য, এই জ্যোতিতে ভস্মীভূত করার মতো তেজ নেই। শীতে কুসুম গরম জলের স্নানের মতই স্নিগ্ধতা আনবে, এইটুকু স্থির বিশ্বাস তার আছে। এইসব ভাবনার জাল বুনতে বুনতে এগিয়ে চলেছে মোহিত। তবে জালে মাছ ধরা দেবে, নাকি নিজেই মাছি হয়ে আটকা পড়বে, তা হয়ত কেবল সময়ই বলতে পারে।
খানিকটা পথ যেতেই ষোড়শী বললে, “এই ছোট রাস্তা দিয়ে খানিকটা গেলেই আমার বাড়ি।”
তার কথামত যেখানে গাড়িটা থামল, সে জায়গাটা একটা ফাঁকা ময়দান। অদূরে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সে বাড়ি মনুষ্যবর্জিত। বরং মনুষ্যত্যজিতই বলা চলে।
মনে মনে খুব খুশি হ’ল ওরা।নেশা ধরানো চোখ আরও একটা নেশার সুযোগ পেয়ে চকচক করে উঠল। এমন জায়গাই তো এতক্ষণ খুঁজছিল। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। কিন্তু এই জল যে মেঘের পুরো সম্মতিতে, তা তারা তখনও বুঝতে পারেনি।
ষোড়শী বললে, “আমি এখানেই নামব।”
সহসা মোহিত তার হাতখানি ধরে বললে, “এবার যে আমাদের একটু লিফট দিতে হবে সুন্দরী।”
ভয়ে আতঙ্কে আঁতকে ওঠার কথা যার, সে কিনা শুরু করলে অট্টহাসি। নিস্তব্ধ চরাচর ফেটে পড়ল আরও অনেক অট্টহাসির ফোয়ারায়। ওরা দুজনে বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলে ওদের চারপাশে বিভিন্ন বেশে, বিভিন্ন রূপে নারীর দল। কারও মুখশ্রী খুব সুন্দর, আবার কারও মুখে অতিরিক্ত কালোর আস্তরণ। তাদের মধ্যে একমাত্র মিল হ’ল এই অলৌকিক হাসি। সত্যিই বড় অলৌকিক এই দৃশ্য। দীপুরা এবার আতঙ্কিত হয়ে উঠল। সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলে উঠল, “তোমরা কারা?”
নারীর দল থেকে একজন পীতবর্ণা ও পীতবসনা বলল, “অসুর দমনে আমি তো বারবার ফিরে আসি, বিভিন্ন বেশে, বিভিন্ন রূপে। আমি হ’লাম বগলামুখী।”
তারপর একে একে ওরা নিজের পরিচয় দিতে থাকে। কালী, তারা, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, মাতঙ্গী, কমলা, সবশেষে ষোড়শী বলে, “এবার বুঝতে পারছিস তো আমরা কারা?”
সাক্ষাৎ দশমহাবিদ্যার দর্শন পেয়ে দীপুরা অবাক। এতদিন যাদের শুধু কাল্পনিক ভেবে এসেছে, আজ তারাই সশরীরে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্কে ওদের কণ্ঠ শুকিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ আগের খুশিতে চকচক করা চোখে নেমে আসে অশ্রুধারা। তারা জোড়হাত করে বলে, “আমাদের ক্ষমা করে দিন। আমরা আর এমন কাজ কোনদিন করব না।”
সহসা বিধবা নিরাভরণা বেশের বৃদ্ধা মহিলা বললেন, “ক্ষমা তো সেও চেয়েছিল, ভিক্ষা চেয়েছিল সম্মানের। তোরা কি তা দিয়েছিলি? দিসনি, বরং মৃতের গলায় দিয়েছিলি কলঙ্কের পুষ্পমাল্য।”

আজ থেকে বছরখানেক আগের ঘটনা। রূপার ঘটনা। রূপা একটা বেসরকারি সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করত। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে তার প্রায়শই রাত ন’টা বেজে যেত। এইরকম একদিন নিজের স্কুটিতে বাড়ি ফিরছিল। রাস্তায় হঠাৎ স্কুটি বিগড়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও স্কুটি স্টার্ট নিচ্ছিল না। তখনই একটা গাড়ির আলো দেখে সাহায্যের জন্য করুণ আর্তি জানায়। কিন্তু সেই তীব্র আলোর হাত যে তাকে চির অন্ধকারে নিয়ে যাবে, তা ভাবেনি রূপা। কামাতুর মোহিত আর দীপু সেদিন রূপাকে জোরপূর্বক নিয়ে গিয়েছিল এক নির্জন পরিত্যক্ত বাড়িতে। তার পরিত্রাহি চিৎকারে হৃদয়গলন তো দূর অস্ত, অত্যাচারের মাত্রা শিখরে উঠেছিল। তীব্র ব্যথায় অসাড় হওয়া দেহ শুধু স্মরণ রেখেছিল বীভৎস ছায়ামূর্তিযুগল। তারপর যমে-মানুষে টানাটানি করে সেই ঘটনার দুইদিন পর চিরমুক্তি পেল ব্যথাতুর দেহ। রাস্তার বাতি নিভল, মোমবাতি জ্বলল। কল্লোলিনী কিছুদিন ফিরে পেল তার আগের আঁধার। বন্দি হ’ল মোহিত আর দীপু হেমাঙ্গিনীর হাতে। হেমাঙ্গিনী চৌধুরী, কড়া মেজাজের ইন্সপেক্টর হিসাবে খুব নামডাক। কিন্তু ঝানু উকিল আর টাকার ভারের কাছে ভূপতিত হ’ল ন্যায়ের পতাকা। অন্যায়ের ধ্বজা পতপত করে উড়তে লাগল বিষাক্ত বাতাসে। আজ বুঝি সেই ন্যায়ের পতাকা লগির সাথ পেয়েছে – শক্ত লগি।
আতঙ্কিত চোখে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাবার চেষ্টা করে দীপুরা। কোথায় পালাবে? দশদিক আগলে অস্ত্রহাতে দশমহাবিদ্যা। সাক্ষাৎ মৃত্যুদর্শন। মৃত্যুদূত যেন নৃত্য শুরু করেছে। তাণ্ডব নৃত্য।
চন্দ্রহাসে শোভিত কালিকামূর্তি বলে, “আমি রক্তবীজের বংশ নাশ করেছি। তোরা তো সামান্য নরাসুর।”
চন্দ্রহাসের কোপে সহজেই নতিস্বীকার করে ভীত কণ্ঠ। সামান্য প্রত্যাঘাত আনার চেষ্টা করেছিল দীপুরা। কিন্তু দশমহাবিদ্যার ক্রোধার্ণবে তা খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। লোহিত স্রোতধারা মাটির বুকে আলপনা আঁকতে শুরু করল। উল্লসিত দেবীর দল, উচ্ছ্বসিত বাতাসে কাশের দোল, শিউলি নতমস্তকে জানাচ্ছে শ্রদ্ধাঞ্জলি।এক অপার্থিব মুহূর্তের সাক্ষী রইলে এই চরাচর। এক অন্ধকারে রচিত হ’ল এক আলোক উৎসের আখ্যান।

পুবদিগন্ত রাঙা করে উঁকি দিচ্ছে নবারুণ। সাদা মেঘ শুষে নিচ্ছে রক্তিম প্রভা। কনস্টেবল রজত ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে বলল, “ম্যাডাম, কিছুই আস্ত রাখেনি।সবকিছু তচনচ করে দিয়েছে। যেমনটা রূপার ওই ঘটনার পর সব ঘেঁটে ঘ করে দিয়েছিল, তেমনই। মনে হচ্ছে কেউ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে। একেবারে ট্রেইণ্ড অপরাধী। অপরাধীর কোন চিহ্ন নেই। এত পায়ের ছাপের ভিড়ে অপরাধীর পায়ের ছাপ খোঁজা উলুবনে মুক্তো খোঁজার সামিল। তবে মনে হচ্ছে, এই কাণ্ডের সাথে এক-দু’জন নয়, যুক্ত আছে বহুজন।”
এগিয়ে গেলেন দীর্ঘাঙ্গী হেমাঙ্গিনী। ফর্সা মুখমণ্ডলে চিন্তার ভাঁজ। মৃত, রক্তাক্ত দীপু আর মোহিতকে দেখে ভিতরে ভিতরে যেন খুশিই হ’লেন। কিন্তু বাইরে তার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই। একটু আগেই ফোন পেয়েছিলেন ওপরওয়ালার। যত দ্রুত সম্ভব অপরাধী খুঁজে বের করার আদেশ জারি হয়েছে, তোড়জোড়ও খুব। ঢিমেতালে চলা প্রশাসন আজ যেন বড্ড বেশি সক্রিয়। ফরেন্সিক টিম উপস্থিত ঘটনাস্থলে, আঁতিপাঁতি করে খুঁজছে। খুঁজছে হেমাঙ্গিনীও। সবার নজর এড়িয়ে একটু ঝুঁকে কী একটা তুলে পকেটে রাখলেন।

বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন হেমাঙ্গিনী। হাতে একটা গ্রুপ ফটো। তিনি সেই ফটোতে দেবী দশভুজা সাজে সজ্জিতা। পকেট থেকে বের করে হাতের তালুতে রাখলেন দুলটা, অপরহাতে একটা টেপা ফোন। এই নম্বরের সাথে পরিচিত বিশেষ কয়েকজন। ডায়াল করলেন একটা নম্বর। ওপ্রান্তের পরিচিত “হ্যালো” শব্দে বললেন, “আরও বেশি সাবধানী হতে হবে তোমাদের। কানের দুলটা তো ওইখানেই পড়ে ছিল।”
একটা শান্তস্বর ইথারকে আশ্রয় করে প্রবেশ করল তাঁর কানে “এই যাঃ! বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। তবে জানতাম, মাথার উপর আপনি আছেন। আমরা জানি, এডিটিং করার সময় ডিরেক্টর সব ঠিক করে দেবেন।”
ছোট থেকেই নাটকের খুব শখ হেমাঙ্গিনীর। কলেজে পড়তে চুটিয়ে নাটক করেছেন, দলও গড়েছিলেন। তারপর রুজিরুটির টানে ওই দলটাকে আর টানতে পারেননি। তবে বছর দু’য়েক আগে তিনি ও কয়েকজন পুরনো বন্ধু মিলে আবার নাটকের দল গড়েছেন। সেই দলে কয়েকজন নতুন মেয়েও আছে। নিয়মিত না হ’লেও মাঝে মাঝে তাদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করেন। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, কখনও কখনও সামাজিকও বটে। এতক্ষণ যার সঙ্গে কথা বলছেন, সে একজন নাটকেরই কুশীলব।

কথা বলে মোবাইলটা বিছানায় রাখল তনুশ্রী। একটা বছর দশের মেয়ে টিভিতে “মহিষাসুরমর্দিনী” দেখছিল। তার কাছে এসে বলল, “মা, মা, তুমি তো সারাক্ষণ বলো পৃথিবীটা অসুরে ছেয়ে গেছে। তবে দুগগা মা কেন আসছে না তাদের বধ করতে?”
মেয়ের মাথার ঝাঁকড়া চুলে হালকা বিনুনি কেটে তনুশ্রী বলল, “কে বললে দুগগা মা আসেনি? এসেছে তো!”
তারপর উর্দিপরা হেমাঙ্গিনীর ফটোটা দেখিয়ে সে বললে, “এনারাই তো এযুগের দুর্গা।”
বাতাসে একটা পোড়া গন্ধ পেয়ে “দেখলি, তোর সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে দুধটা বোধহয় পুড়ে গেল” বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল তনুশ্রী। না, রাতের ষোড়শী।


লেখক পরিচিতি : বিপ্লব নসিপুরী
গ্রাম পোস্ট শীতলগ্রাম,জেলা বীরভূম,পিন ৭৩১২৩৭,পেশা শিক্ষক শখ বই পড়া ও ক্রিকেট

One comment

  1. শফিকুল ইসলাম

    জনাব,কয়েক দিন আগে আমার লেখা একটি কবিতা প্রকাশ করার জন্য এই প্লাটফর্মে পাঠিয়েছি । এটা কবে প্রকাশ হতে পারে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

মাসিক দীপায়ন প্রতিযোগিতা

মাসিক দীপায়ন পুরস্কার pop up