জগন্নাথধামে চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধান রহস্য – ১ম পর্ব

লেখক : রানা চক্রবর্তী

নবদ্বীপের ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরেই নিত্য পূজিত হন বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত মহাপ্রভুর মূর্তি। কথিত রয়েছে, যে মূর্তি বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী নির্মাণ করান চৈতন্যদেবের জীবিত কালেই। সন্ন্যাস গ্রহণের পর চৈতন্যদেবের সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর আর কখনও দেখা হয়নি। কথিত আছে, বিরহকাতর বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চৈতন্যদেবের একটি মূর্তি নির্মাণ করান। সেই বিগ্রহের সেবাপুজো নিয়েই তিনি বাকি জীবন কাটান। চৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এর তিন বছর পরে ১৫১৩ সালে নির্মিত হয় ওই মূর্তি। বলা হয় যে নিম গাছের তলায় তাঁর জন্ম হয়েছিল সেই গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল চৈতন্যদেবের দারু বিগ্রহটি। মূর্তির পাদপীঠে খোদাই করা আছে “১৪৩৫ শক, বংশীবদন”। অনুমান, বংশীবদন নামের এক শিল্পী এই মূর্তির রূপকার। সারা বিশ্বের বৈষ্ণবভক্ত নবদ্বীপে ছুটে আসেন বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত এই ধামেশ্বর মহাপ্রভুর টানে।

বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী জীবিত কালে ওই বিগ্রহের পুজোর জন্য বিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বীর নবদ্বীপের গঙ্গার তীরে কালো পাথরের মন্দির নির্মাণ করান। কালের গ্রাসে সে মন্দির গঙ্গা গর্ভে চলে যায়।

নবদ্বীপের বর্তমান মহাপ্রভু মন্দিরের ইতিহাস প্রসঙ্গে গোস্বামী বংশজাত অধ্যাপক প্রদ্যোতকুমার গোস্বামী তাঁর “নবদ্বীপের সমাজ এবং সংস্কৃতি” বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি লিখছেন, “১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন মহাপ্রভুর মধ্যাহ্ন ভোগের পর মহাপ্রভুর মন্দিরে প্রবেশ করে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী অপ্রকট হলেন।” ওই বই অনুসারে বিগ্রহের সেবাপুজোর দায়িত্ব পেলেন ভ্রাতুষ্পুত্র মাধবাচার্য। তাঁর মৃত্যুর পর পুজোর দায়িত্ব বর্তায় জ্যেষ্ঠপুত্র ষষ্ঠীদাসের উপর। এই সময় থেকেই সমস্যা শুরু হল। নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ মহাপ্রভুর ঈশ্বরত্ব অস্বীকার করেন। শক্তির উপাসকেরা মহাপ্রভু মূর্তি পুজোর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। এমনকি তৎকালীন নদিয়ারাজের কাছে অভিযোগ জানান। এই অবস্থায় অন্য ভায়েরা মহাপ্রভুর মূর্তি পুজোর অধিকার ত্যাগ করলে ষষ্ঠীদাস মালঞ্চপাড়ায় একটি পর্ণকুটিরে গোপনে ওই মহাপ্রভু মূর্তির সেবা পুজোর ব্যবস্থা করেন। “নবদ্বীপের সমাজ এবং সংস্কৃতি” বই অনুসারে, মহাপ্রভুকে পুজো করার অপরাধে গোস্বামীরা সমাজচ্যুত হলেন। তখন নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার এবং মহাপ্রভু মূর্তি রক্ষার তাগিদে দক্ষিণা কালিকার মূর্তিস্থাপন করে পুজো করতে লাগলেন। কালী মন্দিরের নীচে ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে  ঘিয়ের প্রদীপ দিয়ে মহাপ্রভুর সেবা পুজো করতে লাগলেন কোনও রকমে।”

কিন্তু সে সময়ে মালঞ্চপাড়া ভাগীরথীর জমা জলে বছরের বেশির ভাগ সময়ে জলাকীর্ণ হয়ে থাকত। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে পরম বৈষ্ণব দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ তোতারাম দাস বাবাজীর তৎপরতায় তৈরি হয় একটি পশ্চিমদ্বারী মন্দির। সেখানেই শুরু হয় মহাপ্রভু বিগ্রহের সেবা পুজো। কিন্তু এই মন্দির আয়তনে ছিল অত্যন্ত ছোট। অবশেষে ১৮২৮ সালে ভাগ্যকুলের জমিদার গুরুপ্রসাদ রায়ের অর্থানুকূল্যে ওই পশ্চিমদ্বারী মন্দিরের পাশেই গড়ে ওঠে বর্তমানের দক্ষিণদ্বারী মন্দিরটি।

যাদবাচার্যের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মাধবাচার্য এ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অবর্তমানে তাঁর দুই পুত্র দশ আনা-ছয় আনা ভাগে সেবাইত হন এবং এ হিসাব অনুযায়ী বংশপরম্পরায় এ মূর্তি সেবিত হয়ে আসছেন। বর্তমানে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ পুরুষ এঁর সেবাইত এবং প্রায় ১৫০-১৭৫ জন সেবাইত সুনির্দিষ্ট অংশভেদে এ সেবাকার্য নির্বাহ করেন।

দেড়শত বছর পূর্বে কাছাড় থেকে আগত ভুবনেশ্বর সাধু ভক্তদের আর্থিক সহায়তায় বর্তমান সুদৃশ্য রৌপ্য সিংহাসনটি নির্মাণ এবং দোলমঞ্চ ও রামমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান সেবাইতগণ ‘বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতি’ গঠন করে ওই বিগ্রহের সেবা-পূজার কাজ পরিচালনা করছেন।

শ্রী চৈতন্য জীবনের অন্ত্যপর্ব (১৫১৫-১৫৩৩) দিয়েই শুরু করা যাক মহাপ্রভুর রহস্যেভরা দেহাবসান কথা।

১৫১৫ সাল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর – নীলাচল থেকে শ্রীচৈতন্যের বৃন্দাবন গমন।

১৫১৬ সাল মার্চ-এপ্রিল – বৃন্দাবন-প্রয়াগের পর কাশীতে অবস্থান।

মে – পুরী প্রত্যাবর্তন। নীলাচল থেকে রূপের গৌরযাত্রা। সনাতনকে শিক্ষাদান।

১৫১৬ – ১৮ সাল – কাশীতে চৈতন্য কর্তৃক সন্ত কবিরের শবদেহ গঙ্গায় বিসর্জন।

(আনুমানিক) প্রতাপরুদ্র-কৃষ্ণদেব রায়ে সন্ধি স্থাপন। বিজয়নগর অধিপতি কৃষ্ণদেব রায়ের শ্রীচৈতন্যচরিত্রমহিমা অবগতি।

১৫২০ সাল (আঃ) – পুরীতে নানক-চৈতন্য সাক্ষাৎকার।

১৫২৬ সাল – পুরীতে চৈতন্য-শিবানন্দ সাক্ষাৎকার। শিবানন্দপুত্র কর্ণপূরের জন্ম সম্ভাবনায় চৈতন্য কর্তৃক ভাবী সন্তানের ‘পুরীদাস’ নামকরণ।

১৫২৬-২৭ সাল (আঃ) – গোস্বামীদের প্রচার পরিদর্শনে শ্রীচৈতন্যের দ্বিতীয়বার বৃন্দাবন গমন।

১৫২৭-২৮ সাল – ওড়িশী পঞ্চসখার অন্যতম জগন্নাথ দাসের চৈতন্যশরণ গ্রহণ।

১৫২৯ সাল – চৈতন্যদেবকে দক্ষিনী ভক্তদের দক্ষিণ ভারতের দুটি গ্রাম দান। শ্রীচৈতন্যের দক্ষিণ ভ্রমণ (আঃ)।

১৫৩৩ সাল – পুরীতে শ্রীচৈতন্য ও বালক পুরীদাস সাক্ষাৎকার। পুরীতে শ্রীচৈতন্য ও শঙ্করদেব সাক্ষাৎকার। চৈতন্য তিরোভাব।

শ্রীচৈতন্য জীবনের শেষতম বিষ্ময়কর ও রহস্যজনক ঘটনা তাঁর দেহাবসান। পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীর বৈষ্ণব আন্দোলনের এক ও অদ্বিতীয় প্রাণপুরুষ ছিলেন মহাপ্রভু। কিভাবে এবং কেমন করে তিনি দেহত্যাগ করলেন তা আজও গভীর রহস্যেভরা। এটি একটি গভীর ও ব্যাপক অনুসন্ধানের বিষয়।

মহাপ্রভুর দেহাবসান প্রসঙ্গে কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘চৌদ্দশতপঞ্চান্নে হৈলা অন্তর্ধান’ (আদি’১৩) , এটুকু বলেই খালাস হয়েছেন। কখন কিভাবে কোথায় ‘হৈলা অন্তর্ধান’ সে সম্পর্কে আর একটা কথাও তিনি খরচ করেননি।

শ্রীচৈতন্যের তিরোভাব রহস্যে সম্পূর্ণ নীরব থেকেছেন বৃন্দাবনদাসও। মহাপ্রভুর এ ব্যাপারে নানান ধরণের পরস্পর বিরোধী কথা বলেছেন কথা বলেছেন তাত্ত্বিকেরা। কারও মতে, ঈশ্বরের অবতার ছিলেন শ্রীচৈতন্য। সাধারণ মানুষের মতো লৌকিক মৃত্যু তাঁর হলে পারে না। কেউ বলেছেন, পুরীর মন্দিরে জগন্নাথ বিগ্রহের মধ্যে অন্তর্হিত হন তিনি। কারও মতে, সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিলীন হয়ে যান তিনি।

এখন কথা হল, বৃন্দাবনদাস বা কৃষ্ণদাস কি আদৌ নীরব ছিলেন এ ব্যাপারে? ড. বিমানবিহারী মজুমদার ও ড. সুকুমার সেনের মত হল, ‘চৈতন্যভাগবতের পরিসমাপ্তি অত্যন্ত আকস্মিক’। অতএব বৃন্দাবনদাসের মূল পুথির শেষ পর্যায় শ্রীচৈতন্যের লোকান্তর বর্ণনা ছিল না, একথা তেমন জোর দিয়ে বলা চলে না। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ প্রসঙ্গেও একই কথা বলা যায়।

এবার কৃষ্ণদাস কবিরাজের কথা। শুধুমাত্র বেদনাদায়ক বলেই কি মহাপ্রভুর লোকান্তরের বর্ণনা তিনি দেননি ? কৃষ্ণদাস ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী। তিনি জানতেন, মহাপ্রভুর প্রকটলীলার পরেও আছে তাঁর অপ্রকটলীলা। কোনও তাত্ত্বিকের কাছেই প্রকট থেকে অপ্রকটে উত্তরণ খুব একটা বেদনাদায়ক হতে পারে না। কারণ, তত্ত্বজ্ঞানী ভক্ত প্রভুর ইচ্ছা মেনে নিয়ে তাঁর মহিমময় অপ্রকট লীলারসও উপভোগ করতে পারেন অনায়াসে।

দেবকল্প মানুষের লৌকিক মৃত্যুর সম্ভাব্যতা প্রসঙ্গে বলা যায় যে, প্রাচীন অবতারদের জীবনকথা ভুলে যান এই সব মতবাদীরা। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও মৃত্য সম্পর্কে এতটুকুও অলৌকিকতা নেই ভাগবতে। নিতান্ত লৌকিক ভাবে তাঁর জন্ম হয় বসুদেবের ঔরসে দেবকীর গর্ভে। লৌকিক মৃত্যু হয় জরা ব্যাধের তীরের আঘাতে। এতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গৌরব ও মহিমা একটুও হ্রাস পেয়েছে কি? পায়নি। সুতরাং শ্রীচৈতন্যের লৌকিক মৃত্যু বর্ণনায় ভাগবতভক্ত বৈষ্ণবরা ক্ষুব্ধ হবেন, এমনটা ভাববার অবকাশ নেই।

শ্রীচৈতন্যের লোকান্তর প্রসঙ্গে বাস্তব বিবরণ দিয়েছেন চৈতন্য জীবনীকারদের অনেকে। যেমন আছে জয়ানন্দের চৈ.ম. উত্তরখণ্ডে –

‘আষাঢ় বঞ্চিতা (পঞ্চমী?) রথ বিজয় নাচিতে।

ইটাল বাজিল বাম পায় আচম্বিতে।।…

নরেন্দ্রের জলে সর্ব পারিষদ সঙ্গে।

চৈতন্য করিল জলক্রীড়া নানারঙ্গে।।

চরণে বেদনা বড় ষষ্টি দিবসে।

সেই লক্ষে টোটাএ শয়ন অবশেষে।।

পন্ডিত গোসাঞ্জিকে কহিল সর্বকথা।

কালি দশ দন্ড রাত্রে চলিব সর্বথা।।…

মায়া শরীর থাকিল ভূমে পড়ি।

চৈতন্য বৈকুণ্ঠ গেলা জম্বুদ্বীপ ছাড়ি।।’

মহাপ্রভুর এই লৌকিক লোকান্তরের বর্ণনা দেওয়ায় জয়ানন্দকাব্যকে নিষ্ঠাবান বৈষ্ণবরা অনাদর করে থাকেন বলে বলা হয়ে থাকে। এখন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব বলতে কাকে ধরা হবে এবং তাঁর মাপকাঠিই বা কি, বর্তমানের সমালোচকদের এই জাতীয় ধারনার ভিত্তিটাই বা কি তা বোঝা যায় না।

নিত্যানন্দবংশাবতংশ সিদ্ধান্ত বাচস্পতি শ্যামলাল গোস্বামীপ্রভু ৪২১ চৈতন্যাব্দে (১৯০৭ সাল) প্রকাশিত তাঁর ‘শ্রীশ্রীগৌরসুন্দর’ গ্রন্থে জয়ানন্দের পরিবেশিত তথ্যটি গ্রহণ করেছিলেন পরম সমাদরে। গ্রন্থের সমাপ্তিতে গোস্বামীপ্রভু লিখেছেন,

‘একদিন রথাগ্রে নৃত্য করিতে করিতে প্রভুর পদনখে আঘাত লাগিল। উক্ত আঘাতকে ছল করিয়া প্রভু লোকলীলা সংবরণের অভিলাষ করিলেন।’ (পৃষ্ঠা ৬৩৫)

সুতরাং চৈতন্য তিরোভাবের বাস্তব একটি কারণ জয়ানন্দর কাব্যে নির্দেশিত হওয়ায় গোঁড়া বৈষ্ণব সমাজে তাঁর কাব্যটি আদৃত হয়নি, এমত ঠিক নয়। এই জাতীয় বিচার বিভ্রাটের গোড়ার কথা তত্ত্বজ্ঞান, তত্ত্বাভিমান। এইসব তত্ত্বাভিমানীরা মনে করেন মহাপুরুষের লৌকিক মৃত্যু হলে তাঁর মহিমা ক্ষুন্ন হয়। এঁরা ভুলে যান ‘কৃষ্ণের যতেক লীলা সর্বোত্তম নরলীলা’, এক্ষেত্রে ‘নর’ অর্থে মানুষই উদ্দিষ্ট। নরলীলায় কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল মানুষের মতো, মানবীমায়ের গর্ভে, মৃত্যুও হয়েছিল সাধারণ মানুষের মতো। স্পষ্টভাবে এই কথাটাই বলা হয়েছে মধ্বাচার্য্য সম্প্রদায়ে।

এবার চৈতন্যচরিতে দৃষ্টি ফেরান যাক লোকান্তর বর্ণনার দিকে। লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল আছে –

আষাঢ় মাসের তিথি সপ্তমী দিবসে।         নিবেদন করে প্রভু ছাড়িয়া নিশ্বাসে ।

সত্যত্রেতা দ্বাপর সে কলিযুগ আর।         বিশেষতঃ কলিযুগে সংকীর্তন সার।।

কৃপা কর জগন্নাথ পতিত পাবন।           কলিযুগ আইল এই দেহ ত শরণ।।

এবোল বলিয়া সেই ত্রিজগত রায়।          বাহু ভিড়ি আলিঙ্গন তুলিল হিয়ায়।

তৃতীয় প্রহর বেলা রবিবার দিনে।          জগন্নাথে লীন প্রভু হইলা আপনে।।

গুঞ্জাবাড়ীতে ছিল পাণ্ডা যে ব্রাহ্ম।          কি কি বলি সত্বরে সে আইল তখন।।

বিপ্রে দেখি ভক্ত কহে শুনহ পড়িছা।       ঘুচাহ কপাট প্রভু দেখি বড় ইচ্ছা।।

ভক্ত আর্তি দেখি পড়িছা কহয়ে কখন।   গুঞ্জাবাড়ীর মধ্যে প্রভুর হৈল অদর্শন।।

সাফাতে দেখিল গৌর প্রভুর মিলন।       নিশ্চয় করিয়া কহি শুন সর্বজন।।।

এবোল শুনিয়া ভক্ত করে হাহাকার।      শ্রীমুখচন্দ্রিমা প্রভুর না দেখিব আর।।…

শ্রীপ্রতাপরুদ্র রাজা শুনিল শ্রবণে।         পরিবার সহ রাজা হরিল চেতনে।।“

[রাধানাথ কাবাসী সম্পাদীত চৈ.ম. : শেষখণ্ড, ৩১০-৩১৯]

ঈশান নাগরের ‘অদ্বৈত প্রকাশ’ গ্রন্থের কথায় –

‘একদিন গোরা জগন্নাথে নিরখিয়া। শ্রীমন্দিরে প্রবেশিল ‘হা নাথ’ বলিয়া।।

প্রবেশ মাত্রেতে দ্বার স্বয়ং রুদ্ধ হৈল। ভক্তগণ মনে বহু আশঙ্কা জন্মিল।।

কিছুকাল পরে স্বয়ং কপাট খুলিল। গৌরাঙ্গাপ্রকট সভে অনুমান কৈল।’

(একবিংশ পরিচ্ছেদ)

নরহরি চক্রবর্তী চৈতন্য অন্তর্ধানের স্থান নির্ণয় করে ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে লিখেছেন, মামুঠাকুর নরোত্তমকে বলছেন –

‘ওহে নরোত্তম এই স্থানে গৌরহরি । না জানি পন্ডিতে কি কহিল ধীরি ধীরি।।

প্রবেশিলা এই গোপীনাথের মন্দিরে। হৈলা অদর্শন পুনঃ না আইলা বাহিরে।।’

(অষ্টম পরিচ্ছেদ)

ওড়িশী সাহিত্যেও চৈতন্য তিরোধান সম্পর্কে বিচিত্র মুল্যবান তথ্য আছে।

শ্রীচৈতন্যের ওড়িশী পাঁচজন শিষ্য বা পঞ্চসখার অন্যতম ছিলেন অচ্যুতানন্দ।

তিনি শ্রীচৈতন্যের জগন্নাথঅঙ্গে লীন হওয়ার কথা লিখেছেন –

‘চৈতন্য ঠাকুর মহানৃত্যকার রাধা রাধা ধ্বনি কলে।

জগন্নাথ মহাপ্রভু শ্রীঅঙ্গে বিদ্যুন্ প্রায় মিশি গলে।।’

(শূন্যসংহিতা/১)

অচ্যুতানন্দ অন্যত্র লিখেছেন –

কল্পবট মূলে নীল সুন্দর গিরিরে

সুন্দর রূপরে বিজে শঙ্খচক্র করে।।

চিহ্নিলে চৈতন্য যে ব্রহ্মান্ড কর্তা হরি।

কলারে কলা মিশিলা নাহিলা সে বারি।।

(শূন্যসংহিতা , তৃতীয় অধ্যায়, প্রথম ভাগ)

জগন্নাথ চরিতামৃত কাব্যে দিবাকর দাস লিখেছেন –

‘মহাপ্রভু – বিচার কোলে হৃদয়র।           এ কলিকাল বলীয়ার।

থিবার উচিত নুহই।                              নিজধামকু যিবি মুহি।

এমন্ত ভাবি শ্রীচৈতন্য।                           শ্রীজগন্নাথ অঙ্গে লীন।।

গোপন হোইলে স্বদেহে ।                         দেখি কাহার দৃষ্টি নোহে।।

পূর্বে যহিরু আসিখিলে।                         লেউটি সে অঙ্গে মিশিলে।।’

চৈতন্যভাগবতে ঈশ্বরদাস লিখেছেন, চন্দনযাত্রার সময় ভাবাবিষ্ট শ্রীচৈতন্য জগন্নাথকে চন্দন দেওয়ার সময় চন্দনপাত্র পড়ে যায় তাঁর হাত থেকে। সেই সময় মহাপ্রভু প্রবেশ করেন শ্রীজগন্নাথের বিস্তৃত শ্রীমুখে। লীন হয়ে যান জগন্নাথ বিগ্রহের গর্ভে।

ঈশ্বরদাস তাঁর গ্রন্থের শেষে ৬৫ অধ্যায়ে লিখেছেন, জগন্নাথমন্দিরের মুক্তিমণ্ডপে ‘চৈতন্যভাগবত’ পাঠ শুনে সকলে যখন গ্রন্থাকারের প্রশংসা করেছেন সেই সময় মহাপ্রভুর সন্ন্যাসীপার্ষদ বসুদেব তীর্থ উপস্থিত ভক্তবৈষনব্দের কথা মানলেন না, বললেন –

‘প্রভু অঙ্গে চৈতন্য মিশি।                      তীর্থঙ্ক মনকু ন আমি।।

বৈষ্ণবে প্রমাণ করন্তি।                         সন্ন্যাসী কেভে ন মানন্তি।।’

মণ্ডপের এক প্রান্তে ঈশ্বরদাসকে দেখতে পেয়ে তিনি বললেন, শ্রীচৈতন্য লীন হয়েছেন জগন্নাথঅঙ্গে, একথা তুমি লিখলে কেন?

‘শ্রীজগন্নাথ অঙ্গে লীন। কাহু লেখিল এ বচন।’

তখন আর কোনও কথা আসে না ঈশ্বরদাসের মুখে। শেষ পর্যন্ত তিনি স্বীকার করে জানালেন, শ্রীগুরুবচনে একথা লিখছেন। তত্ত্বজ্ঞানের দিক থেকেই ধরতে হবে এ ঘটনা।

‘বোলিই শুণিমা গোঁসাই।             চিত্তকু বোধ যাউ নাহি ।

তহিঁ কি প্রবোধ কহিবি।              সমস্তে শুণ আত্মা ভাবি।

এথকু শ্রীগুরুবচন।                    শূন্যে দর্শন তত্ত্বজ্ঞান।

দর্শনে প্রভু আজ্ঞা হোই ।             সভারে শূন্যে শুনিলই।’

জগন্নাথদেবের অঙ্গে মহাপ্রভুর লীন হয়ে যাওয়ার কথা মন্দিরের ভিতর থেকে কেউ উচ্চস্বরে ঘোষণা করলএ তা আকাশবাণী বলে ধরা যেত। তত্ত্বের দিক থেকে একথা মানা যেতে পারে। চৈতন্যকে জগন্নাথদেবের অভিন্ন বলে মনে করলে জগন্নাথে চৈতন্যের লীন হওয়া তত্ত্বের দিক থেকে গ্রহণ করতে বাধা নেই। এটাও আত্মার সঙ্গে তাঁর আত্মার মিলন। প্রশ্ন হল, তাহলে চৈতন্যের মায়াশরীরের কি হল এবং সেটা গেল কোথায় ? ঈশ্বরদাস জানিয়েছেন,

‘শ্রী জগন্নাথ কলেবর।              একাত্মা একাঙ্গ শরীরে।

সমস্তে এমন্ত দেখন্তি।                মায়া শরীর ন জাণন্তি।।

চৈতন্য পিন্ড সিংহাসন।           দেখন্তি ত্রৈলোক্য মোহন।

ক্ষেত্র পালঙ্কু আজ্ঞা দেই।         এ পিণ্ড নিঅ বেগ কই।।

অন্তর্ক্ষে নেই গঙ্গাজল।             মেলিণ দিঅ ক্ষেত্রপাল।।

শ্রীজগন্নাথ আজ্ঞা পাই।           অন্তর্ক্ষে মেলে শব বহি।।

গঙ্গারে মেলি দেলে শব।          সে শব হোইলাক জীব ।

চৈতন্য রূপ প্রকাশিলে।           গঙ্গারে লীন হোই গলে।।

কেহু ন জানে এহু রস।            ভক্তঙ্ক মুখরে প্রকাশ।।

লেখন নাহি শাস্ত্র পোথা।         অত্যন্ত গুপ্ত এহু কথা।।

এহা ন জাণি বিদুজন।            য়েকা জাণন্তি সংকর্ষণ।।

সুসাধু জ্ঞানী এ জাণন্তি।         গতানুগতিকু বিস্মরন্তি।।’ (৬৫ অধ্যায়)

অর্থাৎ জগন্নাথের সামনেই পড়েছিল মহাপ্রভুর দেহ। তখন জগন্নাথদেবের আজ্ঞায় শবদেহ অন্তরীক্ষে (কাঁধে করে?) বহন করে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় (প্রাচী নদীতে) বিসর্জন দেওয়া হল। এসব অত্যন্ত গোপন কথা। একথা জানতেন একমাত্র সুসাধু জ্ঞানীরা কিন্তু কালক্রমে লকে বিস্মৃত হল একথা।

ঈশ্বরদাস ৬৪ অধ্যায়ে লিখেছেন, প্রভু জগন্নাথদেবের গায়ে চন্দনলেপন করলে জগন্নাথ আনন্দে মুখ ব্যাদান করলেন। সেই সময় মুখগহ্বরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন মহাপ্রভু। তখন চৈতন্যের রূপ পরিগ্রহ করলেন দেব জগন্নাথ। এসব শুনে ক্রোধের আর সীমা রইল না। যেমন,

‘রাজন ক্রোধ কে কহিব।

তাহা জানিলে বাসুদেব।’

বাসুদেব ( জগন্নাথ ) নিজেই তখন রাজা প্রতাপরুদ্র ও প্রভু নিত্যানন্দকে বললেন,

‘তো দুহুঁ ক্রোধ দূর কর

চন্দন যাত্রা মোর সার।’ (৬৪ অধ্যায়)

রাজা বাইরে এসে সান্ত্বনা দিলেন সকলকে। ‘ক্রোধ’ সম্বরণ করলেন সকলে। ‘সমস্তে ক্রোধ সাম্ভালিলে।’

ওড়িয়া কবি ছিলেন গোবিন্দ। তাঁর প্রণীত সংস্কৃত চৈতন্যচরিত ‘গৌরকৃষ্ণোদয়’ কাব্যে অষ্টাদশ সর্গে লিখেছেন, মাঘ মাসে মহাপ্রভু স্বধামে প্রস্থানে ইচ্ছুক হলেন – ‘অভুৎ যাত্রূকামঃ স্বধাম’। ফাল্গুনের শুক্লা একাদশীতে তিনি ‘একনিষ্ঠো বভূব’। সমুদ্রতীরে কুটীরে তিনি সমাধি মগ্ন হলেন। পাঁচদিন কাটল এইভাবে। পঞ্চম দিনে সন্ধ্যাবেলায় সমাধি ভেঙে উঠে তিনি ডেকে পাঠালেন সকলকে। শ্রীকৃষ্ণ-নাম গান শুরু হল। একটি শ্লোক আবৃত্তি করলেন মহাপ্রভু। তারপরই ‘ক্ষোণীং ত্যক্ত্বা ক্ষণরুচিরিবান্তর্দধে গৌরকৃষ্ণঃ’- ক্ষণপ্রভার মতো অন্তর্হিত হলেন গৌরকৃষ্ণ।

প্রসিদ্ধ ওড়িয়া কবি ছিলেন সদানন্দ কবি সূর্য ব্রহ্ম। তাঁর প্রেমতরঙ্গিনী কাব্যে মহাপ্রভুর অন্তর্ধান প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘অষ্ট চালিশ বরষে অন্তর্ধান টোটা গোপীনাথ স্থানে।’ (৩৬অধ্যায়)

চৈতন্যের অন্তর্ধান বিষয়ে এই সব তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে অন্তর্ধান স্থান কাল ও ধরন সম্পর্কে নানাজনের নানা মত। স্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মত –

১. জগন্নাথ মন্দির বলেছেন অচ্যুতানন্দ, দিবাকর দাস, ঈশ্বর দাস, ঈশান নাগর।

২. গুন্ডিচা বাড়ি একথা লোচন দাসের।

৩. টোটা (গোপীনাথ?) বলেছেন জয়ানন্দ।

৪. গোপীনাথের মন্দির নরহরি ও সদানন্দর কথা।

৫. সমুদ্রতীরে কুটীর বলেছেন গোবিন্দ।

সময় তারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন মত –

১. বৈশাখ মাস, সন্ধ্যা

২. বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া একথা ঈশ্বর দাসের।

৩. আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী রাত দশটা বলেছেন জয়ানন্দ।

৪. আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী, রবিবার বেলা তৃতীয় প্রহর লোচনদাসের কথা।

৫. ফাল্গুনি পূর্ণিমা, সন্ধ্যাবেলা বলেছেন গোবিন্দ।

দেহাবসানের ধরন সম্পর্কে বিভিন্ন মত –

১. প্রতাপরুদ্রের উপস্থিতিতে জগন্নাথ অঙ্গে লীন হওয়া বলেছেন অচ্যুতানন্দ।

২. সবার অলক্ষ্যে জগন্নাথ বিগ্রহে বিলীন হওয়া একথা দিবাকর দাসের।

৩. জগন্নাথের হা-করা মুখের মধ্যে অদৃশ্য হওয়া বলেছেন ঈশ্বর দাস।

৪. বাঁ পায়ে মারাত্মক আঘাতের ফলে মৃত্যু জয়ানন্দর কথা।

৫. গুন্ডিচা বাড়িতে অদৃশ্য হওয়া এবং জগন্নাথ অঙ্গে লীন হওয়া বলেছেন লোচনদাস।

৬. জগন্নাথ মন্দিরের অভ্যন্তরে অদৃশ্য হওয়া একথা ঈশান নাগরের।

৭. ভক্ত অনুগামীদের সামনে সমুদ্রতীরে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো অন্তর্হিত হওয়া বলেছেন গোবিন্দ।

 

(তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আমি গবেষক নই সুতরাং এ লেখার কোনও কথা আমার কথা নয়। লেখক পরম শ্রদ্ধেয় ড.শান্তিকুমের দাশগুপ্ত ও নির্মলনারায়ণ গুপ্ত, এঁরা দুজনেই চৈতন্যগবেষক। তাঁদেরই গবেষনার ফসল ‘পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’, প্রকাশক-রত্নাবলী, কলকাতা।

উক্ত গ্রন্থ থেকে বিষয় অবিকৃত রেখে কখনও ভাষা ও বানান পরিবর্তন, কখনও সম্পাদনা করে তাদের কথা আমার ভাষায়, আবার কখনও তাঁদের কথা হু-বহু তাঁদেরই ভাষায় তুলে দিলাম। গবেষনামূলক এ লেখার প্রশংসা গবেষক লেখকদ্বয়েরই প্রাপ্য। লেখক আন্তরিক শ্রদ্ধাসহ কৃতজ্ঞ রইল গ্রন্থলেখক ও তাঁর পরিবার এবং প্রকাশকের কাছে।)

পরবর্তী পর্ব


লেখক পরিচিতি : রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন