ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী (পর্ব – ৪ )

লেখক: দামিনী সেন

গত পর্বের লিঙ্ক এখানে

পরিচ্ছদ ৫

আকাশের আলো নিভে এসেছে প্রায়। তাবলে অন্ধকার নেই কোথাও একটুও। শুধু সমকোণে বাঁক নেওয়া চওড়া রাস্তাটার ওপাশে নিস্পন্দ শুয়ে থাকা শূলীপুকুরের অন্ধকারে তলিয়ে যেতে চাওয়া জলটুকু ছাড়া। রাস্তার ধার দিয়ে জ্বলে ওঠা সার সার হ্যালোজেন আলোগুলো বা নতুন ত্রিশুল আলোগুলোরও যত কার্যকারিতা সব ফুরিয়ে আসে সেখানে।

রাস্তাতে কিন্তু আলো আর আলো। কিন্তু অন্ধকার কি নেই কোথাও? হ্যাঁ, তাও আছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখুন দেখি, শেষ হয়ে আসা দিনের আলোয় উত্তরফটকের দিকে এগিয়ে চলা ঘরমুখী ক্লান্ত পাগুলোর দিকে। ওখানেই মিলবে তার আভাস।

আরও আছে সে কোথাও কোথাও। এই যেমন, ঠিক ঐ সমকোণে বাঁক নেওয়া রাস্তাটার একদম উপরে তিনতলা কাচে ঘেরা মাইতি অ্যান্ড বেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেকের অফিস বিল্ডিংটা থেকে বেড়িয়ে আসা তিনটি ছেলেমেয়ের মুখে। রাস্তার বইতে থাকা আলোর প্রাচুর্য এসে পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে ওদের মুখে, দ্রুত সরে সরে যাওয়া গাড়ির হেডলাইটগুলো এসে ঠিকরে পড়ছে তাদের চোখের তারায় তারায়। মুখেও তাদের হাসি – তৃপ্তির, আশাতীত সাফল্যের। তবু অনির ভুরুতে যেন কিসের একটু ভাঁজ। আরও কিছু ভাঁজ একটু ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে কুণাল ও অর্করও মুখে।

“সুচির বাবা তো বেশ ভালো লোক রে। এক কথায় আমাদের মতো অ্যামেচার নাট্যগ্রুপের পিছনে এতগুলো টাকা!” কুণালের মুখে খেলে যায় তাৎক্ষণিক খুশির এক উচ্ছ্বাস।

“শুধু তাই নয়। বিজ্ঞাপনও তো জোগাড় করে দেবেন বললেন। ফিনান্সিয়াল দিকটা নিয়ে যা টানাটানি চলছিল, এবার সফিদা, পারুদি, বিপ্লবদাও খুব খুশি হবে। এই জন্যই এইসব টাকাওয়ালা লোকেদের ছেলেমেয়েদের গ্রুপে একটু আধটু রাখা দরকার, বুঝলি। নিজেদের মেয়েকে একটু মঞ্চে দেখা যাবে, ব্যস! অমনি বাবা-মা গলে জল।” কুণালের নির্ভেজাল খুশিতে একটু টক জল যোগ করে অর্ক।

অনি কিন্তু তাকিয়ে ছিল রাস্তার সব আলো পেরিয়ে উল্টোদিকে শূলীপুকুর নামক জমাট অন্ধকারটারই দিকে। কুণাল-অর্কর কথোপকথনে খুব একটা মন ছিল না তার। কী যেন অন্য কোনও ভাবনা খেলা করছিল তার চোখের তারায়। অর্কর কথার শেষদিকটা যেন হঠাৎ তাকে টেনে নামিয়ে আনে বাস্তবে। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে বলে, “সুচির মার কিন্তু তীব্র আপত্তি, মেয়ের এই নাটক করা নিয়ে। তিনি মনে করেন, তাঁর মেয়ের সব মেয়েলি ভালোত্বর সর্বনাশ ঘটছে আমাদের এই সঙ্গে। ফলে মেয়ে নাটকে আছে বলেই বাবা আমাদের টাকা দিচ্ছেন, এই যুক্তিটা কি খুব ধোপে টেঁকে অর্ক?”

“হ্যাঁ, সব কিছু অমন বাঁকা চোখে দেখিস কেন রে! কাকুর সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, কাকু তো আমাদের গোটা নাটকটার বিষয়েই বেশ ওয়াকিবহাল। শুধু সুচির পার্টটুকুর বিষয়ে তো নয়। আর বাদ দে তো কে, কেন, কী করল নিয়ে অত চুল চেরা বিশ্লেষণ। আমাদের বেশ কিছুটা সাহায্য জুটলো, এটাই বড় কথা।” কুণালও প্রতিবাদ করে অর্কর মন্তব্যর।

“আচ্ছা আচ্ছা। বুঝলাম। উনি একজন নির্ভেজাল ভালোমানুষ। নাটক খুব না বুঝলেও ভালোবাসেন। এমনিই আমাদের সাহায্য করেছেন। মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। হয়েছে?” সাইকেলটা টেনে নিতে নিতে আবার মন্তব্য করে অর্ক।

“সে তো বুঝলুম। কিন্তু তুই চললি কোথায়?”
“আজকে আর যাব না। একটু কাজ আছে। কাল রিহার্সালে দেখা হবে। বাই।” সাইকেলে বসে প্যাডেলে চাপ দেয় অর্ক।
বাকি দুই বন্ধুও এবার চেপে বসে সাইকেলে। পাশাপাশি যেতে যেতে কিছুটা গিয়ে মুখ খোলে কুণাল, “অনি, কী হয়েছে রে? তুই আজ এত চুপচাপ!”
“না, কিছু না। ভাবছি।”
“কী আবার ভাবছিস!”
“ভাবছি টাকাটা নেওয়াটা কতটা উচিত হল।”
“কেন রে? তোর মাথাতেও কি এবার অর্কর ভূত চাপল!”
“না। আমি জানি, উনি এটা আমাদের ভালোবেসেই দিয়েছেন। কিন্তু …”
“আবার কিন্তু কিসের!”

আর কথা বাড়ায় না অনি। চুপ করে থাকে কিছুক্ষণের জন্য। বেশ কিছুটা পথ পার হয়ে যায় দুই বন্ধু, পাশাপাশি, কিন্তু নীরবে। তারপর আবার মুখ খোলে অনি। “মিষ্টিমুখ বলে মিষ্টির দোকানটা চিনিস?”

“তোদের পাড়ায়? হ্যাঁ, চিনি তো। ওদের তৈরি রসকদম্ব তো বিখ্যাত। কেন?” সাইকেলটা একপাশে কাত করে উল্টোদিক থেকে আগুয়ান মোটরবাইকটাকে জায়গা ছেড়ে দিয়েই ডানদিকে বেঁকে কুণাল ঢুকে পড়ে ছোট রাস্তাটায়। কিন্তু ঢুকে পড়ে তাকে একটু অপেক্ষা করতে হয়। অনি বড় রাস্তাটা পেরিয়ে এদিকে আসতে পারেনি। ওপাশেই দাঁড়িয়ে আছে সাইকেলে। রাস্তার দুইপাশ থেকে দু’জন দু’জনের দিকে চেয়ে একটু হাসে। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলে সাইকেল, মোটর সাইকেল, রিকশা ও গাড়ির স্রোত।

মিনিট কয়েক বাদে ফাঁক পেয়ে অনি এপারে এলে কুণাল হেসে বলে, “তা হলে আর দেরি কেন? তাড়াতাড়ি কর। আমার বলে খিদেতে পেট জ্বলছে।”
“মানে!” ওর কথার খেই ধরতে না পেরে ভুরু কোঁচকায় অনি।
“ঐ যে বললি মিষ্টিমুখে খাওয়াবি। এই এই, কথা ঘোরাবি না কিন্তু। বামুনের ছেলে। রেগে গেলে কিন্তু অভিশাপ দিয়ে বসবো।” হো হো করে হেসে ওঠে দু’জনে।
“তা অভিশাপ দিয়ে আর হবেটা কী! তোর ঐ মিষ্টিমুখ তো গেল। শুনলি না কাকু বললেন, ঐ গোটা জমিটাই ওঁরা নিয়ে নিয়েছেন। মাল্টিস্টোরি কমপ্লেক্স তৈরি হবে।” হাসির হররাটা থামলে মুখ টিপে যোগ করে অনি।
“যাঃ। ও দোকানটা নিশ্চয়ই থাকবে। বরং দেখবি ওর পজিশনটা আরও ভালো হয়ে যাবে। উন্নয়ন বলে কথা …” অবিশ্বাসের হাল্কা হাসি খেলে যায় কুণালের চোখে।
“তা তো বটেই। তবে আমি ভাবছি অন্যদের কথা। দোকানটা ছাড়াও তো ওখানে আরও কেউ কেউ থাকে। ৮২ কাঠা জমি মানে তো আর একটা দোকান শুধু নয়। আর জানিসই তো, কারো পৌষমাস যখন, কারো সর্বনাশ তো হবেই। এখন প্রশ্নটা হল, সেটা কে?” অনির শেষ কথাক’টি ভেসে আসে খানিকটা সগতোক্তির ঢং’এ। তার চোখ কিন্তু তখন নিবদ্ধ সামনের রাস্তার আলোবিরল আধা অন্ধকারের দিকে।


পরিচ্ছদ ৬

নতুন কেনা ছিমছাম কালো ল্যান্সার গাড়িটা প্রায় নিঃশব্দেই এসে থামে মাইতি অ্যান্ড বেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেকের অফিস’এর পাশের সামান্য ফাঁকা জায়গাটায়। খুব একটা বড় জায়গা নয় মোটেও। দুই ডিরেক্টরের গাড়ি রাখার পর সেখানে আর খুব একটা জায়গা থাকে না পিছনের দরজাটাও পুরো খোলবার। ফলে ভারী শরীরটাকে একটু কষ্ট করেই জায়গা করে নিতে হয় নামবার।

নিঃশব্দেই লিফটটা এসে থামে দোতলায়। দরজাটা খুলে যেতে বেড়িয়ে আসে অমিতেশ। হাতের ইশারায় ড্রাইভারকে বলে, উপরে চলে যেতে। লিফটের দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে যায় তার পিছনে। স্যরের অ্যাটাচিকেস হাতে উপরে অদৃশ্য হয় ড্রাইভার মাণিক।

ত্রস্ত কাকলি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৭ ছুঁই ছুঁই। সে এবার উঠবার তোড়জোড় শুরু করেছিল। বেড়নোর আগে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে হাত ব্যাগটা নিতেই ফিরে এসেছিল নিজের ডেস্কে। কিন্তু অমিতেশকে দেখে ঠোঁট শুকিয়ে আসে তার।

অমিতেশও ওকে দেখে ভুরু কুঁচকে একবার নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকায়। তারপর কিছু না বলে শুধু জিজ্ঞেস করে, “সুজয় আছে?”
“হ্যাঁ স্যর। উনি তো ওঁর চেম্বারে। কাজে ব্যস্ত।”
“ঠিক আছে”, অমিতেশ এগিয়ে যায় সুজয়ের ঘরের বন্ধ দরজার দিকে। দরজায় একটা নক করে জানতে চায়, “আসতে পারি?” তারপর আধো উচ্চারিত “কাম ইন”টুকুর অনুমতি নিয়ে ঢুকে পড়ে ভিতরে।
অফিস বেয়ারার দিগম্বরের দিকে অবাক দৃষ্টি ফেরায় কাকলি। “অমিতেশ স্যর আজ সোজা দোতলায় এসে নামলেন! ওঁর তিনতলার গণেশমূর্তির কী হল!”
“বেচারির বোধহয় আজ উপোসই যাবে। কী আর হবে, আমাদের স্যর তো কোনদিন ফিরেও তাকান না ওর দিকে। আজ অমিতেশ স্যরও তো দেখি সোজা এখানেই এসে ঢুকলেন।” ফিচেল হাসি খেলে দিগম্বরের মুখে।
“তা তো ঢুকলেন। কিন্তু আমি এখন কী করি! ওদিকে ওকে দেখ। ঠিক সময়ে কেটে পড়ল।” মিতুনের ফাঁকা চেয়ারটার দিকে বিষদৃষ্টি হানে কাকলি।

আগামী পর্বের লিঙ্ক এখানে

অলংকরণ – শর্মিষ্ঠা দেবযানী


লেখক পরিচিতি: দামিনী সেন
গত শতাব্দীর শেষ পাদে জন্ম। ছেলেবেলা কেটেছে মফস্‌সলে। সেখানেই পড়াশুনো — স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। ঘুরতে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন পড়তে। জানেন একাধিক বিদেশি ভাষা। আগ্রহ বহুমুখী, কলমের অভিমুখও। কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস — সাবলীল তাঁর কলমের গতি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইতিমধ্যেই প্রকাশিত বেশ কিছু কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প। কাব্যগ্রন্থ “ভাঙা সে সাম্পান” প্রকাশের পথে। ধারাবাহিক উপন্যাস “ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী”-র মধ্য দিয়েই ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।