আম্রচরিত – প্রথম পর্ব

লেখক: রানা চক্রবর্তী

বৈজ্ঞানিক নাম ‘ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা’, সংস্কৃতে ‘আম্র’, বাংলায় ‘আম’, ইংরেজিতে ‘ম্যাংগো’, মালয় ও জাভা ভাষায় ‘ম্যাঙ্গা’, তামিল ভাষায় ‘ম্যাংকে’ এবং চীনা ভাষায় ‘ম্যাংকাও’। আম অর্থ সাধারণ। সাধারণের ফল আম। রসাল বা মধু ফলও বলা হয় আমকে। রামায়ণ ও মহাভারতে আম্রকানন এবং আম্রকুঞ্জ শব্দের দেখা মেলে।

ধারণা করা হয়, আম প্রায় সাড়ে ছয়শো বছরের পুরানো। জন্মস্থান নিয়ে রয়েছে নানা তর্ক-বিতর্ক। বৈজ্ঞানিক ‘ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা’ নামের এ ফল ভারতীয় অঞ্চলের কোথায় প্রথম দেখা গেছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আমাদের এই দেশেই যে আমের আদিবাস— এ সম্পর্কে আমবিজ্ঞানীরা একমত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে আলেকজান্ডার সিন্ধু উপত্যকায় আম দেখে ও খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এ সময়ই আম ছড়িয়ে পড়ে মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ ও মাদাগাস্কারে।

চীন পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩২ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এ অঞ্চলে ভ্রমণে এসে বাংলাদেশের আমকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করেন। ১৩৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে আফ্রিকায় আম চাষ শুরু হয়। এরপর ১৬ শতাব্দীতে পারস্য উপসাগরে, ১৬৯০ সালে ইংল্যান্ডের কাচের ঘরে, ১৭ শতাব্দীতে ইয়েমেনে, উনবিংশ শতাব্দীতে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে, ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে আম চাষের খবর জানা যায়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মাটিতে প্রথম আমের আঁটি থেকে গাছ হয়। এভাবেই আম ফলটি বিশ্ববাসীর দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। মোঘল সম্রাট আকবর ভারতের দ্বারভাঙায় এক লাখ আমের চারা রোপণ করে উপমহাদেশে প্রথম একটি উন্নত জাতের আম বাগান সৃষ্টি করেন।

আমের আছে বাহারি নাম বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ। ফজলি, আশ্বিনা, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি, গোপালভোগ, মোহনভোগ, জিলাপিভোগ, লক্ষণভোগ, মিছরিভোগ, বোম্বাই ক্ষীরভোগ, বৃন্দাবনী, চন্দনী, হাজিডাঙ্গ, সিঁদুরা, গিরিয়াধারী, বউভুলানী, জামাইপছন্দ, বাদশাভোগ, রানীভোগ, দুধসর, মিছরিকান্ত, বাতাসা, মধুচুসকি, রাজভোগ, মেহেরসাগর, কালীভোগ, সুন্দরী, গোলাপবাস, পানবোঁটা, দেলসাদ, খিরসা, অরুনা, আম্রপালি, মল্লিকা, সুবর্নরেখা, মিশ্রিদানা, নিলাম্বরী, কালীভোগ, কাঁচামিঠা, বারোমাসি, তোতাপূরী, কারাবাউ, কেঊই সাউই, গোপাল খাস, কেন্ট, সূর্যপূরী, পাহুতান, ত্রিফলা, হাড়িভাঙ্গা, ছাতাপরা, গুঠলি, লখনা, আদাইরা, কলাবতী ইত্যাদি প্রায় ৩৫০ জাতের আম বর্তমানে পাওয়া যায়। তবে অনেকগুলো প্রজাতি এখন বিলুপ্তপ্রায়।

ভারতের জাতীয় ফল আম। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে আম গাছকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদ অধিবেশনে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে আম গাছকে নির্বাচন করা হয়। সবচেয়ে দামি ও জনপ্রিয় আমের নাম ‘আলফানসো’। ভারতে উৎপাদিত এ জাতের এক কেজি আমের দাম ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪০০ টাকা। মায়ানমারের জনপ্রিয় আম রাঙ্গু দেখতে আকর্ষণীয়, খেতে সুস্বাদু। ভারতের গবেষকরা ১৯৭৮ সালে ‘দশহরি’ ও ‘নিলাম’ এ দুটি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে পৃথিবীর বিস্ময়কর জাতের আম উদ্ভাবন করেন; যার নাম ‘আম্রপালি’।

বাঙালি শিশুর অক্ষর পরিচয়ের শুরু একটি ফলের হাত ধরে। ‘অ’-তে অজগর আসছে তেড়ে; ‘আ’-তে আমটি আমি খাবো পেড়ে। কচি রিনরিনে গলায় এ বীজমন্ত্র আউড়ে এগিয়ে চলে তার প্রথম পাঠ। জীবনের সেই ঊষালগ্নে বাঙালি শিশুর মনোভূমে আমের যে মিষ্টি মধুর গোড়াপত্তন হয়, তা চিরদিন থাকে অটুট। অক্ষয়। অজর। নির্বিষ অজগর শারীরিক গঠনের কারণেই কাউকে তেড়ে আসতে পারে না। তবু এর সামান্যতম উল্লেখই শিশুর মনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে শিশুকে স্বস্তির আবহে ফিরিয়ে আনতে তাই দ্বিতীয় বাক্যটিতে অতিদ্রুত তার কচি মুঠোয় গুঁজে দেয়া হলো বাংলার মধুর মিষ্টি ফল আম। পরিত্রাতার ভূমিকায় আমের এই আবির্ভাব শিশুর মনে যে চিরস্থায়ী আসন গড়ে তোলে, তা কি অন্য কোনো ফল কখনো কেড়ে নিতে পেরেছে?

এরই মধ্যে অভিভাবকদের কেউ হয়তো রবীন্দ্রনাথের আমসত্ব দুধে ফেলে, কলা সন্দেশ মাখা পিঁপড়ে কাঁদানো রসসিক্ত মিষ্টি ছড়াটি শিশুটিকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। সেই নিস্তব্ধ দুপুরে বালক রবির ছড়ার হাপুসহুপুস শব্দের জলতরঙ্গে আমাদের নবীন পড়ুয়ার ভেসে যেতে বিন্দুমাত্র অনীহা দেখা যায়নি। আরেকটু বড় হয়ে আমাদের তরুণ পড়ুয়াটি ছাপা হরফের আলোছায়া মাখা, কিছুটা বোঝা আর কিছুটা না বোঝা শব্দের পথ ধরে যেতে যেতে সাক্ষাৎ পেল এক বালকের। বয়সে একটু বড় এ ছেলেটির নাম খোকা। লেখাপড়ার বালাই সম্ভবত ছিল না এর। মাথায় কিসের বোঝা জিজ্ঞেস করায় উত্তর এল—

“আমের ঝাঁকা।
খাসনি কেন?
দাঁতে পোকা।
বিলাসনি কেন?
ওরে বাবা!”

মনে হয় না খোকা দাঁতে পোকার কারণে আম খেতে পারে না। আবার আম বিলিয়ে দেয়ার অধিকারও তার নেই। সে আম বহনকারী মাত্র। ফলের আস্বাদন তার আয়ত্তের বাইরে। খোকার অধিকার তবু কর্মে। ফলে নয়, বিদ্যার অধিকার তো নয়ই। আমাদের পড়ুয়ার মনে অবশ্য ছড়াটি পড়ার পর এত সঠিক তত্ত্ব মাথায় আসেনি, এসেছিল অনেক অনেক পরে পরিণত বয়সে। এতক্ষণে আমের ঝাঁকা মাথায় নিয়ে ভারবাহী পশুর মতো খোকা ধীরে ধীরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে গেছে। হয়তো আজো এমনি করে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের রৌদ্রদগ্ধ দুপুরে আমের ঝাঁকা মাথায় নিয়ে সে হেঁটে চলে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে।

এত দিন পর্যন্ত আমাদের পড়ুয়া ছিল তবু শ্রোতা বা দর্শকমাত্র। এবার তার সকর্মক হওয়ার পালা, বয়সও একটু বেড়েছে, সময় এসেছে তার বালক বীরের বেশে হাজির হওয়ার। হয়তো এসেছে নতুন খেলার উপকরণ, নতুন অস্ত্র— আম পাতা জোড়া জোড়া, এটাই তার চাবুক, এবার খোকা মারবে চাবুক চলবে ঘোড়া। বীরের আম পাতার চাবুকের ঘায়ে কাল্পনিক ঘোড়া ছুটে চলেছে ত্রাহি রবে, সঙ্গে বালক বীরের মুখে উচ্চকিত সতর্কবাণী নিরীহ জ্যেষ্ঠ ভগিনীর উদ্দেশে: ‘ওরে বুবু সরে দাঁড়া, আসছে আমার পাগলা ঘোড়া’। সেই যে ঘোড়া ছুটল, তা শত শত বছর পেরিয়ে শাশ্বত বাংলায় আজো অবিরাম ছুটে চলেছে। এমনি করে চিরন্তন বাংলার চিরন্তন শিশুর সঙ্গে যুগ যুগ ধরে ঘটে চলে আমের নব নব পরিচয় বিভিন্ন প্রেক্ষিতে, জীবনের ভিন্ন ভিন্ন বাঁকে।

বাল্মিকীর রামায়ণ বোঝার বা হাতে পাওয়ার অনেক আগেই শুরু হয়েছে তার নিজস্ব ভাষায়, নিজস্ব ভঙ্গিতে, নিজ মনোভূমে সঞ্জাত এক অপূর্ব শিশুকাব্য, যাকে ‘আমায়ন’ বললে খুব বেমানান হবে না। এই ‘আমায়ন’ প্রজন্মের পর প্রজন্ম রচনা করেছে শিশুরা তাঁদের কল্পনার কালি-কলম দিয়ে। এ রচনার কোনো শুরুও নেই শেষও নেই। এখানে অশোক বন নেই, নেই কোনো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, নেই কোনো পরাজিত, পুত্রহারা স্বজন-হারা বিতর্কিত নিন্দিত রাজন্যের বিলাপ। বানর বা কাঠবিড়ালি রাক্ষস-খোক্কস তার কল্পনার জগতে থাকতে পারে, কিন্তু নেই কোনো অগ্নিপরীক্ষা বা বনবাসের মতো কোনো নিষ্ঠুর অনুজ্ঞা। এই আমায়ন যেন এক ‘ফিলগুড’ আমায়ন। এখানে বিষাদ বা বিয়োগান্তক পর্ব সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ এক চিরমধুর, চিরসবুজ, চির আনন্দে জড়ানো আমায়ন, অন্তত সুখের এক অক্ষয় ভাণ্ডার।
সেই ধূসর অতীত থেকে আম আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করে চলেছে। এই আশ্চর্য স্বাদের ফলটি নিয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে নানা কাহিনী। রাজা-বাদশাহ থেকে সর্বস্তরের মানুষ গ্রীষ্মের এই রসে মজেছে। আমে অরুচি এমন মানুষ খুঁজলেও মিলবে না। এমন আমের প্রশস্তি রয়েছে পুরাণ, মহাকাব্য, ইতিহাস ছাড়িয়ে আরো পেছনে।

হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধদের বিভিন্ন মঙ্গলানুষ্ঠানে আম ও আম পাতার ব্যবহার যুগ যুগ ধরে শুভ চিহ্নরূপে স্বীকৃত।
খ্রিস্টপূর্ব ১৬০ অব্দে ভারতে সাঁচি বৌদ্ধস্তূপ নির্মিত হয়। এই স্তূপের ভাস্কর্যে আমসহ আমের অর্থে কয়েকটি নকশা খোদিত রয়েছে। আমের প্রাচীনত্বের এটি একটি শৈল্পিক নিদর্শন। ইলোরা ও অজন্তার গুহায় প্রাচীন চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে আমগাছ, আম পাতা পুষ্পমঞ্জরিকে শৈল্পিক দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলমে বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে আমের বিয়ে ধুমধাম করে দেয়া হয়েছিল। কালিদাস এ বিয়ে নিয়ে অগাধ প্রশস্তি শ্লোকও লিখেছিলেন। সংস্কৃতিতে আমকে নানা নামে ডাকা হয়, যেমন ‘সহকার’, ‘রসাল’ এবং ‘চ্যুত’। কালিদাসের এই নাটকে আম্রমঞ্জরির উল্লেখ রয়েছে। কবি আমের মুকুলকে প্রেমের দেবতা মদনের পঞ্চশরের একটি শর হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
… “হে মধুকর, তুমি নতুন মধুর লোভে আকৃষ্ট হয়েছ। তুমি আমের মুকুলকে চুম্বন করে এখন কমলে বাস করে আনন্দিত চিত্তে এই চ্যুত মঞ্জরিকে ভুলে গেলে কিভাবে?” …
কালিদাস তাঁর বিখ্যাত মেঘদূত কাব্যে মেঘমালাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যে পর্বতের সঙ্গে, সেটির নাম ‘আম্রকূট’।
ভগবৎ পুরাণে শ্রী কৃষ্ণের লীলা প্রসঙ্গে বারবার উচ্চারিত হয়েছে চ্যুতবৃক্ষের প্রসঙ্গ। কৃষ্ণের অস্ত্র ছিল আম। অন্যকে আম খাইয়ে অনেক কাজ নাকি কৃষ্ণ করিয়ে নিতেন। তাই আমের আরেক নাম ‘কেশবায়ুধ’, অর্থাৎ কেশবের (কৃষ্ণের) আয়ুধ বা অস্ত্র— ‘কেশবায়ুধ’।

আবার রামায়ণে নাকি হনুমান লংকায় গিয়ে প্রথম অবিষ্কার করেন যে রাবণের অধিকারে অসাধারণ একটি ফল আছে। সেটি হাতিয়ে হনুমান চলে আসেন এপারে মূল ভূখণ্ডে। কে জানে হয়তো তার জন্যই তামিল ভাষায় আমকে বলে ‘ম্যান-কে’ বা ‘ম্যান গো’। একেই অনুসরণ করে পর্তুগিজরা বলত ‘ম্যাঙ্গা’। হয়তো এ থেকেই ইংরেজিতে ‘ম্যাঙ্গো’ শব্দটির জন্ম। জাতক কথা অনুযায়ী, গৌতম বুদ্ধকে এক ভক্ত উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন একটা গোটা আম বাগান। বুদ্ধ সেই বাগানে এসে মাঝে মাঝে ধ্যানমগ্ন হতেন। তবে আমকাহিনী বুদ্ধের অনেক আগের পুরাণ কাহিনীতেও পাওয়া গেছে বলে গবেষকদের দাবি। সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত বাগদাদের খলিফারা আমের স্বাদ নিতেন বাদশাহি সুরার রসে। আমের রস তাদের প্রাসাদে বিশেষভাবে তৈরি কক্ষে ছয় মাস ধরে রাখা হতো। সেই রস থেকে তৈরি হতো সুরা। এ খলিফাদের সূত্রে আম মাহাত্ম্য পারস্য হয়ে পৌঁছে মিসরে আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টাব্দে।

সপ্তম শতাব্দীতে এ দেশে আসা চীনের পরিব্রাজক হিউয়েন সাং আম খেয়ে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, ফেরার সময় কিছু আম সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে ইতিহাসের দাবি। হিউয়েন সাং ভারতীয় আমের সেই যে বন্দনার সূচনা করেছিলেন, পরবর্তীকালে পারসিক, মোগল, পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ— সব রসিকের মুখেই শুনি রসালের সুখ্যাতি। কেউ বলেছেন, উপমহাদেশের আম ‘প্রিন্স অব ফ্রুট’। আবার কারো মতে, ‘দ্যা ফ্রুট অব দ্য ম্যাগনিফেরা ইন্ডিকা’, আপেল বা আঙ্গুরের সঙ্গে আমের কোনো তুলনাই হয় না। পনেরো শতকে বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের গৌড় দরবারে চীনের মিং সম্রাটের এক দল রাজদূত উপস্থিত হয়েছিলেন। এই দূতরা তাঁদের রাজকীয় প্রতিবেদনে বাংলার আমের মিষ্টতার কথা লিখে গেছেন।

হোসেন শাহের পুত্র সুলতান নুশরাত শাহ ১৫২৩ খিস্টাব্দে রাজশাহী শহর থেকে ২৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পদ্মা নদীর তীরে বাঘা নামের স্থানে একটি বড় মসজিদ নির্মাণ করেন। এ মসজিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পোড়ামাটির ফলকে তৈরি ফুল, লতা, পাতা প্রভৃতি মোটিফের অলঙ্করণ। মূল মেহরাবের পাশের ছোট মেহরাবটিতে রয়েছে কাঁঠাল ও আমের পোড়ামাটির ফলকের অলঙ্করণ। বাঘায় হোসেন শাহি আমলে প্রচুর আমের চাষ হতো। মসজিদের মেহরাবে বাস্তবসম্মতভাবেই এ শিল্পকলাটি ধরে গেছেন সে আমলের শিল্পীরা।

দ্বাদশ শতকে রচিত কবিতার সংকলন গ্রন্থ সদুক্তি কর্ণামৃত রাজা লক্ষ্মণ সেনের মন্ত্রী কবি উমাপতি ধর, আমের মঞ্জরি ও ফল নিয়ে সংস্কৃত ভাষায় একটি চমৎকার কবিতা লিখে গেছেন। পরবর্তীকালে ড. সুকুমার সেন একটু পরিবর্তন করে কবিতাটির বঙ্গানুবাদ করেছেন। কবিতাটি নিচে উদ্ধৃত করা হলো—
“কোন কোন বৃক্ষ ফুল ফোটাবার কালে সুগন্ধি হয়,
কোন কোন বৃক্ষের কাঁচা ফল হয় সুরভি ও সুস্বাদযুক্ত,
কোন কোন বৃক্ষ আবার ফল পাকলে হয় মনোরম,
কিন্তু ফুল ফোটাবার কাল থেকে ফল পেকে যাওয়া পর্যন্ত—
আগাগোড়া মাধুর্য এ জগতে একমাত্র আম্রবৃক্ষেই প্রকটিত।”

কবি উমাপতি ধর সেই প্রাচীন আমলে তাঁর কবিতার মাধ্যমে আম ও আম গাছের পৃথক বৈশিষ্ট্য এবং বিশালত্বের কথা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে গেছেন।

মোঘল শাসকরা ভারতে ফলচর্চায় বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলন, তা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী ও আকবরনামায় লেখা রয়েছে। তাঁরা শুধু এ দেশের উদ্যানবিদদের উৎসাহ দিয়েছেন তা নয়, তাঁদের আগ্রহে ইরান-তুরান থেকেও অনেক বিশেষজ্ঞ এসে এ দেশে আনা শৌখিন ফলের চাষ শুরু করেন। দেশী ফলগুলোকে স্বাদ হিসেবে আবুল ফজল তিন ভাগে ভাগ করেছেন— মিষ্টি, টক ও ঝাঁঝাল ফল। মিঠে ফলের তালিকায় সবার প্রথমেই রয়েছে আমের স্থান, তার পর আনারস, কমলা, কাঁঠাল, কলা ইত্যাদি। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতে সুবাহ বাংলার ভাটি নামে একটি নতুন বিজিত দেশের আম গাছের বর্ণনা আছে, ‘এই নতুন সংযুক্ত দেশের আমগাছগুলো একজন মানুষের মতো দীর্ঘকায়, মানুষের চেয়ে উঁচু নয়।’

১৫৭০ থেকে ১৫৮০ সালের মধ্যে মোঘল সম্রাট আকবর গোটা ভারত থেকে সংগ্রহ করে এনে বর্তমান বিহারের দ্বারভাঙায় রোপণ করলেন বিভিন্ন প্রজাতির এক লাখ আমের চারা। সেই এক লাখ আম গাছ নিয়ে যে বাগান, তার নাম ‘লক্ষবাগ’। তাহলে অনুমান করা যেতে পারে যে, এই দেশের আমের পরিকল্পিত চর্চা শুরু করেন প্রথমে সম্রাট আকবর। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমচর্চার বিচিত্র তথ্য সম্রাটের স্মৃতিকাহিনী তুজুখের পাতা ওল্টালেই চোখে পড়বে। তিনি সাম্রাজ্যের সব সুবাহ থেকে নানা জাতের আম সংগ্রহ করে প্রতিটির গুণমান ও স্বাদের মূল্যায়ন করিয়েছিলেন। আমির-ওমরাদের আমের উৎকর্ষ বাড়ানোর লক্ষ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উৎসাহ দিতেন। তাঁর এক অনুগত ওমরাহ, মুকাব্বর খান বাদশাহকে একই বাগান থেকে ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ অক্টোবর দুই মাস ধরে অসময়ের আম খাইয়ে তাজ্জব করে দিয়েছিলেন। অসাধারণ মনে হওয়ায় ঘটনাটির বিবরণ তুজুখে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, এ কথা সম্রাট নিজেই বলে গেছেন। আমচর্চায় সাফল্যের জন্য মুকাব্বর খানকে পুরস্কৃত করতে সম্রাটের বিলম্ব হয়নি।

পিতা বাদশাহ জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে প্রকৃতির ফল, পশু-পাখি ও ফুল নিয়ে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি ও গভীর অনুসন্ধিৎসার গুণটি সম্রাট শাহজাহান উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন বলে ঐতিহাসিকদের অভিমত। শিল্প, সংস্কৃতি ছাড়াও সম্রাট শাহজাহান আরোও একটি অক্ষয় কৃতি রেখে গেছেন, যা তার অন্যান্য অর্জনের তুলনায় কোনো অংশে হীনপ্রভ নয়। তাঁর এ অক্ষয় কৃতিটি হলো বাদশাহি ফরমান জারি করে তিনি আম চাষ বা আমচর্চার সুযোগ আমজনতার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। শাহজাহানের এই সংস্কারমূলক কাজটিকে আমের গণতন্ত্রীকরণ বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না। এই শাহি ফরমান জারির আগ পর্যন্ত সমগ্র ভারতে আমের উন্নত মানের বাগিচা তৈরি করা, নতুন জাতের আমের চারা তৈরির জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব অধিকারই ছিল শাহি পরিবারের সদস্য, দরবারের আমির-ওমরাহ এবং বাদশাহর আজ্ঞাবহ অভিজাত সম্প্রদায়ের হাতে কুক্ষিগত। বাদশাহর এ ফরমানের দৌলতে ভালো জাতের আমের বাগান, ভালো চারা উৎপাদন, আম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এই প্রথম সাধারণ মানুষের হাতে এল। আম চাষের ওপর থেকে সম্রাট রাষ্ট্র আরোপিত সব খাজনাও তুলে দিলেন। শাহজাহানের এই ফরমানকে বিলেতের ইতিহাসের অনুকরণে আমের ‘ম্যাগনা কার্টা’ বললে বাড়াবাড়ি নাও হতে পারে। বিকল্প হিসেবে এই ফরমানকে আমের গণতন্ত্রীকরণ বললে আক্ষরিক অর্থেই যথার্থ বলা হবে বলে মনে হয়। সম্রাট শাহজাহানের নানা বিষয়ে আগ্রহের কথা ইতিহাসে সুবিদিত। তিনি আমের মতো সমৃদ্ধশালী এবং অসাধারণ ফলটির স্বভাব-চরিত্র ভালোই বুঝতেন। আমের খুঁটিনাটি নিয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তির প্রশংসায় শাহি দরবারি লেখকদের প্রাচ্যে সুলভ অতিশয়োক্তির অভিযোগ থাকলেও সম্রাটের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণশক্তির ভিত্তি একেবারে নড়বড়ে ছিল না বলেই মনে হয়।
তাঁর সম্পর্কে একটি বহুল প্রচারিত কাহিনী এ রকম: একবার কোনো দূরবর্তী সুবাহ থেকে দ্রুতগামী ডাকবাহকের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় সযত্নে বাছাই করা উৎকৃষ্ট মানের কিছু আম সম্রাটের নামদারের জন্য রাজধানীতে পাঠানো হয়েছিল। সেই আমের একটি সম্রাট হাতে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখলেন, তার পর একটির ঘ্রাণ নিয়ে কিছুক্ষণ পর নাকি বলেছিলেন যে, আম গাছ থেকে পেড়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় মাটিতে রাখা হয়েছিল। ফলে এর ঘ্রাণ ও স্বাদ সামান্য হলেও হ্রাস পেয়েছে। পরবর্তী কালে অনুসন্ধান করে দেখা গেল, সম্রাটের অনুমান অভ্রান্ত।

শাহজাহানের সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল ঘ্রাণশক্তির দাবিতে যারা অতিশয়োক্তির আভাস পান, তাঁদেরও পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। তবু আধুনিক যুগের টি টেস্টার বা ওয়াইন টেস্টার নামের গন্ধ ও স্বাদ বিশ্লেষকদের বিশেষ ক্ষমতা অনেকেরই মনোযোগ আকর্ষণ করবে। বিদেশে এবং আমাদের দেশের চা শিল্পে ‘টি টেস্টার’ নামে একটি মোটা বেতনের চাকরি দীর্ঘদিন ধরে চালু রয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও চা শিল্পে আজও এই পদটি অপরিহার্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। চা কোম্পানি নিলামে যেসব চা কেনাবেচা করে, তার গুণমান স্থির করেন এই টি টেস্টাররা— যন্ত্রপাতি বা রাসায়নিক বিশ্লেষণের পরও এদের যন্ত্রবিহীন পরীক্ষা চায়ের গুণগত মান সম্পর্কে শেষ কথা। এরা চা শুঁকে এবং সামান্য চায়ের লিকার জিভে আস্বাদন করে চায়ের মান স্থির করেন। এরা কেউ কোনো অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী বা রসায়ন শাস্ত্রে বিশাল ডিগ্রিধারী নন। এর মূলে রয়েছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। ঘ্রাণশক্তির তীক্ষ্ণতা, জিভের আস্বাদনক্ষমতার ওপর নির্ভর করেই চা কোম্পানি এদের মতামতকে বিনা বাক্যে মেনে নেয়। ইউরোপ-আমেরিকায় মদের কোম্পানিগুলো ওয়াইন টেস্টারদের মোটা অঙ্কের বেতন দেয়, তাঁদের নাসিকা নামক প্রত্যঙ্গটির ক্ষমতা-দক্ষতার জন্য— এই ক্ষমতা প্রকৃতি প্রদত্ত। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এই প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতাকে পরিশীলিত করেছে মাত্র। সম্রাট শাহজাহানের বেলায় হয়তো এমনটি ঘটেছিল।


আম্রচরিত – শেষ পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন

তথ্যসূত্র:
1. আম, মাহবুব সিদ্দিকী, আগামী প্রকাশনী
2. Romance of the Mango: The Complete Book of the King of Fruits, Kusum Budhwar, Penguin Books India (২০০৩)


লেখকের কথা: রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum