লেখক : দেবাশিস চৌধুরী
ঘুমোবার সময় নাক প্রায় সবারই ডাকে। কারুর কম, কারুর বেশি। কারুর স্পীড আবার মোবাইলের 3G বা 4G এমনকি 5G পর্যন্ত। মানে চোখ বুজলেই স্টার্ট। পৃথিবীতে আজ অবধি সৃষ্টি করা সব সুর পাওয়া যায় নাসিকা গর্জনে। সে মোজার্ট হোক বা বিঠোভেন বা আমাদের এ.আর. রহমান। কারুর আবার “একই অঙ্গে এত রূপ”, মানে বহু কুশল সঙ্গীত পরিচালকের সমন্বয়, এক সাথে। কারুর আবার ওয়েস্টার্ন অর্কেস্ট্রা পার্টি। যেন শাকিরার গানের পিছনে ঝ্যানাঝ্যান কান ফাটানো ম্যুজিক।
স্বামী ও স্ত্রীর একসাথে সমান তালে ডাকলে সংসারে কোন নালিশ বা গোল থাকে না। চিরন্তন শান্তিই শান্তি। নইলে নির্ঘাত দুজনের মধ্যে একজন রেগুলার বলতে থাকবেন ‘বাব্বাঃ ওর নাক ডাকার ঠেলায় রাতে ঘুমোবার যো নেই। সারা রাত জেগে থাকতে হয়।’ দ্বৈত হলে গাঢ় নিদ্রা, উভয়েরই।
একবার শ্বশুরবাড়ির এক শুভ অনুষ্ঠানে কয়েকটা দিন থেকে ছিলাম। ওনাদের আবার বিরাট জ্ঞাতি-গুষ্টি। সকালের ডেলি খাওয়াতেই খান চারেক বড় ব্যাচ বসে যেত। আমার গিন্নির ছোট মাসী-মেসোর আবার নাক ডাকার খুব সুনাম। গোটা বাড়িতে নাকি শোনা যায় সেই সিংহ নিনাদ, এমনটা শুনে ছিলাম। শুনে বেশ কৌতুহল হয়ে ছিল। প্রথম রাতে সবে একটু তন্দ্রা মতন এসেছে, এমন সময় শুনতে পেলুম গর্জন। যেন দুটো সিংহের সামনাসামনি লড়াই, কেউই ছেড়ে কথা বলতে নারাজ। একেবারে খন্ডযুদ্ধের মতন। ঘুম তখন আমার ছুটে গিয়েছে। বেশ মজাই লাগছিল। আমার মতন আরও দুজন উৎসাহী মিলে তখন উৎস খুঁজতে লেগে গেলুম। গিয়ে দেখি একটা ছোট ঘর থেকে গর্জনটা বের হচ্ছে।
আমার সঙ্গে আসা ছেলেটি জানাল, ‘নির্ঘাত ছোট মাসী আর মেসো।’
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল কানে হাত দিয়ে চাপা দিই। “কর্ণবিদারিত” বলে বাংলাতে একটা কথা শুনে ছিলাম। তার জ্বলন্ত উদাহরণ হাতে নাতে পেয়ে গেলুম। কানের পর্দা ফেটে যাবার যোগাড়। কিছুক্ষণ পর সুর পালটালো। এইবার রবিশঙ্কর আর আল্লা রাখার যুগলবন্দি। লাইভ কখনও শোনা হয়নি বলে জীবনে একটা আফশোস ছিল। সেটা বোধহয় পূরণ হল সেদিন। পাশে দাঁড়ানো ছোটমাসির বোনপোটি মাড়ি বের করে হেসে বলল, ‘বোধহয় দুজনেই পাশ ফিরেছে।’
মানেটা এইবার মাথায় ঢুকল। পাশ ফিরলে স্কেল বদলায়। হাই থেকে লো হয়। ভুল বললাম কি না কে জানে। আমি আবার সঙ্গীত বিশারদ নই কিনা। ঘুমের তখন আমার দফা রফা। জলসাটা আরও খানিকটা শোনার ইচ্ছে নিয়ে একটা চেয়ার টেনে ঘরের বাইরেই বসে পড়লাম। সঙ্গে আসা ছেলে দুটি তখন আমাকে “বেস্ট অফ লাক” বলে কেটে পড়েছে।
যুগলবন্দি শেষ হবার পর শুরু হল স্যাড ম্যুজিক। দুঃখের সিনেমাতে শেষ সীনে যেমন হয়। একটানা বেহালার ছড় টানা। মাঝে মধ্যে বাঁশি আর সেতার পুট করা। ঘরের ভিতরের সেই করুণ সুর শুনে চোখ ফেটে আমার জল বেরিয়ে আসার যোগাড়।
বাকি রাতটুকু ঘুমোবার চেষ্টার পরিকল্পনা করে উঠে পড়লাম। একটা বড় ঘর পেরিয়ে আসতে গিয়ে কানে এল ভিন্ন ভিন্ন ধরণের সঙ্গীত। বেশ আবেগ মাখা। পাত্রগুলিকে আবিষ্কার করার জন্য ঘরে প্রবেশ করি। একটা নাইট ল্যাম্প জ্বলছিল। বেশ উজ্জ্বল। ডরমিটরির মতন ঢালোয়া বিছানা পাতা। সারি সারি মাথা। দেখি গিন্নির সেজ আর ছোট মামা জগাই মাধাইয়ের মতন পাশাপাশি শুয়ে, গলা জড়াজড়ি করে গান গাইছেন, থুড়ি নাক ডাকছেন। আহা কি খাসা দ্বৈত কণ্ঠ। যেন কিশোরকুমার আর লতা মঙ্গেশকরের ডুয়েট। “গাতা রহে মেরা দিল”। এ থামে তো ও শুরু করে। ও থামে তো এ।
এক পাশে একটি ফোল্ডিং খাটে শুয়ে বয়স্ক এক আত্মীয়। দাঁত তাঁর কবে অল আউট হয়ে গিয়েছে। দু পাটিই বাঁধানো। সেটি আবার তিনি শোবার আগে খুলে একটা জলের বাটিতে ভিজিয়ে রাখেন। আধো অন্ধকারে তেনাকে দেখি বিশাল হাঁ করে শুয়ে আছেন। যেন গভীর পাতকুয়ো। সেই পাতকুয়ো থেকে বেরিয়ে আসছে বিচিত্র এক শব্দ। ঠিক যেন উনুনে বসানো টগবগ করে ফোটা চায়ের জল।
এক কোণাতে গুঁড়িসুড়ি মেরে শুয়ে মধ্যবয়স্ক এক জামাই। তিনি আবার নাক ডাকার সাথে সাথে অভিনয়ও করছিলেন। মুখমণ্ডলের ভাব কখনও একটা ভুরু তুলে ছবি বিশ্বাস, কখনও মনমোহিনী হাসি ছুঁড়ে উত্তমকুমার, কখনও বা গ্ল্যামারাস প্রসেনজিত, আবার হালের প্রেমিক মার্কা চাহনিসহ দেবও বাদ যায়নি। এক এক নায়কের সাথে তাল দিয়ে এক এক মিউজিক।
পরের রাতে, সৌভাগ্যই বলুন আর দুর্ভাগ্যই বলুন আমার শোবার স্থান হল গিন্নির ছোটমেসোর সাথে ঐ ছোট ঘরটাতে। মেসোর বেশ গোলগাল নাদুসনুদুস চেহারা। বিশাল ভুঁড়ি। প্রচন্ড হাসেন। হাসার সময় ভুঁড়িটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। হাসি থামার বেশ কয়েক সেকেন্ড পর ভুঁড়ির কাঁপুনি থামে। কষে ব্রেক মারার পর গাড়ি হড়কে কয়েক কদম আগে যাওয়ার মতন।
এক প্রকার জোর করেই মেসোকে দেওয়ালের দিকে শোওয়ালাম। ঘর অন্ধকার করে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে দিই। হালকা আলোতে ঘরটা মনে হচ্ছিল যেন “জোছনা ভরা”। মেসো শুরু করে দিলেন হাসির গপ্পো। আমি হাসার আগে নিজেই বেদম জোরে সেই ভুঁড়ি কাঁপানো হাসি হাসছিলেন। পরণের গেঞ্জি তখন উঠে গিয়ে ব্লাউজের আকার নিয়েছে। আমি হাসব কি দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল সেই কাঁপা পুরুলিয়ার পাহাড়ের দিকে। পাহাড়কে কোনদিনও দুলতে দেখিনি। মনে হল স্বচক্ষে তারও দর্শন হল। বহুকাল আগে শোনা রেডিওতে রাত ৯-৫০এর খবর পড়ার মত একটানা বকবকের পর আর কিছু শুনতে পেলাম না। কয়েক সেকেন্ড বিরতির পর বিকট একটা গর্জন কানে এল। প্রমাদ গণলাম। বুঝতে পারলাম সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। চট করে মনে পড়ে গেল বোনপোটির কথা – পাশ ফিরলে লো স্কেল। মা কালীর নাম স্মরণ করে সর্ব শক্তি দিয়ে ঠেলেঠুলে মেসোর বিশাল চেহারাটাকে পাশ ফেরালাম। যন্ত্র বিকল হওয়ার মতন “ঘড়াক” করে একটা শব্দ বের হয়ে চারিদিক শান্ত হয়ে গেল। ঘাবড়ে গেলুম। এই রে, কিছু হয়ে যায়নি তো? আমার আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করে শুরু হল লাইট ম্যুজিক। এবার আর “গাতা রহে মেরা দিল” নয়। শোলের সেই বিখ্যাত ম্যুজিক “সুঁ-উ-উ, কিতনে আদমী থে?” ধড়ে প্রাণ এল। অদ্ভুত সেই লাইট ম্যুজিক বরদাস্ত করতে লাগলাম। ইনপুটের এক আর আউটপুটের আরেক। মানে ছাড়বার আর টানবার আলাদা আলাদা।
ধ্যুত্তেরি বলে বিছানা ছেড়ে উঠে সামনে রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। এরপর দেখি মেসো উপুড় হয়ে শুয়ে। ঠিক যেন পার্কের বাচ্চাদের ঢেঁকি, ভুঁড়িটা ফালক্রাম। পুরো শরীরটা ঢেঁই-কুঁচ-কুঁচ করছে। নাসিকা গর্জন প্রমাণ করে দিল যে তিনি গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। এরপর হেন মণীষী নেই যে ঘুমের ঘোরে মেসো তাঁদের পোজ দেননি। কখনও হাঁটু মুড়ে গান্ধীজী, কখনও বগলে হাত দুটো গুঁজে স্বামীজী। এক সময় পিছনে হাত রেখে কবিগুরু। আঙুল তুলে সামনে দেখিয়ে নেতাজী, দিল্লী চলো। শেষমেশ সটান বিছানাতে দাঁড়িয়ে গেলেন, একটা হাত উপরে তুলে, এইবার শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। আমি হাঁ করে অবাক হয়ে মেসোর কান্ডকারখানা দেখেছিলুম আর ভাবছিলুম করছে কি ভদ্রলোক। এদিকে উনি কিন্তু ঘুমন্ত, আর যথারীতি ভিন্ন ভিন্ন সুরে নাকও ডেকে চলেছেন।
এক সময় কুস্তিগিরদের আছাড় দেবার মতন দড়াম করে বিছানাতে আছড়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ ধরে ঐ ছোট খাটটাতে একটা ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম ভেঙ্গে না পড়ে। আমার আশঙ্কাই সত্য হল। মড়মড় করে দেওয়ালের দিকটা ভেঙ্গে পড়ে। দুটো পায়া আলাদা। মেসো গড়িয়ে দেওয়ালে আটকে যায়। ব্যস্ত হয়ে তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে ওনাকেে উদ্ধার করতে যাই। গিয়ে দেখি ঐ অবস্থাতেও তিনি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। এবারে বাপী লাহিড়ির ঝিকিমিকি ডিস্কো ম্যুজিক “আই এম এ ডিস্কো ড্যান্সার”।
অত ভারী দেহ টানা ছিল আমার মতন চামচিকের সাধ্যের বাইরে। তাই আস্তে ডাক দিলাম, ‘মেসো’। কোন জবাব না পেয়ে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলাম। আচমকা ঘুম ভাঙ্গতে উনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন ‘কৌন হ্যায়? কৌন হ্যায়?’ কে জানে স্বপ্নে উনি হিন্দী সিনেমা দেখেন কিনা। আচমকা ঘুম ভাঙলেই শুনেছি হিন্দী ডায়লগ ঝাড়েন। তারপর বেশ কিছুক্ষণ লাগল ওনার ধাতস্থ হতে। ঘষটে ভাঙ্গা গড়ানে খাট পার হয়ে আসতে গিয়ে ঘটালেন আর এক বিপদ। অবশিষ্ট দুটো পায়াও জবাব দিয়ে দিল। সিঙ্গল খাট তখন চার পায়া ভেঙ্গে ফ্ল্যাট। কোনরকমে হামাগুড়ি দিয়ে লুঙ্গি সামলে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি করে ভাঙ্গল?’ কি করে আর ওনাকে রাতের শোয়ের কথা বলি যা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। জবাবে শুধু বলে ছিলাম, ‘ইঁদুরে বোধহয় পায়াতে লাথ ঝেড়ে ছিল।’
পরের রাতে আর রিস্ক নিইনি। ছাদে, খোলা আকাশের নীচে, তারাদের মাঝে, একটা সতরঞ্চি বিছিয়ে আরামসে ঘুমিয়েছি। নাক ডেকেছি কিনা বলতে পারব না। কারণ সাক্ষী তো কেউ ছিল না।
লেখক পরিচিতি : দেবাশিস চৌধুরী
দীর্ঘকাল কর্মসূত্রে আমি লখনৌতে প্রবাসী। গল্প লেখাটা আমার একটা প্রিয় সখ। আমার গল্প পড়ে সবার মনোরঞ্জন হোক, এটাই আমার কামনা।