মুদ্রাগুন

লেখক : বিপ্লব চন্দ্র দত্ত

একটা ছোট গল্প বলে শুরু যাক-

রহমান সাহেবের মুদ্রাদোষ কথায় কথায় ’আপনার…আপনার’ শব্দটি ব্যবহার করা। জামিল সাহেব এ পাড়ায় নতুন ভাড়াটে এসেছেন। তিনি রহমান সাহেবের মুদ্রাদোষের ব্যাপারটি জানতেন না। একদিন সকাল-বেলায় পাড়ার রাস্তায় দু’জনের দেখা। রহমান সাহেবের হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধ্যা। জামিল সাহেব বললেন- আরে, রহমান সাহেব যে! হাতে ফুল দেখছি। কোথা থেকে আসলেন? রহমান সাহেব উত্তর দিলেন এভাবে-‘যাচ্ছি আপনার বাসায়। আজ আপনার স্ত্রীর জন্মদিন, তাই ফুল নিয়ে যাচ্ছি আপনার স্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে। আপনার স্ত্রী আমাকে খুব ভালবাসে তো…তাই।

পরের গল্পটি আরো ভয়ংকর। আমার এক পরিচিত লোক যিনি প্রতি বাক্যের শুরুতে কিংবা সুবিধাজনক কোনো স্থানে ‘আপনার’ শব্দটি দিয়ে শূণ্যস্থান পূরণ করে থাকেন। একদিন তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন- ‘কালরাতে অনেক দেরি করে আপনার বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি আপনার স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছে আমার বিছানায়। তার অবস্থা এমন বেগতিক যে আর জাগাতে সাহস পেলাম না। আপনার আলোটা নিঃশব্দে নিভিয়ে আপনার স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর আপনার ঘরের মধ্যে একটা শব্দ হল। আপনার স্ত্রী ভয়ে চিৎকার দিয়ে আমাকে জাপটে ধরলো। এরপর আমি আপনার আলোটা জ্বালিয়ে দেখি- আপনার বিড়াল। এরপর আপনার স্ত্রী আমাকে আর ঘুমুতে দেয়নি। এই ‘আপনার’ শব্দের ঠেলায় কার স্ত্রী কার হয়েছে! অনেকে আছেন যারা নিজের পরিবারের সদস্যদের পর্যন্ত অপরের হতে ছেড়ে দেন, তারা কথা বলে থাকেন এভাবে -আপনার বড় ছেলেটা ডাক্তারী পড়ছে। আপনার স্ত্রীর কথা আর কি বলব, আপনার বাবার স্বভাবটা রগচটা, আপনার ছেলে-মেয়েরা একদমই কথা শোনেনা। আপনার ছেলেপেলে নিয়া আমি খুব টেনশনে আছি। কথা শুনে না বুঝলেন? রেজাল্ট তো খারাপ করেই- এরপর আবার আপনার মেয়ের পিছনে ঘুরে। এজন্য আপনার বউরে কইলাম, তুমি তো সারাদিন বাসায় থাকো, একটু নজর দাও- কি বলবো আপনার?

খুবই ভয়ংকর একটি শব্দ ‘আপনার’। সকল প্রকার মুদ্রদোষের মধ্যে এই শব্দটি ব্যবহার করাই সবচেয়ে বিপদজনক। এজন্যই সম্ভবত: মুদ্রা গুণ না হয়ে মুদ্রা দোষ হয়েছে। এক বৃদ্ধ রোগীকে নিয়ে যাওয়া হল মহিলা অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার রোগীর কাছে জানতে চাইলেন- ব্যথাটা কোথা থেকে শুরু হয়? বৃদ্ধ বললেন-আপনার পাছার নীচ থেকে ব্যথাটা উঠে আসে, বুঝলেন! অধীনস্থ এক কর্মকর্তা অফিসের বসকে বলছে-স্যার কালকে আপনার ২ নম্বর থাইক্যা ১২০ টাকা দিয়া একটা তরমুজ কিনলাম। আপনার তরমুজটা সাইজে খুব বড় এবং লাল টকটকে। বাসায় নেবার পর আপনার স্ত্রী একাই খেয়ে ফেলল আপনার তরমুজটা, তাও আবার আপনার বিচি শুদ্ধা। এসব লোকেরাই আবার দোকানে গিয়ে বলেন, “আপনার দুইটা ডিম দেন তো।” ডিম হাতে নিয়ে আবার বলে- আপনার ডিমের সাইজ এত ছোট কেন? মুদ্রাদোষের এই একটা শব্দ ‘আপনার’ দিয়ে ইতিহাস লেখা হয়ে যেতে পারে।

মুদ্রাদোষ এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হল গধহহবৎরংস অথবা চবপঁষরধৎ ঐধননরঃ । মুদ্রাকে আমরা দোষ বলি কেন? এখানে মুদ্রা মানে কয়েন নয়। নাচের ক্ষেত্রে যে নাচিয়ে যত বেশি মুদ্রা আয়ত্ব করবে তার নাচ হবে তত ভালো। এই মুদ্রা শব্দটি এসেছে ভঙ্গী অর্থে। নাচে যেমন মুদ্রা থাকে তেমনটি। মনের অজান্তে বা মনের ভুলে কেউ কেউ যেসব শব্দ বা ভঙ্গী পুনরাবৃত্তি করে। নাচের ক্ষেত্রে যে সকল অঙ্গ-ভঙ্গির প্রয়োজন হয়- সেগুলো হল মুদ্রা। অঙ্গ-ভঙ্গিগুলো যখন বাস্তব জীবনে মানুষ বেশি করে ব্যবহার করে তখনই মুদ্রাদোষ হয়ে থাকে। আমি মুদ্রাকে দোষ না বলে গুণ বলছি; যে গুণের দ্বারা অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে, হাসাতে পারে!

আমার গ্রামের কৈশোরের এক খেলার সাথী- তোতলা। কোন গল্প বলার সময় যদি কারো নাম মনে না আসে, তাহলে তার প্রচন্ড রকমের খিঁচুনী শুরু হয় এবং একসময় মাটিতে শুয়ে কাতরাতে শুরু করে। তাকে সাহায্য করতে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা একটা করে নাম উচ্চারণ করতে হয় আমাদের। সঠিক নামটা উচ্চারণ হতেই সে চিৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়াতো।

এবার আর একটি গল্প-

এক তোতলা ছেলের কিছুতেই বিয়ে হচ্ছেনা। মানে পাত্রী পক্ষ রাজি হয়না। একবার কনে দেখতে গিয়ে পাত্রের অভিভাবকরা তাকে কোন কথা বলতে বারন করলেন। অর্থাৎ তোতলামীর ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাইলেন। শেষে দেখা গেল পাত্রী যখন চা-এর ট্রে নিয়ে এল-পাত্র চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিতেই চিৎকার করে উঠল- ‘গলম, গলম।’ সাথে সাথে পাত্রীর খুব মায়া হল, সে বলল- ‘ফুৎ মালো, ফুৎ মালো।’

সাধারনত: গ্রামের বাড়িতে বড় বড় ঘর থাকে। ঘরের মাঝখান থাকে খালি-দু’পাশে হয়ত থাকে দু’টি পালঙ্ক। এক পাশের পালঙ্কে পুরুষেরা ঘুমায়, অন্য পাশটায় মহিলারা। নিশিরাতে ঘুমের মধ্যে রতন খাট থেকে পড়ে গেল, ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে মহিলাদের পালঙ্কে গিয়ে শুয়ে পড়ল। গ্রামের কিছু কিছু লোকের অভ্যাস এমন- ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানো, নাক ডাকা কিংবা নিজের লুঙ্গি ফেলে পাশের জনেরটা নিয়ে টানাটানি। এমনও দেখা গেছে-পাশের জনের লুঙ্গিটা নিজের দখলে নিয়ে এসে দিব্যি গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। আবার ওইসব ব্যক্তি একা ঘুমালে, সকালে জেগে লুঙ্গির খোঁজে প্রচুর সময়ও ব্যয় করে থাকেন।

অনেকে আছেন- কথায় কথায় বলেন- মানে, বিষয়টা হল, দেখুন, ব্যাপারটা হল, যা-তা ব্যাপার, নাকি কন, যেমন ধরুন, বলেন তো ইত্যাদি। আবার অনেকের অঙ্গ-ভঙ্গি বা মুদ্রা আছে যেমন- নাক খুটানো, চোখের পাতি মারা, আঙ্গুল ফুটানো, মাথা দোলানো, পা নাচানো, হাত-পা নেড়ে কথা বলা, নখ কামড়ানো কেউবা কথায় কথায় ‘ধুর-শালা’ বলতে না পারলে কথা বলাই যেন হয় না। এই যে আমি মানুষের মুদ্রাদোষ নিয়ে লিখছি-এর জন্য কিছু কিছু মানুষের ছিদ্রান্বেষন করতে হচ্ছে। এটাও হয়ত মুদ্রাদোষের মধ্যে পড়ে! অন্যের অনুকরন করাটাও এক ধরনের মুদ্রাদোষ। অনেকে আবার বাংলা-ইংরেজি গুলিয়ে কথায় কথায় বলেন- ঝঁঢ়ঢ়ড়ংব ধরুন, প্রতি উধরষু, ও ষড়াব ড়ৃঁ. আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিংবা আসছে আগামী ইত্যাদি। কেউ কেউ বলেন, ‘আমার আংকেল মানে মামা মিডল ইস্ট অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমার জন্য একটা গোল্ড চেইন অর্থাৎ সোনার হার পাঠিয়েছেন। কেউ বলেন- ‘আমি একসময় খুব ভাল ছাত্র ছিলাম ‘ওয়ান্স আই ওয়াজ এ ভেরি ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট। কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এবসোলিউটলি মিনিংলেস। শুধু তাই নয় এরা চান্স পেলেই আমার ফাদার মানে বাবা, আমার ওয়াইফ মানে স্ত্রী, বলে ইংরেজির পারদর্শীতা দেখায়। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রসঙ্গ পেলেই বলে ওঠে, আমার ফাদার বুঝেছিস, এতো অনেস্ট ছিলেন যে সারা জীবন এক পয়সাও ঘুষ খাননি। আবার বউপাগল লোকেরা কথায় কথায় ওয়াইফের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। প্রায়ই বলেন-‘আমার ওয়াইফ এতো ফাস্ট-ক্লাস রান্না করে যে একবার খেলে জীবনেও স্বাদ ভুলতে পারবেন না।

গ্রামের কিছু মহিলা গরমের রাতে হাতপাখা নাড়িয়ে বাতাস করতে করতে ঘুমিয়ে গেলেও ঘুমের মধ্যেই হাতপাখা নাড়াতে পারেন। এমনি এক মহিলা একটি কবরের পাশে বসে আনমনে বাতাস করছিলেন। পাশ দিয়ে যাওয়ার এক ভদ্রলোক থমকে দাঁড়ালেন, মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, কার কবর এটা? মহিলা বললেন- ‘আমার স্বামীর।’ শুনে ভদ্রলোক বললেন বাহ্! প্রেমের এমন দৃষ্টান্ত আমি এই প্রথম দেখলাম। বেঁচে থাকতেও সেবা করেছেন এখন মৃত স্বামীকেও একই ভাবে সেবা করে চলেছেন, সত্যি অসাধারন! মহিলা যেন একটু লজ্জিত হলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন- আসলে ঠিক তা নয় বিষয় হলো আমাদের গোত্রে স্বামীর কবর শুকানোর আগ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিয়ের নিয়ম নাই! তাই অগত্যা….

কোনো কোনো মহিলার মুদ্রাদোষ সরাক্ষণ সাজুগুজু করে থাকা। তেমনি এক মা কে চিনি- ‘এক মর্ডান মা তার ছেলেকে নিয়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলেন। রাস্তায় হাঁটার সময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টিতে মায়ের সব মেকাপ ধুয়ে গেল। বৃষ্টি থামার পর ছেলেটি তার মায়ের দিকে তাকালো এবং কান্না শুরু করে দিল। মা বলল- কাঁদছ কেন? কি হয়েছে? কান্নার স্বরে ছেলে বলল, আমার মা কোথায়? আমি মার কাছে যাবো।
আমরা অনেকে অনেক সময় নিজেই বলে ফেলি ‘ইয়ে, ইয়ের উপর থেকে ইশেটা দাও তো’। তবে এই ‘ইয়ে ইশে’ এতই কমন যে একে দোষ হিসেবে ধরাও অনেকে বাদ দিয়েছে ইদানিং। এক সময় যা তা বলতে ফালতু বুঝানো হত। ইদানিংকালের তরুনদের বিস্ময়, বিরক্তি, পুলক, ভয় সব ধরনের আবেগ প্রকাশের মত স্থিতিস্থাপকতা আছে এই দুই শব্দের।‘যা-তা’ যারা ব্যবহার করেন, তারা যা-তা লেভেলে, যা-তা জায়গায় যা-তা বলতে থাকেন। যেমন- এই দুই শব্দের একটাকে অনেকেই কথায় বাড়তি প্রয়োগ করেন। ‘আমি হচ্ছি গিয়ে জব করি, তুমি হলো তাকে বইলো ফোন করতে’ এমন কথা শোনা যায় প্রায়ই। সম্ভবত সবচেয়ে বেশি যেই ইংরেজি মুদ্রাদোষটা পাওয়া যাবে তা হচ্ছে ‘ওকে’।
মুদ্রাদোষের কিছু মিষ্টি শব্দ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রচলিত। যেমন- ও..গো, এই..শুনছো, কই..গেলে, ইত্যাদি। বাঙালি কায়দা এমন স্বামীরা বিয়ের দিন থেকেই কিংবা পরিচয়ের পর থেকেই স্ত্রীকে নাম ধরে ডাকতে পছন্দ করে। তারা ‘মল্লিকা’ কে ‘মলি’ সোনালিকে সোনা, নুরজাহানকে নুরী। এরাই আবার পরে শুরু করে- স্বর্ণার মা, অনিকের মা, পল্টুর বাপ, কানাইর বাপ বলে। এই ডাক মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বজায় থাকে। যাই হোক আপনাকে দিয়ে শুরু করেছিলাম। আপনাকে দিয়েই শেষ করতে হচ্ছে। আপনার লেখাটা কেমন হয়েছে বলতে পারছিনা। আপনারাই বলুন!

লেখক পরিচিতি : বিপ্লব চন্দ্র দত্ত
বাংলাদেশ ব্যাংক ময়মনসিংহ অফিসে যুগ্মপরিচালক হিসেবে কর্মরত। জন্ম-বাংলা 1374 সনের 20 কার্ত্তিক নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার ধারাম গ্রামে। শিক্ষাগত যোগ্যতা-এমবিএ(ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং)।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।