লেখক: বর্ণশ্রী বক্সী
সৃষ্টির প্রায় শুরু থেকেই প্রকাশিত কিংবা প্রচ্ছন্নভাবে সাহিত্য মানুষের জীবনে ও চেতনায় অঙ্গাঙ্গী মিশে আছে। সাহিত্য কেবলমাত্র নান্দনিক সৌন্দর্যই উপস্থাপিত করে না, বলা যায় একটা সমাজ ও সময়ের চিহ্নায়ন প্রক্রিয়ায় সাহিত্য কাজ করে স্ট্যাটিস্টিক্সের মতো সূচক বিন্দু নিয়ে। সাহিত্য সেই মাধ্যম যার মধ্যে দিয়ে জীবনের অধরা মাধুরীও মূর্ত হয়ে ওঠে।সমাজ, রাজনীতি, আদর্শ এসব কিছুই সাহিত্য লিখিয়েরা তাঁদের প্রতিভার প্রাখর্যে অসামান্য বাচনিক প্রকাশে ব্যঞ্জিত করেন। জীবন ও সাহিত্যের মেলবন্ধন অচ্ছেদ্য কারণ সাহিত্যে যেমন জীবন থাকে আবার জীবন নিয়েই লেখা হয় নানা কিছু।
একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বেশি জনসংযোগকারী মাধ্যমটির হলো মিডিয়া বা গণমাধ্যম। গণমাধ্যম শব্দের অর্থ গুণের মাধ্যম অর্থাৎ জনসাধারণের মতামত প্রকাশের প্রধান উপায়। গণমাধ্যম কেবলমাত্র রাজনৈতিক কিংবা সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকেই প্রকাশ করে না বরং বলা যায় সাহিত্যের চলমান এবং পারফর্মিং আর্টের সুন্দর উপস্থাপন হয় গণমাধ্যমে।গণমাধ্যমের নতুন তাত্ত্বিকেরা সাহিত্যিক বিতর্ককে প্রাধান্য দিয়েছেন কারণ কিছু ভিত্তিগত পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়, এ ক্ষেত্রে সিনেমা তাত্ত্বিকেরা বলেন, কারিগরি কুশলতা চলচিত্রের বাস্তবায়নে এবং প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে বড় দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। সাহিত্যে যা প্রতিফলিত হয় লেখার মাধ্যমে গণমাধ্যমে তাই উপস্থাপিত হয় অভিনয় গ্রাহ্যতা ও ডকুমেন্টেশনের ভিতর দিয়ে।
সাহিত্য ও গণমাধ্যমের মধ্যে একাত্ম সম্পর্ক রয়েছে। সাহিত্য যদি তাত্ত্বিক হয় তবে গণমাধ্যম প্রায়োগিক। আজকের দিনে মানুষ ব্যস্ততায় কারণে অনেক সময়ই হয়তো লিখিত আকারের সাহিত্য পড়ে ওঠার সময় পাওয়া যায় না। তাই বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যমকে আশ্রয় করে সাহিত্যপাঠের আনন্দ গৃহীত হয় দৃশ্যায়নের দ্বারা। টেলিভিশন, সিনেমা এই মাধ্যমের মধ্যে যথেষ্ট বলিষ্ঠ তার শৈল্পিক বিন্যাসে। গণমাধ্যমের একজন পিতৃসম তাত্ত্বিক Marshal Maluhan এই সম্বন্ধে বলেছেন, “the medium is the message” — গণমাধ্যমের প্রধান কর্তব্য সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, সেই হিসেবে বলতে গেলে সাহিত্য ও তার বিভিন্ন আঙ্গিকের মধ্যে এই ব্যাপারটিকে সুষমামণ্ডিত করে তোলে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক আন্তর্জাতিক মাধ্যম আছে যার মধ্যে দিয়ে নিরন্তর সাহিত্যচর্চার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। একটা ক্লিকেই এখন সাহিত্য মুহূর্তে পৌঁছে যায় কোটি কোটি পাঠকের দরবারে। ফেসবুক, ট্যুইটার, হোয়াটস-অ্যাপ প্রভৃতি মাধ্যম ও আজকের বিশ্বায়নের যুগে সবথেকে শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত।
আমাদের ছোটবেলায় কেবল এর প্রচলন ছিল না তবু ও সাহিত্যকে প্রতিফলিত দেখা যেত টেলিভিশনে। ছোট্টবেলায় মায়ের মুখে নানারকম গল্প শুনে ঘুমাতে ঘুমাতে কখন যেন নিজেরাই রূপকথার অলীক রাজ্যে প্রবেশ করতাম অ্যালিসের আশ্চর্য জগতের মত।এই কাল্পনিক জগতের প্রতিফলন প্রথম দেখি টিভি সিরিয়ালে, সেখানেই বিক্রম-বেতালের সঙ্গে পরিচয় এবং সেই গল্পের মধ্যে অবচেতনে ঢুকে গিয়ে এক অদ্ভুত আনন্দ উপলব্ধি করা। তারপর আরেকটু বড় হতেই রামানন্দ সাগরের বিখ্যাত মহাকাব্যিক সিরিয়াল রামায়ণ, মহাভারত দেখা। বাল্মীকি ও বেদব্যাস যেন তাঁদের হাজার হাজার বছরের পুরনো সাহিত্যকে নতুন মোড়কে আবৃত করে সকলের সামনে উপস্থাপিত করলেন। পাঠকেরা দর্শক হয়ে গিয়ে সেই কাহিনির চরিত্রদের বাস্তব জগতের আঙিনায় অবতীর্ণ দেখলেন এবং তাঁদের দুঃখ বেদনা যা এতদিন কেবলমাত্র শাব্দিক কারাগারে আবৃত ছিল তা বিশুদ্ধ ইমোশনের জায়গায় চলে আসে। রামের সেই হাজার বছরের আগে ঘটে যাওয়া বনবাসের দৃশ্য একবিংশ শতকের মানুষের চোখে সত্যি করে জল নিয়ে এলো। তাহলে এখানে জিজ্ঞাস্য এই ধারাবাহিক দুটিতে কি সাহিত্য নেই, অবশ্যই সাহিত্য আছে এবং পরিপূর্ণভাবে। আজকের যুগে ইলেকট্রনিক্স মাধ্যম সবথেকে স্মার্ট সাহিত্য মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত।
রঙিন আকাশে মেঘের ভেলা ভাসাই
এসো প্রাণে প্রাণে অনুভূতি জাগাই।
সাহিত্য ও গণমাধ্যম যৌথভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে পারে জনগণের মনে। রুপালি পর্দার আবেদন আমজনতার মনে অনেক গভীর ও সুদূরপ্রসারী। সাহিত্যের রসবোধের ব্যাপ্তি অনেক সময়ই সিরিয়াল ও সিনেমার পর্দায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র প্রভৃতি অমর সাহিত্যেকের লেখা গল্প, উপন্যাস গণমাধ্যমের মাধ্যমে পরিবেশিত হয়ে আবারও নতুনভাবে মূল্যায়িত হয়েছে ও হচ্ছে।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে বৃহত্তর অর্থে দুটি তত্ত্বই প্রধান, একটি হচ্ছে ‘art for art sake’ এবং দ্বিতীয়টি “art for social purpose” — সাহিত্য কেবলমাত্র শিল্পের খাতিরে রচিত হলে সেখানে অনেক কথাই উহ্য থেকে যাবে, বিশেষ করে যেখানে মানবিকতার বিরুদ্ধে নেমে আসা যন্ত্রণার কথা রয়েছে। এই কারণে সাহিত্যকে সামাজিক কারণ হিসেবে ও নির্মাণ ও সৃষ্টির খেলা চালিয়ে যেতে হয়। বর্তমান সময়েও সমাজে নানারকম সমস্যা রয়েছে, অনেক জায়গায় দরিদ্র কৃষকেরা চাষে তেমন লাভ করতে না পেরে অর্ধাহারে, অনাহারে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে। কিংবা এই সময়ে নারীদের অনেক ক্ষেত্রেই সমাজে সুরক্ষা বিঘ্নিত, বিশেষ করে যৌন নির্যাতনের ফলে মৃত্যুও বরণ করে চলেছে নারীরা।সাহিত্য ও গণমাধ্যমের যৌথতায় এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।
সাহিত্য ও গণমাধ্যম নিয়ে বলতে গেলে অনেক বড় পরিসরের প্রয়োজন। এই আলোচনার আপাত সমাপ্তিতে এসে এই মীমাংসায় আসা যায় যে, সাহিত্য তার মধ্যে তুলে ধরবে বিভিন্ন বিষয়কে এবং গণমাধ্যম সেই বিষয়কেই তর্ক, বিতর্ক, সিনেমা, সিরিয়াল কিংবা খবরে বাচনিক করে তোলা। শুধুমাত্র তাই নয়, সাহিত্যের বহু মূল্যবান সৃষ্টিকে পুনরায় বাঁচিয়ে তুলতে হবে গণমাধ্যমের নতুন আঙ্গিকের বিন্যাসে।সংক্ষেপে এই কথাই বলা যায় যে সাহিত্য ও গণমাধ্যমকে এই যুগে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠতে হবে। আর সাহিত্য ও গণমাধ্যমের দ্বিরালাপেই প্রত্যাশা করা যায় একটা নতুন সকালের।
লেখক পরিচিতি: বর্ণশ্রী বকসী
বর্ণশ্রী বকসী চাকরি সূত্রে আসামের বরাক উপত্যকায় বাস করেন। সাহিত্য চর্চা তাঁর জীবনের অঙ্গ। কবিতা লেখার পাশাপাশি সেই ছাত্রাবস্থা থেকেই প্রবন্ধ লেখেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল এম.ফিলে বিদ্যাসাগরের অনুবাদ সাহিত্য এবং পি.এইচ. ডি করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যভাষার চিহ্নতাত্ত্বিক অধ্যয়ন নিয়ে।
প্রকাশিত গ্রন্থ
১. রবীন্দ্রকাব্যের চলিষ্ণুতা (প্রবন্ধ গ্রন্থ)
২.শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যচর্চা (প্রবন্ধ গ্রন্থ)
৩.আমিও ওথেলো হবো (কাব্যগ্রন্থ)