লেখক : তাহসিনুর রাইয়ান
মানুষ চিরকাল আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছে—মহাবিশ্বের শেষ কোথায়, আমরা কোথা থেকে এসেছি, মহাবিশ্বের নিয়মগুলো কীভাবে কাজ করে? এই অনুসন্ধিৎসাই নিয়ে এসেছে ব্ল্যাক হোলের ধারণা—এক মহাজাগতিক রহস্য, যা একইসাথে ভীতিকর ও মুগ্ধকর।
ব্ল্যাক হোল কী
ব্ল্যাক হোল হ’ল মহাবিশ্বের এমন একটি অঞ্চল, যেখানে মাধ্যাকর্ষণ এতটাই শক্তিশালী যে আলো পর্যন্ত সেখান থেকে বের হতে পারে না। এজন্য একে সরাসরি দেখা যায় না। তবে এর চারপাশের নক্ষত্র, গ্যাস ও বিকিরণের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছেন। আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (১৯১৫) প্রথম দেখায়, কীভাবে ভর স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়। বৃহৎ ভরবিশিষ্ট নক্ষত্র যখন ধসে পড়ে, তখন সেই বাঁক এত গভীর হয়ে যায় যে একটি অন্ধকার গহ্বর সৃষ্টি হয়—এটাই ব্ল্যাক হোল।
ব্ল্যাক হোলের জন্ম
একটি নক্ষত্রের জীবনচক্রের শেষ ধাপেই ব্ল্যাক হোলের জন্ম হয়। যদি নক্ষত্রের ভর সূর্যের তুলনায় বিশ গুণ বা তারও বেশি হয়, তবে তা শেষ পর্যন্ত সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ভেঙে পড়ে। পতনের পর এর ভর অসীম ঘনত্বে সংকুচিত হয়ে গড়ে তোলে সিঙ্গুলারিটি। সিঙ্গুলারিটির চারপাশে তৈরি হয় ইভেন্ট হরাইজন, যেখান থেকে আর কোন বস্তু বা বিকিরণ পালাতে পারে না। এইভাবেই জন্ম নেয় মহাজাগতিক দৈত্য—ব্ল্যাক হোল।
ব্ল্যাক হোলের প্রকারভেদ
ব্ল্যাক হোলেরও কয়েকটি ধরণ রয়েছে। মৃত নক্ষত্র থেকে তৈরি স্টেলার ব্ল্যাক হোলের ভর সাধারণত পাঁচ থেকে বিশ সৌর ভরের সমান। অনুমান করা হয়, মহাবিশ্বে প্রায় ১০ কোটি স্টেলার ব্ল্যাক হোল রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল, যাদের ভর কয়েক মিলিয়ন থেকে কয়েক বিলিয়ন সূর্যের সমান। প্রায় প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এগুলো অবস্থান করে। আমাদের মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে থাকা স্যাজিটারিয়াস এ স্টার-এর ভর প্রায় ৪.১ মিলিয়ন সৌর ভর।
তাছাড়া রয়েছে ইণ্টারমিডিয়েট ব্ল্যাক হোল, যাদের ভর কয়েকশ’ থেকে কয়েক হাজার সৌর ভর। সরাসরি প্রমাণ মেলেনি, তবে তারকাগুচ্ছের গতিবিধি থেকে এদের অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। আরও রয়েছে প্রাইমোর্ডিয়াল ব্ল্যাক হোল। ধারণা করা হয়, মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ে এগুলো তৈরি হয়েছিল। এদের ভর হতে পারে একটি গ্রহের সমান কিংবা পাহাড়ের মত ছোট। তবে এগুলোর অস্তিত্ব এখনও প্রমাণিত হয়নি।
সময় ও ব্ল্যাক হোল
আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী, মাধ্যাকর্ষণ যত বেশি, সময় তত ধীরে চলে। ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি গেলে সময় ধীরগতিতে চলবে, কিন্তু দূরে থাকা পর্যবেক্ষকের কাছে তা দ্রুত বয়ে যাবে। এই ঘটনাকে বলা হয় টাইম ডাইলেশন। এজন্যই ব্ল্যাক হোলকে অনেক সময় প্রকৃতির টাইম মেশিনও বলা হয়।
ব্ল্যাক হোল পর্যবেক্ষণ
যেহেতু ব্ল্যাক হোলকে সরাসরি দেখা যায় না, বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে এর অস্তিত্ব নির্ণয় করেন। নক্ষত্রের অস্বাভাবিক কক্ষপথ বিশ্লেষণ, ব্ল্যাক হোলের চারপাশে ঘূর্ণায়মান গরম গ্যাস থেকে নির্গত এক্স-রে ও গামা-রে শনাক্তকরণ—এসবের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোলের অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব। ২০১৯ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ ব্যবহার করে প্রথমবারের মতো একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের ছবি প্রকাশিত হয়। এটি ছিল গ্যালাক্সি এম ৮৭-এর কেন্দ্রে অবস্থিত দৈত্যাকার ব্ল্যাক হোল। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
মানুষের আবিষ্কার ও প্রযুক্তি
ব্ল্যাক হোল গবেষণার পেছনে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি। ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রেডিও টেলিস্কোপকে একত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমেই ব্ল্যাক হোলের ছবি পাওয়া সম্ভব হয়েছে। ২০১৫ সালে লিগো ডিটেক্টর প্রথমবার দুটি ব্ল্যাক হোলের সংঘর্ষ থেকে উৎপন্ন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করে। এটি মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণের এক নতুন যুগের সূচনা করে।
অমীমাংসিত প্রশ্ন
তবু ব্ল্যাক হোলের রহস্য পুরোপুরি উদঘাটিত হয়নি। সিঙ্গুলারিটির ভেতরে আসলে কী রয়েছে? সেখানে কি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম ভেঙে পড়ে? ব্ল্যাক হোল কি অন্য মহাবিশ্বে যাওয়ার দ্বার হতে পারে? স্টিফেন হকিং-এর মতে, ব্ল্যাক হোল ধীরে ধীরে বাষ্পীভূত হয়ে একসময় অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। যদি সত্যিই তা ঘটে, তবে ব্ল্যাক হোলের অন্তিম পরিণতি কী হবে, তা নিয়েও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ভাবছেন।
মজার বিষয়
ভাবুন তো, যদি ভবিষ্যতে হঠাৎ আমাদের মহাকাশ ভ্রমণের টিকিটে লেখা থাকে—“ডেস্টিনেশন: ব্ল্যাক হোল”। সেখানে পৌঁছে আমরা হয়ত দেখব সময় থমকে আছে, কিংবা আমাদের মোবাইল ফোনের চার্জ আর কখনও শেষ হচ্ছে না! তবে দুঃখের বিষয়, একবার ভেতরে ঢুকলে আর ফেরার উপায় থাকবে না। তাই আপাতত ব্ল্যাক হোলকে দূর থেকে কৌতূহলের চোখে দেখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ব্ল্যাক হোল শুধু ভয়ঙ্কর মহাজাগতিক দৈত্য নয়, এটি মহাবিশ্ব বোঝার এক গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি। সময়, স্থান ও মাধ্যাকর্ষণের সীমা বোঝার ক্ষেত্রে এটি অনন্য। অদৃশ্যকেও মানুষ বিজ্ঞানের শক্তিতে দৃশ্যমান করতে পারে—এই সত্যের প্রতীক ব্ল্যাক হোল। আজও এটি মহাবিশ্বের অন্ধকারতম রহস্য, আবার একইসাথে মানুষের জ্ঞানের আলোকবর্তিকা। হয়ত আগামী শতাব্দীতে আমরা সিঙ্গুলারিটির অন্ধকার পর্দা ভেদ করে জানতে পারব, এর গভীরে লুকানো আছে কী। তখন মানবজাতির মহাবিশ্বচিন্তায় লেখা হবে এক নতুন অধ্যায়।
লেখক পরিচিতি : তাহসিনুর রাইয়ান
সংক্ষিপ্ত পরিচয়: অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী, প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইয়ান'স রিডারস কর্নার।