লেখক : রাজীব চক্রবর্ত্তী
দুদিন আগের কথা। হাবু হঠাত্ রকের আড্ডায় বসে গম্ভীরভাবে বিড়ি টানতে টানতে বলল, আরেকবার বিয়ে করতে হবে। বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম , কি বললি? হাবু এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ভাবছি আবার বিয়ে করব। মানে? শালা বলে কি? একটা বউকেই খাওয়াতে পারে না আবার আরেকেটা? শখ তো কম না! ভুতো একটা চার অক্ষরের খিস্তি দিয়ে বলে ওঠে, সাহস তো কম নয়। বউ জানে? যা দজ্জাল! তোকে তো মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে রে। হাবু নির্বিকারভাবে হাসতে হাসতে বলে , তোরা সোজা ভাবে ভাবতে পারিস না? আমার শুটকি সুন্দরীকেই (রোগা বলে হাবু বউকে শুটকি সুন্দরী বলে) আবার বিয়ে করব।
কি যে বলছে হাবু আমরা কেউই বুঝতে পারছি না। আমাদের দিকে তাকিয়ে বিড়িতে একটা লম্বা টান দিতেই পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে এল। এবার বিষয়টা বোঝা গেল। গাঁজার ঘোরে হাবু উল্টোপাল্টা বকছে। সবার গালাগালি খেয়েও ওর কোনও হেলদোল নেই। চোখ ছোট করে বলে চলেছে , কালিঘাটে বিয়ে করার দিন থেকেই ভাবছি এটা একটা বিয়ে হল! জমিয়ে বিয়ে করব একদিন। আজ সেই সুযোগ এল।
হাবুকে থামানোর চেষ্টা করা বৃথা। ও এখন বকেই যাবে। আমরাও মজা লোটার জন্য বললাম , তা সে সুযোগ কী করে পেলে বাপধন?
এত দিনে একটা জম্পেস জায়গা পেয়েছি বিয়ে করার। পালুদার সাথে কথা হয়ে গেছে। কয়েকদিন পরেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
বুঝলাম ব্যাটার গাঁজার নেশা ভালই ধরেছে। আর একটু খুঁচিয়ে দিলাম , তা তোর পালুদাটি কে?
মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি এনে হাবু জ্ঞানদার মত বলল , রকে বসে আড্ডা মারলে কি আর দিনদুনিয়ার খবর রাখা যায়? পালুদার পুরো নাম পালসামিয়া। একজন খাঁটি দেশভক্ত। দেশের জিনিস নিজের মনে করে রক্ষা করে। সেই কবেকার কথা … হাবু থেমে গেল।
কিরে থামলি কেন?
ইতিহাসে তো তোরা আবার পাতিহাস। তাই ভাবছি আর এগোব কিনা?
বোঝ ঠ্যালা। ব্যাটা গেঁজেল আবার পড়াশোনা নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছে! তা ফ্রিতে আনলিমিটেড খোরাক যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন হাবুকে থামানোর কোন মানে হয় না। বাধ্য ছাত্রের মত আমরা সমস্বরে বললাম, আমরা শুনতে চাই স্যার।
পালুদার ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদার ….গাঁজার নেশায় হাবু লুপে আটকে গেছে। কেলো চৌদ্দপুরুষ তুলে গাল দিতেই হাবুর জ্যাম কেটে গেল। আবার গড়গড়িয়ে শুরু করল …
ঐ মানে পালুদার পূর্বপুরুষেরা দেশ বিদেশ পেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মরুভুমির দেশে এসে ডেরা বাঁধে বুঝলি। অনেক দূর দেশ থেকে এদেশে এসেছিল। ইতিহাস বইয়ে মাথা কাটা রাজার ছবি তো তোরা দেখেছিস। অনেকে বলে সেই রাজার সাথেও নাকি পালুদাদের বংশের কিরকম যেন লতায়পাতায় সম্পর্ক আছে। ছাড় ওসব কথা। তারপর ব্যবসা ট্যাবসা করে খুব নাম হল ওদের। কত রকমের ব্যবসা! বেচাকেনা ওদের কাছে জলভাত। ইচ্ছে করলে মরুভুমির ক্যাকটাস থেকে দুধ বের করেও বেচে দিতে পারে। তা এই পালুদা এখন লালকেল্লার দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে।
আমাদের হাসতে দেখে হাবু বলল , কি বিশ্বাস হচ্ছে না? তা তো হবেই না। দেশপ্রেমিকদের তোরা আর কবে সম্মান দিয়েছিস? শুধু সমালোচনা করতেই পারিস। পালুদা অনেক দু:খে এই মহান দায়িত্ব নিয়েছে বুঝলি। প্রত্যেকবার দিল্লি থেকে ফিরে আমাকে বলত – লালকেল্লার দিকে তাকানো যায় না। মাঝে মাঝেই দেখি চলটা উঠে গেছে। তার উপর আবার নিজের প্রেমের কথা জানিয়েছে লোকে। বুকে অন্যের গার্লফ্রেন্ডের নাম পুষে রেখে দেওয়ালে লিখে গেছে হানি লাভ মধু। বোঝো। তারপর আবার কত শিল্পকর্ম। লাভের ‘ও’ এর বদলে উল্টানো পান। তা পান পরাগের লাল পিক দিয়ে কি এসব ক্ষত ঢাকা যায়! তাইতো গাঁটের পয়সা খরচ করে দেশের সম্পদ রক্ষার মহান দায়িত্ব নিয়েছে পালুদা।
তোর পালুদার ব্যাপারটা তো বুঝলাম। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারটা কি?
বললাম না একটা জমজমাট বিয়ের স্বপ্ন আমার বহুদিনের। আর আগেই বলেছি পালুদার সাথে আমার কথা হয়ে গেছে। এবার স্বপ্ন সফল হবে। শুটকি সুন্দরীর সাথে আমার বিয়ে হবে ঐতিহাসিক লালকেল্লায়।
ব্যাটার নেশা ভালই চড়েছে দেখছি। হাবু ফুট কাটল।
ঢুলু ঢুলু লাল চোখে হাবু বলে উঠল – নো ব্রাদার। নেশা নয়। ইটস মাই ড্রিম। ডোন্ট ওরি। তোরাও থাকবি সেই বিয়েতে। তবে একটা শর্ত – আগের বারের মত করলে চলবে না।
আগের বারের মত মানে?
মনে নেই? বৌভাতের দিন গলা অবধি টেনে সবাই জল পুলিশের আন্ডারে চলে গেলি, রাত্রে খেতেই পারলি না। আমার দশটা প্লেট নষ্ট হল। এবার ওসব করা চলবে না। বাগানে বিদেশী ঘাস লাগাবে পালুদা, সঙ্গে রঙিন ঝরনা। বমি করে ভাসালে কিন্তু সব কটাকে ধরে ধরে ঝরনার জলে চোবাবে। আর একটা কথা। প্যান্ট – শার্ট বা টি শার্ট পড়া যাবে না। ট্র্যাডিশনাল ড্রেস পড়তে হবে। এখন থেকেই একটা করে শেরওয়ানি বানিয়ে রাখ। পাগড়ির দরকার নেই। ওটা শুধু আমি পড়ব। কমলা শেরওয়ানির সাথে সাদা পাগড়ি। আর শুটকি সুন্দরীর জন্য জরি বসানো ঝলমলে সবুজ লেহেঙ্গা। জমে যাবে বুঝলি।
কল্পিত বিয়ের বর্ণনায় হাবু উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে বলল , ব্যাপারটা একবার ভাব। বিয়ের পর দুজনে এসে দাঁড়াব সেইখানে যেখান থেকে জাতির উদ্দেশ্যে দেশনেতারা ভাষণ দেয়। হাত জোড় করে উপস্থিত অতিথিদের বলব –
সুধীজন , আজকের এই পুণ্যলগ্নে আপনাদের উপস্থিতি আমাদের ধন্য করেছে। আপনাদের আশীর্বাদ ও শুভকামনাকে পাথেয় করে আজ আমরা নতুন জীবনে প্রবেশ করলাম। এই উপলক্ষ্যে সামান্য কিছু পান – ভোজনের আয়োজন করা হয়েছে। আপনারা গ্রহণ করে আমাদের কৃতার্থ করুন।
ওরে কুপমন্ডুকের দল দৃশ্যটা একবার কল্পনা কর। চারিদিকে ঝলমলে আলো। তারমধ্যে ডিজে গান বাজাচ্ছে। লোকজন নাচছে , খাচ্ছে , গল্প করছে … রাত বাড়ছে , নেশা চড়ছে …
তারপর?
ভাবছিলাম হাবু ওর কল্পনার ডানায় ভর করে আরও কিছুটা উড়বে। কিন্তু ব্যটা জাতে গেঁজেল হলেও তালে ঠিক। বলে , তারপর আর কি … নাচতে নাচতে রাতভোর, যে যার বাড়ি চলে যাবি।
আর তুই?
আমি একটু বিশ্রাম নিয়েই রওনা দেব।
রওনা দিবি? কোথায়?
ওহ! বলতে ভুলেই গেছি। বিয়ে তো হবে লালকেল্লায়। আর ফুলশয্যা হবে তাজমহলে। পরদিন সকালেই এসি এক্কা গাড়িতে করে দুজনে লালকেল্লা থেকে রওনা দেব তাজমহলের পথে।
তাজমহলও কি তোর পালুদার কব্জায় নাকি?
এখনও হয়নি। তবে হয়ে যাবে।
হাবু আরেকটা বিড়ি ধরাল। গাঁজার গন্ধ নাকে যেতেই আমরা রে রে করে উঠলাম। হাবু শান্ত গলায় বলল , রাগ করিস না। আজ শুটকি সুন্দরী বাড়ি নেই বলে তিনটে বিড়ি সেজেছি। এটা দু নম্বর। তিন নম্বরটা রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর টানতে টানতে চিলেকোঠা থেকে চাঁদ দেখব আর পৌঁছে যাব তাজমহলে। এবার তোরা ওঠ। আমিও রবি দাদুর একটা কবিতা আওড়াতে আওড়াতে বাড়ি যাই।
গাঁজা মেশানো বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে কবিগুরুর কবিতায় নিজের শব্দ বসিয়ে হাবু হাঁটা লাগালে বাড়ির দিকে –
‘কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল’
লালকেল্লার মত তোমার চোখেও জল!
হে তাজমহল …
লেখক পরিচিতি : রাজীব চক্রবর্ত্তী
জন্ম ১৯৭০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, কলকাতার সিঁথিতে। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। দৈনন্দিনতার ক্লান্তি কাটাতেই মূলত: কলম ধরা। বেশ কয়েকটি লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছেন গল্প, কবিতা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত "সংশ্লেষ" নামক গদ্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর মুক্তগদ্য। ঐ একই বছরে সোনারপুর কাব্যমঞ্চ আয়োজিত স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রকাশিত "অন্য গদ্য" গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর গদ্য। জীবনের বিবিধ অনুভূতি, বাস্তবতাকে ছন্দে বাঁধার প্রয়াসে তাঁর কবিতাচর্চা।