লেখক: ডঃ অভীক সিনহা
মেঘে ঢাকা তারা-এর নীতার চরিত্র বিশ্লেষণ
“দুঃখ যে পাপের ফল তাহা কে বলিল, পুণ্যের ফলও হইতে পারে” — মেঘে ঢাকা তারায় নীতার কথা লিখতে বসলেই অবধারিতভাবে মনে এসে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “রাজর্ষি”-এর এই কথাগুলি। কারণ নীতার চরিত্র হয়তো মন থেকে এই কথাগুলির উপর বিশ্বাসটাকে একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় । আর সত্যিই তো, হবেই না-বা কেন? যে জীবনটা অন্যের স্বার্থে অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরে মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত নিয়েও হাসতে হাসতে বলে ওঠে, “তোরা সবাই আবার কী সুন্দর আগের মতো দাঁড়িয়ে গেলি”, এবং পরের মুহূর্তেই ভয়াবহ শূন্যতার মাঝে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করতে করতে চিৎকার করে ওঠে, “দাদা, আমি কিন্তু সত্যি সত্যি বাঁচতে চেয়েছিলাম”, সেই জীবন তো প্রাত্যহিকতার মুখ থেকে কাব্যিক দুঃখবিলাসিতার আবরণটাকে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলবেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে অপেরা সঙ্গীতের জীবনাবসান ঘটিয়ে পৃথিবী যখন ধীরে ধীরে রক প্রজন্মের আঁতুরঘর হয়ে উঠছে, ঠিক সেই সময়টা বঙ্গদেশের পক্ষে কিন্তু একেবারেই সুরমধুর ছিল না। ইদানীং একটা কথা খুব শোনা যায়, “বাঙালিদের প্রিয় শব্দ হ’ল স্ট্রাগল।” হ্যাঁ, সত্যি কথা, খুবই সত্যি কথা, কারণ বাঙালিদের নিজের জায়গাটা করে নিতে বরাবরই অনেকটা কষ্ট করতে হয়েছে, আর সেটার সূত্রপাত হয়তো সেই সময়টা থেকেই। দেশবিভাজনের অব্যবহিত পরেই দক্ষিণ কলিকাতার উদ্বাস্তু কলোনিগুলিতে নতুন করে লেখা হতে থাকে “স্ট্রাগল” শব্দটির অর্থ, এবং তার সাথে নারীশক্তির উত্থান প্রত্যক্ষ করতে থাকে অধুনা বঙ্গদেশ। সেই নারীশক্তির প্রতীকীরূপ হল নীতা, যে তার পরিবারের অর্থনৈতিক স্তম্ভ। দিবারাত্র এই কর্তব্য পালনের মধ্যে দিয়ে নীতা অত্যন্ত সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছে অধ্যাপক কার্ল জাং-এর “মাদারআর্কটাইপ” সত্ত্বাটিকে, যে নারীত্বের বিভিন্ন রূপের মাধ্যমে তার চারিপাশের মানুষের সেবা করতে করতে শেষে একদিন মিশে যাবে প্রকৃতির মাঝে। নিজের প্রেমিকের সাথে বোনের বিয়ের বাসরে সে গাইবে “যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে”, কেউ তাকে ন্যূনতম সহানুভূতির পাত্র মনে করলে সে গর্জে ওঠে “একটাকাচের বাক্স বানিয়ে আমাকে মোমের পুতুল করে তাতে রেখে দে”, আবার সে-ই অজানা ভয়ে নিজের দাদারকাছ থেকে লুকিয়ে ফেলে নিজের যক্ষ্মার রক্তমাখা কাপড়টিকে। কখনও কোনও একটি মাত্রায় বেঁধে রাখাযাবে না নীতাকে, কারণ সে মুষলধার বর্ষামাঝে মেঘমল্লারের মতো — যাকে শুধু অনুভব করা যায়, কিন্তু কখনই স্পর্শ করা যায় না ।অর্থনীতির ভাষায়, ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগিতার নিয়মানুসারে, অর্থাৎ Law of Diminishing Marginal Utility অনুযায়ী নীতার গল্পের পরিণতি বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না। নিজের মৃত্যুহীন প্রাণকে একটু একটু করে দেন করতে করতে যেদিন সে নিঃশেষ হয়ে গেল, সেদিন শিলংয়ের পাহাড়ে বসে সে উপলব্ধি করে, পরের চাহিদাপূরণ করতে করতে তার নিজের বাঁচার সময় আর বাকি নেই, আর সেই মুহূর্তে তার পাশে আছে সেই মানুষটি, যার উপর নীতা ব্যতীত কারও সূচ্যগ্র বিশ্বাস ছিল না – তার দাদা। তাই জীবনের শেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তার দাদার কাছেই সে বলে ফেলে তার মনে সংগোপনে সযত্নে রাখা তার শেষ কথাকটি, “দাদা, আমি সত্যি বাঁচতে চাই, আমি বাঁচতে যে বড় ভালোবাসি ।”
নীতারা কোনোদিন মরে না, সাধারণ মানুষের মাঝে অসাধারণত্বের পরিচয় দিয়ে তারা যুগ যুগ ধরে বেঁচে থেকে যায় মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে। যতদিন মানুষের স্বার্থের চরিতার্থতা, বিসর্জিত মূল্যবোধ, এবং ভালোবাসার বিপণন মনুষ্যত্বকে করবে কালিমালিপ্ত, ততদিন সেই আঁধারিত অমানিশার মাঝে অগ্নিশলাকার মতোই আবির্ভাব হবে এক নীতার। তাই তার বিরহের দুঃখটা সাময়িক, কিন্তু প্রতীক্ষা চিরন্তন ।
লেখকের কথা: ডঃ অভীক সিনহা
লেখকের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন গোয়া ইনস্টিটিউট অফম্যানেজমেন্টের সাথে। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। তাঁর লেখা প্রথম বই “R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প” প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেইমনোনিবেশ করেছেন।