বাংলা ছায়াছবির রাজরানী কানন দেবী

লেখক : অর্হণ জানা

১৯৯২ সালের ১৮ জুলাই, ৭৬ বছর বয়সে বাংলা সিনেমার রাজরানী কানন দেবীর ইহলোকত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে একটি যুগের সমাপ্তি ঘটে। গ্ল্যামারাস অভিনেত্রী, কিন্নরকণ্ঠী গায়িকা, দায়িত্ব সচেতন প্রযোজক, সমাজসেবিকা – সব মিলিয়ে কাননবালা দেবী ছিলেন সেকালের জীবন্ত কিংবদন্তি। ১৯২৬ থেকে ১৯৬৪ – এই আটত্রিশ বছরের অভিনয় জীবনে তিনি দু’টি নির্বাক ছবি সহ প্রায় চল্লিশটি সবাক ছবিতে অভিনয় এবং ন’টি দুর্দান্ত ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। নির্বাক থেকে টকি, টকি থেকে প্লেব্যাক – এই তিন যুগের সেতু ছিলেন কানন দেবী।

১৯২৬ সাল, ভারতীয় সিনেমা তখন নির্বাক। কলকাতার ম্যাডান থিয়েটারের ফ্লোরে জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ছবি ‘জয়দেব’-এর শ্যুটিং চলছে। ফ্লোরেই শুকনো মুখে ক্ষুধার্ত একটি ন’-দশ বছরের সুন্দরী মেয়ে বসে আছে। পাড়ায় তুলসীকাকু পিতৃহারা এই মেয়েটিকে নিয়ে এসেছেন কাজ দেবেন বলে। ছবি উঠবে, তবে টাকা পাওয়া যাবে। টাকার সন্ধানেই এসেছে মেয়েটি। এই মেয়েটিই হল পরবর্তীকালের সুপারস্টার কানন দেবী। সেদিন তিনি উক্ত ছবিতে রাধার ভূমিকায় অভিনয় করে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন মাত্র পাঁচ টাকা। এক সাক্ষাৎকারে পরে কানন দেবী জানিয়েছিলেন যে, সে দিন পারিশ্রমিক নাকি পঁচিশ টাকা ঠিক হয়েছিল, মাঝপথে কেউ হয়তো কুড়ি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। পরের বছর আবার একটা নির্বাক ছবি ‘শঙ্করাচার্য’তে অভিনয় করেছিলেন কানন দেবী।

এর পর ১৯৩১ সালে কানন দেবী তৃতীয় ছবিতে অভিনয় করেন। ম্যাডান কোম্পানির সবাক ছবি ‘ঋষির প্রেম’-এ নায়িকা রাজকন্যা উৎপলার ভূমিকায় অভিনয় করেন পনের বছরের কাননবালা। ছবিতে ঋষির মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আরেক সুন্দরী অভিনেত্রী সরযূবালা দেবী। ১৯৩১ সালেই ম্যাডান কোম্পানির ব্যানারে ‘প্রহ্লাদ’ এবং ‘বিষ্ণুমায়া’ নামের দু’টি ছবিতে কাননবালা ‘নারদ’ আর ‘শ্রীকৃষ্ণের’ ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই সময় কানন দেবীর মাইনে ছিল মাসে ষাট টাকা করে।

ম্যাডান কোম্পানির চুক্তি শেষ হতেই কানন দেবী তিনশো টাকার মাস মাইনেতে যোগ দেন রাধা ফিল্মসে। গান জানতেন বলে তাঁর কদর ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছিল। তাঁর শিল্পী জীবনের শুরুতেই গানের তালিম নিয়েছিলেন সঙ্গীতজগতের তাবড় তাবড় শিল্পীদের কাছে। ওস্তাদ আল্লা রাখা, পঙ্কজ মল্লিক, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, দিলীপ রায়, নজরুল ইসলাম প্রমুখ দিকপালের সান্নিধ্যেই সঙ্গীতচর্চা শুরু করেন কানন দেবী। মোহিনী কণ্ঠের অধিকারিণী এই গায়িকা-অভিনেত্রীকে সে যুগে ‘রেকর্ড শিল্পী’ বলা হত। তাঁর সুললিত কণ্ঠের ‘আমি বনফুল গো’ গানটি এখনও সমানভাবে জনপ্রিয়।

রাধা ফিল্মসের প্রযোজনায় প্রথম অভিনয় করেন ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’ ছবিতে। ছবিতে বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় কানন দেবী এবং নিমাইয়ের ভূমিকায় বিনয় গোস্বামী অভিনয় করেছিলেন। পরিচালক ছিলেন প্রফুল্ল ঘোষ। এই ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমেই কানন দেবী প্রচারের আলোয় আসেন। এই সময় প্রফুল্ল পিকচার্সের ব্যানারে ‘মা’ নামের এক দ্বিভাষিক ছবিতে অভিনয় করেছিলেন কানন দেবী। এই ছবিটির বাংলায় নায়ক ছিলেন ভাস্কর দেব আর হিন্দিতে জাল মার্চেন্ট।

কানন দেবীর পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ছবি হল জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ছবি ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’। এই ছবিতে কানন দেবীর বিপরীতে ছিলেন জহর গঙ্গোপাধ্যায়। সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেত্রী হিসাবে এই ছবি থেকেই কানন দেবীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। অসাধারণ সুন্দরী কানন এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন যে, রাস্তার ধারে তাঁর আলোকচিত্র বিক্রি হতে শুরু করে, এবং তাঁর পোশাক, অলঙ্কার, চলাফেরা ইত্যাদি তৎকালীন নারীদের জন্যে ফ্যাশনে পরিণত হয়।

হাজার টাকা মাস মাইনেতে তিনি যোগ দেন নিউ থিয়েটার্সে। সেখানকার প্রথম ছবি ছিল দেবকী বসুর পরিচালনায় ‘বিদ্যাপতি’। তবে এই ছবি মুক্তি পাবার এক বছর আগে ১৯৩৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মুক্তি পায় কানন দেবী-প্রমথেশ বড়ুয়া জুটির ছবি ‘মুক্তি’। শুধু ছবিটিই নয়, হিট করল পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরে করা গানগুলিও।

নিউ থিয়েটার্স এবং এম পি ১ প্রোডাকশনের একগুচ্ছ ছবিতে অভিনয়ের পর ১৯৪৭ সালে বোম্বাইয়ের অশোককুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে কানন দেবী করলেন ‘চন্দ্রশেখর’। দেবকী বসু পরিচালিত এই ছবিতে সুর দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য কানন দেবী পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন একলাখ পঁচিশ হাজার টাকা। আজকের নায়িকাদের পিলে চমকে যাবে যে, বোম্বাইয়ের ছবিতে অভিনয়ের জন্য এক প্রযোজক কানন দেবীকে সেই সময়ে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অফার করেছিলেন, তবুও বোম্বাই যাননি কানন দেবী। কলকাতা থেকেই তিনি বোম্বের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন।

জীবিকার তাগিদে সিনেমাতে নামতে হলেও তিনি কোনওদিন ফাঁকি দিয়ে বাজিমাত করার চেষ্টা করেননি। দিনের পর দিন তিনি শিক্ষার্থীর মতো নিষ্ঠার সঙ্গে শিখেই গেছেন। ‘চার দরবেশ’ ছবির উর্দু ভাষা রপ্ত করার জন্য তিনি মৌলবির কাছে উর্দু শিখেছিলেন। ‘সাথী’ ছবির নাচের দৃশ্যের জন্য তিনি শিক্ষক রেখে নাচের তালিমও নিয়েছেন। কানন দেবীই বাংলা সিনেমাকে দিয়েছিলেন স্বাভাবিক অভিনয়। তাঁর গাইবার ক্ষমতাও ছিল সহজ। সাধারণ দ্রুত লয়ে তাঁর গাওয়ার ধরণ কলকাতায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গায়িকা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও তিনি নানা সময় নানা জনের কাছে সঙ্গীত শিখে গেছেন।

১৯৪৯ সালে কানন দেবী তৈরি করেন ‘শ্রীমতী পিকচার্স’, যার প্রথম প্রযোজিত ছবি ‘অনন্যা’। ছবিটির পরিচালক ছিলেন সব্যসাচী। এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অজয় কর, বিনয় চ্যাটার্জি এবং কানন দেবী স্বয়ং। শ্রীমতী পিকচার্সের ব্যানারে একে একে তৈরি হয় ‘মেজদিদি’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘নববিধান’, ‘দেবত্র’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘আঁধারে আলো’ প্রভৃতি শরৎচন্দ্রের অমরকথার চিত্ররূপ। এগুলির মধ্যে ‘আঁধারে আলো’ ছবিটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিল।

১৯৬৪ সালে খ্যাতির চূড়ায় থাকতে থাকতে হঠাৎ সিনেমার জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন কানন দেবী। প্রথমে অশোক মৈত্র, পরে হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিয়ে হলেও সে সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি। এর আগে ১৯৫৬ সালে বন্ধ করেছিলেন গান গাওয়া, তারপর কানন দেবী ‘গোবিন্দ’কেই সম্পূর্ণ সময় অর্পণ করেছিলেন। তার পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েছিলেন সমাজসেবার মহান কাজে। স্প্যাসটিক সোসাইটিতে দেড় লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন, ক্যান্সার হাসপাতাল এবং টিবি হাসপাতালেও দান করেছিলেন। মহিলা শিল্পীমহল গড়ে, নাটক করে দুঃস্থ, নিঃসম্বল মহিলাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন।

বাংলা ছায়াছবির এই কিংবদন্তী অভিনেত্রীকে ভারত সরকার ১৯৬৮ সালে ‘পদ্মশ্রী’, এবং ১৯৭৭ সালে ভারতীয় সিনেমা জগতের সর্ব্বোচ্চ সম্মান ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন।

যতদিন বাংলা সিনেমা থাকবে, ততদিন স্বর্ণাক্ষরে থেকে যাবে বাংলা ছায়াছবির প্রথম তারকা শিল্পী কানন দেবীর নাম।


লেখক পরিচিতি : অর্হণ জানা
অর্হণ জানা। জন্ম ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৬। বর্তমান নিবাস বড়জাগুলি, নদীয়া। ছোট থেকেই লিখতে ভালবাসি— গান, গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ। সুকুমার রায় আমার গুরু। আমার পথপ্রদর্শক। এযাবৎ কয়েকটি পত্রপত্রিকা ও সংকলন গ্রন্থে আমার লেখা কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ও ছড়া প্রকাশিত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।