চুপ-শৈশব: ক্রিং

লেখক: স্বাগতা আচার্য্য

একটুকরো ক্রিং ক্রিং শব্দ গোটা শৈশবকেই দিয়েছিল চমকে ! শব্দ একটাই….কিন্তু তার আগমন বার্তা বোধহয় হাজার রকম ছিল। বাবা যখন সন্ধ্যার পর ফিরতো, সাইকেল উঠোনে তোলার আগে মাত্র দুবার বেল বাজাতো। তাতেই আমি আর সেই আরেক সীমান্ত প্রহরী সতর্ক হয়ে পড়তাম। বই ঠিক খুলে যেত চোখের সামনে। উনি খুলতেন অঙ্ক (হুঁ, যেন উদাহরণ মুখস্থ করছেন!) আর আমি বাংলাগোছের কিছু….নিবিষ্ট ভাব কাটিয়ে উঠবো উঠবো – এমন সময় মা বা ঠাকুমা আমাদের প্রহসনকে অষ্টরম্ভা নাম দিয়ে সদর দরজা খুলে আলো দেখাতো!

একটু আগে ঘটে যাওয়া হলদিঘাটের যুদ্ধের চিহ্ন খুঁজলেই পাওয়া যেত মাথাহীন পেনে, নখের আঁচড়ে। বাবা ঘরে ঢুকেই আমায় অঙ্ক আর প্রতিপক্ষকে বাংলা খোলার নির্বাসন গোছের নির্দেশ দিত। পিঠ দিয়ে চুঁইয়ে পড়ত আতঙ্কের চোরাস্রোত! তেলমাখা সকালে আসতো পিওন দাদু। চারবার ক্রিং  ক্রিং শব্দে আধ্ ঘোমটা টেনে মা বেরিয়ে আসতো। হাতে খাম বা চিঠি নিয়ে শ্রীমতি সই করে দিত….
“কী এল মা?”
“বাবার দরকারি চিঠি”
দরকারি কাগজ হাতে নিয়ে মা কেমন চুপ করে রেখে দিত কালোবাক্সে ! মামার চিঠি আসেনি ! অপেক্ষা আমার মায়ের। কোনো এক কাঠঠোকরার ঠোক্কর লাগা বিকেলে ঠিক হাজির হতো মামা কিংবা মেসো-মাসি। বারকয়েক বেল বাজতো উঠোনে বেলতলায়। মা হয়তো তখন ভেজা শাড়িতে পুকুরে গা ধুচ্ছে। লাক্স সাবানের গন্ধে ম ম করছে সারা পুকুর ঘাট। দূর থেকেই উত্তেজনায় তোতলাচ্ছি !
“মা…..মামা” !
মাও কি আনন্দে চমকালো? 
“খুব মিথ্যা কথা বলিস এখন”
“সত্যিইইইই….তোমায় ছুঁয়ে বলছি” 
হাওয়ায় হাত ভাসাতাম মাকে ছুঁতে। চিনি-নুন-লেবু সরবতে মিশে যেত। বারবার চামচ দিয়ে আলগোছে চেখে নিতাম। কড়ায় ফুলে উঠতো বেগুনি-পেঁয়াজিরা। মা আবেগে কাজ ভুলে যেত। গল্পেরা জেগে উঠতো রাতের চুপকথায়।
পরের দিন থেকে যাবার অনুরোধ বাঁধ ভাঙতো মায়ের ভেজা আঁচলের খুঁট থেকে।
কাকিমা-ঠাকুমাও সায় দিত। জুতোরা লুকিয়ে পড়ত অন্ধকার কোণে। দলবল নিয়ে বাবা-কাকুর সাথে পুকুর ঘিরে ফেলতাম। মাছেরা জমা হত জালের ঝালরে। বাবা তুমি দিয়ে আমাদের ডেকে উঠলে ক্রিং শব্দ হতো না। আজ্ঞে সাড়া দিতাম। হাসিমুখে হাতে দিত ফল-মিষ্টি ভরা ব্যাগ। 

ক্রিং শব্দ সেই ক্লাস ফাইভ থেকে আমাদের হাতে। কেউ চমকায় না। আমরা নিজেরাই চমকাই। বাবা-মামা এখনো ক্রিং করে ওঠে  উঠোনে। পিওন দাদু খুব কম আসে। নিজেরাই তো খবর বয়ে বেড়াচ্ছি পকেটের অলিগলি জুড়ে!


ছবি: প্রণবশ্রী হাজরা


লেখকের কথা: স্বাগতা আচার্য্য
নেশায় -আবোলতাবোল পাঠিকা। পেশায় -সেবিকা। নিবাস -পূর্ব মেদিনীপুর।
লেখকের ভাষায় – “যা ভাবি লেখা আসে তার সিকি; হইচই মার্কা মনন। এলোমেলো বুনন। গুণ খুব একটা নেই। কেউ লেখা চাইলে ধড়ফড় করে কেমন। ভুল ক্রুটি নিজগুনে ক্ষমা করে দেবেন। জানাবেন অকপটে। পরের বার শুধরে দেবার আশায় আছি।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum