বিজ্ঞাপন-জ্ঞাপন

লেখক : বিপ্লব চন্দ্র দত্ত

কথায় আছে- প্রচারেই প্রসার। পণ্যের ব্যাপক প্রচার না হলে সেটার কাটতি কম হয়। তাই পণ্যের বিজ্ঞাপন খুবই জরুরী। বিজ্ঞাপন দিয়ে পণ্যের প্রচার করতে গিয়ে এর মালিক-পরিচালকগন এমন মরিয়া হয়ে ওঠেন যে, প্রসারের জন্য মানুষকে প্রেসার দিয়ে পণ্য কেনায় বাধ্য করেন। অগনিত বিজ্ঞাপনী সংস্থা রয়েছে আমাদের বাংলাদেশে। যেমন- এ্যাডকম লিঃ, এ্যাডমিডিয়া লিঃ, ইউনিভার্সেল মিডিয়া, মিডিয়া কম, গাঙচিল, মাছরাঙা, প্রতিশব্দ, প্রিজম, বেঞ্চমার্ক লিঃ, জানালা বাংলাদেশ, মাত্রা, বিটপী এডভারটাইজিং ইত্যাদি। এর মধ্যে আবার আজব ঘটনা, অদ্ভুত বর্ণনা, আর অবাস্তব কথামালার সমাহারে তৈরি হয় কোন কোন বিজ্ঞাপন। পোষ্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড, ফেষ্টুন, ডিসপ্লে-সাইন এসবে শহরের রাস্তা-ঘাট ছয়লাপ থাকে। এছাড়া পণ্যের বিশেষ ছাড় (ডিসকাউন্ট)ও এক ধরনের বিজ্ঞাপন। ঈদ স্পেশাল, বৈশাখী উৎসব ছাড়, আনন্দ ছাড়, গ্রীষ্মকালীন ছাড়, নববর্ষের বিশেষ ছাড়, শীতকালীন ছাড়, পূজার স্পেশাল, বিরাট মূল্য হ্রাস! পত্রিকার পাতা খুললেই বাহারী বিজ্ঞাপনের চিত্র ভেসে ওঠে। পাত্র চাই, পাত্রী চাই, মোটা হউন, লম্বা হউন, পড়াইতে চাই, প্লট/ফ্ল্যাট বিক্রয়, হারাইয়াছে, স্পেস ভাড়া, ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরোদ্ধার, মেদ-ভুঁড়ি কি করি, হারানো যৌবন ফিরে পাওয়া, ঠিকানা পরিবর্তন, দরপত্র বিজ্ঞপ্তি, সন্ধান দিন, ধরিয়ে দিন, দোকান-কোঠা বরাদ্দ, ওয়ার্ক পারমিট, প্রতারিত হবেন না, নকল হইতে সাবধান ইত্যাদি।

প্লট বিক্রয়ের বিজ্ঞাপনে বলা হয়- মতিঝিল থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্ব। সেটা পাঁয়ে হেঁটে না কি, প্লেনে চড়ে, কে জানে? এককালে যাদের বাড়ি ছিল নদীর ধারে, তারা সর্বদা ভাঙ্গন আতঙ্কে দিন কাটাত, এখন শহরে নদীর ধারে প্লট বিক্রি হয় ‘রিভার-ভিউ’ প্রকল্প নামে। বড় বড় শপিংমল গুলোতে হাল-ফ্যাশনের পোষাক পরিহিত মানব আকৃতির পুতুল সারিবদ্ধভাবে নানান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু যে দাঁড়িয়ে থাকে তা নয়, শিক্ষিত বৈদ্যুতিক পুতুলগুলো সারাক্ষণ কাস্টমারদের আদাব-সালাম দিয়ে অভিবাদন জানায়। এগুলো আবার সাইজে অনেক বড়। এর পাশে গিয়ে দাঁড়ালে নিজেকে মানব আর ওটাকে দানব মনে হতে পারে। ইদানিং কিছু কিছু দোকানে শিরঃচ্ছেদ করা পুতুল মডেলদের মতো পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা ছাড়া বডিটা পোষাক পরে দাঁড়িয়ে থাকার মূল কারণ হল- লুকিং গ্লাসের সামনে ক্রেতার মাথাটা সেটিং করে দেখা হয় পোষাকটা মানিয়েছে কি না।

চটকদার বিজ্ঞাপনের একটু ফিরিস্তি দেয়া যাক। শেভিং সামগ্রী যেমন- রেজার, ব্লেড, আফটার শেভ লোশন, শেভিং ক্রীম এর বিজ্ঞাপনে পুরুষের চেয়ে নারীর উপস্থিতি বেশী দেখা যায়। মনে হয় যেন এ বিষয়টা তারাই ভাল জানে। কোন কারনে মেজাজ চরম গরম হয়ে গেলে প্যারাসুট কোলিং হেয়ার ওয়েল মাথায় মেখে নিন মাথা ঠান্ডা থাকবে। কমপ্ল্যান এর বেলায়ও আমার কমপ্লেন আছে। মেমোরির চার্জ কমে গেলে কমপ্ল্যান খাওয়ান, মেমোরি চার্জ হয়ে যাবে। মাত্র এক ঘষাতেই তেল-চর্বি পরিস্কার করে ভিমবার। লাইফটাকে সিম্পলি মিষ্টি করে ’তীর চিনি’। জীবনে কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর নিশ্চয়তা দিবে “বেঙ্গল প্লাস্টিকের চেয়ার”। প্লাস্টিকের চেয়ারের আবার শ্রেণিবিভাগ আছে। চেয়ারম্যানের চেয়ার হল আরএফএল চেয়ার, আর জনতার চেয়ার হল তালুকদার প্লাস্টিক চেয়ার। ক্লান্তি দূর করতে এবং শক্তি সঞ্চয় করতে আমরা কত প্রকারের এনার্জি ড্রিংক পান করি- টাইগার, স্পীড, ব্ল্যাক-হর্স, পাওয়ার ইত্যাদি। আর কালো হবার জন্যও মন খারাপ হবার কিছুই নেই। ফেয়ার এন্ড লাভলী আছে না! এই যাদুকরী ক্রীমের বদৌলতে এখন পৃথিবীতে কালো মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। সবসময় সবার নজরে থাকতে হলে প্যারাসুট বেলিফুল লাইট হেয়ারওয়েল মাখতে হবে। কিছু অলৌকিক এবং অবাস্তব ব্যাপারও আমরা দেখে থাকি যেমন- ফ্রিজে মাছ রাখার ৫/৭ দিন পরও ফ্রিজ থেকে মাছ লাফিয়ে বের হচ্ছে, ঝাল চানাচুর খেয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হচ্ছে, জুস খেয়ে সত্য কথা স্বীকার করছে অকপটে, চাপার জোর বাড়াতে-‘এটম’ খাচ্ছে। এসব থেকে আমরা যা শিখলাম তা হল-মূমূর্ষূ রোগীকে ফ্রিজে রেখে দিলে কয়েকদিন পর লাফিয়ে বের হবে, সাঁতার জানা না থাকলে চানাচুর খাওয়ার দরকার নেই, আসামীকে পুলিশ রিমান্ডে না নিয়ে একটা জুস খাইয়ে দিলেই হবে। আগেকার দিনে সবাই বলত- দুধ খেলে শক্তি হয়। এখন দুধের শক্তিতেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ‘দুধে হরলিক্স মেশাও, দুধের শক্তি বাড়াও। ’ মনে হয় দুধে হরলিক্স না মিশিয়ে দুগ্ধবতী গাভীকে হরলিক্স খাওয়ালে বাড়ন্ত শক্তি নিয়ে দুধ বের হবে। পেষ্ট ব্যবহারে যদি দাঁতের সকল সমস্যা দূর হয়ে যায় তবে দন্ত-রোগ বিশেষজ্ঞরা কি করবে? ঐ ছাত্রের-ই বা কি হবে, যে বড় হয়ে চোখের ডাক্তার না হয়ে দাঁতের ডাক্তার হতে চায়? তার মতে-মানুষের চোখ থেকে দাঁতের সংখ্যা বেশি বলে, দাঁতের ডাক্তারের ইনকাম টা বেশি হওয়ার কথা। রঙ এর প্রকটতা বুঝাতে আমরা বলি- ধবধবে সাদা, কুচকুচে কালো, টুকটুকে লাল কিন্তু বিজ্ঞাপনের বদৌলতে আমরা ধবধবে সাদা না শুনে সাদার চেয়ে সাদা শুনি, কিংবা সাদার নতুন নাম- ‘ফাস্ট ওয়াশ ডিটারজেন্ট’। ‘সার্ফ এক্সেল’ কাপড় পরিস্কার করে দশ হাতে।

টিভি চ্যানেলের বাটন টিপতে টিপতে আমরা এখন খুব ক্লান্ত। বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য প্রচলিত মাধ্যমগুলোর মধ্যে টেলিভিশন হল অন্যতম। এখন প্রায় ৩৫টির মতো আছে দেশি চ্যানেল। টেলিভিশনে প্রচারিত বিজ্ঞাপনগুলোই বেশি আমাদের নজর কাড়ে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে বিজ্ঞাপন প্রচার একটু বেশিই হয়। শিশু-কিশোররা আবার টিভি বিজ্ঞাপনের খুব ভক্ত। তারা বিজ্ঞাপনের নীতি কথাগুলো খুব মনে রাখে। চ্যানেলে চ্যানেলে বইছে এখন বিজ্ঞাপনের জোয়ার। নাটক, সিনেমা, টক-শো, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, সঙ্গীতানুষ্ঠান, মেগা-সিরিয়াল এমনকি সংবাদ প্রচারের সময়ও কিছুক্ষণ পরপর বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়ে থাকে। এক একটা কোম্পানী পণ্যের বিজ্ঞাপনে যে পরিমান খরচ করেন, পণ্যের উৎপাদনে হয়ত বা তত খরচ করেন না। দেশি চ্যানেলগুলো দেখায় শুধু বিজ্ঞাপন আর টক-শো। দুই দলের দুই নেতা দুই দিকে আর মাঝখানে রেফারি মানে উপস্থাপক। টেবিলের উপর শোভা-বর্ধক টিভি চ্যানেলের লোগো দেয়া মগ। মগে চা, কফি না কি দুধ আছে সেটা আমাদের জানার বিষয় নয়। অনুষ্ঠানে কথার মারপ্যাঁচ একটু বেশি হয় বলেই এর নাম-টকশো। আবার অনেকেই হয়ত ভাবতে পারেন যে-টক-শো হলে ঝাল-শো, মিস্টি-শোও চালু হবে ক’দিন পর। অনুষ্ঠান চলাকালীন কোন এক সময় বিজ্ঞাপন বিরতিতে যাবার আগে উপস্থাপক ভদ্রতা করে বলেন-আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবেন না, ফিরে আসছি বিরতির পর, সঙ্গেই থাকুন, সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ, ফিরে আসছি একটু পর, কোথাও যাবেন না কিন্তু। কারণ তিনি জানেন- পাবলিক খুব চালাক। রিমোটের বোতাম টিপে অন্য কোথাও চলে যাবে। ইদানিং আবার টিভি পর্দার এক কোনায় কাউন্ট-ডাউন করে দেখাচ্ছে কতক্ষন পরে তারা ফিরে আসবেন। বিজ্ঞাপনের আধিক্যের জন্য মূল অনুষ্ঠানের সময়সীমা অনেক কমে যায়।

প্রতিথযশা কবি সাহিত্যিকরাও কম যান না এসব ব্যাপারে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ লেখার পরও বিক্রি তেমন হয় না, যদি না তারা ভাল প্রকাশনা সংস্থা কিংবা প্রকাশকের নাগাল না পান। বইমেলার বিভিন্ন ষ্টলে বই ডিসপ্লে করে, পাঠকদের অটোগ্রাফ দিয়ে, ফটোসেশনে অংশ নিয়ে এবং ষ্টলে ষ্টলে ঘুরে বই বিক্রি বাড়াতে হয়। লোকাল কিছু বাস আছে যেগুলোর গায়ে লেখা থাকে ‘তুফান মেইল’। তার গতিবেগ দেখলেই অনুমান করা যায় নামের স্বার্থকতা। আবার ‘গেইট-লক’ বাসের লক ভাঙ্গা না কি গেইট ভাঙ্গা কিছুই বুঝা যায় না। ইদানিং বড় বড় শহরের ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরগুলো হোম সার্ভিস দেয়। আপনার হোমে বাজার সদাই ডেলিভারী দিবে। এমন দিন হয়ত আসবে- শুধু পৌঁছে দিয়েই ক্ষান্ত হবেনা তারা, রান্না-বান্নাও করে দিয়ে আসবেন।

এবার একটু অর্থনৈতিক বিশ্লেষনের দিকে যাওয়া যাক। দু’টাকার মিনিপ্যাক, সেটা শেম্পুই হোক কিংবা পেষ্ট-ই হোক। চুলচেরা বিশ্লেষনে দেখা যায়- খুচরা দোকানীর ক্রয়মূল্য ১.৫০ টাকা, পাইকারী দোকানী বা লোকাল পরিবেশক/এজেন্ট এর ক্রয়মূল্য ১.০০টাকা, বিভাগীয়/দেশীয় পরিবেশকের ক্রয়মূল্য ০.৭৫টাকা, কোম্পানীর উৎপাদন খরচ (প্লাষ্টিক ফয়েল বা মোড়ক ০.২৫) লাভ ০.২৫ বিজ্ঞাপন খরচ ০.২৫ কাঁচামাল (ক্যামিক্যাল বা রাসায়নিক উপাদান)০.০০ অর্থাৎ কাঁচামাল হল কাঁদামাটি এ ছাড়া আর উপায় কি? ‘জিনিস যেটা ভাল, দাম তার একটু বেশিই হয়’- আমার কথা নয়, বিজ্ঞাপনের ভাষা। আবার সস্তায় পেলে সেটা হয় বাংলালিংক দামে। যত বেশি কথা, তত বেশি লাভ। আবার আমরা যে আড্ডা দেই, সেই আড্ডা দিতেও পয়সা লাগে। গ্রামীন ফোনের শুক্রবারের আড্ডা প্রতিমিনিট ২৫ পয়সা। ওরাই আবার কাছে থাকার কথা বলে-‘কাছে থাকুন’, দূরে যাবার কথাও বলে-‘চলো বহুদূর।’ এতক্ষণ যা জ্ঞাপন করলাম, তাতে কেউ আমাকে আপন ভাববেন না হয়ত। তবে, যারা পণ্যের সুবিধাভোগী এবং বিজ্ঞাপন-সংশ্লিষ্ট তাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। শিশুরা যে ভাবে বিজ্ঞাপনকে বিনোদন ভেবে উপভোগ করে, আমিও না হয়, তা-ই করেছি মাত্র। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ কিংবা কটাক্ষ করা মূল বিষয় নয়। নিছক একটু আনন্দ ভাগাভাগি করলাম। পরিশেষে শ্লোগানের কথা বলি- শ্লোগানও এক প্রকার বিজ্ঞাপন। শ্লোগানে যদি শিক্ষণীয় বিষয় বেশি থাকে আমরা সেগুলোকে স্বাগত জানাই। যেমন-‘বই পড়ুন, অন্যকে বই পড়তে উৎসাহিত করুন’, ‘গাছ লাগান-পরিবেশ বাঁচান’, ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’, ‘যৌতুক নেয়া-দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ’,‘সাবধানে গাড়ী চালান’, ‘১০০ হাত দূরে থাকুন’,‘চলন্ত বাসে চালকের সাথে কথা বলবেন না’, ‘ফুটপাত দিয়ে পথ চলুন’, ‘প্রিয়জনকে বই উপহার দিন’, ‘আপনার শিশুকে স্কুলে পাঠান’, ‘মাদকমুক্ত সমাজ গড়ি’ ইত্যাদি।

লেখক পরিচিতি : বিপ্লব চন্দ্র দত্ত
বাংলাদেশ ব্যাংক ময়মনসিংহ অফিসে যুগ্মপরিচালক হিসেবে কর্মরত। জন্ম-বাংলা 1374 সনের 20 কার্ত্তিক নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার ধারাম গ্রামে। শিক্ষাগত যোগ্যতা-এমবিএ(ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং)।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন