লেখক : সবিতা রায় বিশ্বাস
১৯১১ সালের ২২শে আগস্ট দেবেন্দ্রকিশোর ও অবলাদেবীর পুত্র দেবব্রত বিশ্বাসের বরিশালে মামার বাড়িতে জন্ম হয়। দিদি সান্ত্বনা ছিলেন দেবব্রতর চেয়ে পাঁচ বছরের বড় এবং বোন ললিতা ছিলেন পাঁচ বছরের ছোট। সান্ত্বনার জন্মের আগে দেবেন্দ্রকিশোর ও অবলাদেবীর সংসার ছিল বিষণ্ণতায় ঢাকা। সকলেই জানে, সংসারে নতুন শিশুর আগমন সুখ-শান্তি-আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু অবলাদেবী পরপর তিনটি মৃত সন্তান প্রসব করেন। পরে যখন সান্ত্বনার জন্ম হয়, সকলেই খুব সন্দিহান ছিল, এই সন্তান বাঁচবে তো? তাই সান্ত্বনার জন্মের আট মাস পরে তার নাম রাখা হয়। তারপরে দেবব্রত ও ললিতার জন্ম হয়, এবং সংসারে সুখের বাতাস বইতে থাকে।
দেবব্রত বিশ্বাসের বাবা দেবেন্দ্রকিশোরের কিশোরগঞ্জের বাড়ি ছিল খুব খোলামেলা, ফুল-ফলের বাগান ঘেরা। দেবব্রত বিশ্বাস খুব আনন্দ করে ছোটবেলা কাটিয়েছেন। জাম্বুরা, মানে বাতাবিলেবু পেড়ে ফুটবল খেলতেন, কলাগাছের ভেলা তৈরি করে ললিতা ও দেবব্রত পুকুরে ভাসাতেন। দিদি সান্ত্বনা শান্ত হয়ে থাকলেও ললিতা ও দেবব্রত দুই ভাইবোনে উদ্দাম ছোটাছুটি করে খেলা করতেন। দুই ভাইবোনের আড়ি-ভাব চলতেই থাকত। পোশাকী নাম ‘দেবব্রত’ হলেও কিশোরগঞ্জে ‘দেবু’ নামেই পরিচিত ছিলেন। তবে ইংরেজ নার্সের দেওয়া নাম ‘জর্জ’ দেবব্রতর যেমন পছন্দ ছিল, তেমন সব জায়গায় এটারই পরিচিতি বেশি ছিল।
ললিতার সাথে দেবুর খুব ভাব ছিল। ললিতা কখনও দেবুকে দাদা বলে ডাকেননি, ডাকতেন ‘খোকা’ বলে। দেবুও ছোট বোনকে ডাকতেন ‘খুকি’ বলে। দুই ভাইবোনের যেমন মিল ছিল, তেমন ঝগড়াও হত। তবে দেবব্রত খুব দুষ্টু হলেও পরীক্ষায় প্রতিবার প্রথম হয়ে নতুন ক্লাসে উঠতেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষাতেও খুব ভাল রেজাল্ট করেছিলেন, অঙ্ক এবং সংস্কৃতে লেটার পেয়েছিলেন। প্রতিদিন নিয়ম করে বাবা দেবেন্দ্রকিশোরের কাছে অঙ্ক আর ইংরাজি পড়তে হত। যদিও পড়তে ইচ্ছা করত না, কিন্তু ইংরাজি – তা গদ্য বা পদ্য যাই হোক, সেটা গড়গড় করে মুখস্থ করতে হত। কারণ দেবব্রতর বাবা ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্ম ও ইংরাজি ভাষার ভক্ত। তার আগে সন্ধ্যাবেলায় মায়ের কাছে শিখতে হত গান – ব্রহ্মসঙ্গীত ও অন্যান্য সঙ্গীত।
একটা সমস্যা ছিল, ছোটবেলায় মাঠে-ঘাটে খেলাধূলা করে বড় হলেও কিশোরগঞ্জের কোন হিন্দু পরিবার তাঁদের সঙ্গে মিশত না। তারা দেবব্রতদের বলত ম্লেচ্ছ, তার কারণ ওনারা ছিলেন ব্রাহ্ম। স্কুলে কোন হিন্দু ছেলে দেবব্রতর পাশে বসত না। ফলে কোন হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়িতে তাঁদের যাতায়াত ছিল না। কিশোরগঞ্জে মুসলমান পরিবারের কয়েকজন ছেলে তাঁর বন্ধু হয়েছিল, আর আমেরিকান মিশনারী ও কয়েকঘর বাঙালি খ্রিষ্টান পরিবার ছিল, যারা ওঁদের সঙ্গে মিশত। দেবব্রতর ঠাকুরদাদা কালীকিশোর বিশ্বাস সনাতনী হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করাতেই তাঁদের একঘরে করে রাখা হয়েছিল। তারপরে তাঁর ঠাকুরদার পরিবারকে গ্রাম থেকে তাড়িয়েও দেওয়া হয়। সবথেকে দুঃখের ব্যাপার, ১৮৯৭ সালে স্টিমার থেকে নদীতে পড়ে কালীকিশোর মারা যান। এমনকি তাঁর মৃতদেহও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁর মৃত্যু নিয়ে অনেক মানুষের মনেই সন্দেহ হয়েছিল, এই কাজ কোনো ক্রুদ্ধ হিন্দুধর্মীর।
প্রতিবছর ব্রাহ্মরা মাঘ মাসে ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠার দিন মাঘোৎসব পালন করেন। দেবব্রতরা প্রতি বছর মাঘোৎসবে বাড়ির সকলে মিলে কিশোরগঞ্জের বাড়ি ছেড়ে ময়মনসিংহে বড় পিসিমার বাড়ি চলে যেতেন। ওই এলাকাতে কয়েকঘর ব্রাহ্ম থাকায় বলা হত ব্রাহ্মপল্লী। মাঘোৎসবের দিন সেখানকার ব্রাহ্মসমাজের সব ছেলেমেয়ে, বড়রা সবাই মিলে ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতেন। দেবব্রতর মা অবলা দেবীও গান গাইতেন। মায়ের কাছেই দেবব্রত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলেন। দেবব্রত অবাক হতেন, তাঁর মা এত গান কোথায় শিখেছিলেন এই কথা ভেবে। মায়ের কাছে গান শেখা ছাড়াও দেবব্রত বিশ্বাস তালিম পেয়েছিলেন হিমাংশু দত্ত, অনাদি কুমার দস্তিদার, পঙ্কজ মল্লিক এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে।
১৯২৭ সালে ম্যাট্রিক পাশ করার পর দেবব্রত কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। এই সময়ে ব্রাহ্মসমাজ ও পরে শান্তিনিকেতনে গান গাইবার আমন্ত্রণ পান। ধীরে ধীরে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরপরিবারের সঙ্গে হৃদ্যতা বাড়ে। তখনও তিনি রবীন্দ্রনাথকে দেখেননি। ১৯২৮ সালে ব্রাহ্ম ভাদ্রোৎসবে কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রথম দেখেন দেবব্রত। ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ. পাশ করেন দেবব্রত বিশ্বাস। ১৯৩৪ সালে তিনি যোগ দেন হিন্দুস্তান ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে। এই চাকরিসূত্রে রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পুত্র সুবীর ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ হয় দেবব্রতের। এঁদের সূত্র ধরেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে পদার্পণ করেন দেবব্রত বিশ্বাস।
১৯৩৮ সালে কনক দাশের সঙ্গে দ্বৈতকন্ঠে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেন। এই সময় থেকেই ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ ও অন্যান্য রেকর্ড সংস্থা তাঁর গান রেকর্ড করতে শুরু করে। তিনি যে শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন তা নয়, গণসঙ্গীত ও অন্যান্য গানও গাইতেন। কাজী নজরুল ইসলামের কাছেও তিনি গান শিখেছিলেন। দেবব্রত বিশ্বাস ‘হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি’ থেকে অনেকগুলো গান রেকর্ড করেন। হিজ মাস্টার্স ভয়েস প্রথমদিকে তাঁর কিছু গান রেকর্ড করলেও পরে আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের প্রথম দিকের গানগুলি হল, ‘আকাশ জুড়ে শুনিনু’, ‘ওই আসনতলের মাটির পরে’, ‘ওগো পথের সাথী’, ‘এখন আমার সময় হল’, ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’ এবং ‘এই তো ভালো লেগেছিল’।
১৯৪৪ সালে ‘তাসের দেশ’ নৃত্যাভিনয়ে রাজপুত্রের কণ্ঠের গানগুলো গাওয়ার নিমন্ত্রণ পান দেবব্রত। এই সময় থেকেই প্রথাগত রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর বিরোধ শুরু হয়। দেবব্রত তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন,
“দু-তিন রাত অভিনয় হয়ে যাবার পর পরিচালক মহাশয় (শান্তিদেব ঘোষ) নাটকের শেষ গানটি (বাঁধ ভেঙে দাও) আমায় গাইতে নির্দেশ দিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “গানটি with pleasure গাইব না without pleasure গাইব?” তিনি with pleasure গাইবার নির্দেশ দিলেন। গানটি গাওয়া হত খুব পেলব ভঙ্গিতে। সেদিন আমি গণনাট্য সঙ্ঘের গানগুলোতে যেভাবে গানটি গাইতাম, ঠিক সেই ভঙ্গিতে দ্রুতলয়ে গাইতে আরম্ভ করলাম। দেখতে পেলাম দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যশিল্পী কেলু নায়ার প্রাণের আনন্দে স্টেজের ধুলো উড়িয়ে নেচে নেচে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু অন্যরা ঠিক সুবিধা করতে পারছে না। বলা বাহুল্য, ওই গানের পরে আমাকে আর গাইতে হয় নি।”
দেবব্রত নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে কোন আপস করেননি। সোজা কথা স্পষ্টভাবে বলতে সঙ্কোচ করেননি কখনও। উচ্চারণ নিয়েও তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ গানে দেবব্রত বিশ্বাসের ‘ভরা’ শব্দের উচ্চারণ নিয়ে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতার সঙ্গে বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক আলোচনা করেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস ‘ভরা’ শব্দটি উচ্চারণ করেন ‘ভওরা’। কিন্তু এটা কখনই উচ্চারণবিকৃতি নয়, এটা বিশেষত্ব। গোটা গানটির প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে এই বিশেষত্ব আছে, আর আছে বলেই জর্জ বিশ্বাসের ‘আকাশ ভরা’ গানটি মানুষ মনে রেখেছেন। তিনি যখন ‘ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি’ গাইছেন, তখন সত্যিই পা পড়ছে নরম ঘাসের কোমলতার উপরে। সেই কোমলতা আরও হালকা হচ্ছে দ্বিতীয়বার ‘পা’ ফেলার মূহুর্তে। ফুলের গন্ধে যেভাবে চমক লাগছে, তা দেবব্রত গান গাইবার আগে শোনেনি বাঙালির ‘কান’।
রবীন্দ্রনাথের কথা ও সুরে যখন দেবব্রত বিশ্বাস স্বর মেলাতেন, তখন যেন যাদু হত। কবিগুরুর গানের গভীরতাকে তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন, এবং সেই অনুভূতি তাঁর গাওয়া গানে ধরা পড়ত। তাঁর গানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল আবেগঘন অভিব্যক্তি এবং দরদী কণ্ঠস্বর। তিনি ছিলেন এমন একজন শিল্পী, যিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, জার্মান, ফরাসী এবং রুশ ভাষায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন। ‘রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার’ থেকে তিনি এই ভাষাগুলির প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচলিত ছন্দ, তাল, লয় ইত্যাদিকে কিছুটা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দেবব্রত বিশ্বাস স্বাধীনভাবে গান গাইতেন। একসঙ্গে এই গানের সঙ্গতের জন্য তিনি সেতার, সরোদ, এসরাজ, বেহালার মতো দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি স্পানিশ গীটার, স্যাক্সোফোন, ক্ল্যারিয়ানেট, পিয়ানোর মত দেশীয় বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার করতে থাকেন।
‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গানে যে দেবব্রত বিশ্বাস, তিনি যেন গানেরই চরিত্র। কান্নার মত একটা গান। হারমোনিয়াম ধরে রেখেছে সেই কান্নাকে, একেবারে শেষে সরোদের আচমকা সুর সংযোজন ছাড়া। সহশিল্পী গীতা ঘটকের সঙ্গে এ গানে এক আবিল করুণ রস। ‘ভাঙল’ শব্দ যেখানে ভাঙন দেখায়, ঝড়ের ‘ড়’ যেখানে বাতাসের গতিকে উপলব্ধি করায়, ছিটে বেড়ার ঘরের আলো-আঁধারিতে যেখানে দুটি চরিত্রের অসহায়তার মাথায় হাত রাখে সুর, তাকে গভীর কোন বিপন্নতার অলঙ্কারে সাজায়, তারা অন্ধকারে পড়ে থাকে ‘সকল মানি’। এই যে প্রতিটি শব্দ শ্রোতার বুকের গভীরে গিয়ে কাঁপন ধরায়, এটাই হল সঙ্গীতের বাচিক অভিনয়।
ভালই চলছিল। কিন্তু ১৯৬৪ সাল থেকে বিশ্বভারতী সঙ্গীতসমিতির সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ন বিষয়ে তার সঙ্গে মতভেদ হয়। দু’টি গানে আপত্তি তুলল বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড। ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ আর ‘এসেছিলে তবু আসো নাই’। বলা হ’ল, ওই দু’টি গানের পরিবেশনায় নাকি অতিনাটকীয়তা আছে। দেবব্রত বললেন, বোর্ডের এই ভাবনার সঙ্গে তিনি সহমত নন। অনেক কথা আদানপ্রদানের পর গান দু’টি অনুমোদন পেলেও এরপরে প্রতি পদে বাধা আসতে লাগল। এরপরে বারে বারে আপত্তি আসতে লাগল বিশ্বভারতীর তরফ থেকে। ১৯৬৯ সালে আরও দুটি গানকে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড বাতিল করে দিল। মিউজিক বোর্ড বলেছিল, ওই গানগুলোতে যন্ত্রাণুষঙ্গ বেশি হয়ে গিয়েছিল।
এই বোর্ড রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার ব্যাপারে দেবব্রতকে ছয়টি শর্ত দিয়েছিল-১) (ক) এসরাজ, বাঁশি, সারেঙ্গী, তানপুরা, বেহালা, দোতারা, একতারা, বাসবেহালা বা অর্গ্যান, (খ) পাখোয়াজ, বাঁয়াতবলা, খোল, ঢোল, মন্দিরা। ২) প্রতিটা গানের মূল আবেগটার প্রতি লক্ষ্য রেখে অনুকূল আবহসঙ্গীত যন্ত্রে রচনা করে, আরম্ভে এবং যেখানে গায়কের কণ্ঠের বিশ্রাম প্রয়োজন, সেখানে তা প্রয়োগ করতে হবে। ৩) যে ক’টি যন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, গানের সঙ্গে তার সবকটিকেই বাজানো যেতে পারে। কিন্তু কোন যন্ত্রটি কিভাবে আবহসঙ্গীতে বাজবে, সঙ্গীত রচয়িতাকে তা স্থির করতে হবে গানের প্রতি ছত্রের ভাবটির প্রতি লক্ষ্য রেখে। ৪) আবহসঙ্গীত গায়কের গলার শব্দকে ছাড়িয়ে যাবেনা কখনও। কণ্ঠের বিশ্রামের সময় বা গান আরম্ভের পূর্বে যখন যন্ত্রে আবহসঙ্গীত বাজবে, তখনও এই দিকটার প্রতি বাজিয়েরা যেন বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখে। ৫) তালযন্ত্রের সঙ্গতের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে, যে তালের ছন্দ বা বোল যেন কথার ছন্দ ও লয়ের বিপরীত না হয়। অর্থাৎ দ্রুত ছন্দের গানে যেমন দ্রুত লয়ের ঠেকার প্রয়োজন, ঢিমালয়ের গানে তেমন ঢিমালয়ের ঠেকার প্রয়োজনকে মানতেই হবে; এবং ৬) কথার উপর ঝোঁক দিয়ে অনেক গান গাইতে হয়। এই সব গানের সঙ্গে সঙ্গতের সময় তালবাদ্যেও কথার ছন্দের অনুকূল ঝোঁক প্রকাশ পাওয়া দরকার। তাতে গানের ভাবের সঙ্গে কথার ভাবের সঙ্গতি থাকে। এইসব শর্তাবলী দেবব্রত বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্যময় সঙ্গীতরীতির অনূকুল ছিল না। তাঁর আত্মজীবনী ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত আর রেকর্ড করব না বলেই স্থির করেছিলাম।
তবুও তিনি মনে খুব আশা নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন, হয়ত বিশ্বভারতী সঙ্গীতসমিতি ওনার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকেই দেবব্রত বিশ্বাসের রেকর্ড অনুমোদন করার দায়িত্ব দেবে। কিন্তু ১৯৭৭ সালের ২৫শে অক্টোবর জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র পরলোকে চলে যান। খুব দুঃখের সঙ্গে দেবব্রত বলেছিলেন, “আমি হয়ে গেলাম রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের ‘হরিজন’। হয়ত এভাবেই আমাকে বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে। যদি কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতে আমাকে ঠাঁই দেওয়া হয়, তখন হয়ত আমার কন্ঠস্বর আমার কন্ঠ ছেড়ে উধাও হয়ে যাবে।”
প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে নীরবে প্রতিবাদ জানিয়ে স্বনামধন্য সঙ্গীতসাধক দেবব্রত বিশ্বাস ১৯৮০ সালের ১৮ ই আগস্ট ৬৯ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন।
লেখক পরিচিতি : সবিতা রায় বিশ্বাস
বিভিন্ন ওয়েবজিন সহ শুকতারা, কিশোরভারতী ও অন্যান্য বাণিজ্যিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি| প্রকাশিত বই -২০ টি, সম্পাদনা- ৪ টি | নাটক রচনা, সঙ্গীত রচনা, বাচিক শিল্প সমাজসেবার সাথে যুক্ত| সাথে যুক্ত