লেখক : মীনা রায়চৌধুরী
আজকের দিনে বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতির যুগে, বিজ্ঞানলব্ধ আরাম, আয়েশ ও নিরাপত্তার পরিকাঠামোতে থাকার পরেও মানসিক শান্তির জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। রোগ, শোক, মৃত্যু, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদির কারণেও মানুষের মানসিক ভারসাম্য এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তা সামাল দেওয়াও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষে একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ রয়েছেন। এমনও মানুষ আছেন, যারা কোনও ধর্মমতেই বিশ্বাস করেন না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই কি কোন ধর্মীয় অনুশাসন, রীতিনীতি, বিশেষ কোন দেবতা বা ভগবানের রূপের আরাধনা মানসিক শান্তি এনে দিতে পারে? যদি পারে, তাহলে কীভাবে?
মানুষ পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন বুদ্ধিমান প্রাণী। অন্যান্য প্রাণীদের যেহেতু ক্ষমতা অনেক কম, তারা প্রকৃতি নির্ধারিত কিছু নিয়মকানুন নিজেরাই মেনে চলে। যেমন, সূর্যাস্তের পরে খায় না, পেট ভরা থাকলে আরও ভাল খাবার পেলেও খায় না, অথবা হিংস্র প্রাণীরা অন্যদের আক্রমণ করে না। প্রকৃতি মনুষ্যেতর প্রাণীদের এমনভাবে তৈরি করেছে যে, তারা জন্ম, মৃত্যু এবং বংশবিস্তারের মাধ্যমেই নিজেদের জীবন অতিবাহিত করে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে, মানুষ যা কিছু উন্নতি করেছে, তার বেশিরভাগই প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে। মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে নিজেকে তার জীবদ্দশায় উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে পারে, আবার নিজেকে একেবারে ধ্বংসের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। মনুষ্যজীবন হচ্ছে এমন একটি জীবন, যে জীবনে সে নিজেকে ভগবানত্বে বা অতিপ্রাকৃত ঐশ্বরিক শক্তিতে নিজেকে উপনীত করতে পারে, আবার নিজেকে শয়তানেও পরিণত করতে পারে।
ধর্ম অর্থাৎ যা ধারণ করে
এমন কিছু রীতিনীতি, এমন কিছুর অনুশীলন, এমন কিছু বিশ্বাস ও ভক্তির চর্চা মানুষকে মানুষ হিসেবে ধরে রাখতে ও তার সাথে সাথে জন্ম, মৃত্যুর থেকে মুক্তির আনন্দে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।
ধর্মের সাথে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক
আচ্ছা, যদি আমরা এরকম মনে করি যে, আমাদের শরীর আর নেই, অথবা আমাদের মৃত্যু হয়েছে? আমাদের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক – এই পাঁচটা ইন্দ্রিয় অনুপস্থিত? আমরা কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছি না, কোন গন্ধও পাচ্ছি না, কিছু খেতে পারছি না, কাউকে কিছু বলতে পারছি না, ঠাণ্ডা, গরম ইত্যাদি কিছুই অনুভব করতে পারছি না, মন একলা একলা আর কী বিষয় নিয়ে চিন্তা করবে? সে তো ধীরে ধীরে শান্তই হয়ে যাবে, তাই না? তাহলে কী করতে হবে? মানসিক শান্তি পাওয়ার জন্য কি নিজেকে মেরে ফেলব?
যে কোন ধর্মই এই অনুশীলনটা অবশ্যই করায় যে, জীবিত অবস্থাতেই শত শোকতাপ-বিপর্যয়ের মধ্যেও মানুষ কী করে নিজের মনকে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার থেকে রক্ষা করতে পারে।
মানুষের অতীন্দ্রিয় শক্তি
প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য সমস্ত প্রাণীজগতের মধ্যেই কমবেশী একটা সিক্সথ সেন্স বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে। বন্যা, সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির পূর্বাভাস অনেক সময়ই মনুষ্যেতর প্রাণীরা আগাম বুঝতে পারে। এটা দেখা গিয়েছে যে, যারা অন্ধ, তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অন্যদের থেকে তুলনামূলকভাবে প্রখর। মহিলারাও শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল বলে তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় পুরুষদের থেকে প্রখর।
যারা সন্ন্যাস নিয়েছেন, তাঁদেরকে অবশ্যই ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়। ব্রহ্মচর্য এমন একটি বিষয়, যাকে সারা পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়। স্বামী বিবেকানন্দের একটি উক্তি আছে যে, তিনি তাঁর শিষ্যদের বলছেন যে, তারা যদি একটানা বার বছর ব্রহ্মচর্য পালন করে, তবে সারা পৃথিবী তাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। তারা অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই চোখের সামনে দেখতে পাবে। এর থেকে বোঝা যায় যে, ইন্দ্রিয় সংযম এমন একটা মাধ্যম, যার দ্বারা মানুষ তার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ভাগবত তত্ত্ব এবং জড়জগতের প্রতি অনাসক্তি
এটা তো বোঝাই যায় যে, আমরা কোন একটা অদৃশ্য শক্তির অন্তর্গত। সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি, চলাচল, ধ্বংস কোনও এক অদৃশ্য শক্তির আওতায় সংঘটিত হয়ে চলেছে। আমাদের জন্ম, জীবন অতিবাহিত করা, মৃত্যু – সবই যেন কোন এক বিশাল কর্মযজ্ঞেরই প্রকাশ। আমরা কেন কোন কিছু চিরস্থায়ী করে পাই না? কেন আমাদের বারে বারে দুঃখ পেতে হয়? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে এবং যাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত প্রখর, তাদের অনুভূতির থেকে ঈশ্বর তত্ত্ব বা ভাগবত তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে নানা সময়ে, নানা ভাবে, পৃথিবীর নানা সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে।
কয়েকটি ধর্মমত নিয়ে আলোচনা
অনুমান করা হয় যে, প্রায় ৪৩০০ থেকে ১০,০০০ বা তার বেশি স্বতন্ত্র ধর্ম রয়েছে। এই ধর্মগুলোর মধ্যে চারটি প্রধান ধর্ম হল খ্রীষ্ট ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম। বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষই এই ধর্মগুলোর আওতায় পড়ে।
খ্রীষ্ট ধর্ম – এই ধর্মে একেশ্বরবাদ বিশ্বাস করা হয়। যীশুখ্রীষ্টকে মনে করা হয় ঈশ্বরের দূত বা পুত্র, যিনি পাপীদের উদ্ধার করার জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। খ্রীষ্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের নাম ‘বাইবেল’।
ইসলাম ধর্ম – ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক নবী মুহাম্মদ। এটি একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘আল কোরআন’। মানবজীবনের কল্যাণ ও মৃত্যুর পরে জন্নতবাসী হওয়ার সুযোগ মানুষ পাবে ‘ইসলাম ধর্ম’ অনুসরণ করলে।
হিন্দু ধর্ম – হিন্দু ধর্ম কোন ব্যক্তিবিশেষ প্রতিষ্ঠা করেননি। এটি একটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন ধর্ম। প্রাচীনকালের মুনি ঋষিরা তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা ধ্যানলব্ধ যে ঐশ্বরিক অনুভূতি, জীবনধারণের রীতিনীতি, কৌশল ইত্যাদির ব্যাখ্যা করেছিলেন, যা মানুষকে একটি উন্নত জীবনের দিকে নিয়ে যাবে, এবং অবশ্যই জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তির সন্ধান দেবে। হিন্দু ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলি হল বেদ, উপনিষদ, অষ্টাদশ পুরাণ, শ্রীমদ্ভগবদগীতা, রামায়ণ ও মহাভারত।
বৌদ্ধ ধর্ম – বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গৌতম বুদ্ধ। বৌদ্ধমতে আকাঙ্ক্ষা বা ভোগবাসনা থেকেই সমস্ত দুঃখের উৎপত্তি। জীবন সম্পর্কে বোধের অভাব বা অবিদ্যা মানুষকে বিভ্রান্তির পথে চালিত করে। বুদ্ধ নির্দেশিত আধ্যাত্মিকতার পথ অনুসরণ করলে, মানুষের নির্বাণ লাভ হয়, অর্থাৎ মানুষ দুঃখদুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে পারে।
৩৩ লক্ষ বছর পূর্বের প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে আজকের সভ্যতা মানুষের ক্রমোন্নতি এবং নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর সাথে সাথে উন্নত, নিরাপদ ও আরামদায়ক জীবন কাটানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে। বর্তমান সভ্যতা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার অনেকখানিই প্রদান করে। নানান ধর্মমতগুলি পর্যালোচনা করলে একটা বিষয় বোঝা যায় যে, ভালভাবে বাঁচার জন্যও সুসংহত, সুশৃঙ্খল জীবন কাটানোর প্রয়োজন রয়েছে। আর আমরা যদি দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে চাই, তাহলে আমাদের মনকে যে কোন ধর্মীয় পথে চালিত করতে হবে। তাহলেই জাগতিক উন্নতির সাথে সাথে আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব। উন্নত আধ্যাত্মিকতার মানুষ মানসিকভাবে শান্তিতেই থাকে, জড়জগতের দুঃখকষ্ট তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
লেখক পরিচিতি : মীনা রায়চৌধুরী
Mina Roychowdhury

