পুজোর চিঠি -দশমী

লেখক : অতনু সাঁপুই


দশমীর চিঠি।।

বিয়াস,
তোমার বিয়ের পর আমিও আর ওই পাড়ায় থাকতে পারিনি। একটা চাকরি জুটিয়ে পালিয়েছিলাম কানপুর। বছর চারেক পর ফিরেছিলাম কলকাতায়, তবে পাড়ায় নয়। ততদিনে রাজার হাটের একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে মা-বাবা উঠে গিয়েছিলেন। আমিও সঙ্গী হলাম। নতুন পাড়ায় পুজোর নতুন গন্ধ । কিন্তু পুজোর পুরনো গন্ধ ভোলা আমার আর হল না। ষষ্ঠীতে পায়ে ব্যান্ড-এড। তাই মোড়ের মাথার ফুচকা শুধু। তার বেশী নয়। সপ্তমীতে তোমার বেমক্কা প্রশ্ন-” মেয়ের নাম অঙ্গীরা রাখলে কেমন হয়?”
অষ্টমীতে তোমার দিদি জামাইবাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া।
নবমীতে এক প্লেট চাউমিন-চিলি চিকেন ভাগ করে খাওয়া।

এ সব ভুলবো কী করে? তাই ফেলে আসা আমার ওই মধ্যবিত্ত আবাসনে আর যাইনি। ওখানকার পুজোর সঙ্গে তোমার ভেজা চুল-আইলাইনার আর রুমালে লিপস্টিকের দাগ একাকার হয়ে আছে। কিন্তু গত বছর না গিয়ে পারলাম না। হ্যাঁ। গত বছর দশমীতে বাবলু-বুড়োদের “একবার আয় না, কতদিন বসা হয়নি”-তে সাড়া দিয়ে গিয়েছিলাম ও পাড়ায়। ওরা এখনও ওখানেই থাকে। অসুবিধা হয় না। ওদের তো বিয়াস ছিল না। তাই বিয়াসের না থাকাটাও প্রভাব ফেলে না। গিয়ে দেখলাম, বদলায়নি কিছুই। মাঠের ঘাসগুলো বেড়েছে একটু। আজকাল কেউ বোধহয় খেলে না। মাঠের পাশের গাছটা একই রকম ঘাড় হেলিয়ে। মিন্টুদা-র চাউমিনের দোকানটা এখনও আছে। মিন্টুদা-র ছেলে বসে। বুড়ো-বাপী-বাবলু.. কারও চুল কিছুটা ফাঁকা.. কারও চশমা.. কারও সুগার। শঙ্কু মারা গিয়েছে বছর দুয়েক আগে। তোমাদের জানালায় আলো। দেখে বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। তবে কি? এত বছর পরে আবার একবার তোমার দেখা… .. থাক্। এর মাঝে তো কোনওদিন তোমার কোনও.. যতবার রাস্তায় বাবলু-বুড়োর সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওরা তোমার ব্যাপারে কিছু বলতে গেলেই অন্য কথায় চলে যেতাম। ওদের চোখেও বোধহয় স্পষ্ট ধরা পড়ত আমার অস্বস্তি। পাঁচিলের ধারের স্ল্যাবের বেঞ্চে বসলাম না এবার। বাবলুর বাড়িতেই। দুটো গল্প-চারটে কথার মধ্যে দেখি উসখুস করছে দুটোয়। চেপে ধরলুম। বললে,-“তুই একটু বোস। আসছি..” একা বসে কী করব ভাবতে না ভাবতেই দরজায় দেখি.. তুমি। বিয়াস, বিশ্বাস কর সেদিন আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েও যেতে পারতো। -” চিরকালের একগুঁয়ে। ডাকলে তো আসবে না। খোঁজই নাওনি কোনওদিন। তাই বাবলুদা-কেই বললাম।” বিয়াস, তোমায় প্রথম দেখেছিলাম কোনও এক ষষ্ঠী সকালে। আজ এত বছর পর দেখছি, বিজয়ার পর। অনুভূতিটা তো এক হওয়ার কথা নয়। সেদিন ছিল, কিশোরীর স্বপ্নে ভাসা চোখ। আজ নারীর পূর্ণতার আভিজাত্য। তোমায় নতুন করে দেখার অনুভূতিটা তো এক হওয়ার কথা নয়। তবুও কেন সেদিনের সেই বোবা হয়ে যাওয়া কিশোর আজ এখনও একইভাবে কথা হাতড়ে মরছে? আর বরাবরের মতো এবারও তুমিই বলে চললে।-“ঠিকই বলেছিল বুড়ো দা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কোলেস্টেরল আর বিপি আকাশ ছুঁয়েছে। মরি বাঁচি বোহেমিয়ানা ষোলোআনা। কেন একটু সামলে চললে কি পৌরুষত্ব কমে যায়? বয়স তো কম হল না।” বয়স তোমারও হয়েছে বিয়াস। এখন আর আগের মতো অভিনয় করতে পারো না। এখন চোখের দিকে তাকালে কথা হারিয়ে ফেলো আমারই মতো। নাকের ডগায় জমে ঘাম। কপালের টিপ লাল ছড়ায় দুই গালে।

সেদিন কতক্ষণ মুখোমুখি বসে দুজনে মিলে বাবলুদের ঘরের ফ্যানের শব্দ শুনেছিলাম মনে নেই। তখন মনে হচ্ছিল, ওই ফ্যানটাই বুঝি একমাত্র চলছে। সারা দুনিয়ায় আর বাকি সব থেমে আছে। আচমকা বেরিয়ে গেলে। এলে যখন, সঙ্গে একরত্তি মেয়ে একটা ফুলের মতো।- “আমার মেয়ে। অঙ্গীরা।” একছুটে পালালো অঙ্গীরা। বোধহয় প্রমাণ করতে চাইল, তোমারই মতো। তুমি বলে চললে, “ওকে আমি তোমার.. মানে আমাদের গল্প বলি। বলি, তুমি আমায় ঘুড়ি ওড়াতে শিখিয়েছিলে। কেমন করে আমরা দোল খেলতাম। আমার হাতে মেহেন্দি লাগানোর পর কীভাবে তুমি রিকশ-য় তুলতে..।” থামলে তুমি। অজান্তে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল- “আর?” “আর?.. আর .. বড় হলে বলবো, ছাদের ঘরে রাখা থাকতো, ঘুড়ি লাটাই.. জানালা বন্ধ থাকতো ঘরের। বলবো, স্কুলঘরে পালাতাম রঙ মাখবো না বলে। তুমি তাড়া করে আসতে। বাকিরা বাইরে পাহারায়। আরও বলবো, মেহেন্দি করে ফেরার পথে বৃষ্টি পড়ছিল। মেহেন্দি যাতে ভিজে না যায়, রিকশাকাকু আমাদের রিকশটা পুরোটাই ঢেকে দিয়েছিল….।”

খুব জ্বর হলে একটা ঘোরের মধ্যে থাকতে হয়। সে রকম একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। জ্বর এসেছিল কি? না হলে এত ঘামলামই বা কেন? ঘোর কাটল। বললে,-“খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তোমায়। তোমার বিয়াস ভালো আছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত ভালো থাকার চেষ্টা করি। আমাকে যে ভালো থাকতেই হবে। অনেক বছর আগে এমনই এক দশমীতে কেউ কথা দিয়েছিল, আমি ভালো থাকলেই সে ভালো থাকবে। তার ভালো থাকার জন্য বিয়াসকে যে ভালো থাকতেই হয়। তোমার জন্য তোমার বিয়াস ভালো থাকতে শিখছে রোজ রোজ। নতুন করে। যাতে তুমি ভালো থাকো।”

ফেরার সময় আগের মতোই পাপ্পুর দোকান থেকে সিগারেট কিনছিলাম। কিছুটা দূরে দুটো অল্পবয়সী আবছায়া অবয়ব। কানে এল-“তোমার বন্ধুরাই তোমার সব। এত করে বললাম তাও আজ দেরী করে এলে। এবার কাল থেকে তো আর দেখাও করতে পারবো না। মা বলেছে, এবার থেকে কোচিং-এ মা সঙ্গে যাবে.. ..”

এই শহরে সবার কাছে ।।
একটা করে বিয়াস আছে ।।


লেখক পরিচিতি : সংবাদমাধ্যমে ১৯ বছর কাটিয়ে ফেলা মামুলি ছাত্র। নিরন্তর পাক খেতে থাকা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলা শহুরে ফকির। ফ্যাতাড়ু না হতে পারার আক্ষেপ নিয়ে যার অহর্নিশ যাপন। রোজ রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁজতে চাওয়া বোকাসোকা ছাপোষা.. “যা দেখি, সেটাই সত্যি? নাকি রাষ্ট্র যা দেখাতে চায়, আসলে অভ্যস্থ চোখে আমরা তাইই দেখি? যা সত্য, তা যে সত্য তা বুঝবে কেমনে? “

আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< পুজোর চিঠি – নবমী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum