আগুন

লেখক: সুকুমার খাঁড়া

ট্রেনটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। গগনচুম্বী আগুনের লেলিহান শিখা বিষধর সর্পের মতো ফণা তুলে নাচছে আর উগরে দিচ্ছে দূষণ বিষ। সহেলী রেল লাইনের ধারে গড়ে-ওঠা বস্তির ছিটেবেড়া দিয়ে তৈরী ঘরে বসেই সব দেখতে পাচ্ছে। আকাশ যেন কালো ধোঁয়া’য় ঢেকে যাচ্ছে।

তাঁর স্বামী সুবল ভোরের ট্রেনে কাজে বেবিয়ে গেছে। এখন কাজের বাজার ভালো। শহরের বাবুরা বাড়িতে ফুলের বাগান তৈরী করে। তাছাড়ও রেলস্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে শীতকালীন সবজি, ফসলের ক্ষতের কাজ থাকে। একদিন কামাই করলেই চার’শো টাকা লোকসান। তখন তো ট্রেনগুলো ঠিক মতো চলছিল। কী করে জানবে এমন বিপর্যয় নেমে আসবে? জানতে পরলে কী আর স্বামীকে বেরুতে দিত!

গতকাল কেন্দ্রের সরকার কী একটা বিল পাশ করিয়েছে। সেই বিলের প্রয়োগ হলে — লক্ষ লক্ষ মানুষকে নাকি রাজ্য ছাড়তে হতে পরে। বিলটা’র নাম নাকি CAB।এর অর্থ সে জানে না। অনেকে বলছে ভালো, অনেকে বলছে খারাপ। সে সার কথা বুঝেছে — এই পশ্চিমবঙ্গ তাদের পেটের অন্ন দিচ্ছে। রাজ্য ছেড়ে কোথাও যেতে পরবে না।বস্তির লোক যখন দলে দলে রেলস্টেশেনের দিকে গেল — তখন বুঝেছিল রেল অবরোধ হবে।

সকাল থেকেই চাপা উত্তেজনা শুরু হয়েছে রেল লাইনের দু’ধারের বস্তিতে। তাছাড়া পাশাপাশি অনেক গ্রাম আছে। চারদিক থেকেই লোক জড়ো হচ্ছে স্টেশনসংলগ্ন এলাকায়। গতকাল পাশ হওয়া বিলের বিরুদ্ধে নাকি আন্দোলোন হবে। রেল ও পথ অবরোধ। এই সব আন্দোলন নাকি গরিব মানুষের স্বার্থে করা হয়। কোথায় তাদের উন্নয়ন? তাদের অবস্থা বিশ বছর আগেও যা ছিল এখনো তাই রয়ে গেছে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।

একটি দূরপাল্লার ট্রেন স্টেশনে ঢুকতেই অবরোধ শুরু হয়ে গেল। ট্রেনটি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এত লোকজনের উপর দিয়ে তো যেতে পরবে না। “CAB মনছি না মানব না।” শ্লোগানে শ্লোগানে মুখোরিত হয়ে উঠল গোটা চত্তোর। ট্রেনের যাত্রীরা জানালা-দরজা বন্ধ করে বসে রইল। ভেতর থেকে শিশুদের কান্না ভেসে আসতে লাগল। দেখতে দেখতে লোকসংখ্যা তিন-চার গুণ বেড়ে গেল। অনেকে অবশ্য মজা দেখতে এসেছে। দেখতে দেখতে তিন-চার ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেল। অনেকেই বাড়ি থেকে আনা খাবার খেতে ব্যস্ত।

কে যেন চিৎকার করে বলল, অনেক হয়েছে আর নয় — এবার ট্রেনে আগুন লাগাও। সকলেই এর ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল।

কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না। হঠাৎ একটি কামরা থেকে ধোঁয়া বেরুতে শুরু হল। ট্রেনে বসে থাকা নিরীহ যাত্রীদের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হল। আত্মরক্ষার তাগিদে দরজা খুলে যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাতে লাগল। এদিকে আগুনের লেলিহান শিখা একের পর এক কামরা গ্রাস করতে শুরু করেছে। অনেকেই সঙ্গে থাকা ল্যাগেজ বার করার সুযোগ পেল না। যে যে দিকে পরল প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেল।

অনেক মহিলাদের মতো সহেলী জমায়াতে এসেছে। অনেক অল্প বয়সী ছেলে — মেয়েরাও। তাঁর চৌদ্দ বছরের ছেলে রবীনও। যাত্রীরা নিরাপদেই ট্রেন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছে। এখন সমস্ত ট্রেনটা জ্বলছে। সে আর সহ্য করতে পারল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল। মনে মনে বলল, যা হল তা পাপ — অন্যায়। তারপর রেললাইন ধরে ছুটতে শুরু করল ঘরের উদ্দেশ্যে।

কে একজন বলে উঠল, এবার চল, রেলের কর্মচারীদের গণধোলাই দিতে হবে। একদল লোক ছুটল স্টেশনমাস্টরের ঘরে। ভয় ও আতঙ্কে সে তো কাঁপতে শুরু করেছে। দুস্কৃতীরা তাকে মেঝেতে ফেলে যথেচ্ছ লাথি কিল চড় মারতে লাগল। ততক্ষণে অন্য কর্মচারীরা অফিস ছেড়ে নিরাপদ আশ্রায়ের আশায় ছুটতে শুরু করেছে।

এবার শুরু হল অফিসের যন্ত্রপাতি ভাঙচুর। লাঠি দিয়ে যন্ত্রগুলিকে পিটিয়ে পিটিয়ে আক্রোশ মেটাচ্ছে জনগণ। কয়েকটি দমকলের গাড়ি এল। ট্রেনটি এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। দেরিতে হলেও দমকল এলো। দু’চার জাগায় অল্প মাত্রায় আগুন জ্বলছে। কিছু তো কাজ দেখাতে হবে — তাই যেন করা। দমকলের পাইপ ফিট করে জল ছিটোতে লাগল।

আমি তমলিকা বলছি, সত্যসন্ধানী নিউজ চ্যানেল থেকে। আমরাই প্রথম সরাসরি ঘটনাস্থল থেকে লাইভ দেখাচ্ছি। এই দেখুন সেই ট্রেন, যেটা আন্দোলনকারীরা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু কংকালসার চেহারাটাই পড়ে আছে। আমি ক্যামেরাম্যানকে দেখাতে বলছি, এই দেখুন যাত্রীরা তাঁদের শেষ সম্বল ল্যাগেজগুলোও নিয়ে যেতে পারেনি। সব ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এই দেখুন, স্টেশনের সমস্ত অফিস কীভাবে ভাঙচুর করা হয়েছে। এই দেখুন গণপ্রহারে জখম স্টেশনমাস্টার কীভাবে পড়ে আছে। এইমাত্র বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর এসে পৌঁচেছে। তাঁরা মাননীয় স্টেশনমাস্টার মহাশয়কে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছেন।

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, যে কোনো মূল্যে CAB এ রাজ্যে প্রয়োগ করতে দেবেন না। জনগণকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। রাস্তা অবরোধ, ট্রেন অবরোধ করে আন্দোলন করা যাবে না। তিনি মানুষের পাশে সর্বদা আছেন। একজন মানুষকেও বাংলা ছাড়া হতে দেবেন না। তিনি অহিংস আন্দোলনে পথে নামবেন। একজন মানুষেরও যাতে কোনো অসুবিধা না হয় — তাও দেখবেন।

সহেলী ভাবছে, তাঁর স্বামী বাড়ি ফিরবে কী করে? সকাল থেকেই ট্রেন চলছে না। অনেক জাগায় আন্দোলনকারীরা বাসে আগুন লাগিয়েছে। তাদের এদিকে বাস তেমন চলছে না। হয়তো আজ ফিরতে পারবে না! পথে-ঘাটেই রাত কাটাতে হবে। হয়তো রাতে অনাহারেই থাকতে হবে। ছেলে রবীনও এখনও বাড়ি ফেরেনি।কোথায় যে গেল ছেলেটা!
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে যাচ্ছে। সেও আজ রান্না করেনি। কার জন্যেই বা করবে! একমুঠো মুড়ি জলে ভিজিয়ে খেয়ে নিয়েছে। হঠাৎ পাড়ার ছেলে শিবু এসে বলল, মাসি, একটা খারাপ খবর আছে।

সহেলী উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, কি খবর বল? রবীনের কি কিছু হয়েছে? ওর বাপের কি কিছু হয়েছে? ওরা সুস্থ আছে তো?
শিবু বলল, সবাই ভালো আছে। তবে রবীনকে পুলুশ থানায় তুলে নিয়ে গেছে।
সহেলী বলল, কেন? ছেলেটা আবার কার বাড়া ভাতে ছাই দিল।
শিবু বলল, রেলস্টেশনে ভাঙচুর ও ট্রেনে আগুন ধরানোর অভিযোগে কয়েকজনের সঙ্গে রবীনকেও তুলে নিয়ে গেছে। আমার সঙ্গে থানায় চলো যদি কিছু করা য়ায়।

সহেলী শিবুর সাইকেলের পিছনে ক্যারিয়ারের উপর চেপে বসল। বস্তি থেকে থানার দূরত্ব মাত্র দুই কি.মি। সামান্য এইটুকু পথ যেন শেষ হতে চায় না। নিজের ছেলে বলে কথা। যে কোনো উপায়ে ছেলেটাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।

থানার বড়বাবুর ঘরে ঢুকেই তাঁর পা’দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, রবীনকে ছেড়ে দিন স্যার। বাচ্চা ছেলে। ও কিছু জানে না। বড়বাবুর নির্দেশে রবীনকে আনা হল। বড়বাবু রবীনের চোখে চোখে বললেন, সত্যি করে বল, ট্রেনে আগুন ধরাতে কাউকে দেখেছিস ?

রবীন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমি নিজেই তো কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়েছি। কিছু করতে পরবেন আমার? কাল যদি একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে পেট্রোল জ্বেলে পুড়িয়ে মারি, না পারবেন আপনারা কিছু করতে, না পরবে কিছু করতে আপনাদের আইন। আমি তো চৌদ্দ বছরের নাবালক। সেই তো পাঠিয়ে দেবেন সরকারি হোমে। ক্ষমতা আছে আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর?

বড়বাবু কিছুটা হতভম্ভ। ঐটুকু ছেলের মুখ থেকে এমন কঠোর বাস্তব শুনতে হবে স্বপ্নেও ভাবেননি। কথাগুলো শুনে সহেলীর চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল। সপাটে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিয়ে ছেলের গালে চিৎকার করে বলল, ও আমার ছেলে নয়। ওকে গুলি করে মারুন। আগুনে পুড়িয়ে মারুন। বলেই থানা থেকে বেরিয়ে এলো।

বড়বাবু ভাবছেন মালকটাকে কালকেই কোর্টের তুলতে হবে। বেল যাতে না পায় কেসটা সেইভাবেই সাজাতে হবে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। বড়বাবু বললেন, কালকেই সব কটাকে কোর্টে চালান করে দেব। অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে এলো, তার আর দরকার নেই। সব কটাকে ছেড়ে দাও। উপর মহলের নির্দেশ।

সূর্য পিতলের থালার মতো আকার নিয়ে অস্তগামী। সহেলী প্রদীপ জ্বালিয়ে তুলসি লার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পদশব্দ শনে থমকে দাঁড়াল। কে ও? যেন একটা দানব সহেলীর সন্মুখে দাঁড়িছে। সহেলীর মনে হল দানবটা যেন তাঁর শরীর শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ টেনে খুলছে। সে আতঙ্কে চেতনা হারিয়ে ভূপতিত হল। রবীন ভাবছে তবে কি মা মারা গেল? সহেলী বিড় বিড় করে বলল, বাবু গো, দয়া করো। ছেড়ে দাও। ধর্ষণ করো না। পেট্রলো জ্বেলে পুড়িয়ে মেরো না। আমাকে বাঁচতে দাও। রবীন দেখল, তাঁর মা বেঁচে আছে, প্রদীপের আগুনে মায়ের আঁচলে আগুন লেগেছে। আগুন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে মুখের দিকে। তবুও সে যেন পাথর হয়ে গেছে। মাকে স্পর্শ করতে সাহস পাচ্ছে না। শুধু চিৎকার করে বলল, আগুন, আগুন। কে আছো? আমার মাকে বাঁচাও।


লেখক পরিচিতি: সুকুমার খাঁড়া

কবি ও গল্পকার সুকুমার খাঁড়া এই মুহূর্তে একজন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। পেশায় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক সুকুমারবাবু হুগলি জেলার চুচুড়া শহরের বাসিন্দা। দীর্ঘদিন লিটল ম্যাগাজিনে লেখালিখি করছেন। সুকুমার খাঁড়া মূলত কবিতাচর্চার সাথে যুক্ত থাকলেও গল্প-উপন্যাসও নিয়মিত লিখছেন। সমসাময়িক বিষয় ভিত্তিক, প্রতিবাদী কবিতা লিখতে সাবলীল। কবিতাপাক্ষিক, শতানীক, ছায়াবৃত্ত, মহাজন পথ, আজকের অর্নিবাণ পত্রিকা সহ অনেক পত্রিকায় লিখেছেন। লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত উপন্যাস চারটি, এছাড়াও বহু গল্প লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক এক দশক ধরে বাণিজ্যিক পত্রিকাতেও বেশ কিছু গল্প নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে যার মধ্যে দৈনিক সুখবর, দৈনিক বাংলা স্টটম্যান, দৈনিক একদিন প্রভৃতি দৈনিক বাণিজ্যিক সংবাদপত্রের গল্পের পাতায় বেশ কিছু গল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও ফেসবুকে দুটি উপন্যাস, হাজারের বেশি কবিতা লিখেছেন। প্রকাশিত বই তিনটি :
ছড়া সংগ্রহ-১,
ছড়ায় রামকৃষ্ণ উপদেশামৃত,
কর্কট অদৃশ্য হাত (যুগ্ম উপন্যাস)।
নিজের পচ্ছন্দ মতো লিখতে ভালোবাসেন। চাপিয়ে দেওয়া বিষয় কিংবা বিষয় নির্ধারিত লিখতে পচ্ছন্দ করেন না। সভা-সমিতি এড়িয়ে চলতেই পচ্ছন্দ করেন এই সাহিত্যিক।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।