লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
- সিনেমার নাম: জুলফিকর
- পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
- প্রযোজনা: এসভিএফ এন্টারটেনমেন্ট
- অভিনয়: প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জী, কৌশিক সেন, দেব, পরমব্রত চ্যাটার্জী, যীশু সেনগুপ্ত, অঙ্কুশ হাজরা, নুসরত জাহান, কাঞ্চন মল্লিক, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, পাওলি দাম, নীল মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্য সাবলীল শিল্পীরা।
- সময়: ২ ঘণ্টা ১৯ মিনিট
জুলফিকর সিনেমার প্রথম ট্রেলার দেখার পর থেকেই ধরে নিয়েছিলাম এটা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটা অন্য জায়গা করে নেবে। ট্রেলারের মধ্যেই এতকিছু উপাদান, তাহলে অবশ্যই সিনেমাটার মধ্যে অনেককিছু থাকবে। সে সব নিশ্চয়ই আছে। শেক্সপীয়ারের দুটো নাটক অবলম্বনে যখন এই সিনেমা, তখন তাতে উপাদান তো থাকবেই। প্রচুর উপাদানে ঠাসা সিনেমাটি খুব বড় হোটেলে গিয়ে ভারী খাবার খাওয়ার মত হয়ে গেছে, খেতে খেতেই পেটটা যেন একটু গণ্ডগোল করছিল। কারণ আর কিছুই না, খুব কম সময়ে অনেক ভারী খাবার খাওয়া হয়ে গেলে যা হয়। পরিচালক সৃজিত মুখার্জি বোধহয় শেক্সপিয়ারের যে কোনও একটি নাটক অবলম্বনেই সিনেমাটি বানাতে পারতেন। কিন্তু এর আগে আমরা ওনার সিনেমাগুলোতে যে জিনিসটা দেখেছি সেটা হল একটা সিনেমার মধ্যে অনেকগুলো গল্প। সেটাই ওনার বিশেষত্ব। কিন্তু এবারে সেই বিশেষত্বটাই যেন এই সিনেমাটিকে তার আগের সিনেমাগুলোর মত হতে দেয়নি।
সেই অটোগ্রাফ দিয়ে ২০১০ সালে সৃজিত মুখার্জীর পূজোয় যাত্রা শুরু। তারপর থেকে প্রতি বছরই তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন একের পর এক দুর্দান্ত সিনেমা। আর তার সিনেমার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল একটা সিনেমাতেই অনেকগুলো গল্প থাকবে। আরও ভাল ভাবে বলতে গেলে তিনি কোনও একটি বিশেষ মানুষজনের জন্য সিনেমা বানান না। তার সিনেমার দর্শকেরা সব দলের। তিনি কোন দর্শককে হতাশ করেননা। তাই তার সিনেমাগুলো সবই সুপারহিট। “জুলফিকর” সিনেমাটিও সুপারহিট হবে সে নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা “বাইশে শ্রাবণ” বা “রাজকাহিনী” হবে না। মাত্র আড়াই ঘণ্টা সময়ের মধ্যে পরিচালক এতগুলো চরিত্রকে বাঁধতে চেয়েছেন যে, কোথাও গিয়ে মনে হয়েছে তিনি চরিত্রগুলোর সাথে সুবিচার করেননি, তাদের বিকশিত হতে উপযুক্ত সময় দেননি। বিশেষ করে আকতারের চরিত্রটি। আকতার যেন কাকার মৃত্যুর পর গান ছেড়ে হঠাৎই মাফিয়া হয়ে উঠল, এবং রীতিমত “গদফাদার” সিনেমার “মাইকেল করলিওনি” –এর মত করে। সিনেমার শেষের অংশ “গদফাদার”এর শেষটাকেই মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু “গদফাদার”-এ মাইকেলের চরিত্রকে বিকশিত হতে পরিচালক সময় দিয়েছিলেন অনেক, তিন ঘণ্টার মত। এখানে তো মাত্র আড়াই ঘণ্টাতেই অনেকগুলো চরিত্র ভিড় করেছে, সেখানে আকতার তাই ওইটুকু সময়েই তাবড় মাফিয়া হয়ে গেছে, কারণ তাকে সেটা হতেই হতো। টোনি আর অ্যালবিনার প্রেম তো এতটাই তাড়াতাড়ি যে হঠাৎ একটি গানের শুরুতে তাদের দেখা হয়েই টোনির মনে প্রেম চালু হয়, তবে অ্যালবিনার মনে কি আছে সেটা না বুঝিয়েই অন্য একটি গানের মধ্যে তাদের বিয়ে হয়, বাকি আর কোথাও তাদের প্রেম করতে দেখা যায়নি। সেক্ষেত্রে তাদের বিয়ে আগে থেকেই দিয়ে দিলেই যেন ভাল হত। প্রেম করবার জন্য শুধুমাত্র মার্কাজ আর রানী তলাপাত্র বেশ কিছুটা সময় পেয়েছে। তাই তাদের প্রেমটা অনুভব করা যায়, তাদের কোনও দুঃখে চোখে জল আনা যায়। তবে তাদের প্রেম তো আর “জুলফিকর”-এর মৃত্যুর চেয়ে বড় নয়। সেটা পরিচালক চাননি বোধহয়। তাই জুলফিকরের হত্যার বদলা সারা সিনেমা জুড়েই থাকে, থাকাই উচিত। তবে এই বদলা নেওয়ার মধ্যেই আরও অনেক কিছু যখন হতে থাকে তখন যেন খাবারটা ভারী ভারী মনে হয়, পেটটা যেন একটু আইঢাই করে। মনে হয় সিনেমাটা শুধুমাত্র “জুলিয়াস সীজার” থেকে অনুপ্রাণিত হলেই ভালও হত। অন্তত একদিকে মন দেওয়া যেত, এখানে তো গল্পের এত সুপারফাস্ট গতিতে ঠিকমত মনই দেওয়া গেল না। গল্পের যে মুখ্য চরিত্র, জুলফিকর, তার যে হত্যার দৃশ্য, সেটা সবাইই জানি, যারা শেক্সপীয়ার পড়েছে তারা তো জানে, যারা পড়েনি, তারা এতদিনে ট্রেলারে দেখে জেনে নিয়েছে। কিন্তু তার ঐ হত্যার দৃশ্য অবধি সাসপেন্সটা ধরে রাখা যায়নি, ধরে রাখা হয়নি, গল্পের গতিই যে এতটা দ্রুত! গল্পটাকে খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে জুলফিকরের হত্যার দৃশ্যে আনা হয়েছে। সে দৃশ্যে পরিচালক আমাদের হতাশ করেননি। তখন দর্শক নড়েচড়ে বসে। কিন্তু তারপর আবার গল্প শিথিল হয়ে পড়ে দ্রুততার জন্য। সঙ্গে আরও একটি ব্যাপার আছে, গান এবং আবহসঙ্গীত! গানগুলোই যেন সিনেমাটাকে জীবন্ত করে তুলেছে। অন্যসময় কানদুটো যেন একটু অস্বস্তিতে ভুগছে। সেটা আমার দুটো কানের সমস্যা হতেই পারে, তবু লিখলাম। আসলে এতদিন ধরে ট্রেলার দেখে বা গানগুলো শুনে আমাদের মনে আবহসঙ্গীতের এমন একটা ধারনা তৈরি হয়ে গেছে, যখন সিনেমার সংলাপের সাথে সেইভাবে কোনও আবহসঙ্গীত নেই, তখন কেমন ফাঁকা লাগছে। গানগুলো তো দুর্দান্ত, দুর্দান্ত তাদের দৃশ্যায়নও, শুধুমাত্র একটি ছাড়া। নচিকেতার গলায় গাওয়া “এক পুরনো মসজিদে” গানটির যে দৃশ্যায়ন আলাদাভাবে দেখানো হয়েছিল, সেটি সিনেমায় নেই। সিনেমায় যখন নাম দেখানোর সাথে গানটি চলতে থাকে, তখন যেন মনে হয় গানটির প্রতি অবিচারই করা হয়েছে।
সিনেমার এডিটিং ঠিক ভাল হয়নি, বিশেষ করে দু একটি জায়গায় খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এতকিছু লিখলাম মানে সিনেমাটিকে কিন্তু খারাপ একবারও বলব না, আসলে পরিচালক সে আশা আমাদের মনে এতদিন ধরে দেখিয়েছিলেন, সেটা এখানে পাইনি, তাই আশাহত হয়ে এত কথা লিখলাম। এবার সিনেমার কিছু ভাল দিক দেখব! সেই কথা লিখব, কি কি বিষয়ে তিনি আমাদের মন জয় করে নিয়েছেন, তা না বললেই নয়। দুটো বিষয় সিনেমায় খুব সুন্দর। একটা তো আগেই বলেছি, গানগুলো। ওগুলোই যেন জীবন্ত করে তুলেছে সিনেমাটাকে, দ্বিতীয় হল অভিনয়। প্রত্যেকে তাদের চরিত্রে দাপটের সাথে অভিনয় করে গেছে। বাসিরের চরিত্রে কৌশিক এবং কাশীনাথের চরিত্রে যীশু দুর্দান্ত। তাদের জন্যই যেন লেখা হয়েছে ঐ দুটো চরিত্র। কিছু কিছু দৃশ্যায়ন তো অসামান্য। যখন বাসিরকে কাশীনাথ জুলফিকরের বিরুদ্ধে ওসকায়, সেইখানের দৃশ্যায়ন “জুলিয়াস সিজার” নাটকের কথাই মনে করায়, আমাদের মনে সেই অনুভব জাগায়। আর “জুলিয়াস সিজার” নাটকের সবচেয়ে বেশি অনুভব হয় জুলফিকরের হত্যার দৃশ্যে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐ দৃশ্য। যদিও জুলফিকরের মুখে নাটকের “এট টু ব্রুটে” এর বাংলা সংস্করণ আমরা শুনি, কিন্তু তার আগে বাসিরের গুলিতে আক্রান্ত হয়ে শুধুমাত্র চোখ দিয়েই বুম্বাদা এই সংলাপটি যেন বলে দিয়েছেন। তার চোখেমুখের যে অভিনয় এবং পড়ে যাওয়ার মধ্যেই যেন তিনি এও বলে দিয়েছেন, “দেন ফল সিজার!” দেব কথা না বলে শুধুমাত্র চোখমুখ দিয়েই খুব সুন্দরভাবে মার্কাজ চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছে। তার অভিনয় দক্ষতা এই চরিত্রে প্রকাশ পেয়েছে খুব সুন্দ্রভাবে। পাওলি দামের অভিনয় এবং তার চরিত্র করিশ্মার দৃশ্যায়ন দুটোই খুব সুন্দর। আসল নাটকে ক্যালপুরনিয়ার জায়গা খুব একটা বেশি নেই। এখানে পরিচালক নিজের মত করে করিশ্মা চরিত্রটিকে সাজিয়েছেন এবং খুব সুন্দরভাবেই সাজিয়েছেন। আসলে তার নিজের বানানো চরিত্র বলেই হয়ত তার মধ্যে আমরা পুরনো সৃজিতকে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু তাছাড়া আর সেইভাবে সৃজিত নেই। “বাইশে শ্রাবণ”, “চতুষ্কোণ” বা “রাজকাহিনী”-র মত মনের গভীরে দাগ কাটা নেই। আর নেই বলেই আমরা হল থেকে বেরিয়ে আনন্দে ঠাকুর দেখার মাঝে সিনেমাটিকে অনায়াসে ভুলে যেতে পারি।
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।