নীলকণ্ঠ ফুল ।। Blue Jacaranda

লেখক : মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম (সোহেল)

অতিশয় ধুরন্ধর, প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন, চিৎকার-চেঁচামেচিতে পটু, প্রেমের উচ্ছ্বাসভরা সুললিত সুর, শূন্যে ধ্রুপদি নর্তক, চমৎকার নীলরঙা দুর্লভ নীলকণ্ঠ পাখি- সে তো নয় । কিংবা হিন্দুধর্মের মূল স্তম্ভ ত্রিশক্তির (ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব) মধ্যে অগ্রগণ্য, শৈব সম্প্রদায়ের প্রধান দেবতা, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পরমেশ্বর ভগবান শিব সমুদ্র থেকে হলাহল নামক বিষাক্ত বিষ পানের ফলে গলাতেই আটকে থাকল- বিষে কন্ঠটা গাঢ় নীলবর্ণ হয়ে গেল । শিবের স্ত্রী পার্বতী (হিন্দু দেবী দুর্গা রূপ বা দিব্য জননী / আদি পরাশক্তি সর্বোচ্চ দেবী মহামায়া) ছুটে এসে ভগবান শিবের কন্ঠ টিপে ধরলেন যেন শিবের দেহ পর্যন্ত এ বিষ নেমে না যায় । বিষ পানের ফলে শিবের কণ্ঠ বিষে নীলবর্ণ হয়েছিল আর সে জন্যই শিবের আরেক নাম নীলকন্ঠ বা নীলকান্ত (Neelkantha) । হিন্দু দেবতা বা মহা ঈশ্বরের সেই নীলকণ্ঠ নয় । রূপসী বাংলা ও বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের অমর রচনা ‘অপরাজিতার মতো নীল হয়ে, আরো নীল হয়ে… আমি যে দেখিতে চাই’, সে নীলকণ্ঠও নয় ।
তবে, কে সে নীলকণ্ঠ?
অবারিত সুনীল আকাশের সমগ্র গাঢ় নীল রঙে যার শুধু আকণ্ঠ নীল নয়, পুরো দেহটাই যে নীলাম্বরী শাড়িতে আচ্ছাদিত । যার কাছে শরতের নীলিমায় নীল প্রজাপতিও পরাজিত । ঐশ্বর্যময়, মাহাত্ম্য এবং অভিজাত নীলাভ সৌন্দর্যের জন্যেই তো সে ‘নীলকন্ঠ’ বা ‘নীল জ্যাকারান্ডা’ ফুল । নীলের মাঝেই তার অস্তিত্ব ।
তবে প্রশ্ন জাগে, কেনইবা তাকে ‘নীলকন্ঠ’ বলি? যেখানে কণ্ঠই যে শুধু নীল- তা কিন্তু নয়, যার দেহে পুরোটাই নীলের আধিপত্য ।
নীলকন্ঠ ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম: Jacaranda mimosifolia D.Don ।
Blue Jacaranda, নীল কৃষ্ণচূড়া, Neel Gulmohur, Neelkanth, Black poui, Brazilian rose wood, Mimosifolia fern tree, Green Ebony, Jacaranda tree ইত্যাদি নামে পরিচিত । এটি বিদেশী ফুল । এ ফুলের আদি জন্মস্থান ব্রাজিল । Bignoniaceae পরিবারের একটি উদ্ভিদ এবং ক্রান্তীয় আমেরিকার প্রজাতি । লাতিন ভাষা থেকে এ ফুলের নাম এসেছে । এটি পত্রমোচি, পচনশীল বা চিরহরিৎ দ্রুত বর্ধনশীল একটি শোভাময় গাছ (Ornamental tree) । বসন্তকালে গাছের ডালের ডগায় গুচ্ছবদ্ধভাবে ফুল ফোটে । জ্যাকারান্ডা বা নীলকণ্ঠ ফুল প্রাকৃতিকভাবে জন্মে পূর্ব অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, হাওয়াই দ্বীপ, দক্ষিণ-পূর্ব আমেরিকার উষ্ণ অংশগুলোর অন্তর্ভুক্ত এবং দক্ষিণ আমেরিকা ও তার স্থানীয় পরিসীমায় । নীলকণ্ঠ ফুল দক্ষিণ আফ্রিকা, কুইন্সল্যান্ডের কিছু অংশে আক্রমনাত্মক প্রজাতি হিসেবেও পরিচিত । গ্রীষ্মমন্ডলীয় উচ্চভূমি অঞ্চলগুলোতে ভালো জন্মে । বৃষ্টিপাত সহ্য করলেও তুষারপাত সহ্য করে না । এ প্রজাতিগুলো খুব ভালভাবে বালুকাময় লোম মাটিতে ভালো বৃদ্ধি পায়, যদিও এটি দরিদ্র অগভীর মাটিতে বেঁচে থাকে । জলাবদ্ধতা বা কাদামাটি সহ্য করে না । সিডনি এবং ব্লু পর্বতমালা অঞ্চলগুলোতে সম্ভাব্য পরিবেশগত আগাছা হিসেবেও এটি বিবেচিত হয় । যদিও এ শীতল অঞ্চলে এটি পরিপক্কতা অর্জন করলে কদাচিৎ তা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে । উজ্জ্বল সবুজ রঙের পাতা, ফার্ন এর মতো পালক । শরৎকালে পাতাগুলো গাছ থেকে পতনের আগে হলুদবর্ণ হয় । আকর্ষণীয় নীল, বেগুনী, সাদা, খয়েরি ইত্যাদি রঙের ফুল হয় এবং প্রতিটি ফুল ঘণ্টা আকৃতির । বাদামী কালো বৃত্তাকার পরিপক্ক ফল প্রায় দুই বছর পর্যন্ত গাছে ঝুলে থাকতে পারে । গাছে শুকিয়ে এবং হালকাভাবে বিভক্ত হয়ে বীজ মুক্তি পায় । অঙ্কুরের জন্য সর্বোত্তম তাপমাত্রা ২৫° সেঃ । বীজ শুকিয়ে রেখে অন্তত ১২ মাস ধরে বীজ টেকসই বজায় রাখা যায় । নীলকন্ঠ বা Jacaranda mimosifolia মাঝারি ও বড় আকারের মৌমাছি এবং পোকামাকড়ের উপর নির্ভর করে পরাগায়ণের জন্য । নীলকন্ঠের কাঠ বেশ দামি ও সুগন্ধিযুক্ত । ব্রাজিলে ভেষজ চিকিৎসায় এ গাছের ব্যবহার রয়েছে । সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব New South Wales অঙ্গরাজ্যের রাজধানী Sydney এর প্রায় ৬৩০ কিলোমিটার উত্তরে Grafton এর সারা শহরজুরে দেখা যায় নীলকণ্ঠ বা জ্যাকারান্ডার নীল-বেগুনী ফুলের এক অপরূপ সৌন্দর্য । পথের দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে লাগানো অসংখ্য নীলকণ্ঠ ফুল গাছের মোহনীয় ফুলের নীলরঙে ছেয়ে যায় । Grafton এবং Lismore শহরে দুটি পৃথক রাস্তার নাম Jacaranda Avenue নামকরণ করা হয়েছে । প্রতি বৎসর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহব্যাপি ‘জ্যাকারান্ডা উৎসব’ (Jacaranda festival) হয়ে থাকে । তাই, Grafton কে অস্ট্রেলিয়ার ‘জ্যাকারান্ডার রাজধানী’ বলা হয় ।


লেখক পরিচিতি : মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম (সোহেল)
ফার্মাসিস্ট

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।