ভাওয়াল মামলা: ১৯২৬ সালের ৮ ডিসেম্বর সন্ন্যাসী বোর্ড অব রেভিনিউর কাছে দাবি করেন, তার পরিচয় তদন্ত করার জন্য। কিন্তু বোর্ড সে দাবি অগ্রাহ্য করে। ১৯২৯ সালে সন্ন্যাসী ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ১৯৩০ সালের ২৪ এপ্রিল নিজেকে মৃত রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ বলে দাবি করে এবং ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারি চেয়ে বিভাবতী দেবি, তার ভাই সত্যেন্দ্র নাথ এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দ্বায়ের করেন। এবং এই মামলার বিচার কার্য শুরু হয় ১৯৩৩ সালের নভেম্বরের ৩০ তারিখে।
বাদি পক্ষ এবং বিবাদী পক্ষের উকিলরা ছিলেন পুরো পুরি দুই মেরুর। বাদী অর্থাৎ সন্যাসীর পক্ষের উকিল ছিলেন জাতীয়তাবাদি উকিল ‘বিজয় চন্দ্র’, অন্যদিকে বিবাদী পক্ষের উকিল ‘অমিয় নাথ চৌধুরি’ ছিলেন ইংরেজদের বিশেষ আস্তা ভাজন। এছাড়াও উক্ত মামলায় প্রধান বিবাদী হিসাবে ছিলেন রাণী বিভাবতী দেবী, তবে মূলত কলকাঠি নেড়েছিলেন তার ভাই সত্যেন্দ্র নাথ এবং আশু ডাক্তার। ফলে এটা অনেকটা যুদ্ধের মত পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ালো। জেলা জর্জ ‘অ্যালান হেন্ডারসন’ বিচারপতি ‘পান্না লাল বসু’কে এই মামলার বিচারক পদে নিয়োগ করেন। পান্না লাল বসুর কোর্টে মেজো কুমার অসুস্থাবস্থায় দার্জেলিং-এ অবস্থান কালে তার চিকিৎসার কাজে যে সিভিল সার্জেন যুক্ত ছিলেন সেই ‘জেসি কার্লভাট, ভাওয়ালের বড় রানী সূর্যবালা দেবী’ এবং কুমারের তথাকথিত মৃত্যুর সময়ে দার্জেলিংয়ে উপস্থিক কলকাতার ডাক্তার ‘প্রণোনাথ কৃষ্ণ আচার্য’ এই তিনজনের স্বাক্ষ্য নিয়েই শুরু হয় মামলা।
ডাক্তার আচার্য তার স্বাক্ষ্যে বলেন যে, ‘তার দিব্যি মনে আছে দার্জেলিংয়ে ১৯০৯ সালের মে মাসের কোন এক সকালে একজন নার্স এসে তাকে ডেকে তোলেন এবং বলেন যে দ্বিতীয় কুমার মারা গেছেন বলে ভয় হচ্ছে। তিনি গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন যে, ঘটনা আসলে তাই কিনা। সকাল ৬ টার সময় ডাক্তার স্টেপ অ্যাসাইডে গিয়ে পৌঁছান। এবং দেখেন এক ব্যক্তি খাটিয়ায় শুয়ে আছে। যার মাথা থেকে পা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। পরীক্ষার জন্য তিনি চাদরটা সরাতে যাবেন, ঠিক তখনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন বলে উঠেন যে, তিনি ব্রাহ্মন সুতরাং মৃতদেহ ছোঁয়ার অধিকার তার নেই। ডাক্তার আচার্য ভয়ানক ক্ষুদ্ধ হন এই কথায় এবং সেই সাথে সাথে তিনি উক্ত বাড়ি ত্যাগ করে চলে আসেন। অর্থাৎ দেহ তিনি দেখতেই পাননি।’
প্রতিবাদী পক্ষের উকিলের সওয়াল জবাবে ডাক্তার জানান যে, ‘তার চল্লিশ বছরের এই ডাক্তারি জীবনে ধর্মের জন্য কোন জীবিত বা মৃতদেহ ছুঁতে কেউ কোন দিনই নিষেধ করেননি বা বাধা দেননি। এমনকি তিনি এও বলেন, যে সেদিন যদি তাকে মৃতদেহ পরীক্ষা করতে দেওয়া হতো, তাহলে তিনি নিশ্চই বলতে পারতেন উক্ত ব্যক্তির সত্যিই মৃত্যু হয়েছিল কি না।’
উক্ত মামলায় বিজয় চন্দ্র চক্রবর্তি সন্ন্যাসীর পক্ষে প্রধান উকিল হিসাবে কাজ করেন। এবং বিভাবতীর পক্ষে অমিয় নাথ চৌধুরি প্রধান উকিল হিসাবে কাজ করেন। বিচার শুরু হয় ১৯৩৩ সালের নভেম্বরের ৩০ তারিখ। বিবাদী পক্ষে আরো ছিল কোর্ট অব ওয়ার্ডস, যা বিভাবতী দেবি ও অন্য দুই কুমারের বিধবা স্ত্রীদের প্রতিনীধি হিসাবে কাজ করছিল। বিবাদী পক্ষের আইনজীবিরা প্রমান করার চেষ্টা করেন যে, এই নিরক্ষর সন্যাসী কোন মতেই ব্রাহ্মন বর্নের হতে পারে না। কিন্তু বাদী পক্ষের আইনজীবিরা প্রমান করে দেখান যে, কুমার রমেন্দ্র নারায়ণও প্রায় নিরক্ষর ছিল। বিবাদী পক্ষ থেকে আরো দাবী করা হয়, কুমারের রক্ষীতা এলোকেশির কাহিনী পুরোপুরি মিথ্যা। কিন্তু বাদী পক্ষ এলোকেশিকেও আদালতে হাজির করে। জেরার জবাবে এলোকেশি জানান, ‘পুলিশ তাকে ঘুষ দিয়ে স্বাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছিল।’ বিবাদী পক্ষ আরো দাবী করে, কুমারের সিফিলস স্ট্রোক শেষ পর্যায়ে পৌছে যাওয়ায় তার গায়ে দগদগে ঘা ও ক্ষত থাকার কথা। কিন্তু কথিত সন্যাসীর গায়ে তার কোন প্রমান নেই। সন্যাসী মূলত উর্দূ ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু সন্যাসী দাবি করেন যে, ভ্রমন করতে করতে তিনি বাংলা ভুলে গেছেন। কুমারের চোখের রং নিয়েও বিতর্ক ওঠে। এটাও দাবী করা হয় যে, সেদিন শশ্মানে কুমারের চিতায় সম্ভাবত অন্যকারো দেহ দাহ করা হয়েছিল।
প্রায় চার বছর পর এ ঐতিহাসিক মামলাটির শুনানি শুরু হয়। এমনকি দেশের বাইরে বিলেতেও এর কমিশন গঠন করা হয়েছিল। আদালতে মোট ১০৬৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছিল, এর মাঝে ৯৬৭ জন সন্ন্যাসীকে মেজো কুমার বলে সাক্ষী দিয়েছিল। কুমারের নিকটাত্মীয়দের প্রায় সবাই সাক্ষী দেন, যে সন্ন্যাসীই প্রয়াত মেজো কুমার। এমনকি মেজো রানী বিভাবতীর আত্মীয়দের মধ্যেও অনেকেই সন্ন্যাসীর পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিলেন। এমনকি আদালত থেকে জ্যোতিমর্য়ী দেবিকেও স্বাক্ষ্য হিসাবে কাঠ গড়ায় দাঁড় করান। মূলত জ্যোতিমর্য়ীদেবি কুমারের পক্ষে ছিলেন। এবং তিনি দাবি করেন যে, এই সন্ন্যাসীই তার ভাই মেজো কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ। তিনি আরো দাবি করেন যে, সন্ন্যাসীর চেহারায় তাদের বংশের ছাপ রয়েছে এবং সন্ন্যাসী বাংলা বলতে পারেন। বাদি পক্ষ কুমারের স্ত্রী বিভাবতীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বিভাবতী কুমারের চেহারার সাথে সন্ন্যাসীর চেহারার কোন মিল নেই বলে দাবি করেন। কুমারের অন্য ভাইদের বিধবা স্ত্রী অন্যদা দেবি দাবী করেন, কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ ইংরেজি বলতে পারতেন, এবং বাংলা বলতে ও লিখতে পারতেন। যার কোনটাই সন্যাসী পারে না। এবং তার প্রমাণ সরুপ তারা আদালতে কিছু চিঠি বা কাগজ পত্র দাখিল করেন। কিন্তু কুমারের ভাষাজ্ঞানের প্রমান সরুপ পেশ করা সেই চিঠি গুলো অবশ্য পরবর্তিতে ভূয়া বা জাল বলে প্রমানিত হয়।
- ভাওয়াল রাজ পরিবারের সদস্য শ্রীমতি রত্না চ্যাটার্জীর স্বাক্ষ্যঃ- উক্ত মামলায় ভাওয়াল রাজ পরিবার এবং আশে পাশের এলাকা থেকে বহু স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। যার মধ্যে অন্যতম স্বাক্ষী হিসাবে পরিগণিত ছিলেন, ভাওয়াল রাজ পরিবারের সদস্য শ্রীমতি রত্না চ্যাটার্জী। শ্রীমতি রত্না চ্যাটার্জীর ভাষ্য মতে জানা যায়, মেজোরানী বিভাবতী ছিলেন স্বৈরীনি। পারিবারিক ডাক্তার আশুতোষ দাশ গুপ্তের সাথে ছিল মেজোরানীর অবৈধ সম্পর্ক। তাছাড়া রাণী বিভাবতী সন্তান লাভের বাসনায় ডাক্তার আশুতোষের সাথে বিবাহ বহির্ভূত অবৈধ মিলনে লিপ্ত হন। যার ফলে আশু ডাক্তারের অবৈধ সন্তান বিভাবতীর গর্ভে চলে আসে। কেননা মেজোকুমার ছিলেন শারিরীকভাবে সন্তান দানে সম্পূর্ণ অক্ষম। কারন অ-সংযম যৌনাচারে কিছু দিন আগেই তিনি সিফিলিসে আক্রান্ত ছিলেন। পরে ব্যাপারটা রাজ বাড়িতে জানা-জানি হয়ে গেলে মেজোকুমার যখন বড় রানী সরযুবালা ও ছোট রানী আনন্দকুমারীর প্ররোচনায় বিভাবতী কে শাস্তি দিতে উদ্যত হলেন, ঠিক তখনই তিনি মেজোরানী ও আশু ডাক্তারের ফাঁদে পড়ে দার্জিলিং যান চিকিৎসার জন্য। উল্লেখ্য যে দার্জিলিং চিকিৎসা চলাকালিন সময়ে বিভাবতী তার স্বামী মেজোকুমারকে আরো বেশি করে দূর্বল এভং অসুস্থ্য করার জন্য তকে স্বল্পমাত্রায় বিষ প্রয়োগ করতো।
- ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সন্ন্যাসী নিজেই স্বাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হন। সন্ন্যাসী তার নিজের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের যে সাফাই পেশ করেন, সেটা ছিল অনেকটা এই রকমঃ-
– সেই রাতে আমি আশু ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি। পরের দিন এক ডাক্তার সাহেব আসেন। আমার পেট ফাঁপত। আশু ডাক্তার সেদিন ওষধু দেওয়ার পর আমি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু পর দিন আবারও যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছিলাম। আশু ডাক্তার কাচের গ্লাসে আমাকে কী একটা ওষুধ খেতে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ওষধে কোনই কাজ হচ্ছিল না। পর দিন শরীর আরও খারাপের দিকে গেল। এবং আমি যে ক্রমশ্য দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম, সেটা খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছিলাম। তিনদিনের দিন আমি আরো বেশি দূর্বল হয়ে পড়ি। এবং আশু ডাক্তার আমাকে আবারও সেই একই ওষধ খেতে দেন। কিন্তু তাতে কোনই লাভ হয়নি। সেই রাতে আনুমানিক আটটা থেকে নয়টার মধ্যে আশু ডাক্তার আমাকে গ্লাসে করে কি একটা ওষধ দিলেন। তাতেও কিছু হয় না। কিন্তু সেটা খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমার বুকের মধ্যে জ্বালা করতে লাগল, বমি হলো, এবং সারা শরীর ছটফট করতে লাগল। ওষধ খাওয়ার প্রায় তিন চার ঘন্টা পর থেকে এসবই আরম্ভ হয়েছিল। যন্ত্রনায় আমি তখন চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু সেই রাতে কোন ডাক্তার এলো না। এভাবে কিছুক্ষন চলার পরে এবার শুরু হলো রক্ত পায়খানা। খুব দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম আমি। তারপর একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ি। যখন চোখ মেলি, দেখি পাশে চারজন সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানতে চেয়েছিলাম, আমি কোথায়? তারা ইশারায় ও মৃদু স্বরে আমাকে হিন্দিতে জবাব দিয়েছিলেন, কথা না বলতে। সুস্থ হয়ে উঠলে আমি সন্ন্যাসীদের সঙ্গে হেঁটে ও ট্রেনে চেপে বহু দেশ-বিদেশ ঘুরতে থাকি। তখন আমার স্মৃতি শক্তি একদমই হারিয়ে যায়। আমি আমার অতীতকে ভুলে যাই। তবে আমি মাঝেমধ্যেই আমার গুরুকে জিজ্ঞেস করতাম, বাড়ি ফেরার কথা বলতাম। গুরু জবাব দিতেন, সময় হলেই যাবি। আমি এভাবে বহু বছর এদেশ-ওদেশ বেড়িয়ে নেপালে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখান থেকে তিব্বত। কিন্তু তিব্বত থেকে আবার নেপালে ফিরে আসার পথে গুরু বললেন, তোর বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। আমি গৌহাটি থেকে ট্রেনে চেপে ফুলছড়ি হয়ে ঢাকা আসি। বাকল্যান্ড বাঁধের কাছে আমি বসে থাকতাম। অনেকেই আমাকে ভাওয়াল রাজা বলে ভিড় জমাত। আমি জয়দেবপুরে হাতির পিঠে চেপে ফিরে আসি।
সেই শুরু। এরপরে প্রায় ১৬ বছর ধরে চলল এই মামলা। বিভিন্ন ধরনের জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে রায় গেল সন্ন্যাসীর পক্ষে। এমনকি আরো অনেক আদালত থেকেও এই মামলার রায় সন্ন্যাসীর পক্ষেই আসলো। কিন্তু বিবাদী পক্ষ না দমে মামলা চালাতেই লাগলো। বিভাবতীকে জেরা করার ক্ষেত্রে তিনি সব সময় প্রায় একই কথা বলেছিলেন। বাদি পক্ষের ব্যারিষ্টার কোন জেরাতেই তাকে টলাতে পারছিলেন না। বাদি পক্ষের ব্যারিষ্টার কর্তৃক জেরা গুলো ছিল অনেকটা এই রকমঃ-
বাদি পক্ষের ব্যারিষ্টারঃ- এটা আপনি নিশ্চই জানেন যে, বাদী পক্ষের দাবি তাকে দার্জেলিং-এ খাবারের সাথে আর্সেনিক খাওয়ানো হয়েছিল?
বিভাবতীর নরম কণ্ঠের উত্তরঃ- হ্যাঁ!
– আর আপনি বললেন যে মেজো কুমারের পিত্তশূল বেদনা খুব বেড়েছিল, এবং ইনজেকশনে তার বেদনা কমেছিল। কিন্তু কুমার যে মারা যাবে, সেটা আপনি বা ডাক্তাররা বুঝতে পেরেছিলেন কি?
– আমার কাছে মৃত্যু অপ্রত্যাসিত ছিল।
– আমি কিন্তু একথা বলছি না যে, আপনি নিজ হাতে কুমারকে বিষ দিয়েছিলেন বা বিষ খাওয়ানোর কথা জানতেন? সুতরাং আমার প্রশ্নের উত্তর গুলো খুব ধীর স্থির ভাবে ভেবে চিন্তে উত্তর দেবেন! আচ্ছা আপনি কি জানেন যে, পিত্তশূলের ব্যাথাতে মৃত্যু খুবই বিরল?
– হ্যাঁ জানি।
– আচ্ছা আপনি নিশ্চই জানেন যে, পিত্তশূলে রক্ত পায়খানা হয় না। কিন্তু অপরদিকে আর্সেনিক খাওয়ালে রক্ত পায়খানা হয়। এখন আপনি বুঝতে পারছেন কি, যে আপনার স্বামীকে আর্সেনিক খাওয়ানো হয়েছিল?
– কি করে বুঝবো? আমি কি ডাক্তার?
– আপনি নিজে কখনো গভীর ভাবে ভেবে দেখেছেন, সত্যিই আপনার স্বামীকে আর্সেনিক খাওয়ানো হয়েছিল কিনা?
– আমি জানি ওটা মিথ্যে কথা।
– আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো না কিন্তু?
– আমার অত ভাববার দরকার নেই। কারণ ঐ কথা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। আর্সেনিকে কি হয় না হয় তা আমি আগেও জানতাম না। আর এখনও জানি না।
– আপনি বোধ হয় আজও পর্যন্ত এটা জানেন না যে আশু ডাক্তারের সই করা একটি প্রেসক্রিপশন পাওয়া যাচ্ছে। তাতে কিন্তু আর্সেনিক ছিল?
– না। আমি ঐ সম্পর্কিত বিষয়ে কিছুই জানি না।
– আচ্ছা আপনার স্বামীর মৃত্যুর পর আপনার লাভ হয়েছে না ক্ষতি হয়েছে একটু বলবেন কি?
– কোন স্ত্রীই তার স্বামীর মৃত্যু কামনা করতে পারে না। সুতরাং আমিও পারি না!
– কিন্তু গুজব আছে, আপনার আর আশু ডাক্তারের মধ্যে নাকি একটা পরক্রিয়া সম্পর্ক চলছিল? উক্ত গুজব সম্পর্কে আপনি কি বলবেন? কিংবা গুজবটা যদি সত্যিই হয়, তাহলে তো দেখা যায় কুমারের মৃত্যুতে আপনার লাভই ছিল?
– আমি গুজবে বিশ্বাস করি না। তাছাড়া ডাক্তার বাবুর সাথে আমার কোন ধরনের সম্পর্ক নেই।
বাদি পক্ষের ব্যারিষ্টার কর্তৃক এমন হাজারও প্রশ্ন বিভাবতীকে করা হলেও, শেষ পর্যন্ত তাকে একচুলও টলানো সম্ভব হয়নি। পরবর্তিতে সন্ন্যাসীর গুরুকেও এই মামলায় খবর দিয়ে নিয়ে আসা হয়। তিনি কিভাবে সন্ন্যাসীকে কুড়িয়ে পেলেন এবং কিভাবে তাকে শিষ্য করে গড়ে তুললেন। এবং কিভাবে তাকে আবার তার দেশে ফেরত পাঠালেন তার সবিস্তার বিবরন দিলেন। এভাবে উভয় পক্ষের সমাপনী যুক্তি চলে প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে। এবং সঙ্গত কারণে মামলার রায় দেওয়ার পূর্বে শুনানী মুলতবি করা হয় ১৯৩৬ সালের ২০ এপ্রিলে। বিচারক পান্নালাল বসু তিনমাস ধরে এই বিচারের রায় নিয়ে চুড়ান্ত কাজ করেন। তারপর ১৯৩৬ সালের আগষ্টে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ রায় প্রদান করেন এবং সন্যাসীর পক্ষেই রায় দেন। কারণ সন্যাসীযে মেজো কুমার সেটাই আদালতের কাছে মনে হয়।
তবে রাণী বিভাবতী এবং আশু ডাক্তারের সম্পর্ক নিয়ে যে গুজব ওঠে তা অবশ্য প্রমানিত হয়নি। তা হলেও আশু ডাক্তার এবং সত্যেন্দ্রনাথের উপরে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ কিন্তু মিথ্যা বলে প্রমানিত হলো না। তবে আসল সত্যযে কি ছিল সেটা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ কখনোই কাটেনি। এখনও অনেকের মত অনুযায়ী, সন্যাসী ছিল আসলে একজন বড় মাপের প্রতারক। আবার অনেকের মতে রাণী আর তার ভাই দু’জনে মিলে আসলেই মেজো কুমারকে খুন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা তা পারেন নি। মামলার রায় জানতে বিশাল জন সমাগম হয়। এছাড়াও মামলার রায় দেওয়ার পরপরই পান্না লাল বসু বিচারকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ভাওয়াল স্টেটের কুমার রমেন্দ্র নারায়ণের ভাগ থেকে সন্যাসীকে টাকা নিতে অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু অন্যান্য বিষয় নিঃস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যাবতিয় সম্পত্তি স্থগিত রাখা হয়। এবং এই সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডস এর হাতে রাখেন। এবং একই সময় তিনি বিয়ে করেন। যার ফলে রাজস্ব বোর্ড মামলা নিয়ে কার্যক্রম তখনকার মত বন্ধ রাখে।
তাছাড়া উক্ত রায়ের পর মিঃ এ. এন. চৌধুরি মামলা ছেড়ে দেন, কিন্তু বিভাবতী হাল ছাড়তে নারাজ ছিলেন। এর পর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের কারণে মামলার আপিল ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ঐ সালেই রাণী বিভাবতীর আইনজীবিরা হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে লন্ডনের প্রাইম কাউন্সিলে আপিল করে। জার্মান বিমান হামলায় কাউন্সিলের ভবন ক্ষতি গ্রস্ত হওয়ায় প্রিভিউয়ের অধিবেশন ঘটে তখন হাউস অব লর্ডসে। ১৯৪৫ সালে সেখানে শুনানী শুরু হয় । ডি. এন. প্রিট দাবিদারের পক্ষে এবং ডব্লিউ ডব্লিউ কে পেইজ, কোর্ট অব ওয়ার্ডসের পক্ষে মামলা পরিচালনা করে। প্রিভি কাউন্সিলর মামলার রায় শুনতে রাজি হন এবং ‘লর্ড থাঙ্কের্টন, লর্ড হার্বার্ট ডু পার্স্ক, এবং স্যার চেতুর মাধবন’ আপিলের বিচার করেন। আটাশ দিন ধরে চলে শুনানী। তারপর ১৯৪৬ সালের ৩০ জুলাই তারিখে বিচারকেরা দাবিদারের পক্ষে রায় দেন। এবং যাবতীয় আপলি নাকচ করে দেন। পরের দিন কলকাতার টেলিগ্রাফ মারফত মামলার রায় জানানো হয়।
ফরেন্সিক বিজ্ঞানের জন্য এই মামলা ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। এই মামলাতে একজন অপরিচিত মানুষের পরিচয় বের করবার নানা ধরনের কলা কৌশলের যথেষ্ট প্রয়োগ ঘটেছে। কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ এবং সন্যাসীর শারীরিক মিল ছিল অনেক বেশি। মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের উচ্চতা, জামার মাপ, জুতার মাপ, চুলের রং, শরীরের বিশেষ চিহ্নগুলোর সবই সন্ন্যাসী মেজো কুমার বলে প্রতীয়মান হন। বিশেষ করে ডাক্তাররা মেজো কুমারের শরীরে যে কয়েকটা বিশেষ জন্মগত দাগ, তিল, ফোঁড়ার দাগ ও দুর্ঘটনার ফলে আঘাতের চিহ্ন রয়েছিল, তার সবগুলোই হুবহু খুঁজে পান। এছাড়াও দুই ব্যক্তির আলোকচিত্রিতেও যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকি তাদের দু’জনের কথা বলার ধরন, গলার স্বর, হাঁটার গতি, সব কিছুরই যথেষ্ট মিল রয়েছে। যদিও আঙ্গুলের ছাপ নেওয়ার পদ্ধতীটি এই মামলার সময় চালু ছিল, কিন্তু কোন একটা অজ্ঞাত কারণে সেটা আর পরীক্ষা করা হয়নি। ধারনা করা হয়, কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ বার বছর আগে নিখোঁজ হওয়াতে, তার আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। প্রিভি কাউন্সিলের রায় বের হওয়ার পরদিনই খবর বের হলো কলকাতায়। সে দিন টা ছিল ১৯৪৬ সালের ৩০ শে জুলাই। কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ শেষ পর্যন্ত তিনটা কোর্টেই নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে সক্ষম হলেন। পরদিন যখন খবরটা শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লো, তার ধর্মতলার স্ট্রিটের বাড়িতে তখন হাজার হাজার লোকের সমাগম। সবাই তাকে অভিনন্দন জানাতে চায়!
- চিরদিনের মত চলে গেলেন কুমার রমেন্দ্র নারায়ণঃ- মামলার জয়লাভের পর কুমার রমেন্দ্র নারায়ণের ধর্মতলা স্ট্রিটের বাড়িতে তখন লোকে লোকারণ্য। আর সেই দিন সন্ধ্যাতে ঘটলো আরো এক এমন ঘটনা, যা ছিল অনেকের পক্ষেই এক অপ্রত্যাসিত বিশাল ধাক্কা। কুমার যচ্ছিলেন কর্নওয়াল স্ট্রিটের উপর ঠনঠনিয়া কলি বাড়িতে পূজো দিতে। ঠিক এমনই মূহুর্ত্বে রাস্তায় বের হওয়ার সময় হঠাৎ তার হৃদ যন্ত্র গেল বন্ধ হয়ে। কুমার অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। সেই সাথে সাথে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। তখন তার বয়স ছিল তেষট্টি বছর। পরদিন হিন্দুস্থান র্স্টান্ডার্ডে ছোট করে খবর বের হলো-
“বহুল আলোচিত ভাওয়াল রাজ স্ট্রেটের মেজো কুমার সেই সন্ন্যাসী রমেন্দ্র নারায়ণ, হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। তার শরীর কিছুদিন থেকেই ভাল যাচ্ছিল না। হেমো থিসিস এ আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৬ সালের পহেলা আগষ্ট তিনি শেষ নিঃস্বাশ ত্যাগ করেন।”
প্রিভি কাউন্সিলের রায় জেনে বহু লোক তার বাড়িতে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে তার মৃত্যু সংবাদ শুনে সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়। তারা কি আসলেই জানতো, যে মানুষটাকে তারা এত সমাদর করে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিল, ঠিক সেই একই সময়ে তার মৃত্যুর শেষকৃত্যে তাদেরকে অংশ গ্রহণ করতে হবে? জানা গিয়েছে যে, বন্ধু বান্ধব এবং প্রজাদের সাথে দেখা করতে এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে জয়দেব পুরে যাওয়ার তার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সন্ন্যাসীর সে আশা আর পূরণ হলো না। কুমারের শ্রাদ্ধ হলো কলকাতায়, ১৯৪৬ সালের ১৩ই আগষ্ট। মাত্র ৩৭ বছরের মধ্যে এটা তার দ্বিতীয় নম্বর শ্রাদ্ধ। আর এভাবেই শেষ হলো মেজো কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণের জীবনের অদ্ভুদ ট্রাজেডি ময় কাহিনী।
সমাপ্ত
তথ্যসূত্র:
A Princely Impostor? The Strange and Universal History of the Kumar of Bhawal, Partha Chatterjee.
A Prince, Poison and Two Funerals: The Bhowal Sanyasi Case, Murad Fayezi.
লেখকের কথা: রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।
বিভাবতী এর বাবার বাড়ি কোথায় ছিল?