বিবর্তনের পথ ধরে

লেখক : সেখ তৌফিক

যখন পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের উদ্ভব, তখন কোন নাম ছিল না, কোন জাতি ছিল না, কোন ভাষা ছিল না। তখন মানুষও ছিল না। কোটি কোটি বছরের ভ্রমণে ধূলি থেকে জন্ম নিল জীবনের প্রথম স্ফুলিঙ্গ, এককোষী প্রাণ থেকে বহুকোষী প্রাণ, সাগরের বুকে ভেসে বেড়ানো জীব থেকে স্থলের প্রথম অভিযাত্রী। ডাইনোসরের দাপট ম্লান হয়ে গেল, স্তন্যপায়ী প্রাণীরা মাথা তুলল, আর বহু পরে—খুব, খুব পরে—হোমো সেপিয়েন্স নামের এই প্রাণীটি পৃথিবীর মাটিতে প্রথম পা রাখল।

আমরা আজ যে মানুষ, সেই রূপ পেতে লেগেছে লাখো বছর। আমাদের অস্থি, আমাদের রক্ত, আমাদের DNA এখনও সেই পুরনো যাত্রার কথা বলে। কিন্তু আমাদের সমস্ত সভ্যতা, সমস্ত ইতিহাস—রাজ্য, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি, এমনকি ধর্মও—এমন পুরনো নয়। ক্রোমানিয়ন আর নেয়ানডারথাল গুহার দেওয়ালে ছবি আঁকছিল যখন, কোন ধর্ম তখনও জন্মায়নি। কৃষির শুরু, শহরের উদয়—তারও বহু পরে ধর্মের প্রথম আলো জ্বলে ওঠে। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিষ্টান, ইসলাম—সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মও মানুষের ইতিহাসে স্রেফ কয়েক হাজার বছরের পুরনো। অথচ মানুষ? মানুষ তো অন্তত দুই-আড়াই লাখ বছরের ভ্রমণকারী, তারও বহু আগে থেকে ছিল তার পূর্বপুরুষরা—হোমো ইরেক্টাস, হোমো হাবিলিস, আরও কত নামহীন প্রাণ। এই বিশাল সময়রেখায় ধর্মগুলো ক্ষণস্থায়ী প্রদীপের মতো। অথচ আমরা সেই প্রদীপগুলোর আলো-ছায়ার বিভাজন নিয়েই একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়াই। আমরা ভুলে যাই—আমাদের পূর্বপুরুষেরা সবাই একই ছিলেন।

আফ্রিকার প্রান্তরে যে প্রথম মানুষ আগুন জ্বালিয়েছিল, তার রক্তধারা আজও আমাদের সবার শিরায় প্রবাহিত। সাইবেরিয়ার বরফে যে হাড় জমে আছে, সেটাও আমাদেরই আত্মীয়ের। দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে, এশিয়ার মরুভূমিতে, ইউরোপের পাহাড়ে—সবখানেই আমাদের আত্মীয়ের পদচিহ্ন ছড়ানো। আমরা এক বৃক্ষের ফল, এক মালার ফুল। আমাদের মিলন, আমাদের ঐক্য—ধর্মেরও আগে, ভাষারও আগে, জাতিরও আগে। বিভেদ এসেছে পরে, ইতিহাসের খুঁটিনাটি থেকে, কল্পিত সীমানা থেকে।

বিবর্তনের গল্প শুধু জীবনের গল্প নয়—এটি মানুষের আত্মপরিচয়ের গল্প। বিজ্ঞান আমাদের শেখায়, আমরা কারা—কেবল মাটির পুতুল নই, কেবল নাম-ধর্মের ভিত্তিতে খণ্ডিত দলও নই। আমরা হোমো সেপিয়েন্স, এক মানব পরিবারের সন্তান। ধর্ম, ভাষা, রাজনীতি – সবই সময়ের ক্ষণিক খেলা। কিন্তু আমাদের রক্তে বহমান পূর্বপুরুষের ইতিহাস সেই সব বিভেদেরও আগে, সেই সব ভ্রান্তিরও ওপরে।

যদি আমরা এই সত্যটি বুঝতে পারি, তবে মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা কমে আসবে। তখন হয়তো আমরা দেখব—বিজ্ঞান শুধু জ্ঞানের আলো নয়, মানবতারও আলো। তখন আমরা শিখব, আমরা এক। আমরা বিভক্ত নই। আমরা একই মহাকাব্যের চরিত্র।


লেখক পরিচিতি : সেখ তৌফিক
আমি নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালোবাসি। বিজ্ঞান, বিবর্তন আর মানবতার গল্প খুঁজে বেড়ানোর আমার নেশা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।