দেবদাসী – এক ঘৃণ্য প্রথার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত

লেখক : রানা চক্রবর্তী

দেবদাসী কি? মন্দিরের দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এক বিশেষ শ্রেনীর নর্ত্তকী মেয়েদের নিযুক্তি করা হয়েছিল যাদের দেবদাসী বলা হ’ত। দেবদাসী অর্থাৎ দেবতার দাসী। দেবতার প্রসন্নের উদ্দেশ্যে করা দেবদাসীর নৃত্যকে দেবদাসী নৃত্য বলা হয় । কলহেনের রাজতরংগিণী, কৌটিল্যের অর্থশ্রাস্ত্র, দামোদরের কুট্টনীমতম ইত্যাদি গ্রন্থে দেবদাসীর সমন্ধে উল্লেখ করা আছে। সোমনাথ মন্দিরে দেবদাস নৃত্যের কথা জানা যায়। পদ্ম পুরান ও ভয়িষ্য পুরানে ইহার কথা উল্লেখ আছে। মহাকবি কালিদাস মেঘদূত কাব্যে এই নৃত্যের কথা বর্ননা করেছিলেন।

এই জঘন্য প্রথাটির একটি রাশভারী নামও রয়েছে। সেটি হল, “পবিত্র গণিকাবৃত্তি”। পবিত্র গণিকাবৃত্তি হচ্ছে এক ধরনের সামাজিক রীতি যেখানে একজন মানুষ যৌন সংগম করে নিজ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে। এ ধরনের কাজে যে ব্যক্তি জড়িত থাকেন তাঁকে বলে দেবদাসী বা ধর্মীয় গণিকা।

তবে কেবলমাত্র ভারতেই নয়, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে অতীতে মেয়েদের এই পবিত্র গণিকাবৃত্তি প্রথায় নিয়োগ করা হয়েছিল।

পবিত্র গণিকাবৃত্তি প্রাচীন প্রাচ্য দেশে বেশি মাত্রায় হত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা ধর্মীয় যৌনতার প্রতিটি সু্যোগই কাজে লাগাত। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডটাস বলেন: ব্যাবলীয়ানদের সবচেয়ে খারাপ রীতি ছিল জীবনে একবার হলেও প্রত্যেক মহিলাকে বাধ্য করা আফ্রিদিতি মন্দিরে যেতে, যেখানে তাকে একজন অপরিচিত ব্যক্তির সাথে যৌন কর্মে লিপ্ত হতে হত। যেসব মহিলারা ধনী ও গর্বিত ছিলেন তারা মিলিত হতে চাইতেন না। তাদের তখন দড়ি দিয়ে বেঁধে আনা হত মন্দিরে। প্রচুর অনুগামী লোক ভিড় করত তখন। এভাবে বিপুল সংখ্যক মহিলাকে আনা হত। মহিলারা বাড়িতে ফিরে যেতে পারত না যৌন কর্মে লিপ্ত হওয়ার আগে। অপরিচিত কোন লোককে অবশ্যই টাকা দিতে হত বন্দিনী মহিলার আঁচলে এবং তাকে আহবান করতে হত মাইলিত্তা দেবীর নামে। তাদের মন্দিরের বাইরে মিলিত হতে হত। টাকার পরিমাণ যাই হোক না কেন তা নিতে অস্বীকার করা পাপ। এভাবে সুন্দরী মহিলারা সহজেই মুক্তি পেত অল্প দিনে। অসুন্দরীদের থাকতে হত দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত কোন লোকের সাথে মিলনের আগ পর্যন্ত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ বছর আগে গ্রিসে জেনোফন নামের একজন অলিম্পিক বিজয়ী দেবীর মন্দিরে ১০০ জনের মতো তরুণীকে উপহার হিসেবে দান করে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। করিন্থ নামক ঐ শহরে দেবী আফ্রিদিতির মন্দির ছিল। রোমান যুগে ঐ মন্দিরে প্রায় হাজারের উপর দেবদাসী ছিল।

তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে, যাব-যুম যৌন ইউনিয়নে পুরুষ দেবতা তার সঙ্গিনীর সাথে দেখা যায়। অন্যদিকে অনুত্তরযৌগ তন্ত্রে এই প্রতীক যুক্ত করা হয় যেখানে পুরুষ মূর্তি সাধারণত সমবেদনা ও দক্ষতাপূর্ণ উপায়ে সংযুক্ত থাকে এবং নারী সঙ্গীর প্রতি অন্তর্দৃষ্টি দেন।

দেবদাসী প্রথার চর্চা ভারতে বেশি ছিল, যেখানে গ্রাম থেকে ছোট মেয়েদের ধরে এনে ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী বিয়ে দেয়া হত দেবতার সাথে বা মন্দিরের সাথে এবং তাকে সেখানেই থাকতে হত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অভিযোগ করে যে এভাবে উচ্চস্তরের হিন্দুরা দেবদাসীদের সাথে যৌন কর্ম করত জোর করে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার আইন করে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করেছে। এসব আইনের মধ্যে বোম্বে দেবদাসী আইন ১৯৩৪, দেবদাসী মাদ্রাজ আইন ১৯৪৭, কর্ণাটক দেবদাসী আইন ১৯৮২, অন্ধ্রপ্রদেশ দেবদাসী আইন ১৯৮৮ অন্যতম।

মাঝে মাঝে খ্রিস্টান সাধুদের বাধ্য করা হত ধর্মীয় গণিকাবৃত্তিতে। খ্ৰীস্টীয় ৮ম শতকে থিওদরা ও ডিদাইমুস এবং আন্তনিয়া ও আলেক্সজান্ডার নামক প্রাচীন গ্রিসের দু’জোড়া সাধুর ভাষ্যমতে, তাঁদের লিখিত গ্রন্থে পাওয়া যায় যে, একজন খ্রিস্টান কুমারীকে পাঠানো হচ্ছিল গণিকালয়ে, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে। পথে একজন দয়ালু মানুষ তার সম্মান রক্ষার্থে শহীদ হন ঐ কুমারীর সাথেই।

১৯৭০ -এর দশকে ও ১৯৮০ -এর দশকের শুরুতে ধর্মীয় গণিকাবৃত্তি ছিল নতুন লোক জোগানোর হাতিয়ার। কিছু ধর্মের লোকেরা নিজেদের লোক বাড়াতে এ কাজ শুরু করে। চিল্ড্রেন অব গড গোষ্ঠী এদের মধ্যে অন্যতম। তবে এইডস রোগের প্রাদুর্ভাব তাঁদের কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

ভারতের বিভিন্ন স্থানে দেবদাসী নৃত্যের কথা জানা যায় কিন্তু স্থানভেদে নাম বিভিন্ন।

দেবদাসী  মন্দির সেবিকা। বর্ধিত অর্থে মন্দিরাঙ্গনের বারাঙ্গনা, দেহোপজীবিনী বা গণিকা। দেবদাসীরা ঈশ্বরের সেবিকা। তাদের অতীতে বলা হতো কলাবন্তী যারা শিল্পকর্মে পারদর্শিনী। অভিজাত শ্রেণি তাদেরকে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত করত। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল মন্দিরের মেঝে ঝাড়ু দেওয়া, পবিত্র প্রদীপে তেল ঢালা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, পূজামন্ডপে ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় গান-নৃত্য করা এবং পূজার সময় প্রতিমাকে বাতাস দেওয়া। এ কাজের জন্য তাদেরকে মন্দিরের তহবিল এবং আয় থেকে যা প্রদান করা হতো তা তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অপ্রতুল ছিল। এ কারণে মাঝে মাঝে তারা ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে উঠত।

কৌটিল্য দেবদাসী প্রথা পর্যবেক্ষণের পর স্পষ্টভাবে বলেন যে, দেবদাসীদের মধ্যে যারা মন্দিরে সেবিকার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছে বা অব্যাহতি নিয়েছে তাদের এবং সেসঙ্গে বিধবা, পঙ্গু মহিলা, সন্ন্যাসিনী বা ভিখারিনী, শাস্তিপণ পরিশোধে ব্যর্থ মহিলা, গণিকার মা এবং পশম, তুলা, শণ ইত্যাদি বাছাই-এর কাজে নিয়োজিত মেয়েদের মন্দির উপাধ্যক্ষগণ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করত। কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানীর মতে গর্ভধারণ ও পুনঃপ্রজননের দেবীর পূজাকে ভিত্তি করে দেবদাসী শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। মানবজাতির বংশবৃদ্ধির জন্য প্রাচীন হিন্দুসমাজে একটি মেয়েকে দেবীমাতার নামে উৎসর্গ করার প্রথা চালু ছিল। বৈদিক যুগে গণিকা, বেশ্যা ইত্যাদি নানা নামের বারাঙ্গনা ছিল। মন্দির সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলে আনন্দ ও বিলাসপ্রিয় নতুন নতুন দেবতারও উদ্ভব হয়। ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে নর্তকীদের নিয়োগ করা হয়। দেবতাদের আনন্দ প্রদানের জন্য সৃষ্ট এ-প্রথা রাজা, শাসক ও সর্দারদের পৃষ্ঠপোষকতায় দ্রুত বিকাশ লাভ করে। এর ফলে ঈশ্বরের সেবা, মর্তে ঈশ্বরের প্রতিনিধিদের তথা রাজা, সম্রাট এবং ধর্মযাজক-এর সেবার সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়। ভারতের রাজপুত্র, রাজা এবং জমিদারগণ দেবদাসীদের যখন থেকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করতে শুরু করে তখন থেকে তাদের অবস্থা একটি নতুন রূপ পরিগ্রহ করে।

অনেক দেবদাসীকে নিঃসন্তান পরিবারে নিয়োজিত করা হতো তাদের পরিবার এবং পারিবারিক সম্পত্তি বিলোপের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এক্ষেত্রে মেয়েদের ঈশ্বরের নিকট উৎসর্গ করে তাদেরকে উচ্চতর সম্প্রদায়ের বা অভিজাত লোকের সন্তান ধারণের জন্য যৌনমিলনের কাজে ব্যবহার করা হতো। এসব সন্তানরা পরবর্তীকালে ঠাকুরদাদার নাম ধারণ করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো। দেবদাসী প্রথার ব্যাপক প্রচলন হয় অষ্টম শতাব্দীতে, পুন্ড্রবর্ধন নগরে। বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্র গ্রন্থে সমসাময়িক ভারতে দেবদাসীদের সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। গৌড় ও বাংলার  ব্রাহ্মণ, সরকারি কর্মকর্তা, গৃহভৃত্য, ক্রীতদাস এবং দেবদাসীরা যথেচ্ছ যৌনাচারে অভ্যস্ত ছিল। পুন্ড্রবর্ধন নগরের দেবদাসীরা বিলাসী এবং কামাচারপূর্ণ জীবনযাপন করত। তাদেরকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। দেওপাড়ায় প্রাপ্ত তাম্রফলক অনুযায়ী বিজয় সেন এবং ভট্ট ভবদেব তাদের মন্দিরে শত শত দেবদাসী নিয়োগ করেছিলেন। রামচরিতম এবং পবনদূত গ্রন্থে দেবদাসীদের জীবনযাত্রার সপ্রশংস বর্ণনা দেওয়া আছে। এমনকি আধুনিক যুগেও ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের ইয়াল্লামা, হনুমান এবং শিবমন্দিরে ২ লাখ ৫০ হাজার মেয়েকে নিয়োগ করা হয়। নেপালে বিশেষ করে দোতি, বাইতাদি এবং দাদেলধুরা জেলাসমূহে দেবদাসীদের এসব প্রতিষ্ঠান ছিল সনাতন প্রথা হিসেবে অতি প্রচলিত। এসব স্থানে অবিবাহিত মেয়েদের মন্দিরের সেবিকা হিসেবে কাজ করার জন্য প্রস্তাব করা হতো। অতি সম্প্রতি সরকারের কিছু কঠোর আইন বলবৎ হওয়ায় দেবদাসীর প্রথা বিলোপ্তির পথে।

 

তথ্যসূত্র:
১- Devadasi System in India by O.P. Ralhan and Shashi Panjrath.
২- Devadasi System in Ancient India: A Study of Temple Dancing Girls of South India by Awadh K. Prasad.
৩- Servants of the Goddess: the Modern-day Devadasis by Catherine Rubin Kermorgant.
৪- Devadasi System in Medieval Tamil Nadu by K. Sadasivan.


লেখক পরিচিতি : রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।