সিনেমা রিভিউ: অ্যামাজন অভিযান

লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

  • সিনেমার নাম: অ্যামাজন অভিযান
  • পরিচালনা: কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
  • প্রযোজনা: এসভিএফ এন্টারটেনমেন্ট
  • অভিনয়: দেব, ডেভিড জেমস, স্বেতলানা গুলোকাভা এবং অন্যান্য সাবলীল শিল্পীরা।
  • সময়: ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট

চাঁদের পাহাড়ে বাঙালীর আফ্রিকা অভিযানের পর এবার সেই সিরিজের দ্বিতীয় ছবি, অ্যামাজন অভিযান । সৌজন্যে পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। সিনেমাটি এক কথায় ভালো না খারাপ  এভাবে ঠিক বলা যাবে না। অন্তত আমি তা বলতে পারব না। তার থেকে বরং সিনেমাটার ওপর একটু আলোকপাত করা যাক।

গত কয়েকদিন ধরেই পরিচালক, অভিনেতাদের ইন্তারভিউ টিভি বা সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা যাচ্ছে। আমার কোনোটা দেখা না হলেও শুনেছি তাতে তারা কিভাবে পরিশ্রম করেছে তার বর্ণনা দিয়েছে। সেটা শুনেছিলাম। আর হলে গিয়ে সিনেমাটা ডেকে আসার পর বুঝলাম সেটা সত্যি। অনেক পরিশ্রম করেছে।  চাঁদের পাহাড় বা অ্যামাজন অভিযানের আগে কিন্তু এইরকম সিনেমা বাংলায় হয়নি। গল্পের অভাব কোনোদিনই বাঙালীর ছিল না।  কিন্তু সেই সব গল্পগুলোকে সিনেমার পর্দায় ফুটিয়ে তোলা সবসময়ে সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে চাঁদের পাহাড়ের মত গল্পকে। কমলেশ্বর  সেটা সম্ভব করে দেখিয়েছেন। এবং শুধু চাঁদের পাহাড় করেই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি, বানিয়ে ফেলেছেন শঙ্করকে নিয়েই আরেকটি সিনেমা। বাঙালীর বোধয় এটা স্বপ্ন। শঙ্করের গল্প কেন একটাতেই শেষ হয়ে যাবে। কেন শঙ্কর আবার অভিযানে যাবে না! কমলেশ্বর অনেক বাঙালীর সেই স্বপ্নকে পূর্ণতা দিয়েছেন।
কিন্তু সমস্যা হল এই শঙ্কর, চাঁদের পাহাড় সিনেমাটা থেকেই বড় বেশি করে কমলেশ্বরের শঙ্কর, চ্যালেঞ্জের দেবের ছাপ মারা শঙ্কর। এই শঙ্কর আমাদের ছোটবেলার পড়া বিভূতিভূষণের সেই চাঁদের পাহাড়ের শঙ্কর নয়। এই শঙ্করের মধ্যে আমাদের ছেলেবেলার শঙ্করের থেকেও অনেকটা বেশি করে আছে হিরো দেব। তাই তো দেখেছিলাম চাঁদের পাহাড়ে সে বুনিপ মেরেছিল। বিভূতিভূষণের শঙ্করের দ্বারা যেটা সম্ভব হয়নি। বিভূতিভূষণের শঙ্কর অনেক বেশি যৌক্তিক, অনেক বেশি পরিণত। সে জঙ্গলের নিয়ম, প্রকৃতির নিয়ম জানত যে জঙ্গলে যে কোনও সময়ে যে কোনও কিছু ঘটতে পারে। তবে বুনিপ মারা দেখে হতাশ আমরা এবার আশা করেছিলাম কমলেশ্বরের শঙ্কর আগের থেকে একটু পরিণত হবে। কিছুক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু কাছের জনকে মারা যেতে দেখলে কমলেশ্বরের শঙ্করের মধ্যে জেগে ওঠে আমাদের দেখা ‘হিরোগিরি’র দেব। শঙ্কর তখন ভুলে যায় সে আমাজনের মত এক ভয়ঙ্কর জায়গায় আছে। ভুলে যায় জঙ্গলের নিয়ম।  তাই এবারেও তার সহযাত্রীর হত্যাকারীকে মারতে সে বদ্ধপরিকর হয়। বুনিপকে মারার মত এবারেও ফাঁদ পাতে। সেই ফাঁদে পা দেয় ভয়ঙ্কর সেই জন্তু এবং কমলেশ্বরের শঙ্কর তার বদলা পুরো করে। শুধু এটা হলেও না হয় হত। কিন্তু এ তো গেল বুনিপের মত বদলা নেওয়া। আর আগের বারে সিংহের সামনে যে কেরামতি দেখিয়েছিল, সেরম কিছুও তো চাই। তাই একজায়গায় সে জাগুয়ারের সাথে হাতাহাতি পর্যন্ত করে নেয়। এই হাতাহাতির পর প্রায় অক্ষত অবস্থায় থেকে কোমরের কাছ থেকে তার ছোট আগ্নেয়াস্ত্রটা বার করে একটা গুলিতে জাগুয়ারকে খতম করে। বিভূতিভূষণের শঙ্কর কি আর এতটা সাহসী ছিল?
আগের সিনেমার মতই এ সিনেমাটাও সেই পুরনো দেবের সিনেমাগুলোর মত তাকে হিরোরূপে নিয়ে আসে। নাহলে আর অভিজ্ঞ মার্কো ফ্লোরিয়ান কেনই বা দুর্বল ব্রিজ পেরোনোর সময় শেষমুহুর্তে হঠাৎ লাফ দিয়ে ব্রিজের কাঠ ভেঙে ফেলে! যাতে করে শঙ্কর তার হিরোগিরি প্রমাণ করতে পারে? যদিও সিনেমার মধ্যেই এটা পরিষ্কার যে দেব যথেষ্ট পরিশ্রম করছে তার পুরনো ইমেজ ভেঙে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু সিনেমার চিত্রনাট্য তাকে তা করতে দিচ্ছে না। শুধু তাই না, অন্যান্য ছোটখাটো লজিকাল সমস্যাও আছে। গ্রামে অ্যানা আসতে দেব প্রথমেই তাকে হাত ধরে গাড়ি থেকে নামায়, অথচ নেমে অ্যানা তার দিকে হাত বাড়ালে সে হঠাৎ সংস্কারী হয়ে নমস্কার করে। তাহলে আগে পাশ্চাত্য নিয়মে তার হাতটা ধরতেই বা গেল কেন? ভুলটা শঙ্করের না চিত্রনাট্যের? শঙ্কর যে মদ খায় না সে মার্কোকে একজায়গায় সেটা বলে। তাহলে সেই শঙ্কর কি ভুল করে  একজায়গায় মদ খেয়ে ফেলল? সেটা কি শঙ্কর কথায় কথায় গদ্গদ হয়ে ভুল করে  খেয়ে ফেলল নাকি চিত্রনাট্যের ভুলে? অ্যানাকোন্ডা মার্কোকে মুখে নিয়েও হঠাৎ ছেড়ে দিল কেন? শঙ্করকে দেখে ভয় পেয়ে পালাল? সে কি জানত এই শঙ্করই আফ্রিকার যে বুনিপকে কেউ দেখেনি, তাকে খুঁজে মেরেছিল? তাই কি তার ভয় পাওয়া? নাকি এখানেও দুর্বল চিত্রনাট্য? কিন্তু  চিত্রনাট্যের কথায় যখন এলাম, তখন এটা বলে রাখা ভাল যে এই পরিচালকের হাত দিয়েই কিন্তু বেরিয়েছে উড়ো চিঠি, মেঘে ঢাকা তারা বা ক্ষত’র মত সিনেমার গল্পগুলো। উড়ো চিঠি, মেঘে ঢাকা তারা তে গল্প বলার যে কৌশল সেটা এখানে কই? ‘ক্ষত’তে কি সুন্দর ভাবে সাসপেন্সটাকে তুলে ধরছিলেন তিনি। অথচ এখানে যখন সেই সাসপেন্সের ভীষণ রকম দরকার, আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি না। একসাথে আমাজনের সব বিপদ যেমন অ্যানাকোন্ডা, জাগুয়ার, ব্ল্যাক প্যান্থার, টারান্টুলা, ইলেকট্রিক ইল সবকিছু দেখাতে গিয়ে কোনও একটার প্রতি ফোকাস না হয়ে সাসপেন্সটাই যেন উধাও হয়ে গেছে। তাই আমাজন অভিযান অনেকটা যেন আমাজন ট্যুরিজম হয়ে গেছে। তবে একটা জিনিস এবারে ভালো হয়েছে সেটা হল পুরো সিনেমাটা বাংলায় অনুবাদ করে বলা হচ্ছে। নাহলে আগের মত ডিয়েগো সাহেবের বাংলা শুনতে শুনতে কানে কষ্ট হচ্ছিল। যদিও অনুবাদটার ওপর আরও একটু বেশি করে জোর দেওয়া উচিত ছিল।
জন্তুজানোয়ারের যে গ্রাফিক্স যেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে আসল নয়। তবে এখনই তো বাংলা সিনেমাকে হলিউডের সাথে তুলনা করলে চলবে না। তবে যতটা ভালো করা যায়, সেটা নির্মাতাদের দেখতে হবে। তাই সেটুকু দর্শককেই পুষিয়ে নিতে হবে। সিনেমাটোগ্রাফি খুব সুন্দরভাবে গল্পকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে। গল্পের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে আমাদের। একই কথা এডিটিং-এর ক্ষেত্রেও খাটে।  বাংলা সিনেমায় যে ধীরে ধীরে এরম ছবি হচ্ছে, সেটা একটা আমাদের বিশাল পাওনা। আগামী দিনেও শঙ্করের আরেক অভিযান হলে দারুণ হয়।


শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।