বঙ্গজনের দুঃসময়

লেখক : রতন চক্রবর্তী

বাংলায় বলাবলি ও লেখালেখির যে দুঃসময় চলছে, সেটা বিস্তারিত না বললেও বাঙালিজন মাত্রেই জানেন। অবশ্য বাংলায় কথা বলতে অনেক ক্ষেত্রেই বা বাংলায় কোনও আবেদনপত্র লিখতে অনেকেই লজ্জা পান। যারা এটা করেন, তাদের বিদ্যাবুদ্ধি ও পারিবারিক সামাজিক মান নিয়ে সংশয়প্রকাশও করেন কেউ কেউ। এরা গোত্রান্তরের বা গ্রহান্তরের হবেন বোধহয়। তবে সংখ্যায় বাড়ছে। বাংলা নিয়ে কথা বললে, এদের বিবেচনায়, বাঙালি অস্মিতায় ঘি ঢেলে ভারতীয়তা জলাঞ্জলি দেওয়ার আয়োজন চলছে। আমাদের প্রাচীণ ও নবীন সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক ও বাহকরা অবশ্য ভাবতে শিখিয়েছেন এবং ভাবাচ্ছেন যে, যার যার মাতৃভাষার ও সংস্কৃতির বিকাশ আসলে ভারতীয়তার বিকাশ। রাজনৈতিক নেতারা তাদের ভোটের স্বার্থে কে কী বলছেন বা বলবেন সেটা তাদের ক্ষমতার সমীকরণের অঙ্ক। তার সঙ্গে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারের অনুকূলে প্রাণ-মনের আনন্দযাপনের সম্পর্ক দুরায়ত।

এই যাপনে বাধা বিপত্তি ঘটছে স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থার নিদারুণ অবনমনের গতিতে। সরকারি প্রাইমারি স্কুল কার্যত উঠে যাচ্ছে ক্রমাগত। সরকারপোষিত বাংলামাধ্যম স্কুলগুলোতে শিক্ষকসংখ্যা অনেকক্ষেত্রে নামমাত্রে ঠেকেছে। আবার পড়ুয়াসংখ্যা কোথাও মাত্রাতিরিক্ত। কোথাও অতি অল্পসংখ্যক। দোয়াত আছে, কালি নাই দশা অনেক ক্ষেত্রে দু’তরফেই।

অন্যদিকে পুষ্ট হচ্ছে ইংরেজিমাধ্যম বেসকারি স্কুলগুলি। সেখানে বাংলা প্রায় ব্রাত্য। অন্য ভাষা বাছাই করার ক্ষেত্রে বাঙালি ঘরের পড়ুয়ারাও বাংলা পড়ে না। প্রচার করা হয় এই বলে যে, বাংলা মিডিয়াম স্কুলের পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কাজ জুটবে না। পেশাগত, কৃৎকৌশলগত বা ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রদের স্থান জুটবে না। সমর্থ বাঙালিজন স্বেচ্ছায় তাদের সন্তানদের শিক্ষাপণ্য করছে। ভাবছে না যে, বাংলা পড়ুয়ারাও মেধাবী। ইংরেজি ভাষাজ্ঞানে তারা কমতি কিছু হবে না, স্কুল কলেজে অনুকূল ব্যবস্থাপনা থাকলে। সবচেয়ে বড় কথা চাকরি বা আয়ের বাজার সংকুচিত হচ্ছে সাধারণ, এমনকি তথাকথিত ইংরেজি বলিয়ে লিখিয়েদের জন্যও। এই প্রেক্ষিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম ভাষানির্ভর নয়, নির্বিশেষ। আর যার যার ভাষা সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের সংগ্রাম রাজনৈতিক দলনির্ভরও নয়। দলমত নির্বিশেষে সব মাতৃভাষা প্রেমিকের। বাংলাভাষী মানুষের উপর যে সব অত্যাচারের খবর আসছে, তাকে মোকাবিলা করার জন্য নাগরিক সমাজের চাপ বাড়াতে হবে, রাষ্ট্র ও রাজ্য শাসক রাজনৈতিক দলগুলির, ভোটের অঙ্ক কষার কলঙ্কের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে চাই সুস্থ নাগরিক সমাজের সঙ্গে সুস্থ রাজনৈতিক সমাজের মেলবন্ধন। তা না হলে প্রাদেশিকতা ও ভাষাগত অস্মিতার মূল্য চোকাতে হতে পারে অরাজকতা ডেকে আনার অবিমৃষ্যকারিতায়।


লেখক পরিচিতি : রতন চক্রবর্তী
অর্ধশতক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। দৈনিক, সাপ্তাহিক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চাকরির পাশাপাশি কাজ করেছেন বিদেশি দূতাবাসের কলকাতা তথ্য দপ্তরে। তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন। লিখেছেন ছোট গল্প, নাটক চিত্রনাট্যও। মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী। জন রিডের টেন ডেজ দ্যাট স্যুক দ্য ওয়ার্ল্ড নামে রুশবিপ্লবের দশ দিনের কাহিনি নিয়ে বিশ্বখ্যাত রিপোর্টাজ গ্রন্থ অবলম্বন করে লিখেছেন নাটক অভ্যুত্থান যা ৭৪ জন কুশীলব নিয়ে অভিনীত হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।