লেখক : রানা চক্রবর্তী
তারা বা “আর্যতারা” হলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের একজন নারী বোধিসত্ত্ব, যিনি বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে একজন নারী বুদ্ধের মর্যাদা পান। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে তাঁকে “জেতসুন দোলমা” বলা হয়। তিনি “নির্বাণ-জননী” হিসেবে পরিচিত। তারা কাজ ও কীর্তির গুণাবলির সাফল্যের প্রতিনিধি। জাপানে তিনি “তারা বোসাতসু” নামে পরিচিত। চীনা বৌদ্ধধর্মে তিনি “দৌলাও পূসা” নামে স্বল্প-পরিচিত।
তারা একজন তান্ত্রিক ধ্যান দেবী। বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের তিব্বতি শাখাটি তাঁর ধ্যান অনুশীলন করে আন্তরিক গুণাবলির বিকাশ এবং দয়া ও শূন্যতার বাইরের, অন্তরের এবং গোপন শিক্ষা অনুধাবনের জন্য। একই শ্রেণীর বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বগণের গোষ্ঠীনাম হিসেবেও তারা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বোধিসত্ত্বেরা প্রায়শই বৌদ্ধ গুণাবলির উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হন। সেই দিক থেকে এই ধারণাটি আরও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
দেবী তারার সুপরিচিত রূপগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
ক) হরিত তারা (শ্যামাতারা) – বোধিপ্রাপ্ত ক্রিয়াকর্মের বুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
খ) শুক্লতারা (সীতাতারা) – দয়া, দীর্ঘজীবন, আরোগ্যদান ও শান্তি হিসেবে পরিচিত; এছাড়াও চিন্তাচক্র বা কল্পতরু চক্র হিসেবেও পরিচিত।
গ) রক্ততারা (কুরুকুল্লা) – সকল ভাল জিনিস চুম্বকীকরণের সঙ্গে যুক্ত ভয়াবহ রূপ।
ঘ) কৃষ্ণতারা – শক্তির সঙ্গে যুক্ত।
ঙ) পীততারা (ভৃকুটি) – সম্পদ ও বিকাশের সঙ্গে যুক্ত।
চ) নীলতারা – ক্রোধের পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত।
ছ) চিত্তমণি তারা – তারার একটি রূপ যা তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের গেলাগ শাখায় সর্বোচ্চ যোগ তন্ত্রে বহুলভাবে প্রচলিত। এঁর গাত্রবর্ণ সবুজ দেখানো হয় এবং প্রায়শই হরিত তারার সঙ্গে এক হিসেবে দেখানো হয়।
জ) খদিরববনী তারা – দক্ষিণ ভারতের খদিরবনী বনে ইনি নাগার্জুনের সামনে আবির্ভূতা হয়েছিলেন বলে কথিত আছে। এঁকে প্রায়শই “২২তম তারা” বলা হয়।
বৌদ্ধধর্মের কোনো কোনো সম্প্রদায়ে “একুশ তারা” স্বীকৃত। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের চারটি সম্প্রদায়ই সকালে একুশ তারা স্তোত্র আবৃত্তি করে।
কোনো কোনো বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও হিন্দুধর্মে তারার মন্ত্র একই:
“ওঁ তারে তুত্তারে তুরে স্বাহা।”
তিব্বতি প্রথা অনুসারে তিব্বতি ও বৌদ্ধরা এটিকে উচ্চারণ করেন,
“ওঁ তারে তু তারে তুরে সোহা”।
তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে তারা হলেন দয়া ও কার্যের একজন বোধিসত্ত্ব। তিনি হলেন অবলোকিতেশ্বরের নারী মূর্তি। কোনো কোনো সৃষ্টি উপাখ্যান অনুসারে তিনি অবলোকিতেশ্বরের চোখের জল থেকে উৎপন্ন হয়েছেন:
“তারপর অবশেষে অবলোকিতেশ্বর লাসায় মারপোরির (‘রক্তপর্বত’) শীর্ষে আরোহণ করলেন। তাকিয়ে দেখতে পেলেন ওটাং-এর হ্রদ (‘দুগ্ধসমতল’)। এটিকে তাঁর মনে হল অনন্ত যন্ত্রণার নরকের মতো। অসংখ্য সত্ত্বা সেখানে ফুটছিল, জ্বলছিল, ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। কিন্তু ধ্বংস হচ্ছিল না। সারাক্ষণ তারা যন্ত্রণায় অশ্রাব্য চিৎকার করে চলেছিল। এসব দেখে অবলোকিতেশ্বরের চোখ থেকে জল নেমে এল। তাঁর ডান চোখের জল এসে পড়ল সমতলে। পরিণত হল সম্মানীয় ভৃকুটিতে। তিনি ঘোষণা করলেন: “হে আমার স্বজাতির পুত্রগণ! তোমরা তুষারের দেশে সংবেদী সত্ত্বাদের হ্রদের জন্য কাতর। তোমরা তাঁদের দুঃখের সহভাগী হতে চাও। আমি তোমাদের অভিযানের সঙ্গী হব।” ভৃকুটি এরপর আবার ফিরে এলেন অবলোকিতেশ্বরের ডানচোখে। পরজন্মে তিনি নেপালি রাজকুমারী ত্রিতসুন রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। বাঁ চোখের এক ফোঁটা জল পড়ল সমতলে এবং তা রূপান্তরিত হল সম্মানীয় তারায়। তিনিও ঘোষণা করলেন, “হে স্বজাতির পুত্রগণ! তোমরা তোমরা তুষারের দেশে সংবেদী সত্ত্বাদের হ্রদের জন্য কাতর। তোমরা তাঁদের দুঃখের সহভাগী হতে চাও। আমি তোমাদের অভিযানের সঙ্গী হব।” তারা আবার ফিরে এলেন অবলোকিতেশ্বরের বাঁ চোখে। পরজন্মে তিনি হলেন চীনা রাজকুমারী কোংজো (রাজকুমারী ওয়েনচেং)।”
তারা নির্বাণদাত্রী রূপেও পরিচিত। কারণ তিনিই সেই স্বর্গীয় দেবী যিনি সংসারের দুঃখে তপ্তদের কান্না শুনতে পান।
তারার উৎস হিন্দু না বৌদ্ধ সেটি অস্পষ্ট। এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। মল্লার ঘোষ মনে করেন, তাঁর উৎস হিন্দু পুরাণ শাস্ত্র। সেখানে তাঁদের দেবী দুর্গার একটি রূপ বলা হয়েছে। আধুনিক কালে বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্মের শাক্ত সম্প্রদায়ে (দশমহাবিদ্যার অন্যতম দেবী রূপে) তাঁর পূজা হয়।
তবে দেবী তারার মূর্তি কল্পনা যে দেবী কালির থেকেও বেশি প্রাচীন, তা নিয়ে সকল ঐতিহাসিক ও গবেষকরা সহমত পোষণ করেন।
পরবর্তীকালের বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ মঞ্জুশ্রীমূলকল্প-এ (খ্রিস্টীয় ৫ম – ৮ম শতাব্দী) তারাকে বোধির দয়ার প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। যে প্রাচীনতম মূর্তিটিকে তারামূর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা গিয়েছে সেটি বৌদ্ধ মঠ চত্বর ইলোরা গুহায় (অধুনা ভারতের মহারাষ্ট্রে অবস্থিত) খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে নির্মিত হয়েছিল। উত্তরপূর্ব ভারতে পাল সাম্রাজ্যের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে (খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দী) তারা পূজা জনপ্রিয় হয়।
৮ম শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্যে তন্ত্রের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তারা খুব জনপ্রিয় এক বজ্রযান দেবীতে পরিণত হন। পদ্মসম্ভবের মাধ্যমে ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম তিব্বতে পৌঁছালে তারার পূজানুশীলন তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের মধ্যেও ঢুকে পড়ে। এরপর থেকে তাঁকে “সকল বুদ্ধগণের মা” হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। এটি অনেকটা হিন্দুধর্মের মাতৃকাদেবী ধারণার অনুরূপ।
দেবী হোক, বা বুদ্ধ হোক বা বোধিসত্ত্বই হোক, তারা তিব্বত (এবং উত্তর ভারতে নির্বাসিত তিব্বতি সম্প্রদায়ে), মঙ্গোলিয়া, নেপাল ও ভুটানে বেশ জনপ্রিয়। সারা বিশ্বের অধিকাংশ বৌদ্ধ সম্প্রদায় তারা পূজা করেন।
আধুনিক কালে হরিত তারা ও শুক্লতারা সম্ভবত তারার সবচেয়ে জনপ্রিয় মূর্তি। হরিত তারা ও খদিরবনী তারা সাধারণত ভয়ের থেকে রক্ষার সঙ্গে যুক্ত। আটরকম দ্বন্দ্ব থেকে রক্ষার সঙ্গেও তাঁরা যুক্ত: সিংহ (অহংকার), বুনো হাতি (অজ্ঞান), আগুন (ঘৃণা ও ক্রোধ), সাপ (ঈর্ষা), চোর ও ডাকাত (ভুল মত, গোঁড়া মতবাদ সহ), বন্ধন (লোভ ও কার্পণ্য), বন্যা (কামনা ও বন্ধন) ও অপদেবতা ও দানব (যে দ্বন্দ্ব বিভ্রান্ত করে)। দীর্ঘজীবনের তিন দেবীর একজন হিসেবে শুক্লতারা (বা সরস্বতী) দীর্ঘজীবনের সঙ্গে যুক্ত। তিনি রোগ প্রতিরোধ করেন এবং এভাবেই দীর্ঘজীবন দান করেন। তিনি দয়ার প্রতীক। তাঁর গাত্রবর্ণ সাদা এবং তিনি চাঁদের বলে উজ্জ্বল বলে কথিত।
একাধিক কাহিনিতে বোধিসত্ত্ব রূপে তারার উৎসের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে একটি গল্পে বিশেষ ভাবে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে নারীদের আগ্রহের দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে। ২১শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নারীবাদ গবেষকদের আলোচনার বিষয়ও হয়ে উঠেছে এটি।
এই গল্পে বলা হয়েছে, এক তরুণী রাজকুমারী ভিন্ন এক লক্ষ লক্ষ বছর আগেকার ভিন্ন এক জগতে বাস করতেন। তাঁর নাম ছিল ইয়েশে দাওয়া। এই নামের মানে হল ‘প্রাগৈতিহাসিক চেতনা’। অনেক যুগ ধরে তিনি তোন্যো দ্রুপা নামে পরিচিত সেই জগতের বুদ্ধের পূজা করেন। এই বুদ্ধ তাঁকে বোধিচিত্ত বা এক বোধিসত্ত্বের হৃদয়-মানস সম্পর্কে কিছু বিশেষ উপদেশ দেন। এরপর কিছু ভিক্ষু তাঁর কাছে এসে বলেন, তাঁর বোধিলাভের স্তর অনুসারে এরপর তাঁকে প্রার্থনা করতে হবে যেন তিনি পুরুষ রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তবেই তাঁর ভবিষৎ অগ্রগতি সম্ভব হবে। তখন রাজকুমারী ভিক্ষুদের বলেন, বোধির দৃষ্টিকোণ থেকে এমন কোনো শর্ত নেই। কেবলমাত্র ‘দুর্বল মনস্ক জগৎবাসীরাই’ লিঙ্গকে বোধিলাভের পথে বাধা মনে করে। তিনি ব্যথিত চিত্তে লক্ষ্য করেন যে, নারীরূপা সত্ত্বাগুলির উন্নতির জন্য খুব কম লোকই কাজ করতে আগ্রহী। তাই তিনি সংসার ধ্বংসের আগে এক নারী বোধিসত্ত্ব রূপে জন্মগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তারপর তিনি একটি প্রাসাদে কয়েক লক্ষ বছর ধরে ধ্যান করেন এবং এই অনুশীলনের শক্তিতে লক্ষ লক্ষ সত্ত্বা দুঃখ থেকে মুক্ত হয়। এর ফলে তোন্যো দ্রুপা তাঁকে বলেন যে এরপর থেকে তিনি তারা দেবীর রূপে আগামী জগৎগুলিতে সর্বোচ্চ বোধির প্রতিনিধিত্ব করবেন।
এই উপাখ্যানকে স্মরণ করে দলাই লামার একটি উক্তি উল্লেখনীয়। ১৯৮৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার নিউপোর্ট বিচে কমপ্যাশনেট অ্যাকশন নামক এক সম্মেলনে তিনি বলেন,
“বৌদ্ধধর্মে একটি সত্যিকারের নারীবাদী আন্দোলন আছে। এটি দেবী তারার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বোধিচিত্ত বা বোধিসত্ত্বের হৃদয়-মানস অনুসন্ধান করে যাঁরা পূর্ণ বোধিলাভের চেষ্টা করছেন তাঁদের দিকে তাকান এবং তিনি অনুভব করেন খুব কম লোকই নারীরূপে বুদ্ধত্ব অর্জন করতে চান। তাই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, “আমি নারীরূপে বোধিচিত্ত জাগ্রত করব। কারণ, এই পথে আমার সম্পূর্ণ জীবন এক নারীর। আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমি নারীরূপে জন্ম নেবো এবং আমার সর্বশেষ জন্মে যখন আমি বুদ্ধত্ব অর্জন করব, তখনও আমি নারীই থাকব।”
এরপর তারা এমন কিছু ধারণা গ্রহণ করেন, যা নারী অনুশীলনকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে এবং বোধিসত্ত্ব রূপে তাঁর উত্থানকে নারীদের প্রতি মহাযান বৌদ্ধধর্মের সহজগম্যতা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। ভারতে খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে এটি বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল।
তারা একাধিক নারীসুলভ আদর্শের প্রতীক। তিনি দয়া ও সহানুভূতির মা। তিনিই সূত্র অর্থাৎ, বিশ্বের নারীমূর্তি। তিনি স্নেহ ও সহানুভূতির জন্মদাত্রী এবং জন্মমৃত্যুর চক্রের কারণ খারাপ কর্মের হাত থেকে মুক্তিদাত্রী। সৃষ্টিশক্তিকে তিনি সৃষ্টি করেন, নাড়াচাড়া করেন এবং তার প্রতি হাস্য করেন। শিশুর প্রতি মায়ের যেমন স্নেহ, সকল সত্ত্বার প্রতি তারার তেমনই স্নেহ। হারিত তারার মূর্তিতে তিনি সাংসারিক বিশ্বের সকল দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সাহায্য করেন এবং সেই ধরনের পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করেন। শ্বেততারার রূপে তিনি মাতৃস্নেহ প্রকাশ করেন এবং মানসিক ও শারীরিকভাবে আহত সত্ত্বাদের আরোগ্যলাভে সাহায্য করেন। রক্ততারার রূপে সৃষ্ট বস্তুর নির্বাচনী ক্ষমতার শিক্ষা দেন এবং শেখান কিভাবে সাধারণ কামনাবাসনাকে দয়া ও প্রেমে রূপান্তরিত করতে হয়। নীলতারা বা একজটীর রূপে তিনি ন্যিংমা শাখার একজন রক্ষাকর্ত্রী। এই রূপে তিনি ভয়ংকরী ও ক্রোধী এক নারীশক্তি। ধর্মক্ষেত্রে বাধাসমূহকে ধ্বংস করতে, সৌভাগ্য আনয়নে এবং শীঘ্র আধ্যাত্মিক জাগরণের জন্য তাঁকে আবাহন করা হয়।
তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে তাঁর ২১টি প্রধান রূপ। প্রত্যেক রূপ এক-এক রং ও শক্তির। প্রত্যেকটিই কিছু না কিছু নারীসুলভ গুণের প্রতীক। অধ্যাত্ম জগতের সাধক তাঁদের সাহায্য চাইলে তাঁরাই সর্বাধিক সাহায্য করেন।
তারার নারীসুলভ আদর্শগুলির অন্যতম হল তিনি ডাকিনীদের সঙ্গে লীলা করেন।জন ব্লোফেল্ড তাঁর বোধিসত্ত্ব অফ কমপ্যাসন গ্রন্থে লিখেছেন, তারাকে প্রায়ই ষোলো বছরের কন্যারূপে দেখানো হয়। ধর্মের অনুশীলনকারীরা যখন গভীরভাবে নিজেদের ধর্মপথে নিয়ে যান, তখন তারা তাঁদের মধ্যে আবির্ভূত হন। তিব্বতি উপাখ্যানে দেখা যায়, তারা আত্ম-অহমিকা দেখে হাসেন। যারা নারীশক্তিকে অবহেলা করে, তাদের জীবনে তিনি নানা বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করেন। থিনলে নোরবু ম্যাজিক ড্যান্স: দ্য ডিসপ্লে অফ দ্য সেলফ-নেচার অফ দ্য ফাইভ উইসডম ডাকিনীজ বইতে বলেছেন, এটি একধরনের ‘লীলামানস’। তারার ক্ষেত্রে বলা হয়, তাঁর লীলামানস সেই সব ব্যক্তিদের মনকে মুক্ত করে, যাঁদের মন দ্বৈতবাদী বৈষম্যের দ্বারা গভীরভাবে বদ্ধ থাকে। মুক্তমনস্কতা ও গ্রহণেচ্ছু হৃদয় দেখলে তিনি খুশি হন। এই ধরনের মানুষকে তিনি স্বাভাবিকভাবেই আশীর্বাদ করেন। সেই আশীর্বাদে সেই হৃদয় উন্মুক্ত হয় এবং তাঁর শক্তি এঁদের আধ্যাত্মিক উন্নতির সহায়ক হয়।
নারীসুলভ এই গুণগুলি পরবর্তীকালে ভারতীয় মহাযান বৌদ্ধধর্মে অভিব্যক্ত হয় এবং তিব্বতে বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের উন্মেষের সময় তারা, দাকিনী, প্রজ্ঞাপারমিতা ও অন্যান্য স্থানীয় ও বিশেষ দেবীর মধ্যে প্রকাশিত হয়। তারার পূজা শুরু হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের প্রার্থনা, স্তোত্র ও মন্ত্র যুক্ত হয়। এগুলির উৎস ভক্তিমূলক চাহিদা। তারা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্মগুরুরা একাধিক সাধন বা তান্ত্রিক ধ্যান অনুশীলন পদ্ধতি রচনা করেন। তাঁকে পূজার দুটি উপায়ের জন্ম হয়। সাধারণ মানুষ ও সাধারণ অনুশীলনকারী একটি উপায়ে জাগতিক জীবনের দুঃখমোচনের জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করেন। অন্য উপায়টিতে তিনি তান্ত্রিক দেবী। এই উপায়ে তান্ত্রিক যোগী ও সন্ন্যাসীরা তাঁর গুণাবলি নিজেদের মদ্যে জাগরিত করার জন্য, তাঁর মাধ্যমে তাঁর গুণাবলির সূত্রে পৌঁছাতে, বোধিপ্রাপ্ত হতে, বোধিপ্রাপ্ত দয়া ও বোধিপ্রাপ্ত মন পেতে তাঁর সাধনা করেন।
পদ্মসম্ভবের সময় থেকে তারা তান্ত্রিক দেব যোগের কেন্দ্র। পদ্মসম্ভব ইয়েশে সোগ্যালকে রক্ততারার অনুশীলন পদ্ধতি দিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে বলেন, এটিকে ধনসম্পত্তির মতো গোপন রাখতে। ২০শ শতাব্দীতে আপোং তেরতন নামে এক বিশিষ্ট ন্যিংমা লামা এটিকে প্রথম পুনরুদ্ধার করেন। বৌদ্ধ বিশ্বাস অনুসারে, এই লামাই সক্যপ শাখার বর্তমান প্রধান সক্য তিরজিন রূপে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেছেন। আংপং তেরতনকে চিনতেন এমন এক ভিক্ষু এই পদ্ধতি সক্য তিরজিনকে দেন এবং তিনিই এটি চাগদুদ তুলকু রিংপোচকে দেন, যিনি এটি তাঁর পাশ্চাত্যের শিক্ষার্থীদের কাছে প্রকাশ করেন।
মার্টিন উইলসন তাঁর ইন প্রেইজ অফ তারা গ্রন্থে তারা তন্ত্রগুলির বিভিন্ন শাখার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন তারা-সংক্রান্ত ধর্মগ্রন্থগুলি তান্ত্রিক সাধন হিসেবে ব্যবহৃত হত। উদাহরণস্বরূপ, কর্ম কাগ্যুর মানব পিতা তিলোপার (৯৮৮ – ১০৬৯) কাছে একটি তারা সাধন প্রকাশিত হয়। বিশিষ্ট অনুবাদক তথা তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের কদমপা শাখার প্রতিষ্ঠাতা অতীশ ছিলেন তারা ভক্ত। তিনি তারার একটি স্তোত্র ও তিনটি তারা তন্ত্র রচনা করেন। মার্টিন উইলসনের গ্রথে একটি তালিকা রয়েছে যেখানে বিভিন্ন শাখার তারা তন্ত্রগুলির উৎস দেখানো হয়েছে। তবে তারার তান্ত্রিক অনুশীলন ৭ম শতাব্দীর পর থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আজ পর্যন্ত বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে তারা এক গুরুত্বপূর্ণ তান্ত্রিক দেবী।
বর্তমানে তারা অনুশীলন হয় একজন ইষ্টদেবতা (থাগ দাম, য়িদাম) হিসেবে। অনুশীলনকারীরা তাঁকে বুদ্ধ জ্ঞানের এক প্রত্যক্ষ মূর্তি হিসেবে দেখেন। জন ব্লোফেল্ড তাঁর দ্য তান্ত্রিক মিস্টিজম অফ টিবেট গ্রন্থে লিখেছেন:
“The function of the Yidam is one of the profound mysteries of the Vajrayana…Especially during the first years of practice the Yidam is of immense importance. Yidam is the Tibetan rendering of the Sanskrit word “Istadeva”—the in-dwelling deity; but, where the Hindus take the Istadeva for an actual deity who has been invited to dwell in the devotee’s heart, the Yidams of Tantric Buddhism are in fact the emanations of the adepts own mind. Or are they? To some extent they seem to belong to that order of phenomena which in Jungian terms are called archetypes and are therefore the common property of the entire human race. Even among Tantric Buddhists, there may be a division of opinion as to how far the Yidams are the creations of individual minds. What is quite certain is that they are not independently existing gods and goddesses; and yet, paradoxically, there are many occasions when they must be so regarded.”
যে সকল সাধনে তারাকে য়িদম বা ধ্যানদেবী হিসেবে দেখানো হয়েছে সেগুলি হয় বিস্তারিত নয় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। এগুলির অধিকাংশের শুরুতে তাঁর স্তব রয়েছে। এই স্তবে তাঁকে আবাহন করা হয়েছে এবং তাঁর শরণ নেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর তাঁর মন্ত্র পাঠ করা হয়েছে। এরপর সাধনের ফলে প্রাপ্ত বোধি উৎসর্গ করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর অতিরিক্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রার্থনা বা সাধনের সূত্রপাত যে লামা করেছিলেন, তাঁর দীর্ঘজীবনের প্রার্থনা করা হয়েছে। অনেক তারা সাধনকে বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের জগতের প্রারম্ভিক ধর্মানুশীলন হিসেবে দেখা হয়। যদিও এই দেবীকে আবাহনের জন্য দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন করা হয়েছে তা বৌদ্ধধর্মের সকল শাখারই সূক্ষ্ম শিক্ষা। দুটি উদাহরণ হল জাবটিক দ্রোলচক ও চিমে পাকমে ন্যিংটিক।
(তথ্যসূত্র:
১- Logic in a Popular Form: Essays on Popular Religion in Bengal by Sumanta Banerjee, Seagull Books (২০০২).
২- Hindu Goddesses:Visions of the Divine Feminine in the Hindu Reigious Tradition by David R. Kinsley, California press (১৯৮৮).
৩- The Madness of the Saints: Ecstatic Religion in Bengal by June MacDaniel, Chicago Press (১৯৮৯).
৪- Tantric Visions of the Divine Feminine: The Ten Mahavidyas by David R. Kinsley, New Delhi: Motilal Banarsidass (১৯৯৭).
৫- The Clear Mirror: A Traditional Account of Tibet’s Golden Age by Sakyapa Sonam Gyaltsen, Snow Lion Publications, পৃষ্ঠা 64–65 (১৯৯৬).
৬- Development of Buddhist Iconography in Eastern India by Mallar Ghosh, Munshiram Manoharlal, পৃষ্ঠা 6, 17 (১৯৮০).
৭- In Praise of Tārā: Songs to the Saviouress by Martin Willson, Wisdom Publications, পৃষ্ঠা 40, (১৯৯২).
৮- The Tantric Mysticism of Tibet: A Practical Guide to the Theory, Purpose, and Techniques of Tantric Meditation by John Blofeld, Penguin, পৃষ্ঠা 176 (১৯৯২).
৯- উইকিপিডিয়া।)
লেখক পরিচিতি : রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।