ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী (পর্ব – ৬ )

লেখক: দামিনী সেন

গত পর্বের লিঙ্ক এখানে

৯ম পরিচ্ছদ

“আপনাদের প্ল্যানটা যে শেষে ব্যুমেরাং হয়ে গেল।” গমগম করে ওঠে অমিতেশের গলা। “কী দরকার ছিল, ওদের পাড়াটাকে জড়ানোর। ওটা তো প্রজেক্টের এলাকার বাইরে।”
মাইতি অ্যান্ড বেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেকের অফিস’এর তিনতলার কনফারেন্স রুমের একেবারে গোড়াতেই গণেশের একটা মূর্তি। তার সামনে কিছু ধূপ-ধুনো-ফুল আর কিছু পূজা উপাচার। ব্যস, ঐটুকুই। বাকি পুরোটাই ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট স্টাইলে। আসলে কোম্পানির বর্তমান বড় শরিক মিঃ অমিতেশ বেরা মহাশয়ের দেবদ্বিজে ভারী ভক্তি। তাই পুরোনো মাইতি কনসালটেক নাম পালটে বর্তমান নাম ধারণ করার পরপরই তৈরি এই নতুন ঝাঁ-চকচকে তিনতলা অংশটিতে এই দেবমূর্তির অধিষ্ঠান।
তা সেই দেবমূর্তির জায়গাটুকু ছেড়েই একটা ইউ আকৃতির বড় কনফারেন্স টেবিল। তাকে ঘিরে আজ অবস্থান শহরের বেশ কিছু কেষ্ট-বিষ্টুর। মেয়র নিজে অবশ্য সেখানে নেই, কিন্তু আছেন তাঁর অতি বিশ্বস্ত দুই কাউন্সিলর, শাসক দলের এক স্থানীয় পর্যায়ের হোমরাচোমরা, অমিতেশ নিজে, প্রজেক্টের পিছনে টাকা ঢালা কলকাতার এক প্রোমোটারও। সুজয় সাধারণত এইসব মিটিং খানিকটা এড়িয়েই যায়। সে প্ল্যান নিয়ে মেতে থাকতেই পছন্দ করে। এইসব ব্যবসায়িক বিষয়গুলো সে সাধারণত অমিতেশের উপরই ছেড়ে দেয়। কিন্তু আজ তাকেও সেখানে উপস্থিত থাকতে হয়েছে। এড়ানো সম্ভব হয়নি।
মুখটা একটু নামিয়ে প্রমথেশ জবাব দেয়, “হ্যাঁ। আসলে তখন ভেবেছিলাম ওদের একটু এইভাবে জড়িয়ে দিলে ঐ নিয়েই মাথা ঘামাতে বাধ্য হবে ওরা। প্রজেক্টের বিষয়ে আর মাথা ঘামানোর কথা মাথায় আসবে না ওদের। কিন্তু …” সে প্রজেক্ট এরিয়ারই কাউন্সিলর। বয়সে বেশ তরুণই। এ’ বুদ্ধিটা কার্যকর করে তোলার মূল দায় ছিল তারই। ফলে অভাবিত ব্যর্থতার দায়ে সে এখন একটু তোতলাতে শুরু করে।
“তাছাড়া ওদের না জড়ালেই ঝামেলা হত না মনে করছেন?” তাড়াতাড়ি তার সাহায্যে এগিয়ে আসে দলের অভিজ্ঞ কাউন্সিলর নিলয় সোম। কেশবিরল মাথাটা কিছুটা সামনে ঝুঁকিয়ে চশমার উপর দিয়ে একবার সবার মুখ যেন জরিপ করে নেয় তার চোখ। “ওই পুকুরটার উপর ওই অঞ্চলের সমগ্র নিকাশি ব্যবস্থাটাই দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বের তেলিপাড়া, বোরহাট ও ঐ সমগ্র অঞ্চলটারই অতিরিক্ত জল বড় রাস্তাটা পেরিয়ে এপাশের হাইড্রেনে এসে পড়ে ঐ পুকুরটার মাধ্যমেই। মানে শহরের ট্র্যাডিশনাল নিকাশি ব্যবস্থার একটা পার্ট ঐ পুকুরটা। ওটার বদলে যে ব্যবস্থাই তৈরি করা হোক না কেন, বর্ষাকালে ওটা না থাকলে ওই পিছনের পাড়া জলে ভাসবেই। তখন ওরা এমনি এমনি ছেড়ে দিত মনে করছেন?”
“অর্থাৎ পুকুরের আড়াল দিয়ে পুকুর চুরির মতলবটা হাসিল হল না, তাই তো?” মুখ টিপে একটু হেসে প্রমথেশকে তোতলামির হাত থেকে উদ্ধারে হাত লাগায় সুজয়ও। তবে তার চোখে খেলে যাওয়া বিদ্রুপটুকুতে একটু অস্বস্তিতে পড়ে থেমে যেতে হয় নিলয়কেও।
“তা আপনাদের লোকেরা ওখানে কী করছিল?” অমিতেশের গলায় আবার ধমকের সুর।
“সহি বাত আছে”, দেওয়ালের টিকটিকিটার মতো টিকটিক করে ওঠে কলকাতার প্রোমোটারও।
“ছিল তো। ভালোভাবেই ছিল। কিন্তু লোকগুলো কেমন একরোখা হয়ে গেছে। নিজেদের ভিটে ব্যাপারটায় জড়িয়ে যেতে উল্টোকথা যে আর শুনতেই চাইছে না। কী করব?” অসহায়তাটা ফুটে ওঠে প্রমথেশের গলাতে।
“আর তাছাড়া দলের লোক হলেও তো ঐ এলাকাতেই বাস অনেকেরই। ওদেরও তো বোঝানো মুশকিল হয়ে পড়েছে।” প্রমথেশের সাহায্যে এবার এগিয়ে আসে ফিরোজও। সে নেহাৎ ছোটখাটো কোনও কাউন্সিলর নয়, বেশ দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা।
“তাহলে আমাদের এবার করণীয় কী? চুপচাপ হাত গুটিয়ে পালিয়ে আসব?”
“না না, তা কেন?” বিরক্ত অমিতেশকে এবার প্রবোধ জোগানোর চেষ্টা করে ফিরোজ। “আমরাও একটু পরিকল্পনা পালটে নিয়েছি। ওরা যে কমিটিটা তৈরি করেছে, ওর মধ্যে ঢুকে পড়েছি আমরাও। ঐ পুকুরটার উপর তো এলাকার জলনিকাশি ব্যবস্থাও অনেকটাই নির্ভরশীল। তাই ওটা বোজানো কোনওভাবেই আমরা মানবো না। এইসব বলে মিটিং-ফিটিংও করছি। ক’দিন যেতে দিন। দেখুন ঠিক সামলে নেব। কাজ কিন্তু থামাবেন না।”
“তা তো বুঝলাম। কিন্তু আপনারা ছাড়াও অন্যরাও তো ঐ কমিটির মধ্যে আছে। তারা আপনাদের বাধা দেবে না!”
“দেখুন, বিরোধীদের সাথেও কথা হয়ে গেছে। তবে আপনাদেরও কিছু খরচ করতে হবে। এত বড় প্রজেক্ট …”, ধূর্ত শিয়ালের হাসি খেলে যায় নিলয় সোমের প্রায় বৃদ্ধ চোখে।
“খোরচা তো আমরা করতে রাজিই আছে। লেকিন কাম তো হোতে হোবে।” দরাজ হাতে অভয় বিলোয় কলকাতার প্রোমোটার।
“নিশ্চয়, নিশ্চয়। সে আর বলতে। তবে আরও কয়েকটা গ্রুপকেও ম্যানেজ করা দরকার। ওই এলাকায় একটা ক্লাব আছে। ওই যাদের ছেলেরা ওই মাঠটায় এতদিন খেলাধুলো করত।” চোখদু’টো সরু আর গলার স্বর একটু চাপা হয়ে আসে প্রমথেশের।
“হ্যাঁ। ‘আমরা তরুণ’। ওদের জন্য তো টাকা ধরাই আছে। ওদের বলেননি!” অমিতেশের গলায় বিরক্তির আভাস।
“হ্যাঁ স্যর, বলেছি তো। কিন্তু আরও কিছু চাই। বলছে, ‘এত কোটি টাকার কাজ, আর আমাদের বেলা মাত্র আড়াই লাখ!’ কী বলবো বলুন?”
“ঠিক আছে। আরও কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া যাবে না হয়। কিন্তু এলাকার ঝামেলা আটকাতে ওদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।”
“সে আর বলতে। আমি দেখছি স্যর, কোনও চিন্তা করবেন না”, প্রমথেশের গলায় এবার একরাশ উৎসাহ। “আর একটা অ্যামেচার নাট্যগ্রুপও ক’দিন হল ওখানে খুব যাওয়া-আসা শুরু করেছে। ওতে ওই পাড়ারই একটা মেয়েও আছে। ওদেরও মুখ বন্ধ করা দরকার।”
“ঠিক ঠিক। তবে ওদের মুখ কী আর বন্ধ করতে পারবেন?” নিলয়ের গলায় হঠাৎ কেমন হাল ছেড়ে দেওয়া সুর। “স্বয়ং স্যর নিজেই যখন ওদের পৃষ্ঠপোষক।” একটু আগের বিদ্রুপটুকুর উপযুক্ত জবাব দিতে পেরে নিলয়ের ধূর্ত চোখে তখন হঠাৎ প্রাণের ছোঁয়া। তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে সকলের অবাক চোখই এবার ধীরে ধীরে গিয়ে জমা হয় সুজয়ের বিব্রত মুখে। “ওঁর মেয়ে নিজেই তো আছে ওদের মধ্যে। তাই না স্যর?”
আপাত নিরীহ প্রশ্নটির সামনে হঠাৎ কেমন অসহায় বোধ করে সুজয়। তার হাত-পা সব কাঁপতে থাকে, সে রীতিমতো টের পায়। মুখটা তার নেমে আসে ধীরে ধীরে টেবিলের উপর। সেখানে পড়ে থাকা খোলা ফাইলের এলোমেলো পাতাগুলোয় মরিয়া হয়ে তার দুই চোখ খুঁজতে থাকে যেমন হোক একটা আশ্রয়।


১০ম পরিচ্ছদ

“কাকীমা আসবো?” সিমেন্ট করা বারান্দাটার নিচে দাঁড়িয়ে ডাক দেয় অনি।
“কে?”, বিরক্ত গলায় উত্তর ভেসে আসে পুরোনো শাড়ি দিয়ে তৈরি পর্দায় ঢাকা দরজাটার আড়াল থেকে। কিন্তু বিরক্তির পাশাপাশি তাতে যেন কেমন একটা আতঙ্ক ও অসহায়তার সুরও টের পায় অনি।
“আমি, অনি।”
“ও তুই। আয় আয়।” পর্দাটা ঠেলে বেড়োন আধময়লা অগোছালো শাড়ি পড়া এক মাঝবয়সী মহিলা। অনিকে দেখে তার চোখে খেলে যায় যুগপৎ এক অসহায়তা ও ভরসার হাসি। “এ কী হল বল তো! বন্ধুরাই ছেলেটাকে এইভাবে মারল! এখন ও গাড়ি চালাবে কীভাবে!”
এ প্রশ্নর জবাব অনির কাছেও নেই। একটু চুপ করে থেকে তাই সে জানতে চায়, “পিন্টু কি ঐ ঘরে?”
“হ্যাঁ রে মা। যা না তুই। ওই ঘরে। একটাও কথা বলছে না বাছা আমার। তোকে দেখে যদি কিছু কথা বলে।”
পর্দা সরিয়ে এবার ডানদিকের ঘরটায় প্রবেশ করে অনি। ঘরের ভিতরের অন্ধকারটায় চোখ সইয়ে নিতে একটু সময় লাগে তার। একটু পরে চোখ সয়ে এলে একে একে তার চোখে পড়ে, দেওয়ালে লাগানো একটা নাইলন দড়ি থেকে ঝোলা একটা হলদে লাল চেক চেক গামছা, কয়েকটা জামা-প্যান্ট, জানলায় মশা আটকানোর তারজালি, টেবিলের রংচঙে অয়েলক্লথটার উপর গুচ্ছের কাগজ, তেলের শিশি, ডিওস্প্রে, টেবিল ক্যালেন্ডার, যেমন তেমন করে ফেলে রাখা একটা রংচটা হাতঘড়ি, একটা পাওয়ার ব্যাঙ্ক, আর সে সব কিছুরই মাঝে একটু জায়গা করে নিয়ে, কিছু ওষুধ ও ড্রেসিং’এর জিনিসপত্র।
ঠিক তার পাশে ঐ টেবিলটারই উচ্চতায় দেওয়ালে বালিশ লাগিয়ে হেলান দেওয়া একটা মাথা। উপরের কালো চুলের একটুকরো এলোমেলো ঘাসজমি বাদ দিলে গোটা কপালটাই তার একটা সাদা ব্যান্ডেজে ঢাকা। সহজেই চোখে পড়া সে ব্যান্ডেজটুকুর ঠিক তলায় দুটো ততোধিক অনুজ্জ্বল চোখ, যেন ঐ ব্যান্ডেজেরই ছায়ায় চাপা পড়েছে তারা। ভালো করে না দেখলে ঠিক ঠাহরই করা যায় না। অনিরও চোখ প্রথমে দিশা পায় না তাদের। ব্যান্ডেজ থেকে নিচে নামার পথে তাদের ডিঙিয়ে গিয়েই চোখে আগে পড়ে একটা চিত হয়ে শুয়ে থাকা দেহ, কোমর পর্যন্ত তার একটা সস্তা রংচঙে ছাপা চাদরে ঢাকা। হাতদু’টো তার এলিয়ে পড়া দুইপাশে, বাঁহাতে আবার একটা ব্যান্ডেজ। চাদরে ঢাকা পাদু’টোরও ভঙ্গি কেমন নেতিয়ে পড়া, যেন কোনও সাড় নেই তাতে। কোমরে চোটের ফল, মনে মনে ভাবে অনি। তারপর তার চোখ আবার ফিরে দেখার ভঙ্গিমায় ঐ হাল ছেড়ে দেওয়া হতাশ দেহটা অবলম্বন করেই ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করে। রঙিন গেঞ্জিতে ঢাকা মেদহীন দেহটা আর ক্লান্ত, ভেঙে পড়া চিবুক ও ঠোঁট পেরিয়ে শেষে তা গিয়ে পড়ে ওর দুই চোখে। সে চোখের দৃষ্টি ভীরু, ভরসা হারানো অবিশ্বাসের।
অনি ধীর পদক্ষেপে এসে দাঁড়ায় বিছানার পাশে। বন্ধ ঠোঁটদু’টো তাকে একবার বসতেও বলে না। শুধু চোখদু’টো অনুসরণ করতে থাকে তাকে; দৃষ্টিতে তাদের ভীরু অবিশ্বাস ধীরে ধীরে পালটে গিয়ে জায়গা করে দিতে থাকে এক বিস্ময়ের।
পিন্টুর অক্ষত ডানহাতটা নিজের হাতে তুলে নেয় অনি। নিতান্ত আলগা সে হাত; যেন জীবনহীন। অনি চেপে ধরে সে হাত তার দুই হাত দিয়ে। চোখে তার দৃষ্টি ভরসার, সমবেদনার।
দৃঢ়বদ্ধ ঠোঁটদু’টি এতক্ষণে কেঁপে কেঁপে ওঠে পিন্টুর। চোখগুলো ভিজে ওঠে তার। বুক ঠেলে বেড়িয়ে আসে হঠাৎ এক নিতান্ত মৃদু কিন্তু আর্তরব, “ওরা তো আমারই বন্ধু। তবু ওরা আমায় এভাবে মারল! কেন রে, অনি! কেন? সামান্য ক’টা টাকার এত মূল্য!”
অনির মুখেও কোনও কথা নেই। শুধু পিন্টুর হাতের উপর একটা মৃদু চাপবৃদ্ধি পিন্টুকে জানান দেয়, তার এই কথায় কথায় গাল পেড়ে বসা, ক্লাস এইটে পড়া ছেড়ে দেওয়া, ভাড়ার গাড়ি চালানো, মাঝেমাঝে রাতবিরেতে আউট হয়ে যাওয়া, মূর্খ, ফুটবল পাগল, কিন্তু টাকার কাছে বিক্রি না হয়ে যাওয়া বাল্যবন্ধুটার জন্য কতখানি গর্বিত পাড়ার সকলের প্রিয় এই মেধাবী মেয়েটি। হঠাৎ বুকটা ভারী হাল্কা লাগে তার। যে ভরসা সে এতক্ষণ মনে মনে হাজার ডেকেও খুঁজে পায়নি তার বিছানার উল্টোদিকে টাঙানো কাবার বাঁধানো ছবিটায়, সে ভরসার খোঁজ হঠাৎ জুটে যায় তার মনে।
তবু তার ভিতর থেকে একটা আশঙ্কা ভাষা হয়ে ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে, “অনি, ওরা সাংঘাতিক। ওদের প্রচুর পয়সা। তুই আর এতে জড়াস না নিজেকে। সরে আয়।”
“তাই কি হয় রে? এটা তো লড়াই’এরই ময়দান। লড়তে তো হবেই। আমরা তো আর এখান ছেড়ে কোথাও সরে যেতে পারব না।”
“কাকে তুই পাশে পাবি বল? সব শা…”, তাড়াতাড়ি জিভ কাটে পিন্টু।
হেসে ফেলে অনি, “তোর রাগ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। আসলে আমাদের সমস্যাটা কী জানিস? আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে নিজেরা লড়ি না, ভরসা করি অন্যদের, আর বারবার ঠকি। আমার ভরসা কিন্তু তোদের ঐ রাজনৈতিক দাদারা নয়, তোদের ক্লাবের কর্মকর্তারাও নয়, ওদের কারো এটা নিজেদের সমস্যা নয়, তুই, আমি, আমরা। যারা এরফলে নিজেরা সমস্যায় পড়ব, তারা। অন্যরাও পাশে আমাদের থাকতেই পারেন, কিন্তু লড়াইটা শেষপর্যন্ত আমাদেরই।”
“তাতে কী হবে? আমাদের শক্তি কতটুকু?” বিস্ময়ের ঘোর পিন্টুর গলায়।
“সামান্য। তাই এই লড়াই’এ আমরা শেষপর্যন্ত হয়তো হারব। কিন্তুসেটা হারার আগে নয়।”
অনির কোমল চোয়ালটা পিন্টুর মনে হয় হঠাৎ কেমন শক্ত হয়ে উঠেছে, চিবুকটাও হয়ে উঠেছে কেমন অসম্ভব দৃঢ়। চোখের দৃষ্টিটা তাকে ছাড়িয়ে হারিয়ে গেছে কোন সুদূরে। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে সে’ চোখে আবার ফিরে আসে চেনা জীবন, ভরসার হাসি নিয়ে তা স্থির হয় আবার তার মুখে।“তবে সেই হার থেকে শিখবও।পালটে নেব লড়াই’এর কৌশল। কিন্তু লড়াই ছাড়ব না।” অনির মৃদুস্বরে উচ্চারিত শব্দগুলো পিন্টুর মনে হয় কী যেন এক অসম্ভব শক্তি নিয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা ঘরময়, তারপর খোলা জানলাটা ছাড়িয়ে বাইরে, আরও দূরে, পৃথিবীর পথে পথে।“আমরা, আমাদের থেকে আরও কেউ কেউ। মনে রাখিস, একটা দাস বিদ্রোহে কিন্তু রোমের পতন হয়নি, স্পারটাকাসকেও হারতেই হয়েছিল। কিন্তু রোমও ভিতর থেকে ভেঙে পড়েছিল। গথ আর লোম্বারডিদের সামনে ভেঙে পড়ার পর দাসপ্রথা কিন্তু আর বেশিদিন টেকেনি।”
অবাক পিন্টুর চোখে চোখ রেখে একটু হাসে অনি, “শুয়েই তো আছিস। একটা বই পড়বি?” নিজের ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে সে। বেরটোল্ট ব্রেখটের ‘গালিলেও’। বাংলা অনুবাদ। “একটু পাতা উলটে দেখিস। ভালো তো লাগতেও পারে।”
হাত বাড়িয়ে বইটা নেয় পিন্টু। চোখ বোলায় মলাটটায়। একটু হেসে উঠে দাঁড়ায় অনি। “আজ আসি রে। আবার আসব।” তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পর্দা ঠেলে বেড়িয়ে যায় সে। বইটা হাতে পিন্টু চেয়েই থাকে সেই কাঁপতে থাকা পর্দাটার দিকে। বই’এর মলাট থেকে অন্ধ গালিলেও চেয়ে থাকে তার চোখে।

আগামী পর্বের লিঙ্ক এখানে

অলংকরণ – শর্মিষ্ঠা দেবযানী


লেখক পরিচিতি: দামিনী সেন
গত শতাব্দীর শেষ পাদে জন্ম। ছেলেবেলা কেটেছে মফস্‌সলে। সেখানেই পড়াশুনো — স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। ঘুরতে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন পড়তে। জানেন একাধিক বিদেশি ভাষা। আগ্রহ বহুমুখী, কলমের অভিমুখও। কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস — সাবলীল তাঁর কলমের গতি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইতিমধ্যেই প্রকাশিত বেশ কিছু কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প। কাব্যগ্রন্থ “ভাঙা সে সাম্পান” প্রকাশের পথে। ধারাবাহিক উপন্যাস “ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী”-র মধ্য দিয়েই ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।