লেখক : অর্হণ জানা
বলেছিলেন ঋত্বিককুমার ঘটক। এরকম অকপট স্বীকারোক্তি তাঁর সমসাময়িক কোনও চিত্রপরিচালক করেছিলেন বলে তো মনে পড়ে না। যে কয়েকজন চলচ্চিত্র পরিচালক বাংলা চলচ্চিত্র তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রে তাঁদের অনন্য অবদানের জন্য বিখ্যাত, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ঋত্বিক ঘটক। তবে পরিচালক পরিচয় ছাপিয়ে তিনি একজন ছোটগল্পকারও। লিখেছেন বহু গল্প।
তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘অগ্রণী’ পত্রিকায়। তার পর ‘গল্পভারতী’ পত্রিকায় তৃতীয় গল্প প্রকাশ। গল্প ‘ভূস্বর্গ অচঞ্চল’, গল্পকার ঋত্বিক ঘটক। গল্পটির প্রধান চরিত্র ‘শেরওয়ানী’ মকবুল শেরওয়ানী। কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের সদস্য মকবুল শেরওয়ানী মুসলিম লিগের ঘোর বিরোধী। ১৯৪৭-এর অক্টোবরে পাখতুন আদিবাসী আর পাক সেনারা বারামুলা দখল করে তাঁকেই ধরেছিল শ্রীনগর পৌঁছনোর সোজা পাহাড়ি পথটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। মকবুল তাঁদের ঘুরপথে নিয়ে গিয়ে সময় নিচ্ছিলেন, ভারতের ফৌজ আসার অপেক্ষায়। কাশ্মীরের রাজকীয় সরকারের সেনা তখন ধসে গিয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, শেরওয়ানী ভারতীয় সেনাকে অচেনা দুর্গম পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে মোটরবাইক খারাপ হল। সেটা সারানোর সময়েই পাকিস্তানি সেনার কবলে পড়েন মকবুল। প্রবল অত্যাচারের পরে পাকিস্তানি সেনার গুলিতেই নিহত হন তিনি। কাশ্মীরে শহিদের সম্মান পেয়েছেন মকবুল। মুলকরাজ আনন্দ তাঁকে নিয়ে ইংরেজিতে উপন্যাস লিখলেন ১৯৬৮-তে, ‘ডেথ অফ আ হিরো: এপিটাফ ফর মকবুল শেরওয়ানী’।
কিন্তু সাড়া-জাগানো সে উপন্যাসের কুড়ি বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল ঋত্বিক ঘটকের গল্প ‘ভূস্বর্গ অচঞ্চল’, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘গল্পভারতী’ পত্রিকার একুশতম সংখ্যায়। মকবুল-হত্যার স্মৃতি তখনও জ্বলজ্বলে কাশ্মীরিদের মনে। সে গল্পের ভাঁজে ভাঁজেও ধরা দিল সেই টাটকা স্মৃতি। আমাদের স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে, এই জন্মশতবর্ষেও, বইয়ের হলুদ পাতার মতো বিবর্ণ ঋত্বিকের সেই সোজাসাপটা ছোটগল্প, যা গল্প হলেও সত্যি।
সত্যিই তো! সে গল্পের প্রধান সব চরিত্রই বাস্তব। মকবুল শেরওয়ানী, মহম্মদ আলি জিন্না – সবাই বাস্তব। গল্পের এক জায়গায় পাকিস্তানি ক্যাপটেন যখন শেরওয়ানিকে জিজ্ঞাসা করেন, “কায়েদ-এ-আজম যখন বারামুলায় আসেন বিশ্রাম করতে, তখন তুমিই তাঁর সভায় গোল পাকিয়েছিলে!” তখন, মকবুল শেরওয়ানী খুব মিষ্টি করে হাসেন, “না, মিঃ জিন্না যখন এসেছিলেন, তাঁর সভামঞ্চে উঠে তখন দু’টো কথা বলেছিলাম মাত্র। শ্রীনগরে শেখসাহেবের সামনে তিনি বলেছিলেন, আমাদের রাজনীতিতে তিনি মাথা ঘামাবেন না। তারপরই কিন্তু মুসলিম কনফারেন্সের হয়ে নানা কথা বলেন অন্য সভায়। এখানেও সেই ব্যাপারই করতে যাচ্ছিলেন, অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছিলেন। তাই আর কি তাঁর সভায় উঠে দু’টো কথা বলছিলাম। ফলে ভয় পেয়ে তিনি এখান থেকে খুব তাড়াতাড়ি চলে যান। ডোগরা সৈন্যদের সাহায্যও নিয়েছিলেন। তা, এখানকার দুষ্টু লোকেরা বলে থাকে— বারামুলাই ভারতে একমাত্র স্থান, যেখান থেকে জিন্নাকে প্রাণ হাতে করে পালাতে হয়েছে।”
গল্পকার হিসেবে হঠাৎ করেই উন্মেষ ঘটে ঋত্বিক ঘটকের। চল্লিশের দাঙ্গা-বিধ্বস্ত সময়ে গল্প লিখতে শুরু করেন ঋত্বিক। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাহিত্যিক গোপাল হালদার বলেছিলেন, “প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর হয়ে গেল, শেষ হয়ে যাচ্ছিল বাঙালি জীবনের মূল্যমান, পিতার স্নেহ, মাতার মমতা, সংসারের সকলের সঙ্গে সকলের বন্ধন— য়ুরোপীয়দের মহাযুদ্ধের বলি হচ্ছিল বাঙলাদেশ, ভারতবর্ষ। মন্বন্তর, মহামারী, মৃত্যুর বিরুদ্ধে কতটুকু প্রতিরোধ রচনা করতে পেরেছিল মানুষ? তবু চেষ্টা করেছিল, কিছু প্রাণ-যন্ত্রণায় অস্থির তরুণ-তরুণী দাঁড়িয়ে উঠেছিল, নানা ছোট বড় সংগঠন গড়েছিল এই শপথ ঘোষণা করে ‘আমরা মরব না মরতে দেব না আমাদের ভাই বোনদের’। ঘোষণা করেছিল তাদের গানের দল পথে ঘাটে ট্রামে বাসে; ঘোষণা করেছিল কবিরা কবিতায়, সাহিত্যিকরা গল্পে উপন্যাসে, সম্মিলিত সাহিত্য সংস্কৃতির আয়োজনে; মাঠের সভায়, পথের মিছিলে, নাট্যমঞ্চের নাটকে, নৃত্যতে। এদের মধ্যে এসেছিল সেদিনকার অক্লান্ত জীবনশিল্পী ঋত্বিক ঘটক— ধূমকেতুর মতো উজ্জ্বল যার উদয় আর নাতিদীর্ঘ জীবনের সেরূপ অবসান— তবু চলচ্চিত্র জগৎ সে উদ্ভাসিত করে গিয়েছে তারই মধ্যে। ঋত্বিকের পরিচয়টাই উজ্জ্বলতম ছটায় এখনকার মানুষের প্রাণকে করে তোলে সরসিত ও সঞ্জীবিত। কিন্তু তখনকার আমাদের কাছে ঋত্বিকের অন্য পরিচয়ও ছিল নতুন নতুন প্রতিশ্রুতিতে স্ফুটনোন্মুখ— কবিতায়, ছোটগল্পে, নাটকে আর কত কাজে, তখনই সে দীপ্যমান— জীবন্ত, অক্লান্ত শিল্পশক্তি শিরায় শিরায় তার উত্তরাধিকার সূত্রে।”
সোজাসুজি নিজের কথাটা বলার জন্য ছোটগল্প লিখতেন ঋত্বিক। সিনেমায় আত্মপ্রকাশের ঢের আগে। এমনকি, জীবনভর চাকরি-বিমুখ সেই বোহেমিয়ান লেখা নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিলেন আজীবন। সুরমা ঘটককে চিঠিতে লিখেছেন, “পার্টির দিকটি ভাবিনি। তেমন অবস্থার উদ্ভব হলে ভাবব, জনতার দিকটা ভেবেছি। আমার স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল লেখাতেই। তোমার মধ্যেও চাপা রয়েছে সে ক্ষমতা। এসো আমরা লেখাটাকে আঁকড়ে ধরি। লেখাকে ডেভেলপ করব, নাটক-উপন্যাস-গল্প, প্রবন্ধ, তার থেকে অর্থোপার্জনটা এখনই কিছু বিশেষ হবে না, দুটো বছর লাগবে।”
আঁকড়ে ধরেননি। কেনই বা ধরবেন! মাধ্যমের প্রতি, রূপের প্রতি তো কোনও মোহই ছিল না তাঁর কোনও দিন। তিনি তো চেয়েছিলেন মানুষের কথা বলতে। চেয়েছিলেন শিল্প হোক উন্মুক্ত প্রতিবাদ। সেটা সিনেমাই হোক বা সাহিত্য। সেজন্য তাঁর গল্পগুলিও সাধারণ সমাজবাস্তবতা, দেশভাগের যন্ত্রণা, মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, মধ্যবিত্ত জীবনের সংকট এবং সমাজে শোষণ-বঞ্চনার চিত্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। তিনি নিজেই বলছেন, “চারপাশে যে সমস্ত বদমাইসি অত্যাচার ইত্যাদি দেখছি, তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক জীব হিসাবে সোচ্চার প্রতিবাদ করার ইচ্ছে থেকেই গল্প লেখার আর্জ এসেছিল সেই ছোট বয়সেই। গল্প আমি খুব খারাপ লিখতাম না। আমার এখনও মনে আছে, আমার আর সমরেশের প্রথম ছাপা গল্প বেরোয় ‘অগ্রণী’তে, তারপর সজনীবাবুর ‘শনিবারের চিঠি’, গল্পভারতী’— নৃপেন্দ্রকৃষ্ণবাবু তখন এডিটর, ‘দেশ’—সব মিলিয়ে আমার গোটা পঞ্চাশ গল্প বেরিয়েছিল।”
পঞ্চাশটা নয়, পনেরোটা মাত্র ছোটগল্প উদ্ধার করে ঋত্বিকের প্রথম ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশ করেছিল ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, আটত্রিশ বছর আগে, কোনও এক ৪ঠা নভেম্বর, ঋত্বিক-জন্মদিনে। প্রতিটি গল্পের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল মানানসই ছবি। অলঙ্করণ নয়, গল্প থেকে আঁকা আলাদা ছবি। নিজেরাই গল্প চেয়ে নিয়ে সে সব এঁকেছিলেন গণেশ হালুই, খালেদ চৌধুরী, চিত্তপ্রসাদ, গণেশ পাইন, শ্যামল দত্তরায়, সোমনাথ হোড়ের মতো শিল্পীরা। ছিল ঋত্বিকের করা দু’-একটা স্কেচও, নানা চিত্রনাট্য থেকে।
প্রথম জীবনে কবিতা লিখলেও তার পর আর কোনও দিন কবিতা লেখেননি ঋত্বিক। নিজেই বলেছেন সে কথা। একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “বাঙালী ছেলেদের যা বাঁধা এবং ফরাসিদেরও যা হয় শুনেছি যে, ভেতরে একটা ক্রিয়েটিভ আর্জ দেখা দিলেই প্রথমে কবিতা বেরোয়, তা দু’-চারটে অতি হতভাগা লেখা দিয়ে আমার শিল্পচর্চা শুরু হ’ল। তারপর আমি দেখলাম ওটা আমার হবে না। কাব্যির এক লক্ষ মাইলের মধ্যে আমি কোনদিন যেতে পারব না।” তিনি হয়ত বুঝেছিলেন, কবিতা তাঁর জন্য নয়। তাই স্বেচ্ছায় সে পথ থেকে সরে এসেছিলেন ঋত্বিক।
সেই সময়েই ঢুকে পড়ছেন রাজনীতিতে। নিজেকে নিয়োজিত করেছেন মানুষের কাজে। চারপাশে তখন উত্তাল – যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে। নাড়িতে ছটফটে-টান-লাগা সেই সময়ের তারেই ছোটগল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঋত্বিকের। ১৯৪৭-এ রাজশাহীতে কিছুকাল ‘অভিধারা’ নামের একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। দেশভাগের পরে এ শহরে এসেও চলল সে-ধারা। একটি-দু’টি সংখ্যা ছাড়া আজ অবশ্য তার সবই তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। অযত্নে, অবহেলায় কীট-নষ্ট হয়েছে ‘পণ্ডিতমশাই’ নামের ছোটগল্পটি, ১৯৬৫-তে লেখা।
‘আকাশগঙ্গার স্রোত ধরে’, ‘এজাহার’, ‘শিখা’, ‘এক্সট্যাসি’, ‘রূপকথা’, ‘রাজা’, ‘পরশপাথর’, ‘স্ফটিকপাত্র’, ‘চোখ’, ‘কমরেড’— তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প। তার বেশির ভাগই লেখা ১৩৫৪ থেকে ১৩৫৭-র মধ্যে। অর্থাৎ ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০। তখনও সিনেমায় প্রবেশ করেননি ঋত্বিক। সিনেমায় প্রবেশ তারও পরে, ‘নাগরিক’ ছবিটির মাধ্যমে। সে সব গল্পের বেশ ক’টির পটভূমিও বাংলার বাইরের— দিল্লি, কাশ্মীর, মধ্যভারতের অরণ্যাস্তীর্ণ ভূভাগের এক কোলিয়ারি শহর।
ছেলেবেলা থেকেই বাড়ি থেকে পালানো কুড়ি-পেরোন তরুণটির নিজের বিচিত্র জীবন তৈরি করছে গল্পবীজ। ঋত্বিক ঘটকের বোন সুরমা ঘটকের স্মৃতি বলছে, “…বড়দা কানপুরে নিয়ে গিয়ে টেক্সটাইলে ভর্তি করে দেন। দুরন্ত ছেলেটি এখানে ছিলেন দু’বছর। খুব আর্থিক দুর্গতির মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। সামান্য পয়সার ডাল রুটি খাওয়া ও মজুরদের সঙ্গে মেশার ও ওদের জীবনকে জানার অভিজ্ঞতা তখনই হয়। ছোটগল্প লেখার প্রাথমিক রসদ ঐ সমস্ত অভিজ্ঞতা। বিখ্যাত ‘রাজা’ গল্পটি ওখানকার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই লেখা। … ‘রাজা’ গল্পটি বিয়ের আগে আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। কাশীনাথ (গুণ্ডা) চরিত্রটির উল্লেখ আছে ঐ গল্পে। পরে একটি অর্দ্ধসমাপ্ত উপন্যাসেও ঐ চরিত্রটির বর্ণনা ছিল। অর্দ্ধসমাপ্ত উপন্যাসটি আমার কাছে ছিল। পরে উই নষ্ট করে দেয়।”
জীবনের শেষের দিকে উপন্যাসও লিখতে চেয়েছিলেন আর একটা, নিজের ছেলেবেলা নিয়ে। তার একটা ছকও করেছিলেন। লিখে যেতে পারেননি। তার আগেই, ১৯৭৬ সালে, ৫০ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। তাঁর সেই অ-পার বাংলার ছেলেবেলার স্মৃতির মতই যেন শেষ হয়েও অ-শেষ থেকে গিয়েছে ঋত্বিকের জীবন-গল্প। হারিয়েছে, নষ্ট হয়েছে তাঁর সেই আত্মবিশ্বাসী ছোটগল্পগুলি।
আজ ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রের মতোই তাঁর ছোটগল্পগুলিও গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। তাঁর ছোটগল্প কেবল সাহিত্যরস নয়, এক গভীর সমাজদর্শনের দলিল হিসেবেও মূল্যবান।
লেখক পরিচিতি : অর্হণ জানা
অর্হণ জানা। জন্ম ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৬। বর্তমান নিবাদ বড়জাগুলি, নদিয়া। ছোট থেকেই লিখতে ভালবাসি--- গান, গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ। সুকুমার রায় আমার গুরু। আমার পথপ্রদর্শক। এযাবৎ কয়েকটি পত্রপত্রিকা ও সংকলন গ্রন্থে আমার লেখা কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ও ছড়া প্রকাশিত হয়েছে।

