পুজোর চিঠি – অষ্টমী

লেখক – অতনু সাঁপুই

অষ্টমীর চিঠি।।
বিয়াস,
মাঝেমাঝে ভাবি, মান ভাঙানো এখন কত সহজ। মেসেজ করে সরি বলা যায়। হোয়াটসঅ্যাপে অনুনয় বিনয় করা যায়। ভিডিও মেসেজ পাঠানো যায়।

আহা রে! আগে যদি এ সব থাকতো, আমাদের সে বারের সেই অষ্টমীর দিনটা আরও ভালো হতে পারতো। সেই যে সে বার.. যে অষ্টমীতে রিহার্সাল নিয়ে আমাদের ধুন্ধুমার হল। একটাই ক্লাবঘর। সন্ধেয় তোমাদের রক্তকরবী। তার আগে ফাইনাল রিহার্সাল। তুমি নন্দিনী। আমাদের আবার কেনারাম বেচারামের শেষ সিনটা একবারও রিহার্সাল হয়নি। নবমীতেই স্টেজ। তাও তো ভাগ্যিস, বাচ্চাদের অবাক জলপান আগের দিনই হয়ে গিয়েছিল। তোমার সঙ্গীদের আগেই বলে দিলাম, -“যাও, যাও। তোমরা পরে রিহার্সাল কোরো। এখন ডিসটার্ব কোরো না।” তুমি শুনে বললে,-“তোদের দাদাকে বলে দে, এখনই ঘর না ছাড়লে আজ রক্তকরবী হবে না।” পিউ, মৌ, ডিম্পিরা যখন সবার মাঝখানে এসে তোমার বার্তা শোনালো। বুড়ো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, -“ওহ্! বিয়াস এটা বলতে বলেছে। তা হলে আর আমাদের রিহার্সাল আজ হবে না। ওর কথা না মেনে উপায় আছে?” হেব্বি রাগ হলো। ঘর ভর্তি ছেলেপুলের সামনে আমার এত অপমান! দরকার নেই রক্তকরবী হওয়ার। রেগেমেগে মেয়ের দলের সামনে যেতে না যেতেই কোমর
বেঁধে এগিয়ে এসে বললে,-“তোমাদের তো কাল স্টেজ। আমাদের কেন আগে ছাড়ছো না। আবার বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের এ সব কী বলেছো?” আমি
কিছু বলে ওঠার আগেই আবার শুরু হল। -“তুমি এটুকু কম্প্রোমাইজ করতে পারো না? না কি চাও না আমাদের পারফরম্যান্স তোমার তোমাদের থেকে ভালো হোক। তুমি কি আমায় হিংসে কর? না কি তুমি যে আমার উপর খবরদারি করতে পার, সেটা প্রমাণ করতে চাইছো? বেশ। তবে তাই হোক। সবাই জানুক, তুমিই জিতেছো। করে নাও রিহার্সাল। আমরা অপেক্ষা করব।”

রিহার্সাল শুরু হল বটে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম, এর থেকে না হওয়া ভালো ছিল। একের পর এক পার্ট ভুল। জানা ডায়ালগে হোঁচট। কোনওমতে শেষ করলাম রিহার্সাল। এবার তোমাদের পালা। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল, তোমারও কি একই হাল? কিন্তু দেখার উপায় যে ছিল না। মেয়েরা ঢোকার পরই ক্লাবঘরের দরজা সশব্দে বন্ধ করে দিলে তুমি। নিজেই। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ ক্লাবঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম, এ অষ্টমীতে কষ্ট আছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। স্টেজের পিছনের গ্রীনরুম থেকে তখন খিলখিল হাসি আর চুড়ির রিনিরিনি পাল্লা দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। বিঁধিয়ে যাচ্ছে লক্ষ কোটি সূঁচ..। সেই তুমি ভুল বুঝলে। এমনভাবে ভাবতে পারলে। পারলে বলতে, আমি চাই না তোমার পারফরম্যান্স ভালো হোক? ধীরে ধীরে সেজে উঠল অষ্টমীর সাঁঝবেলা। ঢাকে পড়ল কাঠি আর বুকের ভিতর বাজ। কোনওদিন আমার সঙ্গে দেখা না করে স্টেজে ওঠো না। আজ কি তবে নিয়ম ভাঙার বেলা? এমন কী করলাম, যার জন্য এই শাস্তি? বরাবরের অভ্যস্ত হাত সন্ধ্যারতির ধুনুচি জ্বালাতে গিয়ে জ্বলে পুড়ে একসা। এ দিকে তখন আবার বুড়ো বাবলুদের ‘অতল জলের আহ্বান’। মন ভালো নেই বিয়াস। মন ভালো নেই। এর থেকে ভালো বরং বুড়ো বাবলুদের ডাকে সাড়া দেওয়া। যদি জ্বালা জুড়োয়। সবে দু পাত্তর.. এমন সময়ে পিঙ্কির আগমন। -“কখন থেকে খুঁজছি। কোথায় ছিলে? বিয়াসদি ডাকছে তোমায়।” বিয়াস ডাকছে? তাহলে কি? নাকি এখনও কিছু শোনার বাকি আছে।

স্টেজের পিছনে বেলফুল আর রজনীগন্ধার গন্ধে মোড়া আমার বিয়াস। -“তোমার কি কোনওদিন আক্কেল হবে না? কখন থেকে হন্যে হয়ে খুঁজছি। একবার বলে যেতে হয় তো। তুমি জানো না, তোমায় না দেখে আমি স্টেজে উঠতে পারি না? নাকি ইচ্ছে করে আমায় কষ্ট দাও। শোনো, রাতে মিন্টুদা-র দোকানে চাউমিন বলে রেখো, প্লিজ। একসঙ্গে খাব। আর শোনো, বাবলু দা, বুড়োদা দের ডাকে সাড়া দেওয়ার দরকার নেই। মনে রেখো, তোমার নন্দিনী স্টেজ থেকে তার রঞ্জনকে খুঁজবে। নন্দিনীর রঞ্জন যেন সামনের দিকের চেয়ারে থাকে…… “

বিয়াস, আমি নন্দিনীর রঞ্জন হয়েই থাকতে চেয়েছিলাম..

শুভ অষ্টমী।।


সংবাদমাধ্যমে ১৯ বছর কাটিয়ে ফেলা মামুলি ছাত্র। নিরন্তর পাক খেতে থাকা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলা শহুরে ফকির। ফ্যাতাড়ু না হতে পারার আক্ষেপ নিয়ে যার অহর্নিশ যাপন। রোজ রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁজতে চাওয়া বোকাসোকা ছাপোষা.. “যা দেখি, সেটাই সত্যি? নাকি রাষ্ট্র যা দেখাতে চায়, আসলে অভ্যস্থ চোখে আমরা তাইই দেখি? যা সত্য, তা যে সত্য তা বুঝবে কেমনে? “

আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< পুজোর চিঠি – সপ্তমীপুজোর চিঠি – নবমী >>

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন