লেখক: অয়ন মৈত্র
রবীন্দ্রনাথের অনেক পরিচয়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, চিত্রকর ও আরও কত কি! কিন্তু তাঁর এই বিপুল প্রতিভাময় পরিচয়ের আড়ালে এক অসাধারণ রসিক মানুষ বসবাস করতেন সে সম্পর্কে বাঙালি কমই জানে। তাই বোধহয় তিনি নিজেই বলে গেছেন একজায়গায়- “এতো বুড়ো কোনো কালে/হবো নাকো আমি,/হাসি তামাশারে যবে কবো ছ্যাবলামি।” আসুন রসিক রবীন্দ্রনাথের তেমনি কিছু ঘটনার কথা এখানে ভাগ করে নেওয়া যাক।
১. রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছের জন ছিলেন ড: কালিদাস নাগ। তাঁর মামার কোয়ার্টার ছিল চিড়িয়াখানায়। তিনি সেখানেই থাকতেন। তাঁকে একবার চিঠি পাঠাতে গিয়ে খামের ওপরে ঠিকানা হিসেবে লিখলেন :
“To
Dr. Kalidas Nag
Zoological Gardens
(Human section)”
২. একদিন কবি তাঁর ভক্তদের নিয়ে গল্প করছেন। সেখানে ইংরেজদের কথা উঠতে তিনি বললেন ইংরেজরা নিজেরাই নানান দোষে দোষী। অথচ তারাই আবার পরের নিন্দা করে বেড়ায়। সেই শুনে এক শ্রোতা খুব খুশী হয়ে বলে উঠলেন- জানেন গুরুদেব পূর্ববঙ্গে একটা কথা প্রচলিত আছে-“সকল পক্ষী মৎস্যভোক্ষী শুধু মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী।”
রবীন্দ্রনাথ খুব তারিফ করেন ছড়াটার। তারিফ শুনে ওই শ্রোতা আরও উৎসাহিত হয়ে কবিকে অনুরোধ করলেন কবিকে ছড়াটা মিলিয়ে লাগসই আরও দুলাইন লিখে দিতে। কবির হাতের কাছে কোন কলম ছিলনা। কলম খুঁজতে গিয়ে কবির চোখে পড়ে শ্রোতাদের মধ্যেই কেউ কলম ফেলে গেছেন। কবি সেই কলম দিয়েই লিখে দিলেন-“সকল পক্ষী মৎস্যভোক্ষী শুধু মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী।/সবাই কলম ধার করে নেন, আমিই ক্যানবা কলম কিনি?”
৩. রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন সুধাকান্ত রায়চৌধুরী। একদিন তিনি দেখেন কবিগুরু এক পায়ের মোজা খুলে ফেলে খুব করে পায়ের তলা চুলকোচ্ছেন। অবাক সুধাকান্তবাবু কবিকে জিগেস করেন- ব্যাপারটা কি? উত্তরে কবি বললেন- “চরণকমল, চরণপদ্ম, পাদপদ্ম এসব পদকীর্তন কতবার শুনেছি, কিন্তু পা-কে কেন পদ্ম বলে আজ সেটা ভাল করে বুঝলাম। অন্যের পদ পদ্ম কিনা জানিনা তবে রবি ঠাকুরের চরণ যে পদ্ম তাতে আর কোন সন্দেহ রইল না- তা নাহলে এত জায়গা থাকতে, মোজা ভেদ করে মৌমাছিটা এসে আমার ঠিক পায়ের তলাতেই হুল বিঁধিয়ে দিলে!”
৪. কবি একবার ঢাকা গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে। কবির সেখানে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল একটি বজরায়। এখন সেই বজরায় ওঠার একমাত্র পথ ছিল একটা সরু কাঠের পাটাতন। একবার কবি ওই পাটাতন ধরে বজরায় উঠতে যাচ্ছেন, চারুবাবু সাবধান করে বললেন- “দেখবেন, মাত্র একটা কাঠ দিয়ে উঠতে হবে।”
তৎক্ষণাৎ কবির উত্তর- “হ্যাঁ, দেখতেই পাচ্ছি এটা ‘জোড়া সাঁকো’ নয়।”
৫. এক সভায় সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন একবার। শ্রোতাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন সেখানে। বক্তৃতা শুনে সবাই বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এর খুব প্রশংসা করছিলেন। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন -“বলাই তো ভালোই বক্তৃতা দেবে, ওর নাম যে বলাই, বলাই তো ওর কাজ।”
৬. রবীন্দ্রনাথ পিঠেপুলি খেতে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর অনেক ভক্তই গুরুদেবের এই পছন্দের বিষয়টা জানতেন। একদিন এক মহিলা তাঁর হাতে তৈরি পিঠে কবিগুরুর জন্য পাঠিয়ে দেন। পরে একদিন গুরুদেবের কাছে এসে জানতে চাইলেন তার নিজে হাতে তৈরি পিঠে গুরুদেবের কেমন লেগেছে। উত্তরে কবি বললেন- “লোহা কঠিন, পাথর কঠিন/আর কঠিন ইষ্টক।/তার অধিক কঠিন কন্যে/তোমার হাতের পিষ্টক।”
৭. দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস দার্জিলিংয়ে মারা গেলে তাঁর মরদেহ কলকাতায় এনে সৎকার করার ব্যবস্থা হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন ইনফ্লুয়েঞ্জায় কাবু। ডাক্তার পশুপতি ভট্টাচার্যকে ইনজেকশন দিতে ডেকেছেন। গিয়ে দেখেন সেখানে বিধান রায় দাঁড়িয়ে। সাথে চিত্তরঞ্জনের একটা ফটো। বিধান রায় ছবিটা কবির হাতে দিয়ে বললেন- এই ছবিটাকে ব্লক করে কয়েক লক্ষ প্রিন্ট বের করে সারা দেশে বিক্রি করব দেশবন্ধু স্মৃতি মন্দিরের টাকা জোগাড়ের জন্য। এখন আপনি যদি এর তলায় দুলাইন লিখে দেন তাহলে আরো দামে বিক্রি হতে পারে। ছবিটা আপনাকে দিলাম। যখন বলবেন, এসে নিয়ে যাব। কবি “তুমি বস আমি এখনই লিখে দিচ্ছি” বলে ছবিটা নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন এবং দুমিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন। বিধান রায় ছবির দিকে তাকিয়ে দেখলেন লেখা-“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান”।