লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য
আমায় মেটিয়াবুরুজ শিখিয়েছে অনেক। এবং আমি জানি আগামী দিনেও শেখার আছে বহু কিছু। একটা অঞ্চল, তার মানুষ, জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানতে বুঝতে গেলে একটা জীবন বড়োই কম সময়। তবুও চেষ্টা করতে হয়। লাগাতার এবং আন্তরিক চেষ্টা। কারণ কাউকে বুঝতে গেলে, তার হৃদয় জিততে গেলে একটা মননশীল হৃদয় লাগে।
আমরা বাঙালি হিন্দুরা বহু ক্ষেত্রেই নিজেদের উদার মনের বলে দাবী করে থাকি। আমার কিন্তু একেবারেই এই দাবী সত্যি বলে মনে হয় না। কেন? একটু ভাবলেই উত্তর পেয়ে যাবেন। র্যান্ডমলি আপনার আশেপাশে থাকা যে কোনও বাঙালি মুসলিমকে জিজ্ঞাসা করুন “অন্নপ্রাশন”, “বৌভাত”, “শ্রাদ্ধ”, শব্দগুলোর সাথে পরিচয় আছে কি না? অথবা “দাদু”, “দিদা”, “কাকু”, “কাকিমা”, এই ধরনের সম্পর্ক গুলি সম্পর্কে তিনি জানেন কি না? দেখবেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর পাবেন, হ্যাঁ। অথচ আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় গুগল না হাতড়ে বলুন তো “আকিকা” মানে কি? “ঈদ-উল-ফিতর”, ” ঈদ-উল-আজহা”, এই দুই উৎসব কবে কবে হয় জানেন? “লাইলাত-উল-বরাত” কোন উৎসবের আর এক নাম বলুন তো? “ফুফা”, “খালু”, ” দুলাভাই” শুনলেই কেমন নাক কুঁচকে যায় না? ঈদ শুনলেই আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় একটাই ডায়লগ চোখে পড়ে… “ভাই, বিরিয়ানি খাওয়াবি না?” অথচ আমরা খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করিনা আদৌ ঈদে বিরিয়ানি বানানো হয় কি না?
মাঝেমাঝেই নিজের জাতের বহু লোকের গালে কষিয়ে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করে। আমার প্রতিবেশীকে জানার ন্যুনতম ইচ্ছেটুকুও নেই। অথচ অনায়াসেই কতো বেশি জাজমেন্টাল। আমরা ভিখারি কে দুটাকা দিয়ে, রাস্তায় দুটো গরীবকে পুরোনো জামা দিয়ে দাতাকর্ণ হতে চাই। একটা তেতো কথা বলি, শুনলে আপনাদের বহু লোকের গা জ্বালা করবে। দান খয়রাতিতে বাঙালি হিন্দুরা বাঙালি মুসলমানদের ধারে কাছে নয়। নত হতে শিখতে হবে। নইলে আগামী দিনে সংঘী খুঁজতে উত্তরপ্রদেশ যাওয়ার কোনও দরকার হবে না। হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে চাপা থাকা সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর জন্য নিজেদেরই দায়ী করতে হবে।
আসলে বয়স হচ্ছে তো, তাই বহু সময়েই রাগ সামলাতে পারি না। সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই সব লেখায়। আমার বহু বন্ধু আমাকে বলেন “একদিন তোমার সাথে মেটিয়াবুরুজে যাবো”। আমি বলি কি, নিজেই একদিন বেরিয়ে পরুন আমাদের দাগিয়ে দেওয়া “মিনি পাকিস্তান” এর পথে। গায়ে লাগুক মেটিয়াবুরুজের হাওয়া, নাকে ঢুকুক সেখানকার মানুষের ঘামের গন্ধ। প্রথম প্রথম খটকা লাগবে, অস্বস্তি হবে, চাই কি ঘেন্নাও লাগতে পারে। কিন্তু লেগে থাকুন। দেখবেন মেটিয়াবুরুজের প্রেমে পড়ে যাবেন। সে আপনার হৃদয় জিতে নেবে। আর তারপর তার ভালোবাসার বাঁধন থেকে ছাড়া পাবেন না।
“হেঁটে দেখতে শিখুন, ঝরছে কি খুন দিনে রাতের মাথায়। আর একটা কোলকাতায় সাহেব আর একটা কোলকাতায়, সাহেব বাবুমশাই”…. একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতা শেয়ার করে আজকে ইতি টানি। মেটিয়াবুরুজে যারা ওস্তাগরের কাজ করেন, হেল্পার, রেডিমেড গারমেন্টসের কারবারি, তাদের বড়ো অংশ বাঙালি মুসলিম। অথচ যারা তাদের কাপড় সরবরাহ করেন, তাদের অধিকাংশই মাড়োয়ারি। এই অঞ্চলের কয়েকশো কাপড়ের গোডাউনের মালিক অমুসলিম। বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে যখন গোটা দেশের সাথে আমার সাধের রাজ্য দাঙ্গার ভয়ে কাঁপছে, তখন এই মেটিয়াবুরুজের কিছু বাঙালি মুসলিম যুবক পথে নেমেছিলেন এই অমুসলিম মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের জানমাল রক্ষার জন্য। খিদিরপুরের দিক থেকে যখন লুঠতরাজ চালানোর জন্য মেটিয়াবুরুজের কাপড়ের গোডাউনে আক্রমণ করা হয়, তখন এই অঞ্চলের মুসলিমরা একজোট হয়ে তাদের প্রতিহত করে। একটি গোডাউনও লুঠ হতে দেয়নি তারা। উল্টো দিকে থাকা সন্ত্রাসীরা তাদের “কৌম কে দুশমন” বলে দাগালেও মেটিয়াবুরুজ হার মানেনি। আজও সেখানে মাড়োয়ারিরা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করছে। এই আমার ভালোবাসার মেটিয়াবুরুজ, আমার মেটিয়াবুরুজের ভাইরা। এদের ভালো না বেসে পারবেন?
পরের পর্বের লিঙ্ক এখানে
লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।
খুব ভালো লেখা
সাধারণত এরকম আত্ম সমালোচনা মূলক লেখা চোখে পড়ে না, খুব ভালো লাগলো ।
অপেক্ষায় থাকলাম।
উপস্থাপনার ভঙ্গিমাটি খুব সুন্দর লাগল
মহাশয় কে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে দুটি কথা বলছি
প্রথমত: আপনার ভালোবাসা ভালোলাগা আমার ভালো লাগলো। মানুষ মানুষকে ভালবাসবে তাকে কাছ থেকে চিনবে এ অত্যন্ত ভালো লক্ষণ, আমি অন্তত তাই চাই।
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে পৌঁছে তাদের কথা লিখছেন এই জন্য আপনাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাব।
দ্বিতীয় বক্তব্য: হিন্দু প্রতিবেশীর অজ্ঞতার জন্য আপনার থাপ্পর মারতে চাওয়া নিয়ে। এই মারধরের প্রয়োজনীয়তা কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। এই যে আপনি না জানার কথা বলছেন এই ভাষা আমাদের বাংলায় পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহার হয়নি। একেবারে লাগোয়া কোন প্রতিবেশী এই ভাষা ব্যবহার করেন না। এই ভাষার কিছু কিছু আমাদের শোনা হলেও নিয়মিত শোনা বা পড়া হয়না।
বাংলাদেশে গিয়ে আপনি পিসেমশাই বললে অনেকে নাও বুঝতে পারতে পারে। এটা তাদের থাপ্পড় খাওয়ার মতো কোনো অপরাধ নয়। ওখানে বাংলায় পিসেমশাই কথাটি ব্যবহার হয় না। বাংলাদেশের হিন্দুরা আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। এমনকি আমাদের দেশে যে সমস্ত হিন্দুরা মুসলমান প্রতিবেশীদের সাথে খেলাধুলা করে বড় হয় তারা অধিকাংশ কথাই জানে। এতে বিশেষ কোন কৃতিত্ব নেই। আর যারা জানে না তাদের কে থাপ্পর মারার মধ্যেও বিশেষ কোন কৃতিত্ব নেই। ভালো থাকবেন আগামী দিনে আরো ভালো লেখার আশায় রইলাম।
মেটিয়াবুরুজের প্রশংসা করতে গিয়ে হিন্দুদের গালমন্দ না করলেও চলে,যে যেমন এলাকায় থাকে সে সেরকম শেখে, এখানে হিন্দুমুসলিম ব্যাপার নেই।
বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ বহুকাল ধরেই পরষ্পরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে একই এলাকায় বসবাস করে আসছেন । আমাদের পূর্বপুরুষদের বসবাস পূর্ববঙ্গে হলেও এবং তাঁরা উদ্বাস্তু হলেও তাঁদের মধ্যে কখনো মুসলমান বিদ্বেষ লক্ষ্য করিনি । মূল কলকাতার অধিকাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষই উত্তর ভারত থেকে আগত । যার ফলে মফস্বল বাংলার মানুষ ছাড়া অনেকেরই ধারণা নেই যে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলেন । আমাদের অজ্ঞানতা নিয়ে আমাদের গর্ববোধ বোধহয় সমস্যার মূলে নিহিত রয়েছে ।
আত্মবিশ্লেষনীধর্মী লেখা। এ আলোচনা স্বাস্থ্যকর
চলতে থাকুক