লেখক : অয়ন মৈত্র
কল্কি ২৮৯৮ তে বুড়ো হাড়ে কি ভেলকিই না দেখালেন মিঃ বচ্চন! অশ্বত্থামার চরিত্রে যে দাপট উনি দেখিয়েছেন তাতে এখন মার্কেটে ট্রেন্ডিং অশ্বত্থামা। যুধিষ্ঠিরের সেই বিখ্যাত ছলনা – ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ ‘ ছাড়া অনেকেই মহাভারতের এই চরিত্র সম্পর্কে তেমন পরিচিত নই। মশাই যে কোন আতি পাতি হরিদাস পাল নয় সে তো মিঃ বচ্চনকে দেখেই আঁচ পেয়ে গিয়েছেন এতক্ষণে। এই সুযোগে একবার ওঁর সম্পর্কে জেনে নেবেন নাকি?
মহাভারতের মাস্টার ট্রেনার প্রবাদ প্রতিম কোচ দ্রোণাচার্যের ছেলে হলেন অশ্বত্থামা। অশ্বত্থামার মা কৃপি ছিলেন পাণ্ডব ও কৌরব পরিবারের কূলগুরু কৃপাচার্যের বোন। মনে করা হয় বর্তমান দেরাদুনে অবস্থিত তাপকেশবর মন্দিরের কাছে কোন জায়গায় তাঁর জন্ম হয়। বাবা দ্রোণ বহুবছর ধরে শিবকে তুষ্ট করতে তপস্যা করে অশ্বত্থামাকে পেয়েছেন। নামী বাবার দামী ছেলে অশ্বত্থামার জন্ম হয় কপালে একটি রত্নখচিত হয়ে। এই রত্ন বা মণিটির বলে অশ্বত্থামা বিশেষ শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন। মানুষের তুলনায় নিম্নস্তরের সমস্ত প্রাণীর তুলনায় তিনি শক্তিশালী ছিলেন। কেবল এটাই নয় খিদে, তেষ্টা, ঘুম, ক্লান্তি, রোগ, বার্ধক্য এবং কোন অস্ত্রের তাঁকে স্পর্শ করার ক্ষমতা ছিলনা। একরকম অপ্রতিরোধ্য অজেয় বলা চলে তাঁকে।
শ্যালক কৃপাচার্যের আমন্ত্রণে দ্রোণাচার্য সপরিবারে কৌরবদের রাজধানী হস্তীনাপুরে চলে আসেন। এখানেই বাবার কাছেই ধনুক চালানো শিখেছেন অশ্বত্থামা অর্জুন সহ দ্রোণের বাকি শিষ্যদের সঙ্গে। অর্জুনের পরে তিনিই সবথেকে দক্ষ ছিলেন ধনুক চালানোয়। ক্রমে ক্রমে অশ্বত্থামা বীর যোদ্ধা হয়ে ওঠেন। ভালো জাতের ঘোড়ার প্রতি অশ্বত্থামার বিশেষ দুর্বলতা যে আছে সেটা দুর্যোধনের চোখ এড়ায়নি। কৌরব আস্তাবল থেকে অতি উচ্চ প্রজাতির একটি ঘোড়া দুর্যোধন অশ্বত্থামাকে উপহার দিলে অশ্বত্থামাও দুর্যোধনের বদান্যতায় আপ্লুত হয়ে তাঁর অনুগত হয়ে পড়েন। দুর্যোধনের আনুগত্য স্বীকার করার অর্থ কৌরব রাজ্যের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা।
এবার চলে আসা যাক সরাসরি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। যুদ্ধ যখন দশম দিনে পা দিয়েছে, ভীষ্মের পতন হয় ও দ্রোণ কৌরব সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ সেনাপতি হন। দ্রোণ দুর্যোধনকে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি যেভাবেই হোক যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করবেন। আদতে কিন্তু তিনি কোনভাবেই তা পারলেন না। এদিকে দুর্যোধনের তো দ্রোণের এই অক্ষমতা দেখে মাথায় রক্ত চড়তে শুরু করেছে। দ্রোণকে উদ্দেশ্য করে নানান কটূক্তি এবং অপমান শুরু করেন তিনি। অশ্বত্থামা দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন এবং ভেতরে ভেতরে দুর্যোধনের প্রতি প্রবল ক্ষোভও সৃষ্টি হচ্ছিল। তবুও নিজেকে সামলে নেন তিনি শেষ পর্যন্ত।
যুদ্ধ যখন চোদ্দো দিনে পৌঁছলো অশ্বত্থামা অর্জুনের সামনে বারংবার প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন যাতে অর্জুন জয়দ্রথের কাছে পৌঁছাতে না পারেন। এমনকি ক্রুদ্ধ অর্জুন দুর্যোধনকে হত্যা করার জন্য শক্তিশালী মানবাস্ত্র নিক্ষেপ করলে অশ্বত্থামা সর্বাস্ত্র তীর ব্যবহার করে দুর্যোধনের ঐশ্বরিক স্বর্গীয় বর্ম এবং জীবনকে সফলভাবে রক্ষা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্জুনের কাছে পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান।
কৃষ্ণ জানতেন সশস্ত্র দ্রোণকে পরাজিত করা অসম্ভব। তাই, তিনি ছলনার আশ্রয় নিলেন। ভীমকে মন্ত্রণা দেন অশ্বত্থামা নামে একটি হাতিকে বধ করতে এবং দ্রোণের কাছে গিয়ে বলতে অশ্বত্থামা মারা গিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। অবশ্য এই মিথ্যে বলার কাজটি দেন যুধিষ্ঠিরের ওপর। কারণ ধর্মপুত্রের বলা কথার ওপর কেউই অবিশ্বাস করবে না। এদিকে যুধিষ্ঠিরও নিজের নীতি আদর্শ থেকে সরতে রাজি নয়। ময়দানে আবার নামতে হল কৃষ্ণকে। যুধিষ্ঠিরকে বললেন স্পষ্ট করে বলবে – অশ্বত্থামা মারা গিয়েছে। সঙ্গে আলতো স্বরে বলবে হাতি না মানুষ সেটা জানিনা। তাহলে কাজও হল এদিকে আদর্শচ্যুত হতে হল না। দ্রোণের কাছে গিয়ে যুধিষ্ঠির চিৎকার করে বললেন – “ अश्वत्थामा हत: इति तरो वो कुंजरो वा” অর্থাৎ অশ্বত্থামা হত হয়েছে কিন্তু নর না কুঞ্জর (হাতি) সেটা বলতে পারব না। অশ্বত্থামা হত – বৃদ্ধ দ্রোণাচার্যের হৃদয় চূর্ণ করার জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল। শোকে বিহ্বল দ্রোণ অস্ত্র ত্যাগ করা মাত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন ( দ্রৌপদীর ভাই ) শোকাহত ঋষির শিরশ্ছেদ করলেন।
ছলনার আশ্রয় নিয়ে পাণ্ডবরা তাঁর বাবাকে হত্যা করেছে শুনে অশ্বত্থামা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন যা যে কোন পুত্রের পক্ষেই অত্যন্ত স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। পাণ্ডবদের উচিত শিক্ষা দিতে তিনি তাঁর অস্ত্র ভাণ্ডার থেকে নারায়ণস্ত্র প্রয়োগ করলেন। প্রলয়ংকারী রূপে সেই অস্ত্র প্রত্যেক পাণ্ডব সেনাকে হত্যার জন্য তিনি নিক্ষেপ করলেন। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে আমরা এটিকে প্রিসিশন গাইডেড ব্যালিস্টিক মিসাইল রূপে পাই। স্যাটেলাইট দ্বারা লক্ষ্যবস্তুর লোকেশন একবার লক করে লঞ্চ করে দিলেই হল। লক্ষ্যবস্তুকে ঘায়েল না করে ফিরবে না সে। ইজরায়েল সেনার থেকে কেনা এই ধরণের মিসাইল ব্যবহার করে ভারত বালাকোটে জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করেছিল। কৃষ্ণ জানতেন শত্রু যদি অস্ত্র ত্যাগ করে দেয় তাহলে নিরস্ত্রকে এই অস্ত্র আঘাত করতে পারেনা।
কৃষ্ণ সমস্ত সৈন্যদের রথ থেকে নেমে নিরস্ত্র হওয়ার নির্দেশ দিলেন। ফলত যা হওয়ার তাই হল। একজ্যাক্ট লোকেশন ট্র্যাক করতে না পেরে মিসগাইডেড হয়ে সেই অস্ত্র দিকভ্রষ্ট হয়ে অন্যদিকে চলে গেল। হতাশ দুর্যোধন মরিয়া হয়ে অশ্বত্থামাকে পুনরায় অস্ত্র ব্যবহার করার অনুরোধ করলে, অশ্বত্থামা বলেন এই অস্ত্র যদি আবার ব্যবহার করা হয় তবে এটি লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত না করে তার ব্যবহারকারীকে আঘাত করবে।
দুঃশাসনের ভয়ানক মৃত্যুর পর, অশ্বত্থামা হস্তিনাপুরের কল্যাণের কথা মাথায় রেখে দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের সাথে সন্ধি করার পরামর্শ দেন। পরে, দুর্যোধন ভীমের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার পর, কৌরবের পক্ষ থেকে বেঁচে থাকা শেষ তিনজন, অশ্বত্থামা, কৃপা এবং কৃতবর্মা তাঁর পাশে ছুটে আসেন। অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে কথা দেন তিনি পাঞ্চালদের শেষ দেখেই ছাড়বেন। আশ্বস্ত দুর্যোধন তাঁকে সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। মৃতপ্রায় দুর্যোধনকে মৃত্যুর অপেক্ষায় ফেলে রেখে অশ্বত্থামা কৃপা ও কৃতবর্মার সাথে প্রতিশোধ স্পৃহা বুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। যেতে যেতে রাত হয়ে গেল। সামনে ঘন বিস্তীর্ণ বনের মধ্যে প্রবেশ করা এই অন্ধকারে ঠিক হবেনা ভেবে তাঁরা উপযুক্ত জায়গা দেখে বিশ্রাম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কৃপা ও কৃতবর্মা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লেন কেবল জেগে রইলেন অশ্বত্থামা। পিতার অসহায় মৃত্যু সাথে তাঁর সমবয়সী দুর্যোধনের মৃত্যু তাঁকে ভেতর ভেতর অস্থির, উন্মাদ করে তুলেছে। পাণ্ডবদের নির্বংশ না করা অবধি তিনি শান্তি পাবেন না। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তাঁর চোখ গেল সামনের একটি গাছে। দেখলেন সন্ধ্যা নামতেই শয়ে শয়ে কাক তাদের বাসায় ফিরে এসেছে। প্রকৃতি জুড়ে এখন তাদের কোলাহল নেই। আর এই প্রগাঢ় শান্তির মাঝেই একটি ঘটনা শুরু হল যা দেখে অবাক হয়ে গেলেন অশ্বত্থামা। দেখলেন একটি প্যাঁচা উড়ে এসে ঐ গাছের ডালে বসল। তারপর একটি একটি করে রাতের অন্ধকারে কাক হত্যা করে খেতে শুরু করল। অশ্বত্থামার মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। এটাই তো পরম সুযোগ। রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে আক্রমণ করতে হবে পাণ্ডব শিবিরে। আচমকা এই আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যাবে পাণ্ডব শিবির। কৃপাচার্য এই চক্রান্তের ঘোরতর বিরোধী হয়ে অশ্বত্থামাকে নিরস্ত করার অনেক চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হলেন তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই অশ্বত্থামার সঙ্গী হয়ে পাণ্ডব শিবির আক্রমণ করতে চললেন রাতের অন্ধকারে।
অশ্বত্থামা পাণ্ডব শিবিরে পৌঁছে শিবিরের প্রধান দরজার সামনে কৃপাচার্য ও কৃতবর্মাকে দাঁড়াতে বললেন এবং সাথে এও বললেন – এই দরজা দিয়ে যেন একজনও বেঁচে বেরোতে না পারে। এই বলে শিবিরের পেছন দরজা দিয়ে শিবিরে প্রবেশ করলেন। আর তারপর যেটা শুরু হল তাকে জার্মানরা বলে ‘ব্লিৎজক্রিগ’। হঠাৎ ভয়ংকর আক্রমন যা আক্রান্তপক্ষকে এতটাই হতভম্ব করে দেয় যে সে পাল্টা আক্রমণের কথা চিন্তা না করে প্রাণ রক্ষার জন্য আকুল হয়ে পড়ে। ট্রয়ের যুদ্ধে ঠিক এভাবেই বিশাল কাঠের ঘোড়ার পেট থেকে বেরিয়ে গ্রিক যোদ্ধারা ট্রয় ধ্বংস করেছিল। আধুনিক কালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাই হয়েছিল এই ব্লিৎজক্রিগের মাধ্যমে। ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মানি যখন পোল্যান্ড আক্রমণ করে তখন সবে ভোর হচ্ছে। সময় ভোর পৌনে পাঁচটা। স্থল এবং আকাশপথে দুদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণে পোল্যান্ড সেনাবাহিনী কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়ে। এর ঠিক পরের বছর ১৯৪০ সালে একইভাবে জার্মানি ফ্রান্স আক্রমণ করে। পরের বছর ১৯৪১ সালে জাপান ঠিক এইভাবে আমেরিকার পার্ল হারবার আক্রমণ করে। একদম সাম্প্রতিক ঘটনা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস জঙ্গিগোষ্ঠী এভাবেই সকাল সাতটায় ইজরায়েলে প্রবেশ করে গণহত্যা চালায়।
অশ্বত্থামা শিবিরে প্রবেশ করে তাঁর বাবার হত্যাকারী ঘুমন্ত ধৃষ্টদ্যুম্নকে লাথি মেরে জাগিয়ে তোলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে কাতরভাবে অস্ত্র দ্বারা হত্যার অনুরোধ করলেন যাতে তাঁর স্বর্গ প্রাপ্তি হয় কিন্তু অশ্বত্থামা তাঁর বুকে লাথি মেরে তাঁকে হত্যা করলেন। এরপর তিনি যুধিষ্ঠিরের ছেলে প্রতিবিন্ধ্যকে তরোয়ালের কোপে হত্যা করলেন। তারপর ভীমের ছেলে সুতসোমকে হত্যা করলেন। এরপর নকুলের ছেলে শতানীককে মাথা কেটে হত্যা করলেন। তারপর তিনি অর্জুনের ছেলে শ্রুতকর্মা ও সহদেবের ছেলে শ্রুতসেনকে হত্যা করলেন। রক্তের লোভে ও মাংসের গন্ধে দলে দলে মাংসাশী পশু ও পাখি শিবিরে ঢুকে মৃতদেহ নিয়ে টানাটানি করতে শুরু করল। শিবির ছেড়ে যাওয়ার আগে কৃপ, কৃতবর্মা ও অশ্বত্থামা শিবিরের তিনদিকে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেলেন।
পঞ্চ পাণ্ডব ও কৃষ্ণ সেই শিবিরে উপস্থিত ছিলেন না বলে বেঁচে গেলেন। ভোর হতে অশ্বত্থামার তাঁদের শিবির আক্রমণের ঘটনা শুনে তাঁরা শিবিরে এসে পৌঁছে যা দেখলেন শোকে দুঃখে বিহ্বল হয়ে পড়লেন সকলে। শোকে বিহ্বল অর্জুন পণ করলেন অশ্বত্থামাকে হত্যা তিনি করেই ছাড়বেন। এরপর পঞ্চ পাণ্ডব অশ্বত্থামার খোঁজে বেরিয়ে মহর্ষি ব্যাসের আশ্রমে খুঁজে পেলেন। ওদিকে পাণ্ডবদের এখনও জীবিত দেখে অশ্বত্থামা রাগে দিকবিদিক শূন্য হয়ে তাঁদের হত্যার জন্য ঘাসের একটি ছোট ফলক থেকে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে ব্রহ্মশিরাস্ত্রকে আহ্বান জানান। কৃষ্ণ অর্জুনকে তৎক্ষণাৎ অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে তাঁর নিজের ব্রহ্মশিরাস্ত্রকে অগ্নিসংযোগ করতে বলেন আত্মরক্ষার জন্য। দুই ব্রহ্মাস্ত্রের সংঘর্ষে আকাশে সূর্যের থেকেও বড় অগ্নিকুণ্ডের সৃষ্টি হলে প্রলয়ের আশংকায় ব্যাস হস্তক্ষেপ করেন এবং অর্জুন এবং অশ্বত্থামা দুজনকেই তাঁদের অস্ত্র ফিরিয়ে নিতে বলেন। অর্জুন ফিরিয়ে নিতে পারলেও অশ্বত্থামা পারলেন না। তিনি পারলেন না কারণ তিনি অস্ত্র প্রয়োগের কৌশল জানতেন তা ফিরিয়ে নেওয়ার কৌশল জানতেন না। জানতেন না কারণ তাঁর বাবা দ্রোণাচার্য তাঁকে এই কৌশল শেখাননি, একপ্রকার ইচ্ছে করেই। দ্রোণ জানতেন তাঁর ছেলে অর্জুনের মত স্থিতধী ও সংযমী নয়। কোন মানুষের উদ্দেশ্যে এই অস্ত্র প্রয়োগের যে নিষেধাজ্ঞা আছে তা তাঁর ছেলে মানবে না। বাস্তবে হলও তাই। অস্ত্র যখন ফেরানোই গেলনা কৃষ্ণ বাধ্য হয়ে পাণ্ডবদের বাঁচাতে এই ব্রহ্মাস্ত্রের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিলেন। দিলেন কিন্তু সেটি একেবারে সরাসরি অর্জুনের পুত্রবধূ উত্তরার দিকে। উত্তরা তখন গর্ভবতী ছিলেন। অস্ত্র গিয়ে সরাসরি উত্তরাকে আঘাত করে এবং উত্তরার গর্ভজ সন্তান তথা পাণ্ডব বংশের শেষ সম্বলেরও মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে কৃষ্ণ উত্তরার গর্ভে থাকা সন্তানকে পুনরায় প্রাণ দান করবেন।
অর্জুন এরপর পশুকে যেভাবে বন্দী করে সেইভাবে দঁড়ি বেঁধে অশ্বত্থামাকে দ্রৌপদীর সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালেন। কৃষ্ণ এরপর অর্জুনকে মনে করিয়ে দেন দ্রৌপদীকে দেওয়া তাঁর প্রতিজ্ঞা – দ্রৌপদীকে তিনি তাঁর সন্তানের হত্যাকারীর মাথা এনে দেবেন। কিন্তু আজ অর্জুন রাজি হলনা অশ্বত্থামাকে হত্যা করতে। আফটার অল তাঁর পিতৃতুল্য গুরুর সন্তান তিনি। দ্রৌপদীও রাজি হলেন না অশ্বত্থামাকে হত্যার বিষয়ে। যুক্তি দিলেন তিনি চান না কৃপী তাঁর মত সন্তান হারা হোক। এর ওপর অশ্বত্থামা ব্রাহ্মণ। যুধিষ্ঠিরও সহমত পোষণ করলেন কিন্তু ভীম রাজি হলেন না এই সিদ্ধান্তে। স্পষ্ট বললেন অশ্বত্থামাকে কেন হত্যা করা উচিত। কৃষ্ণ তখন অর্জুনকে বললেন এমন কাজ করো যাতে আমার এবং ভীমের মতের দাম থাকে আবার তোমার এবং দ্রৌপদীর মতও সম্মানিত হয়। অর্জুন তখন অশ্বত্থামার কাছে গিয়ে তাঁর কপাল থেকে তরোয়ালের খোঁচায় মণিটি উপড়ে নিলেন। একেই শিশু হত্যার কারণে অশ্বত্থামা তাঁর শরীরের উজ্জ্বলতা হারিয়েছেন এরপর মণি হারিয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়লেন এবার। কৃষ্ণ এরপর তাঁকে অভিশাপ দিলেন – সঙ্গী বিহীন হয়ে অশ্বত্থামা কলিযুগের শেষ অবধি গভীর অন্ধকার বনে একাকী ঘুরে বেড়াবেন। সঙ্গে এও বললেন তাঁর ক্ষতস্থান থেকে অনন্তকাল ধরে পুঁজ ও রক্ত বেরোবে আর ব্যাথায় উন্মাদ হয়ে অশ্বত্থামা চিৎকার করতে থাকবেন। কৃষ্ণের অভিশাপ গ্রহণ করে অশ্বত্থামা চলে গেলেন। চলে গেলেন কোন এক দিকশূন্যপুরের উদ্দেশ্যে তাঁর কৃতকর্মের দায়ভার নিয়ে অনন্তের দিকে।
প্রচলিত উপকথা অনুযায়ী কেউ বলে অশ্বত্থামা নাকি আজও মধ্যপ্রদেশের আসিরগড় দূর্গে বাস করেন। কেউ বলে উত্তরপ্রদেশের কানপুরের বাঙ্কা ছতারপুরের অন্তর্গত শিবরাজপুরে অবস্থিত বাবা খেরেশ্বর ধাম নামে পরিচিত একটি মন্দিরে আজও প্রতিদিন লোকচক্ষুর আড়ালে অশ্বত্থামা শিবের আরতি করেন।
এই উপকথা সত্যি না মানব মনের কল্পনাজাত উপকথা সেই তর্কে না গিয়ে আমি বরং একটি অন্য বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। গোটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জুড়ে জার্মান সেনার যে বিক্রম এবং গতি আমরা দেখেছি তার পেছনে কেবল অসামান্য যুদ্ধ সম্পর্কিত পারদর্শিতাই একমাত্র কারণ ছিলনা। যে অমানুষিক বর্বরতা যে ক্ষিপ্রতার সাথে জার্মান নাৎসি সেনা দেখিয়েছে তার পেছনে ছিল পারভিটিন নামের একটি মেথামফেটামিন গোত্রের ড্রাগ। এই ড্রাগ খিদে তেষ্টা ঘুম ক্লান্তি অনুভূতি সব ভুলিয়ে দেয় বেশ কয়েকদিনের জন্য। একজন জার্মান সেনা এই ড্রাগ নেওয়ার পরে টানা তিনদিন না খেয়ে না ঘুমিয়ে যুদ্ধ করে যেতে পারতেন। মূলত এই ড্রাগের দৌলতেই জার্মানি এত দ্রুত ফ্রান্স আক্রমণ করে তার পতন ঘটাতে পেরেছিল। অশ্বত্থামার সাথে কিছু মিল পাচ্ছেন ? না পাওয়ারই কথা। কিন্তু পেলে কাকতালীয় ভেবে নেবেন ।
লেখক পরিচিতি : অয়ন মৈত্র
প্রাবন্ধিক
Monograhi Alochona
দারুণ লেখা!
দারুণ হয়েছে লেখাটা। এরম আরও লেখা চাই।