অশ্লীলতার দায়ে – প্রথম পর্ব

লেখক : রানা চক্রবর্তী

ময়মনসিংহের গচিহাটার মজুমদারবাড়ি। সাত আট বিঘা জমি, বসতবাড়ি, ধানের গোলা ছাড়িয়ে সামান্য এগোলেই টল-টল করছে পুকুর, পাশে বাঁশঝাড়, মাঝেমধ্যেই দুলে উঠছে হাওয়ায়। আবহে ভাসছে তাদের শিরশিরে পত্রালাপ। সকাল থেকে নিঝুম দুপুর জুড়ে এমনটাই চলতে থাকে। এরই মাঝে গাছগাছালির আলোছায়ার আলপনা গায়ে মেখে বাড়ির বউ-মেয়েরা পুকুরে স্নান সেরে ভিজে কাপড় জড়িয়েই ঘরে ফিরে যায়। এ তো সে কালের গ্রাম-বাংলার রোজকার দৃশ্য। তবু এ নিয়ে কেউ তো সে ভাবে ছবি আঁকেননি। মজুমদারবাড়ির একমাত্র শিল্পী পুত্রের মাথায় ঘুরতে থাকে বিষয়টা। এক দিন সময় সুযোগ করে পুকুরধারে তাঁর সদ্য-বিবাহিতা রূপসি স্ত্রী সুধারানিকে ভিজে কাপড়ে দাঁড় করিয়ে, বসিয়ে বেশ কিছু ছবি তুলে ফেললেন নানা বিভঙ্গে। তিনি তাঁর ছবি আঁকার প্রয়োজনে ফোটোগ্রাফের সহায়তা নিতেন। কিন্তু তিনি দস্তুর মতো জানতেন, ফোটোগ্রাফকে হুবহু ‘কপি’ করাটা কারিগরের কাজ। শিল্পীর নয়। ‘এই পরিদৃশ্যমান জগতে যা দেখব যদি তাই আঁকি তবে তার কি প্রয়োজন?’

বেশ কিছু দিন হল তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাস পড়া শেষ করেছেন। সেখানে ‘রোহিণী’ চরিত্রটি তাঁর মনে সবিশেষ ছাপ ফেলেছে। এই রোহিণী তাঁর বহু ছবিতেই সচেতন এবং অবচেতন ভাবে ঢুকে পড়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রোহিণী প্রসঙ্গে লিখছেন: ‘রোহিণীর যৌবন পরিপূর্ণ’, সে বিধবা কিন্তু তার ‘অধরে পানের রাগ, হাতে বালা, ফিতে পেড়ে ধুতি পরা, আর কাঁধের উপর চারু বিনির্মিতা কালভুজঙ্গিনীতুল্য কুণ্ডলীকৃতা লোলায়মানা কবরী।’ সে ‘ঘাটে উঠিয়া আর্দ্র বস্ত্রে দেহ সুচারুরূপে সমাচ্ছাদিত করিয়া ধীরে ধীরে ঘরে প্রত্যাবর্তন করে’ ইত্যাদি।

মজুমদারবাড়ির পারিবারিক ফোটো অ্যালবামে রয়েছে ‘মালতী’ লেখা একটি ছবি। ছবিটি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও চিনে নিতে অসুবিধা হয় না যে এই সদ্যস্নাতা ‘তন্ময়’ ছবির মুখটি ওরই। কিন্তু কে এই মালতী দেবী? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি শিল্পীর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে আসে, তা হলে সুধারানি দেবী কোথায় এই ছবিতে? এখানেই কৌশল। ফোটোশপের কায়দায় শিল্পী তাঁর যুবতী স্ত্রী সুধারানির দেহবল্লরিতে মালতীর লাবণ্যময়ী মুখ জুড়ে দিয়ে গড়ে তুলছেন তাঁর মানসপ্রতিমা।

পরেও এই একই কৌশল ব্যবহার করে বহু ছবি এঁকেছেন তিনি। বস্তুত কোনও বিষয়কে চিত্রায়িত করার জন্য তিনি তাঁর ক্যামেরায় তোলা ছবি এবং মডেলকে সামনে রেখে করা ‘লাইফ ড্রয়িং’এর সাহায্য নিতেন রেফারেন্স হিসাবে। তিনি তাঁর সাহিত্যপাঠ, জীবনের প্রাত্যহিকতা আর কল্পনাকে একত্রিত করে অবিসংবাদিত নৈপুণ্যে গড়ে তুললেন সদ্যস্নাতা যুবতীদের সেই ‘চিত্র’। শরীর আর মন নিয়ে এক সূক্ষ্ম খেলায় আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর ছবির দর্শকদের। সাদা শাড়ি, নবনী-লাঞ্ছিত উজ্জ্বল ত্বক সংলগ্ন হয়ে যে ভাবে যৌবনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে শুরু করে, ঠিক একই ভাবে, ক্যানভাসে চিত্রিত মহিলাটি, তাঁর সামগ্রিক শারীরিক উপস্থিতি সত্ত্বেও, দর্শকদের থেকে আড়াল রচনা করে নেয়।

কাঁখে ধরা কলসি থেকে জল পড়ে চলে, আর চার দিকের জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভ্রুক্ষেপহীন সদ্যস্নাতা তার চিন্তার গভীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে। এ এক ‘আছি’ আর ‘নেই’-এর খেলা। যে নেই তাকে খোঁজো, যা নেই তাকে ভেবে নাও। এই ভেবে নেওয়া থেকেই তাঁর চিত্রিত কাপড়ের আর্দ্রতা যৌনতার চেতনা উদ্রেক করে, কিন্তু একই সঙ্গে সদ্যস্নাতারা দর্শকদের থেকে মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দরুন গোপন ক্যামেরায় তোলা ‘ভয়ারিস্টিক’ (voyeuristic) ছবির মতো হয়ে ওঠে। ফলত বহু ক্ষেত্রেই এ সব ছবির দর্শক এক অপরাধবোধে আক্রান্ত হন। এ সমস্ত কারণেই এই শিল্পীর ভিজে কাপড়ের ছবি চির কাল বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থেকেছে।

ময়মনসিংহের গচিহাটার ছেলেটি এন্ট্রান্স পরীক্ষা না দিয়েই বাড়ি থেকে কলকাতায় পালিয়ে এসেছিল শিল্পী হবে বলে। সরকারি আর্ট স্কুলে পড়তে পড়তে আবার বিরোধ— পঞ্চম জর্জের আগমন উপলক্ষে শহর সাজাতে নবীন ছাত্রদের সামান্য পয়সা দিয়ে নিয়োগের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে নামলেন এই শিল্পী ও আরও ক’জন। প্রিন্সিপাল পার্সি ব্রাউন সঙ্গে সঙ্গে নাম কেটে দিলেন ধর্মঘটীদের।

এ বার ভর্তি হলেন তিনি রণদাপ্রসাদ গুপ্তর জুবিলি আর্ট অ্যাকাডেমিতে, মন ভরল না সেখানেও। অবনীন্দ্র-শিল্পধারা তাঁর অন্বিষ্ট ছিল না, পশ্চিমী অ্যাকাডেমিক রীতিতে দক্ষ হতে চাইছিলেন তিনি, বিশেষ করে মানবদেহ অঙ্কনে। শেষে স্বশিক্ষাই তাঁকে পৌঁছে দিতে পেরেছিল চূড়ান্ত সাফল্যে।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে বেঙ্গল স্কুলের শিল্পীদের রমরমার দিনে সর্বভারতীয় স্তরে এই শিল্পী যে সম্মান অর্জন করেছিলেন, সে কথা আজ বিস্মৃতির আড়ালে। একের পর এক সর্বভারতীয় প্রদর্শনীতে সেরার পুরস্কার, পাটিয়ালার রাজশিল্পীর মর্যাদার পাশাপাশি কাশ্মীর, বিকানের, জয়পুর, যোধপুর, ঢোলপুর, ময়ূরভঞ্জের রাজাদের পৃষ্ঠপোষণা ছিল অকৃপণ। ছবি আঁকার সঙ্গে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব আর্ট প্রতিষ্ঠা, তাঁর পত্রিকা প্রকাশ, ‘শিল্পী’ পত্রিকা, ইন্ডিয়ান মাস্টার্স শিল্পগ্রন্থমালা বাঙালির শিল্পচর্চায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের জন্ম ১৮৯৪ সালে। ভ্যান গঘ মারা গেছেন আট বছর আগে। রাজা রবি ভার্মা তখন কাজ করছেন আর অমৃতা শেরগিল কয়েক বছর পরই জন্মাবেন। এসব হিসাব থেকে দেখা যায়, হেমেনের জন্মটা ছিল এক সন্ধিক্ষণে—পশ্চিমে আধুনিক রীতির চিত্রশিল্পীরা তুমুল কাজ করছেন আর ভারতে রবি ভার্মার হাত ধরে পাশ্চাত্য চিত্রশৈলীর প্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু রবির বিষয়বস্তু একেবারে ভারতীয়ই ছিল। তাঁর তুলিতে ভারতের নারী, দেবী, পুরাণের কাহিনী নতুন আঙ্গিকে ধরা দিয়েছিল।

ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই শিল্পকলার অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল নিরাবরণ নারীদেহ। রবি ভার্মার কাজে আমরা দেখি শাড়ির পেছনে নারীর সৌন্দর্য। কিন্তু ততদিনে ভারতে হাজির হয়ে গেছে ভিক্টোরিয়ান মোরালিটি। নারীদের নানা রূপে আঁকা হলেও তাঁদের শরীরে এবার মোটা, লম্বা পোশাক জুটেছে। নগ্ন শরীর ব্রাত্য হয়ে গেল।

১৮৯৬ সালের ৬ জুলাই ই বি হ্যাভেল কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের দায়িত্ব নেন। তিনি স্বদেশী চেতনার উন্মেষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলায় চিত্রশিক্ষার মডেল তৈরি করেছিলেন। তাঁর পাশে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু পাশ্চাত্যের চিত্রশিল্পের যে বিপুল, দিগন্ত বিস্তৃত বিকাশ, তাঁকে গ্রাহ্যে না নেয়ায় আর্ট স্কুলের অনেকেই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। পাশ্চাত্য রীতি-কৌশলকে এড়িয়ে শুধু ভারতীয় শিল্পচর্চা, তাও আবার ভিক্টোরীয় মোরালিটির ছায়ায়—এমন পরিস্থিতিকে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলেরই কিছু ছাত্র মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা বলেছিলেন, পাশ্চাত্যের শিল্পকলা যে উচ্চতায় উঠেছে, তার স্পর্শ ছাড়া ভারতে চিত্রচর্চা অর্থহীন। এ বিরোধের ফলাফল হিসেবে ১৮৯৭ সালে কলকাতায় আরেকটি আর্ট স্কুল জন্ম নেয়—‘জুবিলি আর্ট একাডেমি’। এ ধারার নেতৃত্বে ছিলেন রণদাপ্রসাদ গুপ্ত। চিত্রকাল নিয়ে দুই মতধারার এ বিরোধের কালেই জন্মালেন হেমেন্দ্রনাথ।

হেমেন্দ্রনাথ ১৮৯৪ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার গচিহাটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দুর্গানাথ মজুমদার ময়মনসিংহের আঠারবাড়ি এস্টেটের কর্মচারী ছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল হেমেনের। কিন্তু এ ঝোঁককে পরিবার ইতিবাচক চোখে দেখেনি। পরিবারের সঙ্গে এ নিয়ে ঝামেলা বাড়ছিল। হেমেন তখন ময়মনসিংহের সিটি স্কুলে দশম শ্রেণীর ছাত্র। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন বাড়ি ছাড়ার। কারণ শিল্পী হওয়াই তাঁর ধ্যান। গচিহাটার মজুমদার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে কলকাতায় হাজির হলেন, উঠলেন অখিল মিস্ত্রি লেনে দিদি হৈমলতার বাড়িতে। বোনজামাই রমেশ সোম সমঝদার মানুষ, হেমের শিল্পী হওয়ার আগ্রহটা বুঝতে পারলেন। তিনি হেমেন্দ্রনাথকে অবনীন্দ্রনাথের গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। এটা ছিল ১৯১০ সালের ঘটনা। কিন্তু এ সরকারি আর্ট স্কুলে দ্রুতই হেমেন্দ্রনাথের মোহভঙ্গ হলো। তিনি বুঝলেন গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে শিল্পচর্চা স্বাধীন নয়। তুলিটা ইচ্ছেমতো চালানো যাবে না। শিল্পী হতে গিয়ে যিনি স্কুলজীবনেই বাড়ি ছেড়ে এসেছিলেন, সেই স্বাধীন আর ক্ষুব্ধ আত্মার পক্ষে তো এ বিধিনিষেধ মেনে নেয়া সম্ভব নয়! একই সময় আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল, ১৯১১ সালে দিল্লি দরবার উপলক্ষে আসা পঞ্চম জর্জের সম্মানে কলকাতায় তোরণ তৈরি হবে। কিন্তু হেমেন এর বিরুদ্ধে ছিলেন। সব মিলিয়ে ছেড়ে দিলেন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ।

ভারতীয় চিত্র শিরোনামের নিবন্ধে হেমেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “প্রাচীন চিত্র বা মূর্তি দেখিলে তাহাতে ‘ভারতীয় পদ্ধতি’ বলিয়া সনাতন কোনো লক্ষণ বা প্রকাশভঙ্গি ছিল না…।” এরপর ভারতীয় কলা নিবন্ধে লিখেছেন, “সর্বাপেক্ষা মিথ্যা ও হাস্যকর ব্যাপার—এই ‘ভারতীয় পদ্ধতি’ শব্দটি। যিনি সর্বপ্রথম এই শব্দটি উচ্চারণ করিয়াছিলেন, তাঁহার মধ্যে সত্বুদ্ধির একান্ত অভাব ছিল। আরো আশ্চর্যের বিষয় এমন অসার কথা দেশের গাত্রে বিলক্ষণ দাগ কাটিয়াছে।” ভারতীয় কলা নিবন্ধে হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার স্পষ্টত দুটি বক্তব্য রাখলেন। এক. আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল এবং অবনীন্দ্রনাথের নব্যভারতীয় শিল্পকলা; যা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে শেখানো হতো তা ছিল ‘অসার’। আর দ্বিতীয় যে কথাটা তিনি স্বীকার করেছেন তা হলো এই, নব্যভারতীয় শিল্পকলার যথেষ্ট প্রভাব ছিল সমকালীন সময়ে। গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের সেই বদ্ধ কুয়োর ব্যাঙ হওয়া হেমেনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রিয় বন্ধু অতুল বসুর পরামর্শে তিনি রণদাপ্রসাদ গুপ্তের জুবিলি আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হলেন। ১৯১১ থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত তিনি কলকাতার জুবিলি একাডেমিতে শিক্ষা গ্রহণ করেন। অবশ্য শোনা যায় জুবিলি একডেমিতে হেমেন শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তিন বছর।

হেমেন, অতুল পাস করার পর ছোটখাটো কাজ করে জীবিকা ধারণ করতে শুরু করেন। এসব কাজের মধ্যে ছিল থিয়েটারের জন্য চিত্রকর্ম আঁকা, পরিবারের মৃত সদস্যদের ছবি থেকে প্রতিকৃতি এঁকে দেয়া।

১৯১৯ সালে হেমেন্দ্রনাথ বন্ধু অতুল বসু, যামিনী রায় ও ভবানীচরণ লাহাকে নিয়ে বিডন স্ট্রিটে চালু করেন ইন্ডিয়ান একাডেমি অব আর্ট নামে একটি চারুকলা প্রতিষ্ঠান। ১৯২০ সালে এ প্রতিষ্ঠানের ত্রৈমাসিক জার্নাল ইন্ডিয়ান একাডেমি অব আর্ট প্রকাশিত হয়। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, শিল্পকে কেবল ধনীদের অধিকার থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের নাগালে নিয়ে আসা। সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশ্চাত্য রীতি অনুসরণকারী শিল্পীদের কাজ নিয়ে প্রদর্শনীরও আয়োজন করেন।

ইন্ডিয়ান একাডেমি অব আর্টের পাঠক বৃদ্ধিতে তারা নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সাদামাটা কাগজে ছাপা হলেও এর নকশায় ছিল আকর্ষণীয় সব আয়োজন। শিল্প সমালোচনামূলক প্রবন্ধের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট খবর, গসিপ, ভ্রমণবৃত্তান্ত, ছোটগল্প, কৌতুকসহ নানা ধরনের লেখা প্রকাশিত হতো। জার্নালের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার, অতুল বসু ও যামিনী রায়ের চিত্রকর্ম প্রকাশ। এদের পুরস্কারজয়ী চিত্রগুলো কালার প্লেটে ছাপা হতো। এ জার্নালেই হেমেনের প্রথম আলোচিত ছবি পল্লী প্রাণ প্রকাশিত হয়। এ পল্লী প্রাণে দেখা যায় জলসিক্ত শাড়িতে এক পল্লী নারীকে। এ ভেজা শাড়িতে নারীকে উপস্থাপনাই হেমেনকে স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে।

ইন্ডিয়ান একাডেমি অব আর্ট জার্নালটি অর্থাভাবে একসময় বন্ধ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এমন পরিচ্ছন্ন মুদ্রণ ও রঙিন ছবিতে পূর্ণ চিত্রশিল্পের পত্রিকা সম্ভবত ভারতে আগে আর প্রকাশিত হয়নি। এরপর তাঁরা করলেন সোসাইটি অব ফাইন আর্টস, এটি বেশ সাফল্যের মুখ দেখেছিল। খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, এ সময়টা ছিল স্বদেশী যুগ, বাংলার শিল্পকলার স্থানীয় ঘরানারই তখন একচ্ছত্র প্রভাব। এটাই ছিল ভারতে প্রথম জাতীয়তাবাদী শিল্প আন্দোলন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার শিষ্যরা বিভিন্ন পদ থেকে একাডেমিক বা পাশ্চাত্য রীতি অনুসরণকারীদের বিতাড়িত করেন। পাশ্চাত্য রীতি এবং প্রাচ্য রীতির এ দ্বন্দ্ব গুরুতর আকার ধারণ করেছিল। প্রাচ্য রীতির বাহকদের মূল কেন্দ্র ছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট, যা পরিচালনা করতেন অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ। তাঁরা প্রতিষ্ঠানটির ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন এবং এখান থেকে পাশ্চাত্যপন্থী শিল্পীদের বের করে দেন। লক্ষ করার বিষয়, অবনীন্দ্রনাথের মতো প্রভাবশালী শিল্পীর সামনে থেকেও হেমেন তাকে দিয়ে প্রভাবিত না হয়ে স্বতন্ত্র যাত্রাপথ বেছে নিয়েছিলেন।

এমন পরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যপন্থী শিল্পীরা কলকাতায় তাদের প্রদর্শনী করতে পারছিলেন না, তাই তাঁরা তাঁদের কাজ বাংলার বাইরে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছিলেন। কিন্তু অনেক শিল্পীর সে সামর্থ্য ছিল না। ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টের আধিপত্যকে খর্ব করতে জন্ম হলো সোসাইটি অব ফাইন আর্টসের। এ সোসাইটি ১৯২১-২২ সালে প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করে এবং সেটা ছিল এক বিরাট আয়োজন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাশ্চাত্য রীতি চর্চাকারী শিল্পীদের এক হাজারের বেশি চিত্রকর্ম নিয়ে এ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

১৯২৪ সালে অতুল বসু স্থায়ীভাবে ইংল্যান্ডে চলে গেলে হেমেনদের দলটি ভেঙে যায়। বিদ্রোহ আর অ্যাক্টিভিজমের পর এবার হেমেনের পেশাদার শিল্পীজীবন শুরু হয়ে যায়। নারীকে কেন্দ্রে রেখে তিনি তাঁর চিত্রকর্মগুলো তৈরি করতে থাকেন। এখানে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায় নারীর অবসর এবং তার মনের বিভিন্ন অবস্থা। দিবাস্বপ্নে মগ্ন নারীকে আঁকেন তাঁর ‘রোজ অর থর্ন’ – এ। ছবিটির দিকে একবার তাকালেই হেমেনের দক্ষতা দৃষ্টিগোচর হয়। এ ছবিতে ভঙ্গির নয়, বরং ভাবের খেলা দেখা যায়। আর ভঙ্গির চেয়ে ভাবকে ফুটিয়ে তোলা যে কঠিন, সে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না! ছবিতে সিল্ক পরিহিতা নারীর পেছনে থাকা গোলাপ প্রেমের আনন্দ-বেদনাকে প্রকাশ করছিল। ১৯৩৬ সালে কলকাতায় প্রদর্শিত হয়। এরপর ১৯৫২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠিত দুনিয়ার সেরা সুন্দরীদের পোর্ট্রেট নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীতে ছবিটি ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিল।

চলবে…


লেখকের কথা: রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।