লেখক : নাহার তৃণা
(প্রথম পর্ব)
১.
রাত এখন গভীর। শহরতলির এই অংশটা মূল শহরের তুলনায় অজ পাড়াগাঁ বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। রোহান সেরকমটাই ভাবে। সন্ধ্যা ঘন হতেই যথারীতি অধিকাংশ বাড়ির আলো নিভে গিয়েছে। গুটিকয়েক সড়কবাতি টিমটিমিয়ে জ্বলছে। ওগুলো বিরামহীন জ্বলবে ভোরের আলো না ফোটা পর্যন্ত। নিস্তব্ধ রাতে চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রোহান আলোছায়ার নাচন দেখে। একেকটা গাছের ছায়া, রাস্তার ফাঁকা মোড়, পথের ওপর নিশ্চল চেয়ে থাকা সড়কবাতি, যেন ঘুমন্ত শহরকে পাহারা দেবার তাগিদে ঠায় দাঁড়িয়ে।
রোহান নিজেকে আবারও সেই পুরনো প্রশ্নটা করে, সে কি অন্যায্য কিছু করছে? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হাইপ্রোফাইল ক্লায়েণ্টের এনক্রিপ্টেড ফাইল ক্র্যাকের পর থেকে তার ভেতর পুরনো অস্বস্তিটা নতুন করে শুরু হয়েছে। যতবার সে এই কাজ করে, ততবারই প্রশ্নটা যেন তাকে বিব্রত করতে উঠেপড়ে লাগে। অন্যের প্রাইভেসি ভেঙে খুব ন্যায্য কিছু সে করছে না এটা যেমন সত্যি, একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে দেশ-দশের অনিষ্ট হয় সেরকম কাজও সে করে না। আগে সে সরকারি দপ্তরে প্রকৌশলী হিসেবে নিযুক্ত ছিল। যেখানে কাজের পরিবেশ ছিল অতি বিষাক্ত। কাজের চেয়ে একে অন্যের পেছনে লেগে থাকাতেই যেন অতিরিক্ত আগ্রহ ছিল সবার। সেখানে ব্যতিক্রমী হতে চাওয়া মানে জেনেবুঝে বিপদকে কাছে টানা। ওর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। নিজের কাজটুকুই সে করতে চেয়েছিল একান্তভাবে। দলাদলির মাঝখানে পড়ে গিয়ে বাধ্য হয়ে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিন বন্ধু মিলে একটা কনসালটিং ফার্ম খুলেছে। কনসালটিংয়ের আড়ালে মাঝেমধ্যেই তাকে ক্লায়েণ্টের জন্য এমন কিছু কাজ করতে হয়, যা নৈতিকতার পাল্লায় পাস মার্ক পায় না। আর ওরকম কিছুর পরই তার ভিতর শুরু হয় সেই একই উত্তরহীন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্লান্তিকর খেলা।
গাড়ির রেডিওটা মৃদুস্বরে বেজে যাচ্ছিল। এই মুহূর্তে শেষ রাতের বুলেটিন হচ্ছে। হঠাৎই রোহান কান খাড়া করে, “দু’সপ্তাহ আগের এক সন্ধ্যায় কর্মস্থল থেকে নিখোঁজ হওয়া এমআইএস টেকনোলজিসের সিনিয়র গবেষক কমল জ্যোতি চাকমার সন্ধান এখনও পাওয়া সম্ভব হয়নি। পুলিশ এবং গোয়েন্দাসংস্থার খোঁজ অব্যাহত রয়েছে…”
কমল জ্যোতির নিখোঁজ হওয়ার খবর জানা সত্ত্বেও রোহান কেমন চমকে উঠল। ওই নামটার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত টানাপোড়নের সূক্ষ্ম একটা যোগ রয়েছে। একবার একটা ইউএসবি ফাইল ক্র্যাক করার বিষয়ে ভদ্রলোককে সে সাহায্য করেছিল। কমল জ্যোতিকে তার ভীষণ অমায়িক এবং স্বল্পভাষী মানুষ বলেই মনে হয়েছিল। অবশ্য একবারের সাক্ষাতে একটা মানুষকে আর কতটুকুই বোঝা সম্ভব। রোহানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পার্টনার বনির মাধ্যমে তিনি তার কাছে এসেছিলেন। কাজ শেষে জানিয়েছিলেন, “আপনার বন্ধুটি আপনার সম্পর্কে একটুও বাড়িয়ে বলেননি। এরকম একটা ফাইল ক্র্যাক করা মামুলি কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।” তিনি তার প্রশংসা করেছিলেন বলে নয়, সংযত আচরণ এবং ওর কাজ সম্পর্কে সামান্য জানাশোনা থাকায় কমল জ্যোতিকে রোহানের পছন্দ হয়েছিল। মানুষটার নিখোঁজ হওয়ার খবর শোনার পর থেকে রোহান তার আপডেট জানতে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে। তবে ওর ধারণা, কমল জ্যোতি আর জীবিত নেই। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। যদি অপহরণের ঘটনা হত, তবে এরই মাঝে মুক্তিপণ বা সেরকম কিছুর দাবি নিয়ে কেউ না কেউ সামনে আসত। অন্তত দাবির কথা জানা যেত। সেরকম কিছুই যেহেতু এখনও প্রকাশ্যে আসেনি, তখন ধরে নেওয়া যায় যে ভদ্রলোক আর বেঁচে নেই। কিন্তু কী কারণে তাঁকে মরতে হ’ল? তিনি এমন কিছুর সাক্ষী ছিলেন, যা একটা পক্ষের জন্য বিপজ্জনক ছিল? কিংবা ব্যক্তিগত কোন আক্রোশের ফলাফল? অবিবাহিত মানুষটার আপনজন বলতে তেমন কেউ নেই। পত্রপত্রিকার খবরে সেরকমই উঠে এসেছে। তবে তাঁর নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই গভীর একটা রহস্য জড়িত। কি হতে পারে কারণটা?
আনমনা হয়ে পড়েছিল রোহান। সেই মুহূর্তে, হঠাৎ তার গাড়ির সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ায় এক তরুণী। ভাগ্যিস আগেভাগে খেয়াল করেছিল ব্যাপারটা। অজান্তেই ব্রেকে পা পড়ে যায়। রাতের নিস্তব্ধতা ছিঁড়েখুঁড়ে বিকট শব্দে ব্রেক কষে রোহান। গাড়িটা মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে। ফাঁকা রাস্তা বলে কোন ঝামেলা হলো না। বিরক্তি এবং কৌতূহল নিয়ে জানালার কাচ নামিয়ে তাকাল রোহান। সামনে দাঁড়ানো তরুণীর চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক, কিন্তু কণ্ঠে সাবলীল জোর, “আমার সাহায্য প্রয়োজন!”
কোন প্রশ্নে না গিয়ে রোহান দরজা খুলে দেয়। মেয়েটির সাহায্য চাইবার অ্যাপ্রোচে নতুনত্ব আছে বলতেই হবে। অবলার মত ‘আমাকে সাহায্য করুন’ – এর বদলে সপাটে বলেছে তার সাহায্য প্রয়োজন। যাকে বলা হচ্ছে, যেন সে বাধ্য তাকে সাহায্য করতে। ইণ্টারেস্টিং! গাড়ির দরজা খুলতেই সে জড়তাহীন ভাবে উঠে বসে। লম্বা একটা নিশ্বাস বাতাসে ভাসিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে, “যত জলদি সম্ভব আমাকে এখানে থেকে সরিয়ে নিয়ে চলুন। কুইক!”
মেয়েটির আচরণ উদ্ধত নয় মোটেও, একরকমের জোর আছে, এবং সেটা যার কাছে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে তার প্রতি। সে কি তার চেনা? রোহান খানিকটা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। মুখ ফসকেই অবধারিত দুটো প্রশ্ন গড়িয়ে গেল মেয়েটির দিকে, “আপনি কে? কী হয়েছে খুলে বলবেন?”
“আমার নাম নীরা। আমার পিছু নিয়েছে কেউ। ওরা আমাকে খুন করতে পারে। সময় হলে আমি সব বুঝিয়ে বলবো। কিন্তু এখনই নয়।”
“পুলিশের কাছে না গিয়ে এত রাতে মাঝ রাস্তায় অপরিচিত কারো গাড়ি থামানো আপনার জন্য বিপজ্জনক নয় বলছেন? আমি খারাপ লোক নই এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কিসের ভিত্তিতে?”
“আহ্! সময় নষ্ট না করে গাড়ি স্টার্ট দিন প্লিজ।”
নীরাকে প্রায় কমান্ডিং ভয়েসে ‘প্লিজ’ বলতে শুনে হেসে ফেলে রোহান। হাসিটা গোপানের চেষ্টা না করে বরং উপভোগ করতে করতে নিশ্চল গাড়ির গতি তোলে। ভিতরে ভিতরে সে বিস্ময়ে কম আলোড়িত হচ্ছে না।
নীরা… এই নামটা কোথাও শুনেছি কি? আর চোখদু’টো… কথা বলবার ভঙ্গিটাও কেমন পরিচিত না!“নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে” লাইনটা মনে মনে আওড়ে ভাবে, আজ তবে গোটা শহরটার বড় দুঃখের রাত, নীরা আজ বিপদে পড়েছে। সে নীরার প্রেমিক হলে তাকে বিপদমুক্ত করতে হয়তো এভাবে ভাবত,“আমি ধনুকে তীর জুড়েছি—- এবার ছিলা সমুদ্যত, হানবো তীর ঝড়ের মতো–” মন্দ হত না এমন হুকুমদার স্বভাবের একজন প্রেমিকা জুটলে। কিন্তু এটা কি ওসব নিয়ে ভাববার উপযুক্ত সময়? এরকম এক মুহূর্তে তার মাথায় আজগুবি মেলোড্রামাটিক ভাবনার বুড়বুড়িতে বিব্রত না হয়ে সে বরং দ্বিগুণ মজা পেল। তার সহকর্মীদের ধারণা, রোহানের বুকে সর্বকর্মা প্রেম ভালবাসা নামের অনুভূতিটি গুঁজে দিতে ভুলে গিয়েছেন। নিজের ছেলেমানুষিতে আবার আরেকপ্রস্থ হেসে ফেলে রোহান। তার স্বভাববিরুদ্ধ ভাবনায় নাকাল হওয়ায় বিরক্ত না হয়ে কেন সে মজা পাচ্ছে, এটাও কম রহস্য নয়। মেয়েটির মধ্যে কি এমন কিছু আছে, যা তাকে অন্যরকম ভাবনায় টেনে নেবার চেষ্টা করছে? পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা। হাসিটুকু মুছে নিয়ে গম্ভীর হয়ে সে সামনে তাকাল। তার আগে চোরাদৃষ্টিতে পাশে বসা মেয়েটিকে দেখে নেয় একপ্রস্থ। আশপাশ ভুলে সে ফোনের স্ক্রিনে ডুবে আছে। আজব! এমন শুনশান নিশুতি রাতে, অপরিচিত একজনের গাড়িতে অত নিশ্চিন্তে কেউ বসে থাকতে পারে! জানতেও চাইছে না তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রোহানের ভেতরে কেমন শিরশিরে একটা অনুভূতি ছড়াল। কোন বিপদে পড়তে যাচ্ছে না তো!
গাড়ি ততক্ষণে শহরের আলো পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। নিঃশব্দে চলছে গাড়ি, কিন্তু দুই যাত্রীর মাথায় চিন্তার তুমুল আলোড়ন চলছে। যদিও কেউ কারো ভাবনার নাগাল পায় না।
হঠাৎই নীরবতা ভেঙে রোহানের ফোনে টং করে একটা শব্দ হয়। কারো মেসেজ এলো। কৌতূহল নিয়ে ফোনের মেসেজটা খোলে। অজানা নাম্বার থেকে এসেছে মেসেজ, “Stay out of this. Or you’ll be next.”
মুখে কিছু না বলে ফোনটা নীরার সামনে তুলে ধরে।
“They know you are my savior. Are you afraid?”
“Not at all.”
উত্তরটা দিয়ে রোহান হালকা হাসে। ভয় পাওয়ার সময় বহুদিন আগেই সে পিছনে ফেলে এসেছে।
২.
মেসেজটা পাওয়ার পরপরই রোহান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, নীরা নামের মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে যাওয়া নিরাপদ হবে না। ওরা শহরের একেবারে শেষপ্রান্তে পুরনো গুদামের মতো দেখতে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। সেটিকে হানাবাড়ি বলাই শ্রেয়। ভূতপ্রেতে বিন্দুমাত্র আস্থা নেই রোহানের। গুণ্ডা-বদমাশরা হানা দিতে পারে বড়জোর। তবে এটি রোহানের পরিচিত নিরাপদ ঠিকানা। এমন জায়গা, যেখানকার খোঁজ খুব সহজে পাওয়া সম্ভব না।
নীরা জানালার পাশে বসে আছে চুপচাপ। এতক্ষণ সে তার ব্যক্তিগত টুকটাক তথ্য দিয়েছে রোহানকে। এরপর সে কর্মস্থলের তথ্য জানাবে। সেগুলো মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে হয়তো। মেয়েটি শুধু বুদ্ধিমতিই নয়, একই সঙ্গে বিচক্ষণ এবং সাহসী। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বাইরের দিকে তাকিয়ে নীরা বলল, “আমার কাছে যে তথ্য আছে, সেটা যদি ভুল হাতে পড়ে, তাহলে প্রচুর মানুষ মারা পড়বে নিশ্চিত।”
রোহান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, “কী এমন জিনিস আছে আপনার কাছে, যার ভিত্তিতে এমন কথা বলছেন?”
নীরা তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট USB ড্রাইভ বের করল। “এই ড্রাইভে আছে এমআইএস টেকনোলজির সেই গবেষণার তথ্য, যেটা তারা আর্মি এবং প্রাইভেট মিলিশিয়াদের কাছে বিক্রি করতে চায়। এটা কোনো সাধারণ প্রযুক্তি নয়। এটা মানুষের চেতনা নিয়ন্ত্রণ করার অস্ত্র।”
রোহানের কপালে ভাঁজ পড়ে। মেয়েটি যা বলছে তা কতটুকু সত্যি? কাটা কাটা ভাবে সে জিজ্ঞেস করে, “আপনিও নিখোঁজ কমলের দলের একজন, তাই তো?”
নীরা যেন সামান্য চমকাল। মুহূর্তখানেক চুপ থেকে বলল, “দল মানে! কমল স্যার কোম্পানির সিনিয়র গবেষক। আমি তাঁর জুনিয়র। স্যার আমাকে খুব স্নেহের চোখে দেখেন, বিশ্বাস করেন। যখন কোম্পানির ভিতরের গণ্ডগোল একটু একটু করে বুঝতে শুরু করি, তখনই কাজটা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিষয়টা স্যারকে জানাই। প্রোজেক্টটা থামানোর অনেক চেষ্টা স্যার করেছিলেন, পারেননি। তখন তাঁর পরিকল্পনা মত যতটা সম্ভব প্রোজেক্টের গোপন ডেটা সংগ্রহ করে সরে আসার সিদ্ধান্ত হয়। আমাকেও স্যার তখনই সরে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। সঙ্গে এও বলেন, স্বার্থপরের মত নিজের জীবন নিয়ে না ভেবে বৃহত্তর স্বার্থের কথা যেন ভাবতে চেষ্টা করি। তিনি অতটা গভীরভাবে চিন্তাটা আমার ভিতর না ঢোকালে আমি হয়ত সত্যিই স্বার্থপরের মত স্রেফ নিজেকে নিয়ে ভাবতাম। আপনার কথা তিনিই আমাকে জানান। মাঝরাতে ওইভাবে আপনাকে থামানো মোটেও কোন কাকতলীয় ঘটনা ছিল না। যদি আর একটা দিন হাতে পাওয়া যেত, স্যারই আপনার সঙ্গে দেখা করতেন, আমি নই। কিন্তু তার আগেই ওরা তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে।”
“তিনি নিখোঁজ হওয়ার দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছে। এতদিন লাগল কেন আমার সঙ্গে যোগাযোগে? তাছাড়া আপনি যা বলছেন, তার পক্ষে কোন প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”
“নিজের জীবনের স্থায়িত্ব নিয়ে আমাকে আগে ভাবতে হয়েছে। তাছাড়া কমল স্যার নিখোঁজ হওয়ার পর ওরা খুব সক্রিয় ছিল তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠদের গায়েব করায়। সম্ভবত আমিই এখনও ওদের হাতে ধরা পড়িনি। আর প্রমাণের কথা বলছেন? এই ড্রাইভটাই প্রমাণ। আর…” সে পকেট থেকে আরেকটা জিনিস বের করল। একটা ছোট্ট পেন ক্যামেরা, যেটা দেখে রোহানের চোখ বড় হয়ে গেল।
“এতে আছে রিয়্যাল-টাইম ভিডিও, যেখানে দেখা যাচ্ছে কাদের সঙ্গে এমআইএস মিটিং করছে। পুলিশ-সেনাবাহিনীর অনেকেই জড়িত। একজনের নাম বললে বিশ্বাস করবেন না হয়ত।”
রোহান ছোট্ট করে বলল, “বলেন শুনি।”
“ডিআইজি কিরণ বিশ্বাস।”
নামটা বলে নীরা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রোহানের দিকে। যা ভেবেছিল, সেরকম প্রতিক্রিয়াই রোহানের চোখেমুখে ভেসে উঠতে দেখল। নামটা শোনামাত্রই রোহানের মুখে বিমূঢ়তা আর অবিশ্বাসের ছায়া নেমে এল। কিরণ বিশ্বাসকে বরাবরই তার বিশ্বাসযোগ্য এবং শক্তির জায়গা মনে হয়েছে। একজন সৎ, সাহসী অফিসার হিসেবে দেশজুড়ে তার সুখ্যাতি। রোহান নিস্তেজ স্বরে বলল, “অবিশ্বাস্য!”
“আমরা এখন শুধু বিপদের মুখে না, সম্ভবত মৃত্যুরও মুখোমুখি।” নীরার বলার ভঙ্গিতে এমন একটা কিছু ছিল, রোহান সরাসরি তার দিকে তাকাল।
“যে কাজের জন্য আমার কাছে এসেছেন, সেটা শুরু করা যাক। দিন ওটা।”
রোহানের বাড়ানো হাতে নীরা ড্রাইভটা তুলে দিতেই রোহান যেন অন্য মানুষে পরিণত হ’ল। পরিস্থিতি পরিবেশ ভুলে সে তখন তৎপর, ডুবে গেল কাজে। ড্রাইভটি এনক্রিপ্টেড। এটি সাধারণ কোন তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি নয়। দ্রুত হাতে তার ল্যাপটপে সেটা সংযুক্ত করে নিল। সঙ্গে সঙ্গেই অটোমেটিক এনক্রিপশন ডিক্টেট হ’ল। এর পাসওয়ার্ড প্রোটেকশন ব্যবস্থা যথেষ্ট জটিল। ভ্রু’তে সামান্য ভাঁজ পড়ল ওর। মৃদুস্বরে বলল, “এটা খুব সহজে হবে না বস…” এরপর নীরাকে আশ্বস্ত করতে সামান্য হেসে বলল, “মুশকিল যখন আছে, তার আসানের পথও থাকে। নো চিন্তা।”
কোড ব্রেকের জন্য ব্রেকিং টুল হিসেবে Hashcat ব্যবহারের পাশাপাশি ডিকশনারি অ্যাটাকের চেষ্টা চালাল। অনেকসময় এধরণের কাজে সাধারণ পাসওয়ার্ড ব্যবহৃত হয়। রোহানের জন্য ওগুলো তেমন সমস্যা নয়, বরং সময়স্বল্পতা ভীতির কারণ। নীরা উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে রোহানের দিকে। লোকটার হাত অতি দ্রুত মুদ্রায় কীবোর্ডের ওপর ঘুরছে। যেন তুখোড় এক জাদুকর ইন্দ্রজাল বিছিয়ে চলেছে সময়কে থমকে দেবার মন্ত্র খোঁজার তাড়নায়।
“হাতে কিন্তু সময় একদমই নেই রোহান!”
এই প্রথম নীরার কণ্ঠে ভয়ের স্পষ্ট আভাসে মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে তাকাল রোহান। তার ব্যস্ত আঙুল একাধিক অ্যালগরিদমের মাধ্যমে পাসওয়ার্ড আনলকের চেষ্টা করে চলেছে। একই সাথে Autopsy এবং Volatility টুলদু’টোর সাহায্যে চলছে ফাইলের ফরেনসিক বিশ্লেষণ, যার মাধ্যমে ড্রাইভে লুকোনো তথ্য শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
“ওহ নো!”
দু’হাতে নিজের চুল খামচে ধরে প্রথম চেষ্টা বিফলের ক্ষোভ ঝাড়ল রোহান। তারপর ডানহাতের চার আঙুলের ভেতর বাম হাতের চার আঙুল ঢুকিয়ে জিকজ্যাকের কায়দায় দ্রুত আঙুলের ব্যায়াম করে নিল। নীরার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল, “Whoever designed it, there’s no doubt this thing is deep-sea level tough. But I’m no rookie, boss… yet here we are.” বলতে বলতে সে দ্রুত Brute Force Mode চালু করে দিল। তৎক্ষণাৎ USB ফাইলের এনক্রিপশন ডিক্রিপ্ট হতে শুরু করল।
“পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না, ফর শিওর।” আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়লো ওর কণ্ঠ থেকে।
হঠাৎ বাইরে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। কারা যেন বাড়ির চারপাশে ঘোরাফেরা করছে। নীরা ফিসফিস করে বলল, “ওরা এসে গেছে।”
বাইরে থেকে ল্যাপটপের আলো যাতে দেখা না যায়, তার জন্য রোহান দরজার আড়ালে সরে বসল। মুখ না তুলেই সে চাপাস্বরে নীরাকে বাইরে নজর রাখতে বলল। জানালার কাছে যেতে যেতে নীরা ফিসফিস করল, “তাড়াতাড়ি শেষ করুন।”
রোহানের মুখে তৃপ্তির হাসি। ক্র্যাকের পালা শেষ করে সে ততক্ষণে VPN এবং PGP এনক্রিপশন ব্যবহার করে তথ্যগুলো একটা নিরাপদ উৎসে পাঠাতে শুরু করেছে। সাবধানের মার নেই। একাধিক ব্যাকআপ তৈরি করতেও সে ভোলেনি। তারপর ল্যাপটপ বন্ধ করে দ্রুত সব ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়াল। জানালার কাছে যেতে যেতে পকেট থেকে তার ছোট্ট রিভলভার বের করে হাতে নিল। কাজের খাতিরে অনেক সময়ই তাকে নানা কিসিমের উটকো বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। আত্মরক্ষার্থে সে নিজের কাছে এটা রাখে। লাইসেন্স আছে তার। সাধারণত গাড়ির ড্যাশবোর্ডেই থাকে জিনিসটা। আজ নীরার কারণে সেখান থেকে বের করে পকেটে পুরেছিল, নীরার চোখকে ফাঁকি দিয়ে।
“লিসেন, এখন আর পালানোর পথ নেই। বেঁচে ফেরার জন্য একটাই উপায় – লড়াই করা।”
৩.
ঘরের বাতাস যেন থমকে গেছে। নীরা জানালার পাল্লা একটু ফাঁক করে বাইরে তাকাল। চার পাঁচজন অচেনা মানুষ বাইরে ঘোরাঘুরি করছে। ওদের প্রত্যেকের হাতে বন্দুক। তাদের চোখেমুখে একধরণের হিংস্রতা, যেন সামনে পেলে বন্দুকের সবকটা গুলি বিঁধিয়ে তবেই শান্ত হবে। সেরকম পরিকল্পনা নিয়েই ওরা এসেছে।
রোহান চাপাস্বরে বলল, “ওরা সংখ্যায় বেশি। গোলাগুলি হলে কেউ বাঁচব না। আমাদের পালাতে হবে, এখনই।”
নীরা তৎক্ষণাৎ তার ব্যাগ থেকে পেন ক্যামেরার মেমোরি কার্ড বের করে রোহানের হাতে দিল। “রোহান, আপনি এটা নিয়ে পালান। যদি আমি ধরা পড়ি, তবু তথ্যগুলো যেন নিরাপদে থাকে। ওগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।”
রোহান তেতে উঠল, “আপনার মাথা খারাপ নাকি! ভাবলেন কী করে এরকম বিপদের মুখে আপনাকে একা রেখে আমি পালাব? আমরা একসঙ্গেই যাব।”
নীরা তার চোখে চোখ রেখে শান্তস্বরে বলল, “আপনার পেশার মানুষেরা যুদ্ধ করতে জানে না রোহান। কিন্তু আমি জানি কীভাবে টিকে থাকতে হয়।”
বাইরে শুকনো ডালে কারও পা পড়ার শব্দ হ’ল, ধীরে ধীরে কেউ দরজার কাছে এগিয়ে আসছে।
এটা তর্কের সময় নয়। রোহান নীরার কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে দ্রুত পায়ে পেছন দিকের জানালার দিকে এগিয়ে গেল, “পেছনের জানালায় কেউ নেই। এখান দিয়ে লাফ দিন নীরা, বাকিটা আমি সামলাচ্ছি।”
নীরাকে ইতস্তত করতে দেখে রোহান বলল, “বিশ্বাস রাখুন। আমাদের আবার দেখা হবে। কিন্তু আপাতত এখান থেকে বেরিয়ে যেতেই হবে।”
এক মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হলো দুজনের। রোহানের ভেতর অচেনা অনুভূতি গড়াল সন্তর্পণে। রোহানের ডানহাতটা মুঠোয় নিয়ে নীরা বলল, “দেখা হবে।” তারপর ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে লাফিয়ে পড়ল গাঢ় অন্ধকারের বুকে। নীরার ল্যাণ্ডিংয়ের ‘ধুপ’ শব্দটা কানে পৌঁছনোর সাথে সাথে রোহান ঘরের ভেতরে সুরক্ষিত জায়গা খুঁজে লুকিয়ে পড়ল, হাতে প্রস্তুত রিভলভার।
দড়াম করে দরজাটা খুলে গেল। অস্ত্র হাতে তিনজন লোক ঘরে ঢুকল।
“কী ব্যাপার, ঘর খালি মনে হচ্ছে, কেউ ছিল না?” বিভ্রান্তি নিয়ে ন্যাড়া গাট্টাগোট্টা শরীরের লোকটা প্রশ্ন করল।
গোঁফদাড়িতে ঢাকা, গলায় বাঘমুখো লকেট ঝোলানো লোকটা ধীর গলায় বাতাস শুঁকে বলল, “মেয়েটা এখানেই ছিল। গন্ধ ফেলে গেছে।”
“এখানে যখন কেউ নেই, শুধু শুধু সময় নষ্ট না করে ফিরে চল। পরবর্তী নির্দেশনার জন্য তার আগে বসকে ফোন করা দরকার।” শুঁটকো মত লোকটার কথা শুনেও বাকি দুজনের ভিতর হেলদোল দেখা গেল না। ভ্যাবলার মত একে অন্যের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
হঠাৎ কয়েকদফা ঠাস্ ঠাস্ শব্দে হানাবাড়ি কেঁপে উঠল। ওদের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে রোহান গুলি চালিয়েছে। বাঘমুখো লকেটওয়ালা দড়াম শব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। বাকিরা চমকে সরে গেল ছিটকে। সেই সুযোগে রোহান সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে দরজা ঠেলে চিতার গতিতে বেরিয়ে গেল।
বাইরে বেরিয়ে সে নীরাকে দেখতে পেল না কোথাও। মনে মনে ভাবল, মেয়েটা নিশ্চয়ই নিরাপদে সরে যেতে পেরেছে। অনেকটা পথ দৌড়ে এসে থামল রোহান। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে পরিচিত প্রিয় গন্ধ। ভেজা মাটি আর হাসনুহানা ফুলের যৌথ সুবাস। গাড়িটা আপাতত ফেলে যেতে হচ্ছে। তার ব্যবস্থা করতে অফিস ম্যানেজার রতনকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে ফোনের সুইচ অফ করে দিল। চারপাশে সর্তক চোখে তাকিয়ে, আশেপাশে কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে গাছের আড়ালে শরীর মিশিয়ে সে হাঁটতে শুরু করল।
টুমরো নেভার ডাইজ – অন্তিম পর্ব
লেখক পরিচিতি : নাহার তৃণা
নাহার তৃণা, বাংলাদেশের ঢাকায় জন্ম, বেড়ে ওঠা। বর্তমানে উত্তর আমেরিকায় বসবাস করছেন। তিনি মূলত মাতৃভাষা বাংলায় লেখালিখি করেন। পাশাপাশি ইংরেজি কিছু ওয়েবজিনে লিখছেন। বাংলা ভাষায় নাহার তৃণার প্রকাশিত বই রয়েছে ৭টি। সম্প্রতি তার প্রথম ইংরেজি বই, Fleeting Impressions: A Collection of Flash Fiction প্রকাশিত হয়েছে।

