যৌথ পরিবারের ইতিকথা – ৩

লেখক : দেবাশিস চৌধুরী

আমার তখন ছেলেবেলা। যৌথ পরিবার আমাদের। জেঠতুতো, খুড়তুতো ভাই-বোনেরা মিলে বাড়ির বৈঠকখানার ঘরে একসাথে পড়তাম। আমাদের পড়াতেন ছোটপিসী। তাঁর তখনও বিয়ে হয়নি। পড়ার সাথে সাথে পিসীর চোখের আড়ালে দুষ্টুমিও চলত। আমার এক খুড়তুতো বোন পড়ার সময় ঘুমে ঢুলত খুব। পালা করে পেছন থেকে জোরে হেঁচকা মেরে চুল টেনে দিতাম। ধরা পড়লে পিসীর কাছে কানমলা আর গাঁট্টা খেয়েছি খুব। 

আমাদের বাড়িতে ঘরের সংখ্যা কম ছিল না। সব ছেলেদের জন্যই একটা করে নির্দিষ্ট ঘর ছিল। এমনকি ছোড়দাদুরও (বাবার ছোটকাকা) নিজস্ব একটা ঘর ছিল।  বৈঠকখানার ঠিক বাইরে একটা তক্তপোশ পেতে বাড়ির কাজের লোক অমরদা শুত।

একবার শীত তখন সবে বিদায় নিয়েছে। পাখা চালাবার তখনও প্রয়োজন হয়নি। জানলা দিয়েই ফুরফুরে হাওয়া আসত। হঠাৎ মাঝরাতে বাড়ির সবাই তারস্বরে “চোর চোর” শব্দ শুনতে পায়। ধড়মড় করে জেগে উঠে সবাই বিছানাতে বসে পড়ে। ঘরের বাইরে বের হবার মতন সাহস কোন পুরুষই জোটাতে পারছিলেন না। প্রথমে বের হন ছোড়দাদু। ওনার গলার স্বর শুনে অন্যান্য পুরুষরা ঘর থেকে বের হয় অস্ত্র সমেত। 

আমার বাবার হাতে ছিল লোহার শাবল, মেজকাকার ভোজালি, সেজকাকার বড় একটা লাঠি, রাঙ্গাকাকার হাতে জং ধরা একটা তরোয়াল আর ছোটকাকার হাতে দাদুর মরচে পড়া বহু পুরোনো অচল পাখি মারার বন্দুক, যা জীবনে ব্যবহার হয়নি। শুধু ভালোকাকারই কোন পাত্তা ছিল না। ওদিকে ছোড়দাদুর এক হাতে ছিল পুরোনো একটা বল্লম আর অন্য হাতে ছিল একটা টেবল ল্যাম্প, যার ওপরের শেড কবে গায়েব হয়ে গিয়েছে।

বাড়ির সমস্ত লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পুরুষরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে চোর খুঁজতে লেগে গেলেন। একদল একতলায় আর অপর দল দোতলায়। একতলায় বন্দুক হাতে সার্চ পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছিল ছোটকাকা। থেকে থেকে শোনা যাচ্ছিল ওনার তীব্র স্বরের আস্ফালন – ‘তুই জানিস না যে কার বাড়িতে ঢুকেছিস। তোকে গুলি করে মেরে আমি জেলে যাব।’ বাকিরাও কম বিস্তর হুঙ্কার ছাড়ছিলেন।

ওদিকে দোতলায় সার্চ পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছিল বল্লম হাতে ছোড়দাদু। এই দোতলাতেই একতলার রান্নাঘর ও দালানের উপর ছিল বড় একটা ছাদ। ছাদের ওপারে খালপাড়ের বাগান। ছাদটা সাধারণতঃ অন্ধকার থাকত। কোন লাইটের ব্যবস্থা ছিল না। একটা প্লাগ পয়েন্টে টেবল ল্যাম্পের তারটা লাগিয়ে তিনি লম্বা তারটা সযত্নে বিছিয়ে ছাদ অবধি পৌঁছে গেলেন। ছাদের মাঝামাঝি জায়গায় এসে আমেরিকার “স্ট্যাচু অফ লিবার্টি”র মতন ল্যাম্পটি শূন্যে তুলে চারিদিক আলোকিত করে বাবা আর সেজকাকাকে বললেন, ‘তোরা চারপাশটা ভাল করে দেখ কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে কিনা।’

কাকার কথা মান্য করে ওনার দুই ভাইপো লেগে পড়লেন চোর খুঁজতে। ভারী শাবল অনেকক্ষণ বওয়ার ফলে সেটা বারবার বাবার হাত পিছলে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। এদিকে সেজকাকা অনেকদিন পর হাতে লাঠি পেয়ে বাঁইবাঁই করে ঘোরাতে থাকলেন। দুজনে ছাদের কোন কোণা বাদ দিলেন না। ওনাদের খোঁজার নমুনা দেখে ছোড়দাদু ক্ষেপে উঠে বললেন, ‘হতভাগা তোরা চোর খুঁজছিস না ইঁদুর ছানা? আলসেতে দেখ। বাইরে লটকে ঝুলে আছে কিনা। আমি যেতে চাই না। শেষে আমার হাতে খুনখারাপি হয়ে যাবে।’

চোর না পেয়ে বিরক্ত ছোড়দাদু ল্যাম্পটা ছাদের মেঝেতে রেখে ছাদের একটা ইঁট খুলে নিয়ে শাবল দিয়ে ভেঙ্গে টুকরো করলেন। তারপর এক একটা টুকরো নিয়ে ধপাধপ পিছন দিকের নারকোল গাছে মারতে লাগলেন। কারণ জিজ্ঞেস করতে জানালেন, ‘যদি নালকোল গাছে লুকিয়ে থাকে তো।’

বাড়ির ভিতরে মহিলারা তখন যে যার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। শুধু ঠাকুমা হাতের কাছে কিছু না পেয়ে একটা নুড়ো ঝাঁটা সম্বল করে সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন। ‘বৌমারা তোমরা কেউ খবরদার দোর খুলবে না। চোরই হোক আর ডাকাত, এই ঝাঁটার বাড়ি ঝেঁটিয়ে ওর বিষ ঝেড়ে দেবো। আমি থাকতে তোমরা ভয় পেও না।’

হট্টগোলে আশেপাশের বাড়ির লোকেরা তখন ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। পাশের বাড়ির গাঙ্গুলীরা ওদের ঝাঁকরা চুলো কুকুরটাকে ছাদে ছেড়ে দেয়। তিনি আবার দুবার ঘেউ-ঘেউ করে, ঠ্যাং তুলে কম্মো সেরে নিজের আস্তানায় ফিরে যান। অপর দিকে লাগোয়া চাটুজ্জে বাড়ির পুরুষরা একজন দুজন করে বেশ কয়েকজন ওদের ছাদে একত্রিত হয়ে  আমাদের বাড়ির উঠোনে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে।

ভালকাকার গভীর ঘুম। ঘুমের মধ্যে ওনার লুঙ্গি প্রথম রাতে স্বস্থানেই থাকত। রাত বাড়ার সাথে সাথে সেটি উপরে উঠতে থাকত। গায়ের চাদর, মাথার পাগড়ি হয়ে সেটি অবশেষে শরীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যেত। হৈ হট্টগোল শুনে তিনিও ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। ওনাকে দেখেই পাশের চাটুজ্জে বাড়ির ছাদ থেকে একজন বলে উঠলেন, ‘ও মনাদা কি পড়ে বেরিয়েছ? ওটা তো বৌদির সায়া।’

নিজের পরণের দিকে একবার নজর বুলিয়েই ভালকাকা পোঁ করে দৌড় লাগালেন নিজের ঘরের দিকে। আসলে তাড়াহুড়োতে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে খাটের পিছনে রাখা আলনা থেকে যা পেয়েছেন তাই টেনে পরণে গলিয়ে নিয়ে ছিলেন।

বিস্তর খোঁজাখুজি করার পর যখন চোরের হদিশ পাওয়া গেল না, তখন বাড়ির সাতজন পুরুষ মিলে উঠোনে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হঠাৎ এক সাথে সবার নজর পড়ল বৈঠকখানার ঘরের বাইরে তক্তপোশে, চাদরে মাথা ঢেকে শোওয়া বাড়ির কাজের লোক অমরদার দিকে। ওর আবার ঘুমের ঘোরে কথা বলার অভ্যেস ছিল। রাগটা সামলাতে না পেরে ছোড়দাদু বললেন, ‘নির্ঘাত ঐ হতভাগাটা ঘুমের মধ্যে চোরের স্বপ্ন দেখেছে। আজ খড়ম পেটা করে উজবুকটার পিঠের চামড়া তুলব।’

যৌথ পরিবারের স্মৃতিটাই এখন রয়ে গিয়েছে। সেই সাতজন পুরুষের মধ্যে কেউই আজ জীবিত নেই। হারানো দিনগুলি বারবার রোমন্থন করার একটা আলাদা সুখের অনুভূতি হয়।


লেখক পরিচিতি : দেবাশিস চৌধুরী
দীর্ঘকাল কর্মসূত্রে আমি লখনৌতে প্রবাসী। গল্প লেখাটা আমার একটা প্রিয় সখ। আমার গল্প পড়ে সবার মনোরঞ্জন হোক, এটাই আমার কামনা।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।