লেখক : স্বয়ামদিপ্তা মিত্র
রায়গড়ের আকাশ সেদিন অস্বাভাবিকভাবে স্থির ছিল। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা মেঘগুলো যেন নড়তেও ভয় পাচ্ছিল। দুর্গের উঁচু প্রাচীর ছুঁয়ে হাওয়া উঠছিল ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যেও একটা থমথমে অপেক্ষা লুকিয়ে ছিল—যেন ইতিহাস নিজেই নিঃশ্বাস আটকে আছে। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ সেই নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পারতেন। তিনি একা দাঁড়িয়ে ছিলেন দুর্গের প্রান্তে। নিচে কোকন নদীর সরু রেখা, দূরে অরণ্য, তারও পরে শত্রুর দেশ। হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। তবুও তাঁর উপস্থিতিতেই দুর্গের প্রহরীরা সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। শিবাজীর শক্তি ছিল তাঁর চোখে—যে চোখ সময়কে পড়তে পারত। তিনি জানতেন, যুদ্ধ আসছে। কিন্তু যুদ্ধ সব সময় ঘোড়ার খুর আর তরবারির ঝংকার নিয়ে আসে না। অনেক সময় যুদ্ধ আসে আমন্ত্রণপত্র হয়ে।
মুঘল দরবার থেকে সেই আমন্ত্রণ যখন এল—আগ্রায় উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ—দরবারে ফিসফাস শুরু হয়ে গেল। কেউ বলল এটা সম্মান, কেউ বলল ফাঁদ। অধিকাংশই বলল, যাওয়া মানেই মৃত্যু। শিবাজী কিছুই বললেন না। তিনি শুধু চিঠিটা ভাঁজ করলেন, তারপর ধীরে চোখ তুললেন। “যে ভয় পায়, সে আগেই হেরে যায়,” তিনি বলেছিলেন শান্ত গলায়। এই শান্তিই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
আগ্রার পথে যাত্রা সহজ ছিল না। প্রতিটি শহর, প্রতিটি বিশ্রামস্থল—সবখানেই চোখ ছিল। কে সেবক, কে গুপ্তচর, কে হত্যাকারী—এই পার্থক্য চোখে দেখা যায় না। কিন্তু শিবাজী মানুষের দৃষ্টি পড়তে জানতেন। তিনি কম কথা বলতেন, বেশি দেখতেন। দরবারে পৌঁছনোর দিন আগ্রার আকাশ ঝলমল করছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য্য যেন ইচ্ছে করেই চোখ ধাঁধানো করে সাজানো। সোনালি স্তম্ভ, রেশমি পর্দা, আর অগণিত অভিজাত মুখ—সবই যেন ক্ষমতার প্রদর্শনী। কিন্তু সেই প্রদর্শনীর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল অপমান। শিবাজীকে ইচ্ছে করেই পিছনের সারিতে দাঁড় করানো হ’ল। এমন জায়গায়, যেখানে ছোট রাজাদের দাঁড় করানো হয়। এই অপমান ছিল পরিকল্পিত—একটা নীরব আঘাত। এক মুহূর্তের জন্য দরবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শিবাজী ধীরে সামনে তাকালেন। আওরঙ্গজেবের চোখে তিনি ভয় নয়, হিসেব দেখলেন। হিসেব—কতটা নিচু করলে এই মানুষটা ভেঙে পড়বে।
কিন্তু শিবাজী ভাঙেননি। তিনি কথা বলেছিলেন। চিৎকার করে নয়, অভিযোগ করে নয়। তিনি শুধু বলেছিলেন, “যে সাম্রাজ্য শত্রুকে সম্মান দিতে জানে না, সে নিজের শক্তিকেই ছোট করে।” এই কথার পরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যায়। তাঁকে বন্দি করা হয়। কোন শিকল নয়, কোন অন্ধকার কারাগার নয়—একটা রাজকীয় বন্দিত্ব। বাইরে পাহারা, ভিতরে নজরদারি। তাঁকে মারলে শহীদ হবে, বাঁচিয়ে রাখলে ভয়ের প্রতীক। এই দ্বন্দ্বেই মুঘল দরবার আটকে ছিল। আর এই ফাঁকটাই শিবাজী ব্যবহার করেছিলেন। দিনের পর দিন তিনি দেখেছেন—প্রহরীদের বদল, পাহারার সময়, চোখের ক্লান্তি। তিনি অপেক্ষা করেছেন। কারণ তিনি জানতেন—শব্দ করে জেতা যায়, কিন্তু নীরবে জেতাই স্থায়ী।
একদিন ফলের ঝুড়ি এল। অনুমতি ছিল, রাজকীয় আতিথ্যের অংশ। কেউ খেয়াল করেনি—সেই ঝুড়ি শুধু ফল বহন করছে না। বহন করছে ইতিহাসের দিক বদলানোর মুহূর্ত। রাতের অন্ধকারে, যখন প্রহরীরা অভ্যস্ত নির্ভারতায় ঢুলছিল, তখন সেই ঝুড়িই বাইরে গেল। আর তার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন শিবাজী মহারাজ—কোন যুদ্ধ ছাড়া, কোন রক্তপাত ছাড়া। সকালে আগ্রা বুঝেছিল—তারা একজন মানুষ নয়, একটি ধারণাকে হারিয়েছে।
দাক্ষিণাত্যে ফিরে শিবাজী আর আগের মত ছিলেন না। আগ্রা তাঁকে শিখিয়েছিল—শত্রু যত বড়ই হোক, তার চোখে চোখ রেখে তাকাতে জানতে হয়। তিনি দুর্গ বানালেন শুধু পাথরে নয়, বুদ্ধিতে। তাঁর গুপ্তচররা ছায়ার মত চলত। শত্রুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই তাঁর কাছে খবর পৌঁছত। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন আঘাত এল ভিতর থেকে। একজন নিজস্ব সরদার, লোভে পড়ে, গোপন পথের খবর শত্রুকে দিয়ে দিল। রাতের অন্ধকারে আক্রমণ শুরু হ’ল। অনেকেই পালানোর কথা বলল। শিবাজী থামালেন। তিনি জানতেন, সব যুদ্ধ পালিয়ে জেতা যায় না। শত্রু যখন দুর্গের ভেতরে ঢুকল, তখন দরজা বন্ধ হ’ল। পাহাড় নিজেই যুদ্ধ করল। পাথর গড়াল, পথ ভেঙে পড়ল। ভোরের আলোয় দেখা গেল—শত্রু পরাজিত। বিশ্বাসঘাতক ধরা পড়ল। সে কাঁপছিল। ক্ষমা চাইছিল। শিবাজী তার দিকে তাকালেন দীর্ঘক্ষণ। তারপর বললেন, “ভয় দেখিয়ে রাজ্য টেকে না, ন্যায় দেখিয়ে টেকে।” শাস্তি হ’ল। কিন্তু তা ছিল রাজ্যের জন্য, প্রতিহিংসার জন্য নয়।
বছর কেটে গেল। যুদ্ধ চলল। শিবাজী জিতলেন, হারালেন, আবার দাঁড়ালেন। কিন্তু কখনও নিজের আদর্শ ছাড়লেন না। তাঁর স্বরাজ্য ছিল কেবল ভূমি নয়—সম্মানের দাবি। মৃত্যুর পরেও শিবাজী হারিয়ে যাননি। কারণ তিনি তখন আর একজন মানুষ নন। তিনি হয়ে গিয়েছিলেন সাহসের ভাষা। রায়গড়ের হাওয়া আজও সেই ভাষায় কথা বলে। শব্দহীন। গভীর।
এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় জয়—নীরব জয়।
লেখক পরিচিতি : স্বয়ামদিপ্তা মিত্র
বিজ্ঞান নিয়ে পড়া,কিন্তু লিখতে ভালোবাসি,উত্তরপাড়া ,হুগলীতে থাকা হয়।


এখানে অনেক দিন আগে একটা কবিতা পাঠিয়েছি কিন্তু এখনো তা প্রকাশ করা হয়নি