কৃষ্ণগত প্রাণ: দ্বিতীয় পর্ব

লেখক: মিত্রা হাজরা

কৃষ্ণগত প্রাণ: প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং দিব্য আনন্দের উৎস, তাঁর আলিঙ্গনে দরিদ্র সুদামা দিব্য আনন্দে ভরপুর হয়ে গেলেন। কোনো কষ্ট কোনো গ্লানি তাঁর মধ্যে আর অবশিষ্ট থাকলো না। শ্রীকৃষ্ণ নিজ সিংহাসনে তাঁকে বসালেন। নানা রকম ফল, মিষ্টান্ন পানীয় দিলেন, চন্দন, অগুরু, কুমকুম দিয়ে মার্জনা করলেন, ধূপদীপে আরতি করলেন। স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী রুক্মিনী চামর হস্তে ব্যজন করতে লাগলেন, তাঁর কুঞ্চিত কেশদাম, স্বর্ণ হাস্যোজ্জ্বল রূপ যেন অমৃতবারি বর্ষণ করছে। যিনি সর্বদা নারায়ণের সেবারতা, তিনি নিজে সেবা করছেন সুদামাকে।

কৃষ্ণ বলছেন – ‘হে সখা, তুমি যে এখানে এসেছ, এটাই আমার পরম সৌভাগ্য।’
অপরিচ্ছন্ন দীন ব্রাহ্মণকে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং অভ্যর্থনা করছেন – প্রাসাদ রমণীরা অবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন এই ব্রাহ্মণ কোনো সাধারণ মানুষ নন। তিনি নিশ্চয় বহু পুণ্য কর্ম করেছেন, তা না হলে স্বয়ং লক্ষ্মীপতি ওঁর সেবা করছেন কেন! অগ্রজ শ্রী বলরাম ও রুক্মিনী দেবীকেই কৃষ্ণ শুধু আলিঙ্গন করেন, এনাকে আলিঙ্গনও করছেন!

শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ‘সখা, গুরুকুলে তুমি আমি একত্রে যে জ্ঞান অর্জন করেছি, সে সকলই আমাদের সঞ্চিত জ্ঞান, যা আমাদের সঠিক মার্গ দর্শন করছে। সদগুরুর পরিচালনায় গুরুকুল-জীবনে সুশিক্ষা প্রাপ্ত হলে, ভবিষ্যতে মানুষের জীবন সফল ও সার্থক হয়। সহজেই অবিদ্যার তমো অন্ধকার অতিক্রম করতে পারে। অলীক মায়া তাঁকে প্রভাবিত করতে পারে না।
আমাদের জীবনে গুরুর দান অনেক, আবার গুরুও একাধিক হন। পিতা, মাতা আমাদের প্রথম গুরু, কারণ তাঁদের করুণায় আমরা এ দেহ প্রাপ্ত হই। যিনি আমাদের বিদ্যা দান করেন তিনি শিক্ষাগুরু। আর যিনি দীক্ষা দান করে আমাদের পরমার্থিব সাফল্যের দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করেন তিনি দীক্ষাগুরু। তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা সংসার সমুদ্র অতিক্রম করে, ভগবৎধাম বৈকুন্ঠের দিকে যেতে পারি।’

সুদামা বলছেন, ‘হে মিত্র, তুমিই আমার গুরু, শুধু গুরু না, তুমি পরম গুরু। গুরুগৃহে তোমার সঙ্গে বসবাস করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তোমাকে উপলব্ধি, আমি তাই করতে চেষ্টা করি সতত। তোমার দিব্য রূপের বিভিন্ন অংশ বাল্যকাল থেকে আমি প্রত্যক্ষ করছি। তুমি শিষ্যরূপে গুরুগৃহে আমাদের সঙ্গে বসবাসের অভিনয় করছিলে। এর অর্থ নিজের প্রীতির জন্য তুমি লীলাবিলাস করছিলে।’

কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে প্রাসাদটি ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। রাজপ্রাসাদ সুচারু রূপে সজ্জিত ছিল, মুক্তোর মালা এবং বহু মনিরত্ন দিয়ে অলংকৃত ছিল এই প্রাসাদের কক্ষগুলো, মন মাতানো সুগন্ধী-যুক্ত পুষ্পে বাগানের শোভা বর্ধিত হচ্ছিল, দুর্লভ পারিজাত বৃক্ষ তার সৌরভ ছড়াচ্ছিল, এই সমস্ত ফুলের সুগন্ধে গুঞ্জনরত মধুমক্ষিকারা বৃক্ষের চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছিল। এই সুন্দর প্রাসাদ যেন এক দিব্য আনন্দ সমুদ্রে সন্তরণ করছে।

এক কপর্দকশূন্য নিঃস্ব ব্যক্তি বিষয়-আশয় লাভের উদ্দেশ্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে। কিন্তু কৃষ্ণভক্ত সুদামা শুধু শুদ্ধাভক্তি ছাড়া আর কিছু কামনা করেননি শ্রীকৃষ্ণের কাছে।

যাইহোক কয়দিন শ্রীকৃষ্ণের কাছে কাটিয়ে সুদামা স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। মন ইষ্ট চিন্তায় মগ্ন। কিন্তু নিজের গৃহে এসে আশ্চর্যজনক পরিবর্তন দেখতে পেলেন। তাঁর জীর্ণ কুটিরের পরিবর্তে সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি রশ্মির মত চাকচিক্যপূর্ণ বহু মূল্যবান মণিরত্নময় প্রাসাদ দেখতে পেলেন। কমল, শাপলা, শালুকে পূর্ণ সরোবর দেখতে পেলেন। সুদামা ভেবে কূল পান না এ কোথায় এসে উপস্থিত হলেন! সামনে বহু অলঙ্কারে সজ্জিতা তাঁর পত্নীকে দেখতে পেলেন। গভীর প্রীতি ও অনুরাগে অবনত হয়ে তিনি স্বামীকে প্রণাম করলেন।

প্রাসাদে প্রবেশ করে দেখলেন কোমল দুগ্ধ ফেননিভ শয্যা, হস্তিদন্তে নির্মিত স্বর্ণময় রত্নখচিত পালঙ্ক, প্রাসাদ ধন-ঐশ্বর্য্যে পরিপূর্ণ। পত্নীর কাছ থেকে জানতে পারলেন সবই শ্রীকৃষ্ণ ব্যবস্থা করেছেন। তাঁদের দারিদ্র্য দূর করতে শ্রীকৃষ্ণ কৃপা করেছেন । সুদামা বুঝলেন শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্যামী, বন্ধুর দুর্দশা দেখে তিনি স্থির থাকতে পারেননি। কিন্তু সুদামার তো এ সব কিছুরই প্রয়োজন নেই। এই বিপুল ঐশ্বর্য্য যে সুদামাকে তাঁর ভগবানের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবে। তাঁর জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল, প্রার্থনা করলেন – হে মঙ্গলময় হরি, মধুসূদন, এ দেহ মন যেন তোমার চিন্তায় সতত কাটে, আর শেষের সে দিনে যেন তোমার করুণা থেকে বঞ্চিত না হই।

শ্রীকৃষ্ণ পরম করুণাময়, নিরন্তর কৃষ্ণ সান্নিধ্যের ফলে শীঘ্রই কৃষ্ণভক্ত সুদামা সচ্চিদানন্দ ধামে গমন করলেন। আত্মা অনন্তে মিশে গেল।


(চলবে)


লেখকের কথা: মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।