সিনেমা দর্শন : শিন্ডলার্স লিস্ট

লেখক : পিনাকী চক্রবর্তী

সিনেমার নাম: শিন্ডলার্স লিস্ট (Schindler’s List)
পরিচালনা: স্টিভেন স্পিলবার্গ
প্রযোজনা: স্টিভেন স্পিলবার্গ, জেরাল্ড আর মোরেন, ব্রঙ্কো লুসটিগ।
অভিনয়: লিয়াম নেসন, বেন কিংসলে, র‍্যালফ ফিনেস, ক্যারোলিন গোডাল, প্রমুখ শিল্পীরা
সময়: ১৯৫ মিনিট (৩ঘণ্টা ১৫ মিনিট)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর তৈরি মানবিক ছবি গুলোর মধ্যে অন্যতম আমেরিকান এপিক ইতিহাস নির্ভর নাটকীয় ক্ষেত্রের চলচ্চিত্র হচ্ছে “শিন্ডলার্স লিস্ট”; ১৯৯৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে নভেম্বরের ৩০ তারিখে ও ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে ইউনাইটেড স্টেটসে সিনেমাটি মুক্তি পায়, পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের অন্যতম সেরা ক্লাসিক পর্যায়ের সিনেমা। থমাস কেনেলির “শিন্ডলার্স আর্ক” প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে, একটি ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস থেকে সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন স্পিলবার্গ। গল্পটি মানবিক গল্প এবং যুদ্ধের বিধ্বস্ত, ভগ্ন, ও ক্ষিপ্ত মানবিক দিকের বিপরীতগামী। আদি ও অনাদি অনন্তশয্যায় শায়িত বিশ্বসভ্যতা, যুগ যুগ ধরে জলপ্রপাতের মতনই বয়ে চলে। শোকসন্তাপ, ক্ষোভ ক্ষরা, অথবা লাভ ও লোভের গভীর গহন সমীকরণে ধেয়ে আসছে যুদ্ধ। যুদ্ধের সাথেই রয়েছে যুদ্ধবন্দী, শুধুই বুঝি লড়াই চলে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে! মননে, বিবেকের পৃষ্ঠভূমিতে, অথবা ভবিষ্যতের বিচারসভাতেও চলে বিচার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল (১৮৩৯ সাল, ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৫ সাল, ২ সেপ্টেম্বর), জার্মান বাহিনী ক্রাকো দখল করে নিয়েছে, একটি প্রাচীন পুরাতন স্বপ্নের স্থাপত্যের মতন ইহুদী অধ্যুষিত পোল্যান্ডের অংশ। নাৎসি বাহিনী অঞ্চলটি দখল করে নেয়। পূর্ব ইউরোপের অধিকৃত অঞ্চলকে জার্মানির নাৎসি বাহিনী নিজেদের সমান্তরাল প্রশাসন চালায়, এইরকম একটা অঞ্চলে জার্মান ব্যবসায়ী অস্কার শিন্ডলার নাৎসি বাহিনীর সমর্থক হিসেবে মেটাল, গ্লাস, সেরামিকের ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে ওঠেন। এই যুদ্ধের কালোবাজারি মরশুমে লাভের অঙ্ক আরও স্ফীত করবার জন্য ইহুদী ব্যবসায়ী, নাৎসি বাহিনীর উঁচু পদে থাকা অফিসারদের সাথে সম্পর্ক ভাল করে, এর ফলে ব্যবসা আরও বড় হয়ে যায়। এই ব্যবসার জন্য প্রচুর কর্মীর দরকার হয়। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ইহুদী বন্দীদের কাজে লাগানোর জন্য নাৎসি অফিসারদের সাথে আর্থিক লেনদেনের কথা শুরু হয়। এই যুদ্ধবন্দীদের মৃত্যুই ছিল ভবিতব্য, তবুও নিয়তির নিয়ত মুচকি হাসি বন্দীদের বেঁচে থাকবার আশা দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে সেখানে আসে এমন গেথে নামে এক নিষ্ঠুর জার্মান অফিসার, নির্বিচারে যিনি নির্দেশ দেন দুই হাজার ইহুদীদের গুলি করে খতম করবার। শুরু হয় গুলির গুলতানি, যখন যেমন ইচ্ছা মুহূর্তে শিশুর হাতে শোভিত খেলনা হয়ে ওঠে বারুদ ভরা বন্দুক, ইহুদী বন্দীদের নিয়ে এক অমানবিক মৃত্যু আর নির্যাতনের “মিউজিক্যাল চেয়ার গেম” শুরু হয়, আর দু’হাজার বন্দীদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। জার্মানি এই সময় যুদ্ধে হারছে। শিন্ডলার এই সময় চোখের সামনে মৃত্যু মিছিল দেখছেন, গণহত্যার মৃতদেহের স্তূপ দেখছেন, একটি সুস্থ সুন্দর মিষ্টি নিষ্পাপ রেড কোট  চাপানো মেয়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখেছেন, আবার সেই মেয়েটির দেহকে মৃতদেহ হয়ে যেতেও দেখেছেন! ঠিক করে ফেলেন, এই বন্দীদের যে কোন ভাবেই হোক বাঁচাতে হবে। রীতিমত মোটা অঙ্কের বিনিময়ে একেকজন বন্দীর জীবন রক্ষা করেন, ঠিক হয় প্রায় ১১০০ জনের নাম তালিকাভুক্ত করে তাদের ওনার অন্য ফ্যাক্টরিতে লুকিয়ে রাখা হবে, যুদ্ধ শেষ না হওয়া অবধি। এই নিয়েই সিনেমার গল্প এগিয়েছে।

সিনেমাটিকে বুঝতে, হাঁটু ভাঁজ করে নতজানু হয়ে দর্শকদের বসতে হয়নি, তার পরিবর্তে সহমর্মী ও সহজাত ভালোবাসা নিয়ে, মানবিক হলেই, সাদাকালো ক্যামেরায় এক মানবিক মহাকাব্যের আখ্যান প্রস্ফুটিত হয়েছে, যার কারিগর পরিচালক।

সিনেমাটির প্রতিটি দৃশ্য মানবিক হয়ে উঠেছে। একটি দৃশ্যে আছে, যেখানে অশীতিপর বৃদ্ধ জীবনের লোভে নিজের কর্মী হওয়ার গৌরব প্রকাশ করেন। জার্মান সেনারা বুড়ো বন্দীদের গুলি করে মারছিল, এই বৃদ্ধ ভেবেছিলেন হয়ত বা এই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছেন। কিন্তু ভবিতব্য সাদা বরফে রক্তের দাগ! যুদ্ধবন্দীদের প্রতি করা অত্যাচারের প্রতিটি দৃশ্য প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। দেখতে দেখতে মনেই হয়না এটা চলচ্চিত্র, মনে হয় আমরা বুঝিবা দেশ, কাল, সময় ছাপিয়ে বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠেছি। আমরা হয়তো নিজেরাই সিনেমার চরিত্র। এইরকম আরও অনেক দৃশ্য রয়েছে, জার্মান ব্যবসায়ী শিন্ডলার মানবিক হয়ে উঠবার মুহূর্তরা চোখে জল এনে দেবে, যে কোনও স্নেহশীল মানুষকে কাঁদিয়ে দেবে। ইহুদী বন্দীদের থেকে ভালোবাসার অভিজ্ঞানরূপে আংটি পাবেন, প্রাণরক্ষার ও বিদায়বেলায় মালিক সিন্ডলারের প্রতি কর্মচারী ও প্রাণে বেঁচে যাওয়া ইহুদী যুদ্ধ বন্দীরা, যাদের প্রাণের বিনিময়ে মোটা ঘুষ দিয়ে ছিলেন, এবং জার্মানি আত্মসমর্পণ করলে শিন্ডলার নিজের চেষ্টা ও চেষ্টা সত্ত্বেও ব্যর্থ হওয়ার যন্ত্রণা ব্যক্ত করেন, সেই দৃশ্যগুলো সিনেমাপ্রেমীদের অদ্ভুত, অনাবিল অভিজ্ঞতা উপহার দেবে। মানুষ হয়েও মানুষ হয়ে ওঠবার চেষ্টা মানুষই যে কোন পরিস্থিতিতে যে কোন সময় শুরু করতে পারে। এর জন্য আলাদা কিছু নয়, কেবল মানবিক হয়ে উঠবার ইচ্ছাটা থাকা দরকার। এর পাশাপাশি সিনেমাটির মধ্যে হাল্কা, স্থির, শান্ত হিংস্রতা রয়েছে, যেটি মর্মান্তিক হয়ে ওঠে, দেখতে দেখতে দমবন্ধ হয়ে আসবে, অথচ মৃত্যুর নিষ্ঠুর খেলা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, সেই দৃশ্যগুলো ভাবিয়ে তোলে। যৌনতার যৌনমুক্তির বার্তা শুনতে পায়নি নিষ্ঠুর মৃত্যুর খেলায় মগ্ন মৈনাক হয়ে থাকা জার্মান অফিসার এমন গেথে, যার হাতের বন্দুকের ট্রিগারে ছিল ইহুদী বন্দীদের জীবন! শেষে অবশ্য প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল গেথেকে, কিন্তু বহু নিষ্পাপ, সুন্দর, মানুষকে বিনা কারণে গুলি করে খুন করেছিলেন। সেই গুলির মুহূর্তগুলির সাথে দর্শক হিসেবে সহবাস করা খুবই মর্মান্তিক যন্ত্রণাদায়ক।

মানবিক মূল্যবোধ এই আজকের পৃথিবীতে তলানিতে এসেছে, কিন্তু এই ছবির গল্প মানবিক হয়ে উঠবার মন্ত্রোচ্চারণ করে, এক ব্যবসায়ীর কালোবাজারি মুনাফা লুঠের মানুষ থেকে মানুষের জীবনের মূল্য বুঝে মহামানব হয়ে উঠবার মুহূর্তগুলোকে উৎসবের মতন উদযাপন করে। সব উৎসবেই আনন্দ থাকে না, আবার চোখের জল মানুষের জীবনের মূল্য নির্ধারণ করেও উৎসব করে। এমন সিনেমার কাছে শুধু চোখের জলের ঋণ থেকে যায়। কেন যুদ্ধ হয়? কেন খুন হয়? কেন গণহত্যার সম্মুখীন হয় যুদ্ধবন্দীরা? মানবিক মূল্যবোধ ভূলুন্ঠিত হয়েছে, হবে, কিন্তু দায় কার? এই এসব প্রশ্নের চেয়েও সেই অপরাধ থেকে, মানবিক দংশন থেকেও মূল্যবোধ ক্ষয়িত অপরাধী হয়ে, মানুষের হাতেই রয়েছে মানব সভ্যতাকে রক্ষার জিয়ন কাঠি।


লেখক পরিচিতি : পিনাকী চক্রবর্তী
পেশাদার লেখক। চিত্রনাট্যকার ও কন্টেন্ট, স্টোরি লেখেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন

দীপায়ন