লেখক : দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
ফিডার রোডে যোগেশদার ছোট্ট সেই চায়ের দোকানটা। ওখানে আমরা আড্ডা দিতাম। একসময় ওই দোকানটায় বসে আমরা স্বপ্ন দেখতাম। সারারাত জেগে কাটত ওই স্বপ্নগুলো ফেরি করে। ওখানেই আমাদের প্রেমের সূচনা। ওখানেই আমাদের সবার ওই একটি বালিকাকে পাওয়ার জন্য আকুলতার জন্ম।
অলকেশ বসত ক্লাসের লাষ্ট বেঞ্চে । চুপচাপ, ভীতু… এখন থাকে লন্ডনে। বিশাল বাড়ি, বিএমডব্লিউ গাড়ি, আপেল বাগান…
বিজন পরীক্ষার সময় চোতা নিয়ে আসত পকেটের ভাঁজে। দুটো চা বাগান কিনে এখন চা শিল্পের আইকন…
দেদার খরচ করতো ফিরোজ। কোন রকমে পাস করত। এখন আধুনিক কাপড় কলের মালিক মুম্বইয়ের বাসিন্দা…
ক্লাস পালিয়ে গড়ের মাঠে মোহনবাগানের ফুটবল খেলা দেখতে যেত অপূর্ব । আজ রাজনৈতিক নেতা… স্বদেশ অন্ত প্রাণ অপূর্বর। লাল-বাতি, স্যালুটে অভ্যস্ত জীবন।
পাঁচটা ছেলের ঘাড়ে জল বিছুটি ঘষে ক্লাস ছেড়ে পালিয়েছিল পাগলা মানিক… এখন আইআইটির মস্ত অধ্যাপক।
মনোরঞ্জন বাংলায় চল্লিশের বেশি কোনদিন পায়নি। আজ শারদীয়া সংখ্যায় একটা গল্প বা উপন্যাসের আশায় ওর বাড়িতে প্রকাশকের লম্বা লাইন।
আজও শিহরিত হই মনিশংকরের সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত শরীরটার কথা মনে এলে। ভাবিনি দূরে চলে যাবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
তিরিশ বছর পর এক রবিবার আমরা যোগেশদার দোকানে আবার এলাম সবাই। এক মনিশংকর নেই, চলে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যোগেশদা বেঁচে নেই। দোকানটা আছে আজও। আমরা দোকানের ভেতর বসে চা খেতে খেতে আমাদের বাল্যপ্রণয়ের কথায় ডুবলাম। রুদ্ধ হোল আমাদের কন্ঠ…
আশ্চর্য আমরা কেউই সেই বালিকার নামটা মনে করতে পারলাম না। আমাদের কিশোর মন যাকে নিয়ে নৌকো ভাসাতো প্রতিদিন… যার জন্যে আমাদের রক্তে উঠত ঢেউ… সত্যিই আশ্চর্য তার নাম আজ মনে করতে পারলাম না আমরা কেউই।
“বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়ে হয়েছিল ঠিকই/ কিন্তু পাহাড়কে সে কোনদিনই ভুলতে পারল না”… আমাদের বুকের পাঁজরে লুকিয়ে আছে এক মস্ত পাহাড়… চিরে দেখো সেই পাহাড়ের হাড়-পাঁজর… “ভিতরে থৈ থৈ করছে শত ঝর্ণার জল”।
লেখক পরিচিতি : দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথিতযশা নাট্য সংস্থা "সুন্দরম" এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান "গীতবাণী" র সম্পাদক তথা আবৃত্তি ও নাট্য বিভাগের প্রশিক্ষক। পেশাগত ভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্নাতক।