বাহুবলীর চরিত্র বিশ্লেষণ: মহেন্দ্র বাহুবলী

লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

আমি আগে একটি লিটিল ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখতাম। সেখানের সম্পাদকের সাথে আমার বেশ সখ্যতাও গড়ে উঠেছিল। তার মত মানু্ষ আজকাল প্রায় দেখাই যায়না। নিজের লেখার সাথে, সম্পাদনার সাথে কোনোরকম আপোষ সে করেনি। তার কলম কখনও কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি, এমনকি ম্যাগাজিনের কিছু পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক নেতাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় কিছু অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তার কলম, বারেবারে। এর জেরে তাকে ম্যাগাজিন ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু সে দমে যায়নি, নতুন ম্যাগাজিন খুলেছে তারপর। তার শত্রুদের ক্ষমতা দেখে আমি ভয় পেয়েছি, সাবধান করেছি, কিন্তু সে কোনও কথা শোনেনা। এমন আদর্শবাদী, প্রতিবাদী যে নিজের আদর্শের জন্য প্রাণও দিতে পারে, এরম মানুষ বইয়ের পাতায় বা সিনেমার পর্দাতেই দেখা যায়। কিন্তু ওই সম্পাদকদাদা হচ্ছেন এরমই বিলুপ্তপ্রায় মানুষদের একজন। কিছু মানুষ হয়, যারা অন্যায় একদম সহ্য করতে পারে না. সে অন্যায় যার সাথেই করা হোক না কেন। কোথাও কোনো অন্যায় দেখলেই গর্জে ওঠে তারা। তারা অন্যায়কারীর নাম , শক্তি , প্রতিপত্তি কিছুই দেখে না। তারা শুধু প্রতিবাদ করতে জানে। আর এরা আছে বলেই অন্যায়ের  প্রতিবাদ হতে থাকে।

আমাদের বাহুবলীর অন্যতম নায়ক শিবাও হল এরকমই এক প্রতিবাদী চরিত্র। অন্যায় যে কখনই  কোনও অবস্থাতেই সহ্য করে নি। শুরু থেকে বারে বারেই সে প্রতিবাদ করে এসেছে। যখন বাহুবলী ১ এ অবন্তিকাকে ভল্লালের সেনারা মারবার চেষ্টা করছিল, তখন সে এসে পুরো সেনাবাহিনীর সাথে একাই যুদ্ধ করে। যখন সে ভল্লালের রাজত্বে দেবসেনাকে  উদ্ধারের জন্য এসে উপস্থিত হয় এবং ভল্লালের সেনাদের মধ্যে সে মিশে থাকে, তখন ভল্লাল জিজ্ঞেস করে যে তার মূর্তি উন্মোচনের সময় কাউকে তারা দেখেছিল কিনা। কেউ উত্তর না দিতে পারে ভল্লাল তাদের গালাগালি দেয়, তখনও এগিয়ে আসে শিবা, “আমি দেখেছি মহারাজ” বলে এগিয়ে এসে আগুনের কুণ্ডটাই ফেলে দিয়ে পালায় সে। সর্বোপরি সে যখন নিজের বাবার মৃত্যুর কথা শোনে, শোনে মাহিস্মতিতে রাজা ভল্লাল দেবের অত্যাচারের কাহিনী, সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না, করতে পারে না। তখনই ছুটে যায় ভল্লালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে।
আবার আমরা দেখব তার প্রতিবাদ শুধুই মানুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে না, তার প্রতিবাদ মানুষের বানানো নিয়মের বিরুদ্ধেও। যখন তার মা সংজ্ঞা সে যাতে আর পাহাড়ে না চড়ে, এই মনস্কামনা নিয়ে দূর থেকে জল বয়ে এনে শিবলিঙ্গের মাথায় ঢালতে থাকে, সে এটা দেখে কষ্ট পায়। এবং স্বামিজিকে বলে কেন সে তার মাকে কষ্ট দিচ্ছে। স্বামিজি বলেন, “শিবের মনে কি চলছে আমি কি জানি?”
এ প্রশ্নে সে শিবলিঙ্গের কাছে আসে। শিবলিঙ্গের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে শিবের মনে কি চলছে। এখানে একটা জাগতিক সত্য তুলে ধরা হয়েছে। ভগবান কিন্তু মানুষকে কষ্ট দিয়ে তার জন্য কোনও কাজ করতে বলেননি। আমরা যে নিজেদেরকে কষ্ট দিয়ে বলি ভগবান খুশি হচ্ছে, এটা আমাদের বানানো নিয়ম। শিবা সেই নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করেছে। যদি শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢাললেই শিব খুশি তাহলে, শিবলিঙ্গকে জলের যেখানে উৎস সেখানে রেখে এলেই তো হয়! এই সোজা কথাটা আমরা বুঝিনা। শিবা ওরফে মহেন্দ্র বাহুবলী আমাদের সেটা বুঝিয়েছে, সে নিয়ম বদলে দেখিয়েছে।
শিবার মধ্যে আরও একটি গুণ আমরা দেখতে পাব পরিবারকে ভালবাসা। সে কখনই তার নিজের লোকের কষ্ট দেখতে পারেনি। যখন মাকে কষ্ট পেতে দেখেছে, সে শিবলিঙ্গকে কাঁধে তুলে নিয়েছে। যখন সে জানতে পেরেছে দেবসেনা নামের কেউ মাহিস্মতি রাজ্যে বন্দী, তাকে না আনলে তার ভালবাসা অবন্তিকা কষ্ট পাবে, তখন সে ছুটে গেছে দেবসেনাকে মুক্ত করতে। আর যখন সে জানতে পারে দেবসেনা তার জন্মদাত্রী মা এবং তার ওপর এত অত্যাচার হয়েছে, তখন তো আর থামতে দেখি না আমরা শিবাকে। সবচেয়ে বড় কথা সে যখন জানতে পারে অমরেন্দ্র বাহুবলী তার বাবা, তখন বাবার নামেই সে আলাদা গর্ব অনুভব করে।  কিছু মানুষ থাকে যারা নিজেরা যেমন মহান হয়, তেমনই  তাদের জন্ম হয় কোনও এক মহান বংশে। এবং সেই বংশে জন্মগ্রহণ করে গর্ববোধ করে তারা। এ গর্ব ঠিক বাজে অহংকার নয়, এ গর্ব হল Pride। তারা নিজেদের জীবনকালে যেমন  কীর্তি প্রতিষ্ঠা করে যায়, কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তি নিয়েই তারা যথেষ্ট গর্বিত থাকে।তাইতো জনগণের প্রতি শিবাকে আমরা বলতে শুনি “এই রাজ্যকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে রাজমাতা শিবগামীর পৌত্র, অমরেন্দ্র বাহুবলীর ছেলে মহেন্দ্র বাহুবলী ফিরে এসেছে।”
তবে মহেন্দ্র বাহুবলীর চরিত্রের সবচেয়ে বড় দিক বোধয় লক্ষ্যের প্রতি দৃঢ়তা। যাকে ইংরাজিতে বলি determination।  কিছু মানুষ হয় যারা কোনো লক্ষ্যের প্রতি এতটাই দৃঢ় হয়, যে সে লক্ষ্য যতই কঠোর হোক না কেন, নিজেদের নিষ্ঠা এবং অমানুষিক পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা তা অর্জন করেই ছাড়ে। ছোট থেকেই শিবা পাহাড়ের ওপর উঠবে এরম ছিল তার লক্ষ্য। কিন্তু অত বড় পর্বতে চড়া কি আর চাট্টিখানি কথা! তবে চেষ্টায় সব  সম্ভব, যদি যদি হাল না  ছেড়ে লাগাতার বছরের পর বছর পরিশ্রম করা যায়, তাহলে লক্ষ্যকে পাওয়া অসম্ভব কিছু না। শিবার মধ্যে দেখেছি আমরা, লক্ষ্যের ওপর স্থির থাকার সেই দৃঢ় মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। কোনো বাধাই তাকে এত তার পথ  থেকে,তার এই মানসিকতা থেকে সরাতে পারে না, টলাতে পারে না। এই দৃঢ় মানসিকতাই তাকে পরবর্তীকালে যুদ্ধে জিতিয়ে  তোলে।


শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।