পুজোর কদিন আমরা সবাই ভি.আই. পি

লেখক : অয়ন মৈত্র

আর মাত্র কয়েক ঘন্টা।তারপরই অফিসিয়ালি শেষ হয়ে যাবে দুর্গাপুজো এ বছরের মত।বৃষ্টি পড়েই চলেছে।লো বাজেট প্রতিমার মেক আপ ধুইয়ে, হন্ডা সিভিকের উইন্ড স্ক্রিন বয়ে, রোলের দোকানের পলিথিন চুঁইয়ে বৃষ্টির জলগুলো হাই ড্রেন ভরে দিচ্ছে, ভিখারির ম্যাট্রেস ভিজিয়ে দিচ্ছে।বৃষ্টি যাতে এবছরও আমাদের সাধের শারদীয় আবেগে কামড় বসাতে না পারে তার জন্য যতবার বলেছি আমরা মা’কে, মাধ্যমিকের রেজাল্টের আগেও ততবার বলিনি। আলিপুর আবহাওয়া অফিসের ‘গুণ’গেয়ে, যাবতীয় সতর্কবার্তাগুলোকে ডাল মাখনি দিয়ে ভাল করে মেখে লাচ্ছা পরোটা দিয়ে সাঁটিয়ে, ন্যাচারালি ওঠা ঢেকুরগুলোর ডেসিবেল ইচ্ছাকৃত আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে আমরা যখন যে যার নীড়ে ফিরে যাব, তখনও  আমাদের পাশের প্যান্ডেলে ভিড় থিক থিক করবে বিরিয়ানির দোকানের মত।

বৃষ্টি পড়েই চলেছে এখনো।ঠিক একটানা নয়।অনেকটা মাতালের পায়ের স্টেপগুলো পড়ে যেরকম প্যাটার্নে, সেরকমভাবে, থেমে থেমে।অগোছালো আবেগে কবিতা আসে এমনভাবে কোন কোন রাতে।নবমীর রাত শেষ হয়ে গেল নিতান্ত ঘর বন্দী হয়ে।শেষটা এভাবে হবে, ভাবিনি আমরা। আমরা মানে, মেড ইন কলকাতা, মেড ইন সাব-আরবান যারা।
পুজোর আনন্দটা এই যে পুরো নাইন্টি ডিগ্রি হতে হতে সাড়ে ছেষট্টি ডিগ্রি কোণ করে আটকে গেল, আমরা বেশিরভাগ তবুও কিন্তু হ্যাপি, স্যাটিসফায়েড।আর যারা হলাম না এখনো, তারা পূজোটাকে এবার আর মহাকাব্য না ভেবে, বরং ভাবি ছোটগল্প।’অন্তরে অতৃপ্তি রবে/সাঙ্গ করি মনে হবে/শেষ হয়ে হইল না শেষ’ সেইরকম আর কি।

কলকাতা আর তার কলারে লেগে থাকা শহরতলীর মাঝের দূরত্বটা কমে যায় প্রতিবছর এই সময়টায়, ওই অনেকটা জলবিষুব কিংবা মহাবিষুবে পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যেকার ব্যবধান কমার মত করে। এক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে যেটা সেটা হল ‘ভি.আই. পি’ পাস। দুপাশে গিজগিজে শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ পাওয়ার লাইনের মত মানুষের ভিড়টাকে রেখে, তার মধ্যিখান দিয়ে ‘ভি.আই. পি’ গেটটা ঠেলে গটগটিয়ে হেঁটে যেতে যেতে যে অনুচ্চারিত ফিলিং বুকটা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়,সেখানে বালিখাল আর বালিগঞ্জ সব সমান। কর্পোরেট অফিসার আর করপোরেশন ক্লার্ক লেভেলড।আসলে এই জীবনে আমরা সবাই একবার অন্তত ‘ভি.আই. পি’ হতে চাই।এই চাওয়াটার কোন বর্ণ বৈষম্য হয় না, জাত হয় না। ধর্ম হয় না।শ্রেণী হয় না।কলের মিস্ত্রী হোক আর শিল্পপতি, আমরা সবাই চাই কাঁচের দরজাটা উল্টোদিক থেকে কেউ ‘পুল’ করে দিক আমরা ‘পুশ’ করবার আগেই। আমার উল্টোদিকের সেলসগার্লটা ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকুক আমায়। দুর্গাপুজো হল এই আশাপুরণের চারণ ভূমি।এক অপ্রতিরোধ্য ইউটোপিয়া। যেখানে একটা ‘পাস’-এ দশ মিনিটের জন্য আমিই ‘জেড প্লাস ক্যাটেগরি’ আমিই ‘লাইমলাইট’, আমিই ‘পেজ থ্রি’, আমিই এক এবং একমাত্র ‘ব্রেকিং নিউজ’। বহু কষ্ট করে, কিংবা লিটার লিটার তেল ঢেলে বসের চরণতলে পড়ে থেকে জোগাড় করা এই একটা কার্ডের কোন ভ‍্যালুয়েশন হয়না তখন। প্রাইসলেস অ্যাসেট। প্রচন্ড ভিড়ে ঠাসা প্যান্ডেলের ‘ভি.আই. পি’ গেটের সামনে গিয়ে গার্ডকে কার্ডটা শো করানোর পর, ‘যান’;আর তারপর থেকে প্যান্ডেলের দিকে এগোনো আমার প্রতিটা স্টেপ তখন ‘পদক্ষেপ’; দুপাশে আপামর ভারতবর্ষ। ওদের ক্লান্ত অপেক্ষা ক্লিষ্ট মুখগুলো মনে করিয়ে দেয়, মন্ডপে ঢোকার আগে অবধি আমিই একমাত্র ‘ভি.আই. পি’, বাকি সব আমজনতা। মিডল ক্লাস ক্রাউড।

এবারের মত পুজো শেষ।মা ডুবে যাবে কাল শেষ বিকেলে নিরুত্তাপ মুখে। খসে পড়বে মুকুট, গলে পড়বে মাটি, একটু একটু করে মা ডুব দেবে অনেক গভীরে যেখানে ডুবুরি পৌঁছয় না, আলো পৌঁছয় না, শব্দ পৌঁছয় না। মানুষ আবার তার দরমার চালে, ডিলাক্স আ্যপার্টমেন্টে, সারিবদ্ধ কলোনিতে ফিরে যাবে যে যার রুট অনুসারে।চার আনা লাভের গুড় খেয়ে যাবে বারো আনা পিঁপড়েতে, প্রমোটারে, জি.এস.টিতে। ডিসকাউন্ট শেষ, জীবন আবার চলতে শুরু করবে এম.আর.পিতে। বছর বছর আমরা এভাবেই হ্যাপি, স্যাটিসফায়েড। পূজোর কদিন আমরা সবাই ভি.আই. পি…আমরা, মানে বাঙালিরা আর কি।


শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।