পুজোর চিঠি – সপ্তমী

লেখক : অতনু সাঁপুই

বিয়াস,
আজ সপ্তমী। একবার সপ্তমীতে কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি! সকাল থেকে বৃষ্টি হয়ে দুপুরের পর কাদা আর জল। এদিকে আবার সেদিন আমাদের ঠাকুর দেখতে যাওয়ার কথা। দুপুরে একবার ক্ষনিকের দেখায় মন বোঝার চেষ্টা করলাম। “আজ কী না বেরোলেই..” তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বাকি কথাটা গিলে ফেললাম। কম দিন তো চিনি না তোমায়। ও চোখের শাসন-বারণ-অভিমান-অনুরাগ আমার নখদর্পণে। আসলে তুমি তো ঠিক ঠাকুর দেখতে বেরোতে চাওনি। পুজোর ছলে, চেনা।
চোখের ভিড়ের থেকে একটু দূরে.. চেয়েছিলে সপ্তমীর সন্ধে কাটাতে আমার সঙ্গে। আমিও কি চাইনি? কিন্তু ওই হতচ্ছাড়া বৃষ্টি যদি তোমার শাড়ির আঁচলের কণাটুকুও ভিজিয়ে দেয়। তাও কি আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব? হ্যাঁ। সেদিন তুমি শাড়ি পরবে বলেছিলে। তসর। আমার পছন্দের।

অগত্যা সেই বাজে কাজটা করতে হল। বাড়ির সবাই অবাক। অবাক কৃষ্ণা বৌদি। বুড়ো বাবলুরা। আর আমি…. লজ্জায় মাটিতে মিশে যাই আর কি। সেই প্রথম আমি বাড়ি থেকে বেরোলাম ছাতা হাতে নিয়ে। স্কুল-কলেজেও কোনওদিন নিইনি। হয় রেনকোট, নয় উইন্ডচিটার। সেই প্রথম ছাতা হাতে। তোমার জন্য। কিছুই হয়নি ভাব করে একবার তোমাদের ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে হনহন করে হাঁটা দিলাম মোড়ের মাথায়। এবার অপেক্ষা। তুমি আসবে বলে..। এলে তুমি। টিপ টাপ টুপ গায়ে মেখে। কেউ পরাতো না। তুমি নিজেই পরতে শাড়ি। জেনেই বোধহয় আরও বেশী ভালবেসে ফেলেছিলাম একদিন। তসরের সঙ্গে সে দিনের সেই লাল টিপ আর হাতের বালা। তোমার মায়ের। আলোয় সাজা স্যাঁতস্যাঁতে সপ্তমীর সন্ধেয় মনে হল, তোমায়
নিয়ে মঙ্গলে পালিয়ে যাই। তখন চন্দ্রবিন্দু বলতো, “মঙ্গলে নাকি মানুষ থাকে না..”। তাহলে আর ভয় কিসের। তুমি আমি দোঁহে মিলে গড়ব সংসার। পাগলী তোমার সঙ্গে মাঙ্গলিক জীবন কাটাব। পাগলী তোমার সঙ্গে ভিখ মেঙ্গে কাটাব জীবন। ঘোর কাটল তোমার কনুইয়ের আলতো ঠেলায়।- “মোড়ের মাথায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে?” চিরতার জল নয়। বিশ্বাস করো, কানে যেন সত্যিই মধু ঢেলে দিল। এই তো গতকাল দেবু দা বলছিল, বৌদি না কি দেবুদাকে এভাবেই বলে।

জোর করে তুললে ট্যাক্সিতে। খুব অভিমান হল। বিয়াস তুমি জানো, আমার হাতে তখন ছাত্র পড়ানো ওই ক’টা টাকা। তবুও….। ট্যাক্সিতে উঠে গাল টিপে বললে, ” মেজোমামা এসেছিলেন। দিয়ে গেলেন পুজোর হাতখরচা তাঁর আদরের বোনঝিকে।
আচ্ছা, আমার টাকা কি আমাদের দুজনের নয়?” কী আর বলবো। গম্ভীর স্বরে বললাম,”বেশ। তবে মনে থাকে যেন। এর পরের খরচ সব আমিই করব।” মাটন রোল, বিজলিগ্রিলের আইসক্রিম, বাগবাজারে চা আর হ্যাঁ.. ঘটি গরম দশ টাকার। মনে আছে, সেদিন আমরা কোনও ঠাকুরই দেখিনি। (আর ছাতাটা ভুল করে ট্যাক্সিতেই ফেলে এসেছিলাম)

কখনও বৃষ্টি কখনও আবছায়া সন্ধেতারা। সপ্তমী সন্ধেয় ট্যাক্সির ব্যাকসিটে দুই মঙ্গল গ্রহের প্রাণী। এই জাগতিক লেনদেনের অনেক ঊর্দ্ধে.. আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে.. টাইম মেশিনে পাড়ি দিয়ে.. চোখের নিমেষে বানিয়ে ফেলেছিল ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। রোজ সকালে বায়না করব। ঠেলে পাঠাবে অফিসে। ফিরব বিকেলে ব্যালকনিতে তোমায় দেখব বলে। সপ্তাহে একদিন সিনেমা, বাইরে খাওয়া। ছেলের নাম কী হবে। মেয়েকে আঁকার স্কুলে কে নিয়ে যাবে। পুজোর ছুটিতে দার্জিলিং। বড়দিনে দীঘা। আঙুলে আঙুল পেঁচিয়ে এক বেকার বাঙালি আর এক নারী হয়ে ওঠা মেয়ে বুনে চলেছে স্বপ্নের সোয়েটার…

চাতক নাসা মঙ্গলে জলের হদিশ পেতে আজও মরিয়া। এখনও মঙ্গলে মানুষ থাকে না বিয়াস…

শুভ সপ্তমী।


লেখক পরিচিতি : সংবাদমাধ্যমে ১৯ বছর কাটিয়ে ফেলা মামুলি ছাত্র। নিরন্তর পাক খেতে থাকা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলা শহুরে ফকির। ফ্যাতাড়ু না হতে পারার আক্ষেপ নিয়ে যার অহর্নিশ যাপন। রোজ রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁজতে চাওয়া বোকাসোকা ছাপোষা.. “যা দেখি, সেটাই সত্যি? নাকি রাষ্ট্র যা দেখাতে চায়, আসলে অভ্যস্থ চোখে আমরা তাইই দেখি? যা সত্য, তা যে সত্য তা বুঝবে কেমনে? “



আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< পুজোর চিঠি – ষষ্ঠীপুজোর চিঠি – অষ্টমী >>

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন